বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬

মাহরীন ফেরদৌসের ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ : বিষাদ ও নৈঃশব্দ্যের অরিগামি : রাজিব মাহমুদ

0

ধান ভানার আগে একটু শিবের গীত গাই।

কিছুদিন আগে এক উইকেন্ডে টরন্টোর ভ্যান গঘ মিউজিয়াম থেকে স্ট্রিট-কার-এ বাসায় ফিরছিলাম। একেবারে শেষ কম্পার্টমেন্টটার কোনার আসনটাতে বসে মিউজিয়ামে দেখা পেইন্টিংগুলোর নানা শেডের বিচিত্র রং-এর আলো-ছায়ার বিন্যাস মাথায় নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। চলমান শহরটার উপর দ্রুত বিছিয়ে পড়ছিল সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়া আর ইয়ারবাডে তখন লানা ডেল রে গেয়ে যাচ্ছিল—

Love casinos, Indian reservations.
But, baby, if you love me,
Take me to the gas station…

ঠিক এ সময়টায় অনেকটা কাকতালের মতোই আমার স্ট্রিট-কারটা একটা গ্যাস স্টেশনের সামনে পৌঁছে জটে আটকে গেল। এদিকে স্টেশনের ভেতরেও নানা ধরনের গাড়ির মাঝামাঝি আকারের একটা জটলা লেগে গিয়েছিল। তবে গাড়ির ভেতরে মানুষগুলোর চোখে-মুখে উইকেন্ডের গা-ছাড়া একটা স্বস্তির আমেজ।

Arigamir Golokdhadhay Cover

অরিগামির গোলকধাঁধায় | মাহরীন ফেরদৌস | প্রকরণ: ছোটোগল্প | প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা | প্রকাশক: কথা প্রকাশ | মুদ্রিত মূল্য:  ২০০ টাকা। বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

উইকডেতে এই শহরের মানুষগুলো (আমি নিজেও যাদের একজন) সন্ধ্যার রংটাও ঠিকঠাক স্বাদ নিয়ে দেখার সুযোগ পায় না। সারা দিন কাজ শেষে বাড়িতে ফেরার ক্লান্তিটা যখন চোখে ভারী হয়ে চেপে বসে তখন অনেকটা কন্ডিশনড রিফ্লেক্সের মতো সান্ধ্য-বোধের একটা ছায়া পড়ে মগজে।

অথচ শুধু এই রং আর এর নানা ডাইমেনশানের ভেতর সাঁইত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত কিন্তু কুঁড়ি থেকে ফুল হওয়ার মুহূর্তটার মতো ছড়ানো একটা জীবন পার করে গেছেন ভ্যান গঘ।

আমি জটে আটকে থাকা মুহূর্তটাতে ভাবছিলাম সেই মৃত গ্র্যাসহপারটার কথা যে কিনা ভ্যান গঘের Olive Trees পেইন্টিং এর ভেতরে মৃত পড়ে ছিল প্রায় সোয়া শতাব্দী। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে পেইন্টিংটা দেখতে যাওয়া দর্শনার্থীদের যারা গ্র্যাসহপারটাকে খেয়াল করেছেন তারা হয়তো ভেবেছেন এটা শিল্পীর তুলির কোনো আলগোছ আঁচড়। বেশিরভাগ মানুষ হয়তো লক্ষই করেননি সময়ের টানেলের ভেতরে ঘুমন্ত এক মৃত্যুর ছোট্ট মুচমুচে হয়ে যাওয়া শরীরটাকে। অথচ শেষমেশ বিপুল ও Starry Night-এর মতোই বিশাল এক শিল্পীর জীবন ও কাজের সাথে জড়িয়ে গেল সময়ের ঘূর্ণিতে ধূলিকণার মতো হারিয়ে যাওয়ার কথা থাকা এই ক্ষুদ্র পোকাটা।

যাই হোক, গ্র্যাসহপার-প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে কারণ আমার স্ট্রিট-কার তখন একটা সাবওয়ে স্টেশনে ঢুকবে ঢুকবে করছিল। সাবওয়েতে আমি সবসময় কিছু না কিছু পড়ি। সাধারণ হালকা কিছু। ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে একটা গল্পের শুরুর প্রথম প্যারার দুই তৃতীয়াংশে চোখ আটকে গেল—

‘প্রায় অনেক বছর পর এমন কারও সাথে পরিচয়। পরিচয়টুকু পথে কিংবা গলির মাথায়। বাড়ির সামনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে, ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে যাওয়া রেস্তরাঁয়। টঙের দোকানে কারও ভীষণ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ায়। ছাদের অলকানন্দা ফুল কিংবা খুলনার ঝপঝপিয়া নদীর তীরে। এতবার পরিচয় কীভাবে হয় ভাবতে পারে সবাই। তবে তা ব্যাখ্যা করা দুর্বোধ্য ও জটিল। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই বারবার, নানা স্থানে হচ্ছে পরিচয়।’ (প্যারাকজম)

এটুকু পড়ে মনে হলো এটা ঠিক সাবওয়েতে পড়ার ম্যাটেরিয়াল নয়। কিন্তু বর্ণনাটুকুর আপাত: চেনা-ভাবের মধ্যে একটা অচেনা রহস্যময় জগতের যে ইঙ্গিতময়তা ছড়ানো ছিল সেটাকে জানার তীব্র আকর্ষণটা বাসায় যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখা সম্ভব হলো না।


অরিগামির গোলকধাঁধায় : নির্বাচিত গল্পপাঠ


প্যারাকজম

‘প্যারাকজম’ অরিগামির গোলকধাঁধায়-তে আমার পড়া প্রথম পড়া ও সবচাইতে প্রিয় গল্প।

গল্পের প্রথম প্যারায় লেখক ‘দেখা হওয়া’ আর ‘পরিচয়’ নিয়ে উপরে উল্লেখিত যে প্যারাডক্সিক্যাল আবহটি তৈরি করেছেন সেখান থেকে মূল গল্পে ঢুকতে ঢুকতে গল্পটাতে একেবারে আমূল গেঁথে গেলাম। জীবনের প্রাত্যহিকতার ভেতরের একটা ছোট্ট অথচ আলগা সুতাকে আলগোছে তুলে নিয়ে একটা অন্য জগতের সম্পর্কের ন্যারেটিভের ভেতরে পাঠককে ঠেলে দেন লেখক।

কেন জানি মনে হলো এই গল্পের বীজটা লেখক ঠিক তৈরি করেননি বরং কোথাও কোনো দৃশ্যমান বা শ্রুত ইঙ্গিতের মধ্যে গল্পটার ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। এরপর লেখক গল্পটাকে নিজের মতো হয়ে উঠতে দিয়ে পাশাপাশি হেঁটেছেন শুধু। গলানো মাখন মধুতে যেমন স্বচ্ছন্দে মিশে যায়, ঠিক তেমনি গল্পের আখ্যান, চরিত্র, সংলাপ সব ঠিকঠাক মিশে গিয়ে একটা চমৎকার মায়াময় বয়ান তৈরি হয়েছে লেখাটায়।

‘প্যারাকজম’-এর প্রিয় লাইন:

‘আমার খুব ইচ্ছা করে খেলার মাঠের পাশের এই পার্কের গল্প আমি তাকে শোনাই, কিংবা ঘর থেকে একটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে এসে বলি, চলো দেখে আসি স্টেশনের শেষ ট্রেনটা কোন গ্রামে যায়। কী আছে সেখানে? অনেক অনেক গাছ, শান্ত নদী, লেবু বাগান, বৃষ্টির পর রংধনু আর সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ঝিঁঝি পোকাদের ঘোরলাগা গান!’

‘মথ’ গল্পে একরকম পুনঃনির্মাণ তথা রুপান্তরের গল্পই বলতে চেয়েছেন লেখক। সেই নির্মাণ যে সবসময় ইতিবাচক বা আশা-জাগানিয়া হবে সেরকম নয়। অনেকদিন পরে দেখা হওয়া দুই বন্ধুর বেশ সহজ ও স্বাভাবিক কথোপকথন দিয়ে গল্প শুরু করে লেখক ধীরে ধীরে পাঠককে টেনে নিয়ে যান স্বল্পালোকিত এক পরাবাস্তবতার টানেলের ভেতর।

এই চমৎকার সুখ-কল্পনার শব্দ-পোট্রেটটার সাথে শুধু ‘আমার ইচ্ছে করে’ বাক্যটা জুড়ে দিয়ে যেন কিছু হাহাকার-চূর্ণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো গল্পের শরীরে। অর্থাৎ আমার শুধু ইচ্ছেই করে কিন্তু আমি জানি এই ইচ্ছে কখনো পূরণ হবার নয়; চেতনায় কয়েকটা বুদ্বুদ তুলেই এরা চিরতরে হারিয়ে যাবে সময়ের অন্ধকারে। কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া ইটালিয়ান সিনেমা ‘The Hand of God’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাবিয়াত্তো’র একটা ডায়লগ মনে পড়ে গেল এ প্রসঙ্গে। ফাবিয়াত্তো সবকিছুর বিনিময়ে একজন ফিল্মমেকার হতে চেয়েছিলেন যিনি বলেছিলেন—

“I don’t wanna talk about sad stuff. Then there’s nothing to talk about.”

 

মথ
‘মথ’ গল্পটা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভ্যান গঘের সেই গ্র্যাসহপাটার-এর কাছে। ভ্যান গঘ বা সোরেন্টিনো শিল্পী তাই তাঁরা নিজের জীবনকে পুনঃনির্মাণ করেছেন সেলফ-পোট্রেট এঁকে বা ফিল্ম বানিয়ে কিন্তু Olive Grass-এ আটকে পড়া এই গ্র্যাসহপারটার জীবন পুনঃনির্মাণ করবে কে?

‘মথ’ গল্পে একরকম পুনঃনির্মাণ তথা রুপান্তরের গল্পই বলতে চেয়েছেন লেখক। সেই নির্মাণ যে সবসময় ইতিবাচক বা আশা-জাগানিয়া হবে সেরকম নয়। অনেকদিন পরে দেখা হওয়া দুই বন্ধুর বেশ সহজ ও স্বাভাবিক কথোপকথন দিয়ে গল্প শুরু করে লেখক ধীরে ধীরে পাঠককে টেনে নিয়ে যান স্বল্পালোকিত এক পরাবাস্তবতার টানেলের ভেতর। আবারও মনে পড়ল ‘The Hand of God’-এর একটা ডায়লগ ‘Cinema…is a distraction from reality. Reality is lousy’। ‘মথ’ গল্পে এই ‘lousy reality’ থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছেন লেখক মাহরীন ফেরদৌস এবং আমরা বাস্তবের কংক্রিট পথ থেকে একটানে ভেসে উঠেছি শূন্যে।

গল্পটাকে লেখক এমনভাবে এগিয়ে নিয়েছেন যে গল্পটার পরিণতি নিয়ে আলাদাভাবে কিছু ভাবার ফুরসত পান না পাঠক। তাই কোনোপ্রকার চমকের জন্য প্রস্তুতিবিহীন পাঠক গল্পের শেষটায় এসে ঠিক চমকে না গেলেও যেন কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। গল্পের নির্মাণশৈলী প্রসঙ্গে মনে হয়েছে যে এর শেষটা হয়তো লেখকের মাথায় প্রথমে এসেছে। এরপর শেষের চমকটুকুকে গন্তব্যের মতো ধরে রেখে লেজের দিক থাকে আস্তে আস্তে গল্পের শরীরটাকে উল্টোদিকে তৈরি করেছেন তিনি। পুরো গল্পের বয়ান, শব্দচয়ন, ও পরিবেশ নির্মাণে ধৈর্য ও যত্নের ছাপ স্পষ্ট।

‘মথ’-এর প্রিয় লাইন:

‘আমি দেখতে পাই, ওর মা কাঁদছে সেই তরুণ প্রেমিকের বুকে।’

 

চক্র
‘চক্র’ গল্পটা শুরু হয় একটা চাকার প্রসঙ্গ তুলে ও ভয়ংকর একটা দুঃসংবাদ আসার মধ্য দিয়ে। লেখকের আগের গল্পটা গল্প পড়ে ধারণা হয়েছিল যে এই গল্পের শেষেও বিহবল হয়ে যাওয়ার মতো কিছু একটা থাকবে যা পাঠকের ভাবনায় হয়তো নতুনভাবে আরেকটা অভিঘাত সৃষ্টি করবে। তাই গল্পটার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গল্পের নামকরণ থেকে ইঙ্গিত (ফোরশ্যাডোয়িং) খুঁজে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি গল্পটা কোনদিকে যেতে পারে। যদিও শেষটা নিয়ে ভেবে গল্পটার স্বাদ নিয়ে নিয়ে পড়ার আবেদনটুকু নষ্ট করতে চাইনি। যাই হোক, মা-ছেলেকে দিয়ে শুরু হওয়া গল্প গিয়ে শেষ হয়েছে জীবনের আশ্চর্য এক চক্রময়তার মনোলোগের মধ্য দিয়ে।

‘চক্র’-এর প্রিয় লাইন:

‘ঠিক তখনই আমার কানের ভেতরে যেন কার ছুটে চলার শব্দ শুনতে পাই। যেন কেউ ডাকছে। আমাকে। দূর থেকে, বহু দূর থেকে। পায়ে পায়ে সেই ডাকের পিছু নিয়ে ছাদের রেলিংয়ের কাছে চলে আসি।’

 

পৃথিবীর শেষ গান
‘পৃথিবীর শেষ গান’ গল্পটা একটা বৃষ্টিস্নাত দিনের বর্ণনা দিয়ে শুরু। এমনিতে আমাদের দেশের মফস্বলীয় শহরাঞ্চলের বৃষ্টির কথা শুনলেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পের “বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস” ও “চায়ের কাপে ভাঙা পাতা সময়কে মন্থর কাঁপায়”-এই লাইন দু’টো মগজে ভেসে উঠতে উঠতে মনে পড়ে রঞ্জুর “বিষাদবর্ণ দেওয়াল”-এর কথা। ‘পৃথিবীর শেষ গান’ গল্পটি মিস্টার ইয়োলো বলে এক বিষাদাচ্ছন্ন মানুষের গল্প যার “চুলের দিকে তাকালে মনে হবে, ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর ভুল করে সাদা চকের গুঁড়ো পড়েছে।” লেখক মিস্টার ইয়োলোর চরিত্রটি এমনভাবে তৈরি করেছেন যে প্রথম থেকেই চরিত্রটি সম্পর্কে পাঠকের জানার একটা দারুণ আগ্রহ জন্মে যায়। এরপর গল্প আগাতে থাকে আর পাঠক মিস্টার ইয়োলো সম্পর্কে জানতে থাকে নানা গুজব ও ধারণার মধ্য দিয়ে। পাঠক ঠিক বুঝতে পারেন না যে গল্পের নামকরণ অর্থাৎ পৃথিবীর শেষ গানের সাথে মিস্টার ইয়োলোর সম্পর্ক কোথায়। যতক্ষণে সেটা পাঠক জেনে যান ততোক্ষণে গল্প শেষ। পাঠকের আগ্রহকে একটা ডিটেইলিং-সমৃদ্ধ অথচ মন্থর-নয় ন্যারেটিভের মধ্য ধরে রেখে শেষ পর্যন্ত চমৎকার গল্প বলে গেছেন লেখক।

‘পৃথিবীর শেষ গান’ এর প্রিয় লাইন:

বৃষ্টির জলধারায় যেন তার প্রায় সব স্মৃতিই গিয়েছে মুছে। এভাবেই মাস পেরুবে, যাবে বছর। ঋতুবদলের ফলে তার মাথার চুল থেকে মুছতে শুরু করবে ব্ল্যাকবোর্ডের রঙ। মিস্টার ইয়োলো শুধুই একটি বিষাদগ্রস্ত, হতাশাজনক প্রশ্নচিহ্ন হয়ে সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে থেকে যাবে।

 

বিস্কিটের গুঁড়ার মতো বিকেল
‘বিস্কিটের গুঁড়ার মতো বিকেল’ গল্পটা আমার কাছে একটা গদ্য কবিতার মতো মনে হয়েছে। সেই অর্থে কোন গল্প নেই এতে। হাঁটতে বের হওয়া এক বিকেলে গল্পের পাত্র-পাত্রীর প্রকৃতি-বীক্ষণ, মানুষ ও যুদ্ধকে দেখে ওঠা এটুকুই গল্প। পুরো গল্পটা একটা লিরিক্যাল অ্যাবস্ট্রাকশান এর শব্দ-পোট্রেট যেন। গল্পটা শুরু হতে না হতেই ঝুপ করে শেষ হয়ে যায়।

‘বিস্কিটের গুঁড়ার মতো বিকেল’-এর প্রিয় লাইন:

কোথা থেকে যেন বাতাস উড়ে আসে। গাছের ডালে মৃদু শনশন শব্দ। মহাযুদ্ধের লড়াকু সৈনিকের একটা হাত হঠাৎ একটু একটু করে ঝাপসা হতে থাকে, যেন মস্তবড় গোলার টুকরা লেগেছে মাথায়। বিস্কুটের গুঁড়ার মতো তাকে অল্প অল্প করে পড়ে যেতে দেখি।

 

চাঁদের গায়ে ছায়া

লেখক যখন পরিচিত প্রেক্ষাপট ছেড়ে শুধু একটা গল্প বলার জন্য অন্য এক প্রেক্ষাপট তৈরি করেন তখন সেটাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তৈরি করা ও সেখানে অনেকটা দাবার বোর্ডে গুটি বসানোর মতো করে এককেকটা চরিত্রকে তাদের ওজন ও মেজাজ অনুযায়ী ঠিকঠাক মতো বসানোটা অসম্ভব চ্যালেঞ্জিং মনে হয় আমার কাছে। এ জাতীয় গল্পের এই অংশটুকু দুর্বল হলে পরবর্তীতে গল্পটায় যতো চমকপ্রদ টার্নিং-ই থাক না কেন শুরুর এই খামতির কারণে গল্পের শরীরটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ‘চাঁদের গায়ে ছায়া’ গল্পে লেখক সেই চ্যালেঞ্জটা খুব চমৎকারভাবেই উতরে গেছেন। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে গল্পের প্রেক্ষাপটটা হয়তো লেখকের স্বপ্ন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতরে পাওয়া অথবা লেখকেরই আত্মসৃষ্ট কোনো রূপকথার জগৎ থেকে নেওয়া; এরপর সেটার ওপর তিনি ডিটেইলিং করেছেন। খুবই অল্প স্পেসে মনে রাখার মতো একটা গল্প।

চাঁদের গায়ে ছায়া’-এর প্রিয় লাইন:

‘কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে নিথর গাছগুলো যখন আবেশে ডুবে থাকত, আ তখন নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত। আর তারপর বাগানের গাছের পাতা থেকে জিভ দিয়ে শিশির খেত চেটে।’

 

মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি

‘মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি’ মধ্যবিত্তের চেনা গল্প। গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে একটা ডিসপ্যাশোনেট দূরত্ব রাখার চেষ্টা করতে করতেও লেখক যেন মাঝে মাঝে গল্পটার ভেতরে ঢুকে পড়ছিলেন। মূল চরিত্র রোকেয়া’র বেদনার সাথে ক্ষণে ক্ষণে যেন লীন হয়ে যাচ্ছিলেন লেখক। এই গল্পটার শক্তি মূলত এর পরিবেশ তৈরি করার মধ্যে। মশারি, আকাশ, লোডশেডিং মিলেমিশে মফস্বলীয় রাতের এক আবেশময় মায়াকঙ্কাল দাঁড় করিয়েছেন লেখক। কঙ্কালটুকু ধারণ করে আছে সময় এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আর মায়াটুকু সৃষ্টি হয়েছে গল্পের পরিবেশ বর্ণনার একটা নস্টালজিক মেলাঙ্কোলিয়ার মধ্য দিয়ে।

‘মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি’-এর প্রিয় লাইন:

‘রক্তিম চলে যাবে ভেবেই তার মনে হচ্ছে সে পাতালে চলে যাচ্ছে। আকাশ গলে যাচ্ছে বেদনায়।’

 

রুবি তোমাকে চিনি

‘রুবি তোমাকে চিনি’ গল্পটা অর্থনৈতিক শ্রেণিপার্থক্যের মোটামুটি পরিচিত একটা গল্প। তবে এই গল্পের শক্তির জায়গাটা মূলতঃ কেন্দ্রীয় চরিত্রটির বহির্জগত ও অন্তর্জগতের একটা প্যারালাল ন্যারেটিভ তৈরি করার মধ্যে। বাইরের পরিবেশ বর্ণনার পাশাপাশি মূল চরিত্রের ভেতরে চলতে থাকা নানা শেডের ছোটো ছোটো অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা গল্পটাকে ভেনিস শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা লেকে ভাসমান গন্ডোলার মতোই গ্রেইসফুলি এগিয়ে নিয়ে গেছে। পুরো গল্পজুড়ে রুবিকে চেনা-না চেনার দোদুল্যমানতাটা গল্পের শেষে এসে একটা ইঙ্গিতের ভেতর আটকে যায়। পাঠক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে গল্পটির প্রধান চরিত্র আসলেই রুবিকে চেনেন কিনা যদিও গল্পের শিরোনাম বলছে চেনেন।

‘রুবি তোমাকে চিনি’-এর প্রিয় লাইন:

আমার জিমের লকার কোড ৩১৪০, আমার পার্লারের সিরিয়াল নং২৫, আমার জুতার সাইজ ৬, আমি ৩৬ বি সাইজের ব্রা পরি, আমার নেটফ্লিক্সের বিল মাসে বারশ টাকা আর আগস্টের তিন তারিখে আমার মেয়ের জন্ম। আমাকে প্রথম প্রেমপত্র দিয়েছিল শোভন নামের এক হিন্দু ছেলে যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি।

 

এক কামরার ঘর

‘এক কামরার ঘর’ গল্পটাতে সারাংশ করে বলে দেওয়ার মতো কোন গল্প নেই। পুরোটাই বাস্তবতা-পরাবাস্তবতার মাঝে আটকে যাওয়া একটা টানা বয়ান। পাঠক বোঝে না যে আম্মার কী হয়েছে, লেখকও পাঠককে বোঝানোর দায় নেন না। গল্প বলতে বলতে তিনি কখন যেন একটা পরিচিত পৃথিবীর সাধারণ সুখ-দুঃখের জগৎকে পাঠকের অলক্ষ্যে একটা পরাবাস্তব খোপে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিয়েছেন। চরিত্রগুলো কেন এতটা বোবা ও অস্থির সেটা বুঝতে না বুঝতেই গল্পে প্রবেশ করে এক অচেনা মহিলা। আর পাঠক গল্পটাকে ঠিক বোধের ভেতরে ধারণ করার আগেই গল্প শেষ হয়ে যায়। মাহরীন ফেরদৌসের গল্পের এই আচমকা শেষগুলো পাঠককে ধাক্কা দেয় ও বাকি গল্পটকু যেন নিজেরা তৈরি করে দেওয়ার উস্কানিও দেয় কিছুটা।

‘এক কামরার ঘর’-এর প্রিয় লাইন:
আমার মনে হয় ম্যাপটা ঘুরছে অল্প অল্প করে মেঘের মতো। হলুদ, কমলা, গোলাপি, সবুজ, গাঢ় সবুজ, নীল সব রঙের ছড়াছড়ি। একদম উপরে ইংরেজিতে ক্যাপিটাল অক্ষরে লেখা দ্য ওয়ার্ল্ড।


কিছু সামগ্রিক পাঠ পর্যবেক্ষণ


১.
মোট চৌদ্দটা গল্পের সংকলন মাহরীন ফেরদৌসের ‘অরিগামি’র গোলকধাঁধায়’ পড়তে গিয়ে আমার বরাবরের মতোই মনে হয়েছে গল্প মূলত তিন প্রকার— প্রথম প্রকার গল্প লেখক তৈরি করেন আশপাশের নানা উপাদান দিয়ে। অনেকটা ওভেনে কেক বানানোর মতো। আর দ্বিতীয় প্রকার গল্প লেখক খুঁজে পান; অনেকটা কোথাও বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ কোনো দৃশ্য বা শব্দ বা এদের দ্বৈতসত্তাকে একসাথে আবিষ্কার করার মতো। প্রথম প্রকার গল্পের অস্তিত্ব লেখকের মস্তিষ্ক ছাড়া আর কোথাও নেই কারণ লেখক লেগো পার্টস জোড়া দেওয়ার মতো করে গল্পের নানা অংশ জোড়া দিয়ে গল্পটাকে সচেতনভাবে গোড়া থেকে নির্মাণ করেন। আর দ্বিতীয় প্রকার গল্প কোথাও না কোথাও ছিল—লেখক শুধু গল্পটাকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করেন মাত্র। আর তৃতীয় প্রকারের গল্প হলো এই দুই প্রকার গল্পের মিশ্রণ।

‘অরিগামি’র গোলকধাঁধায় ’-এ এই তিন প্রকারের গল্পই আছে।

২.
বিশ্বসাহিত্য কিংবা বাংলা সাহিত্যেও ফিকশনে চমকপ্রদ প্রথম লাইন লেখার একটা ঐতিহ্য আছে। অর্থাৎ প্রথম লাইন দিয়েই পাঠককে গল্পে আটকে ফেলার একধরনের সচেতন চেষ্টা। অনেক লেখক এই চেষ্টাটাকে রীতিমতো সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগুলোর মধ্যে সেরকম কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। বরং কোনো কোনো গল্পে মনে হয়েছে সেগুলোর যেকোনো লাইনই হতে পারে গল্পগুলোর প্রথম লাইন। যে পাঠক তাঁর গল্প পড়তে চান, তাকে একটা টানা পাঠ-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই পরিচিত হতে হবে গল্পের প্রেক্ষাপট ও পাত্র-পাত্রীর সাথে। লেখক নিজে থেকে পাঠককে তাঁর গল্পে গেঁথে ফেলার কোনো চেষ্টা করবেন না। কিন্তু গল্প পড়তে গিয়ে পাঠক নিজেই গল্পে গেঁথে যাবেন না এই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কারণ এটা পাঠক হিসেবে আমার সাথেই হয়েছে।

মাহরীন ফেরদৌস গল্প বলেন একটা পরিচিত, প্র্যাকটিসড ভঙ্গিতে এবং ধীরে সুস্থে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। গল্প তৈরি হতে হতে এর মাঝে নকশার মতো সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আর ছোটো ছোটো বিশ্লেষণ এসে জায়গা করে নেয় যা কিনা গল্পের ফ্লো-তে একটা শান্ত ঢেউয়ের মতো ব্যাপার তৈরি করে। এরকমভাবে বলা যায় যে রাত শেষে ভোরের আলো ফোটার মতো আস্তে আস্তে তার সাদা কাগজে গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি ফুটে উঠতে থাকে।

৩.
খুব এফোর্টলেস একটা ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে নৈঃশব্দ্যকে ভাষা দিতে পারেন মাহরীন ফেরদৌস আর সেই ভাষার ভেতরে বাজিয়ে তুলতে পারেন চেনা বিষাদের অচেনা সুর। তাঁর চরিত্ররা প্রতিদিনের ভাষায় কথা বলেও মনে হয় যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে। এই সবকিছুই তাঁর প্রোজের টেক্সচারে মিশে যায়, আলগা সুতার মতো উঠে থাকে না। এটা প্রায় সবগুলো গল্পের ক্ষেত্রেই সত্য। যেমন ‘প্যারাকজম’ গল্পের এই লাইনগুলো—

‘আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে ধরনের অনুভূতির পৃথক কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। শুধু জানি তার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। আর মনে হয় সবকিছু এভাবেই থাক।’

মাহরীনের লেখায় কাব্যের ভারটুকু নেই কিন্তু সৌন্দর্যটকু আছে। যেমন: ‘পৃথিবীর শেষ গান’ গল্পের এই দুইটা লাইন— ‘আবার কোথাও যেন মেঘ ডেকে উঠল। চারপাশে জেগে উঠল বৃষ্টি নামার কোমলতা।’ এই ‘কোমলতা’র সাথে পাঠক পরিচিত কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে আলতো করে ন্যারেটিভে তুলে আনাটা যেন হাল্কা আঁচে একটা পুরোনো স্মৃতিকে উস্কে দেওয়ার মতো।

এই লাইনগুলো একটু খেয়াল করে পড়লে বোঝা যায় যে লেখক খুব চেনা শব্দ দিয়ে ও চেনা বয়ান ভঙ্গির ভেতরে থেকেই চেনা রিয়েলিটির ভিন্ন ভিন্ন ভিজুয়াল ডাইমেনশান তৈরি করে যাচ্ছেন। কোনো আরোপিত উপমা-উৎপ্রেক্ষা বা অস্বাভাবিক নিরীক্ষাপ্রবণতা নেই তাঁর গল্পে। তাঁর ভাষা একই সাথে সরল ও কাব্যময়। এই কাব্য হয়তো আলাদা আলাদা দলছুট কোনো লাইনে পাওয়া যায় না, কারণ এরা ছড়িয়ে থাকে প্যারাজুড়ে। মাহরীনের লেখায় কাব্যের ভারটুকু নেই কিন্তু সৌন্দর্যটকু আছে। যেমন: ‘পৃথিবীর শেষ গান’ গল্পের এই দুইটা লাইন— ‘আবার কোথাও যেন মেঘ ডেকে উঠল। চারপাশে জেগে উঠল বৃষ্টি নামার কোমলতা।’ এই ‘কোমলতা’র সাথে পাঠক পরিচিত কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে আলতো করে ন্যারেটিভে তুলে আনাটা যেন হাল্কা আঁচে একটা পুরোনো স্মৃতিকে উস্কে দেওয়ার মতো। যেন দাদার মুখে পুরোনো দিনের এক মেঘলা দিনের স্মৃতি রোমন্থন শুনছি।

৪.
লেখকের গল্পগুলোর মতো গল্পের বিষয়-নির্বাচনেও এক ধরনের দ্বৈত অভিঘাত থাকে। তিনি গল্প শুরু করেন আপাত গতানুগতিক একটা ভঙ্গিতে। আগেই উল্লেখ করেছি যে গল্পের বিষয়বস্তু আমাদের পরিচিত, চরিত্রগুলোও বেশ চেনা। কিন্তু গল্প যত আগাতে থাকে এই চেনা বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। পড়া শুরুর কিছুক্ষণ পরে মনে হয় ওই চেনা-পরিচিত জগতের ভাইবটা একটা ফয়েলের মতো আলগা হয়ে গল্পের শরীর থেকে খসে খসে পড়ে যেতে থাকে। যেন চেনা গলি দিয়ে ঢুকিয়ে লেখক পাঠককে সন্তর্পণে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন গল্পটির অচেনা ও অভাবিত ভরকেন্দ্রের দিকে। আর এই কাজটি সুচারুভাবে তিনি করতে পারেন তাঁর একেবারে নিজের তৈরি ভাষাভঙ্গির কারণে। মাহরীনের গল্প পড়লেই বোঝা যায় যে গল্পগুলো বেশ যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করা হয়েছে যা আমাকে কিছুদিন আগে পড়া সমকালীন লেখক-সম্পাদক লুইস হ্যার্নবি’র এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়—

‘When writers self-edit at line level with confidence, story is elevated by the sentence, rather than buried beneath it.’

৫.
খুব দগদগে আরবান রিয়ালিজম-সমৃদ্ধ গল্প বা গদ্য পড়ে যারা অভস্ত তাদের হয়তো এই বইয়ের গল্পগুলো ভালো লাগবে না। যেমন ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ের হাড্ডি খিজিরীয় বাস্তবতার গল্পের যারা একরোখা মুগ্ধ পাঠক, তাদের জন্য অরিগামির গোলকধাঁধা নয়। কিন্তু ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ যাদের মধ্যে একধরনের বৃষ্টিবুনোট রাতের ঘোর তৈরি করে তাদের এই বইয়ের গল্পগুলোর সাথে একটা চমৎকার সময় কাটবে এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি।

আর তাই রিয়ালিটিকে ‘as it is’ ডিল করার কলম মাহরীন ফেরদৌসের নয়। যেমন এই সংকলনে ‘বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়’ শীর্ষক একটা গল্প আছে যেখানে লেখক রিয়েলিটিকে সরাসরি ডিল করেছেন কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই গল্পটা অন্য গল্পগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। যদিও এই গল্পেও চমৎকার কিছু লাইন আছে যেমন—

‘আব্বার শোবার ঘরের দরজা ছিল বন্ধ। সাঁইত্রিশ দিন আগেও যে ঘরে গেলে আম্মাকে খবরের কাগজ পড়তে বা রেডিওতে গান শুনতে দেখা যেত, যে ঘরের দরজা রাতের বেলা খোলা থাকলে আব্বার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যেত। সেই ঘর আজ ভেতর থেকে বন্ধ। এক অচেনা নারী আমার আম্মার স্থানে ঘুমাচ্ছেন, কিংবা হয়তো অন্যকিছু করছেন।’

তাই একজন পাঠক হিসেবে মত দিতে চাই যে মাহরীন রিয়েলিস্টিক ঘরানার লেখক নন বরং তাঁর গল্প চমৎকার খেলে যখন রিয়ালিটির ট্রিটমেন্টটা তিনি কোনো একটা টুলের মধ্য দিয়ে করেন, যেমন পরাবাস্তবতা ইত্যাদি।

৬.
শিরোনামে বলেছি যে লেখকের গল্পে বিষাদ ও নৈঃশব্দ্য রীতিমতো জুটি বেঁধে বিচরণ করে। প্রায়শই এদের দুইজনকে এমনভাবে পাওয়া যায় যে পাঠকের মনে হয় এরা আলাদা আলাদাভাবে তাদের খুব চেনা হলেও এইভাবে একসাথে পাঠক এদেরকে আবিষ্কার করেননি কখনো বা আবিষ্কারের সুযোগ তৈরি হয়নি। যেমন ‘প্যারাকজম’ গল্পের এই লাইনগুলো—

‘আবার স্বপ্নে দেখলাম কোনো এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। শেলফের শতশত বইয়ের পাতাগুলোর ভেতর থেকে অনবরত পানি ঝরে একটা নদী হয়েছে। সেই নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। ভাসছে অজস্র বই। বইয়ের খোলা পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে কচুরিপানা ফুল।’

এ এমন এক সাধারণ অথচ অলীক স্বপ্ন যার অস্তিত্ব চরিত্রটির চোখে দেখা জগতের বাইরে কিন্তু চরিত্রটি এগুলোকে চোখে দেখা জগতে স্পর্শ করে দেখতে চায়। পাঠক বোঝে যে এটা সম্ভব নয় আর বোঝার পর পাঠকের মন ভারী হয়ে ওঠে। এভাবেই নিজের গল্পজগতের বিষাদ ও নৈঃশব্দ্যকে পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন লেখক। এরা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে খানিকটা জটিল কিন্তু দৃষ্টিনন্দন এক অরিগামি। ফিটজেরাল্ডকে লেখা হেমিংওয়ের সেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে যেখানে হেমিংওয়ে লিখেছিলেন—

‘Forget your personal tragedy. We are all bitched from the start and you especially have to hurt like hell before you can write seriously. But when you get the damned hurt, use it—don’t cheat with it।’

লেখা বড়ো হয়ে যাচ্ছে। শেষ করি ত্রিশ বছর বয়সে প্লেন ক্র্যাশে মারা যাওয়া মার্কিন সংগীতশিল্পী প্যাটসি ক্লাইন-এর একটা গানের প্রথম চার লাইন দিয়ে যে গানটা আমি পুরো বইটা পড়তে পড়তে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে শুনেছি—

I go out walkin’ after midnight
Out in the moonlight
Just like we used to do, I’m always walkin’
After midnight, searchin’ for you (wa-wa-walking, wa-wa-walking)

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ঢাকায়। বর্তমানে কানাডা-প্রবাসী। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক। পড়েছেন ও পড়িয়েছেন ঢাকা, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও টরন্টোতে। অনুবাদক ও ছোটোগল্পকার। লেখা প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, দিল্লী ও ম্যানচেস্টার থেকে। ছোটোগল্পের বই ‘হ্যাঁ অথবা না-এর গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯-এ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।