দ্ব্যর্থবোধক কোনো সন্ধ্যায় এক আয়ুক্ষয়ী ডেরায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আরও খানিকটা দীর্ঘ করা উচিত যতসব যোগাযোগহীনতার সেতু। শুধু মনই যথেষ্ট নয়, আমাকে সৃষ্টি করতে এমনসব স্মৃতি, যার তীব্রতায় গ্রীষ্মেই এসে যাবে পাতাঝড়া দিন। বসন্তের আগেই মানবগ্রন্থিতে নতুন করে সঞ্চার হবে প্রেমের। ওদিকে স্থিরতা না জানা কোনো মন বেমালুম ফেঁসে গেলে বনে, তাকে শেখাতে হবে নৌকা ভাসানোর শাশ্বত কৌশল। যদিও মন ফেঁসে গেলে আর করার থাকে না কিছুই, কিংবা থাকলেও আমরা সেসব হারিয়ে ফেলেছি দূর গ্রামের কোনো বনতুলসির ঝাড়ে অথবা সেসব পানিতে ফেলে দিয়েছে কোনো দুষ্ট শিশু—যার বাবা আমাজনে বসে টানছে মাফিয়া ফুল এবং মা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে তলিয়ে গেছে ঘুমে।
কেন জানি না, শিশুর কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে যায় ঋ’র কথা কিংবা ঋ-কে মনে করতেই আমি মঞ্চে নিয়ে আসি শিশুদের—যাদের কেউ কেউ ভীষণ দুষ্টু, কেউ আক্রান্ত অটিজমে, কেউ শুধু কাঁদে আর ফিরে যেতে যায় মায়েদের কাছে।
পাবলিশিং হাউজে কাজ করার দিনগুলোতে এক কুখ্যাত রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতাম একা একা এবং ভাবতাম এইসব দিনের কথা আমার মনে পড়বে ভীষণ। মনে পড়বে, কোনো এক পাগলের হাতে একশো টাকা গুজে দিয়ে গলা অবধি হাওয়া খাওয়া রাত।
পাবলিশিং হাউজে কাজ করার দিনগুলোতে এক কুখ্যাত রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতাম একা একা এবং ভাবতাম এইসব দিনের কথা আমার মনে পড়বে ভীষণ। মনে পড়বে, কোনো এক পাগলের হাতে একশো টাকা গুজে দিয়ে গলা অবধি হাওয়া খাওয়া রাত। মনে পড়বে আমলাদের শিশুতোষ লেখা সম্পাদনা করে জাতে তোলার দিন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ্য করতে না পেরে, সম্পাদনার কাজটা ছেড়ে দিই আমি এবং এক উদার আমলা মক্কেলের সুপারিশে আমার চাকরি হয়ে যায় স্বদেশের সবচেয়ে বয়স্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি আনন্দিত হই, আনন্দিত হয় আমার ইচ্ছারা। আমি বিষ্ময়ে, গর্বে, মহা উদ্যমে শুরু করি পড়ানো। ভাবি, এই জীবনটাই তো চেয়েছিলাম আমি। দেশের সমস্ত কবিযশপ্রার্থী অন্তঃসারশূন্য আমলাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠি তখন।
সেখানে কিছুদিন যেতেই আবিষ্কার করি, এক সারিবদ্ধ অথর্বের দলের সর্দার বনে গেছি আমি। ওরা আসে এক গাধাবাছাই মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এবং হয়ে ওঠে গর্বিত কীট। পড়াশোনা কীভাবে করতে হয়, ওদের দলের সিংহভাগই জানে না। ওদের ত্যালানো, ভাইবা বোর্ডে আওড়ানো মুখস্ত বুলি, সিভিল সার্ভিস প্রীতি—সবকিছুই আতলামির চূড়ান্ত মনে হয়। এইসব হব হব শ্রমিকদের জন্য এতো এতো আয়োজন আমার কাছে অনর্থক লাগে।
নিজের অপারগতাটুকু আড়ালে রেখে, সব দায় সিস্টেমের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পারি জমাতে চাই অন্য একটা শহরে, দূরে। যেখানে আমি যেতে চেয়েছি সেই স্কুলের দিনগুলো থেকে। স্বপ্নে দেখেছি সেখানকার ডর্মে থাকছি আমি। লাইব্রেরির পাশে আমার মতো করে বেড়ে ওঠা ভিনদেশী কোনো মাঝবয়সী অধ্যাপকের সাথে ভাগাভাগি করে ফুকছি সিগারেট। আলাপ করছি কোনো স্যাঁতস্যাঁতে ইজম নিয়ে কিংবা নির্জন কোনো শুঁড়িখানায় বসে কেটে যাচ্ছে বিনিদ্র সব কৌতুহলী রাত, অবিরাম স্মৃতিকথন, বিরক্ত করছে না কেউ—এইসব মনে পড়ে।
মিউ মিউ করা অলস দুপুরের দীর্ঘশ্বাস ঘাড়ে নিয়ে যখন মনে মনে আমি বসে আছি এক বিশেষত্বহীন শুঁড়িখানায়, তখন প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে আমাকে ডাকে সে। গতানুগতিক সব তরুণীর মতোই সে জানায়, আমার কবিতার বইয়ে শুধু এতো ক্ষোভ, গালিগালাজ ও মনখারাপ কেন? তার নাকি মনে হয় এখানে এসেও বেশ বিরক্ত আমি, যেকোনো দিন হব দেশান্তরী। আমি অস্বীকারের হাসি হাসি। জড়তাহীনভাবে সে জানায় আমি যেন কোনো ধানাইপানাই করার চেষ্টা না করি। কারণ সকলের মনের খবর জানার এক আশ্চর্য বিদ্যার অনেকাংশ রপ্ত করে ফেলেছে সে। বলে, তারও নাকি ভালো লাগে না এখানে। ইচ্ছা হয়, এখানকার অপদার্থগুলোর মনে মোহর মেরে দিতে। জানায়, দূরের এক শহরে জনমানবহীন পড়ে আছে তার প্রপিতামহের বাড়ি। আমি যে পেতে চাই ওর নিবিড় বন্ধুতা এটাও জেনে গেছে সে। তার নাম–ঋ।
০২.
ক্রমে আমার শরীর ও মনের দ্রাব্যতা বেড়ে তৈরি হয়েছে আরও একটি ব্যক্তিগত নদী। আমি গলে গলে পড়েছি শুধু। বাতাসের অস্বাভাবিক ঘ্রাণে হয়েছি দলছুট, কখনো জীবনছুট প্রায়। চতুর্পাশে আরোপিত শূন্যতা ধূ ধূ। আস্থা হারানো এক বিভ্রান্ত দুপুরে ঋ আমার বন্ধু হয়ে গেল এবং জানা গেল, ঋ জীবনের মতো সত্য। আমার আনন্দ সন্ধানের মতো ধ্রুব। ওর যতো দীর্ঘশ্বাস, সব হয়ে গেল আমার। যেহেতু আমার কোনো দুঃখ বা দীর্ঘশ্বাস ছিল না কোনো দিন, কিছু বিচিত্র স্মৃতি ছাড়া ওকে দেওয়ার মতো কিছুই থাকল না আমার। তারপর আমরা নিজেদের আবিষ্কার করলাম এক নিরন্তর সৃষ্টির খেলায়, সেখানে ক্ষয়ই অধিক দৃশ্যত। ভ্রম হয় সময় ঝিমিয়ে আছে স্থির। এরকমই একদিন ঋ বলে, আমার শরীরেও নাকি আছে এক আসক্তির ঘ্রাণ। ঋ ভাবত আমাদের শরীরে থাকে শুধু সাধারণ পারফিউম ও কিছু অভ্যাসের বেমানান গন্ধ। সম্ভবত ঠিক তখনই আমার স্থিরতা জানা মনও অতর্কিত বনে ফেঁসে যায়। সেই ফেঁসে যাওয়া আমাকে ভুলিয়ে দেয় সমস্ত শাশ্বতিক ছল, পুনরায়।
অবিরাম শরীরে শরীর লেগে থাকা কোনো সমুদ্রগামী দিনে ঋ জানতে চায়, এর আগে কতজনকে ভালোবেসেছি আমি। এ প্রশ্নের সত্য কোনো উত্তর দেওয়া যায় না বলে আমি পুনরায় হয়ে উঠি অতিকায় সাপ। আরও বলে, আমার প্রেমের কবিতাগুলো কেন লুকিয়ে রাখি।
০৩.
যে শহরে আমরা থাকি, সে শহরের বাংলা করলে দাঁড়ায়—শহরের দিকে। ঋ’র সাথে আমার সম্পর্কটাও বোধহয় তেমন, টের পাই না, কিসের দিকে যেন চলে যাই আমরা ক্রমাগত। অবিরাম শরীরে শরীর লেগে থাকা কোনো সমুদ্রগামী দিনে ঋ জানতে চায়, এর আগে কতজনকে ভালোবেসেছি আমি। এ প্রশ্নের সত্য কোনো উত্তর দেওয়া যায় না বলে আমি পুনরায় হয়ে উঠি অতিকায় সাপ। আরও বলে, আমার প্রেমের কবিতাগুলো কেন লুকিয়ে রাখি। বোঝাতে পারি না, প্রেমের কবিতা লিখতে পারিনি আমি কোনো দিন। লিখতে বসলেই মনে হতো, আমার সমস্ত গোপন গহন স্মৃতিরা ক্রমশ প্রকাশিত হয়ে উঠবে দশদিকে ঘুর্ণায়মান চোখেদের কাছে। আমি এক আত্মপ্রতারক, জেনে যাবে কেউ কেউ। তাই তো একের পর এক এঁকে যাই বিমূর্ত সব ছবি। কল্পিত গ্রাফিতিতে ছড়াই আমার বিদ্বেষ আছে যত।
বোধগম্য হয় না, মনোবিদ্যা পড়ানো ঋ কেন টের পায় না এসব উথাল-পাথাল অপ্রস্তুত বেদনার রং। এদিকে মন বিষয়ক কোনো বিদ্যা না জেনেও আমি মনের ভেতর আরও মন নিয়ে ঘুরে বেড়াই নির্বিকার, অতি কৌতুহলী কিছু ছেলেমেয়েদের পড়াই মানুষের ইতিহাস। ওর প্রশ্নের জবাবে আমি এইসব বলি।
ও শুধু হাসে। ওর অধর গলে পড়ে যাওয়া মার্লোবোরোর অনুত্তোজিত আগুনে বিছানার চাদর পুড়ে যায়। পুড়ে যায় কয়েক দশক-মেয়াদউত্তীর্ণ বোতলভর্তি উদগ্রীব জল। পুড়ে যায় আমার কাছে গচ্ছিত থাকা পুরোনো আপনদের ধূসর-কোমল স্মৃতি। হাসি থামে না। হাসিতে বেড়োতে থাকে রংবেরঙের অলীক সব প্রজাপতি।
০৪.
নিঃশব্দ শিশিরপাতের মতো ভোর হয়ে আসে
নিজের ভেতরে নিজে লুকিয়ে থাকার আয়োজন
প্রতিবার বলাবলি এখানে ভীষণ ক্ষত পাখি
কিছু আয়ু লুকায়িত যদি ফেরে পুরোনো আপন
কখনো একইভাবে আমাকে রাগের নামে ডাকে
কখনো তোমাকে পাখি ঘুম জ্বর বলিনি কিছুই
কখনো জানো খুব আমাকে আমার মতো আদর
তখনো জেনো পাখি আমার ভীষণই একা থাকা
তবুও নির্ভার পাখি বহু দিন যেন চিরদিন
তবুও বিভ্রম শুধু যদি না মেলে জীবনবোধ
নিজেকে যতই জানি–জল ও ছলের কোলাহল।
জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।