মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১৭

কিশোর গল্প : চুপকথাদের সাথে দিনরাত : মোহাম্মদ আলি

0

Utsob-Songkha_Motifগোঁয়ারগোবিন্দ শব্দটা আমার ডিকশনারিতে লেগে গেছে ক্লাস ফোরে পড়ার সময়। সমস্যা সেখানে না। ‘গোঁয়ারগোবিন্দ’ শব্দটাতে কিছুটা হলেও একটা ভাবসাব আছে, ম্যাডাম-স্যারেরাও সে নামে ডাকে। কিন্তু স্কুলের ছোটোবড়ো আর শয়তান দোস্তবন্ধুরা সবাই আমাকে ডাকে ‘গোবাইজ্জা’ বলে। বিচ্ছিরি-বিরক্তিকর শব্দটা! শোনামাত্রই মেজাজ খিঁচড়ে যায় আমার। কিন্তু স্বাস্থ্যসুরত খুব একটা ভালো না বলে ওই পর্যন্তই করি। নইলে মেরেটেরে চেহারার ম্যাপ পালটে দিতাম একেকটার। শয়তানের হাড্ডি সবগুলি! আরে, আমার নাম ধরে ডাক তোরা! তা না গোবাইজ্জা-গোবাইজ্জা বলে ক্ষেপাবে খালি। তোদের কী যোগ্যতা আছে এগুলি বলার! তোরা কি চাইলেই আমার মতো পার্কে পার্কে, গ্রামেগঞ্জে, এখানে সেখানে ঘুরতে যেতে পারবি? যখন-তখন হুটহুট করে উড়াল দিতে পারবি বনেবাদাড়ে? ভয়েই-না তোরা মরে যাবি। ভীতুর ভীতুর একেকটা! খালি ফুটানি আছে কথায়। স্কুল থেকে তোরা যাবি কক্সবাজারে? সেখানে গিয়ে তোরা কী করবি? খালি সাগরে নেমে দুই-একটা ডুব দিবি, আর বেকুবের মতো ঢেউয়ের ঠেলায় উলটিপালটি খেয়ে লোনা-পানি পেটে ঢুকাবি—এই তো? গবেটের দল! যা, মায়ের কথামতো, বাপের কথামতো সাগরে নামবি আর হোটেলে গিয়ে বেহুঁশের মতো ঘুমাবি? এইসবই হবে তোদের দিয়ে। যত্তসব!

কিন্তু এগুলো নিয়ে ভেবে ভেবে সময় পার করার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। আমি আছি সুযোগের অপেক্ষায়। খালি একটু ফাঁক দরকার। সোজা চলে যাব জায়গামতো। আমারে তখন আর কে পায়! শুধু ঝামেলা হবে মায়ের কানে গেলে। পৃথিবীর কাউকে আমি তোয়াক্কা করে চলি না। আব্বু আর ভাইয়াকে আমি পাত্তা দিই না একরত্তি। আব্বুকে ম্যানেজ করা এক সেকেন্ডের ব্যাপার। আর ভাইয়া? ও তো ঠিকমতো আমার চোখে চোখ রেখে কথাই বলতে পারে না। গাধা-টাইপ! আমার দেড় বছরের বড়ো মাত্র। নাম ধরেই তারে ডাকতাম। মা খবরদারি করেছিল বলেই-না তারে ‘ভাইয়া’ ডাক ডাকতে হয়, নইলে…!

গোবাইজ্জা শব্দটার মানে আমারে জেনে নিতেই যে হবে। …স্যারদের কাছ থেকে জানাটা খুবই সহজ। কিন্তু ঝামেলা অন্য জায়গায়। তারাই-না আবার এ নামে আমারে ডাকা শুরু করে দেয়! থাক দরকার নাই। সৌরভ মামার কাছ থেকে একসময় জেনে নেবো।

কিন্তু কাণ্ডটা ঘটানোর আগে একটা ব্যাপারে একটু সুরাহা না হলে আমার ভালো লাগছে না। গোবাইজ্জা শব্দটার মানে আমারে জেনে নিতেই যে হবে। …স্যারদের কাছ থেকে জানাটা খুবই সহজ। কিন্তু ঝামেলা অন্য জায়গায়। তারাই-না আবার এ নামে আমারে ডাকা শুরু করে দেয়! থাক দরকার নাই। সৌরভ মামার কাছ থেকে একসময় জেনে নেবো। এ এক আজব মামা আমার। পুরা ডিকশনারিই নাকি তার মুখস্থ! যেনতেন ডিকশনারি না, বাংলা ডিকশনারি—মা গো মা!

না থাক। এইটা আজাইরা কাজ। জরুরি কাজ সারতে হবে সবার আগে। চুপকথাদের একটা তালিকা বানাতে হবে দ্রুত। নইলে সব মাঠে মারা যাবে। এ কাজে পাবলিক লাইব্রেরিই ভরসা। কাজ সারতে হবে আসলে দুইটা। ম্যাপ দেখা, বইগুলাকে নেড়চেড়ে দেখা। বিকেলে বকুলদার বাড়িতে গিয়ে চুপকথাদের খোঁজখবর নিতে গেলাম। কাউকে গুরু বলে যদি জানি, সে বকুলদা। ‘চুপকথা’ তো তারই দেওয়া নাম। একবার আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এত নাম থাকতে গাছদের আপনি চুপকথা বলেন কেন?’ উনি সে-কথার উত্তর না দিয়ে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গাছ না, বলো উদ্ভিদ।’ ‘কেন, গাছ বললে সমসা কী?’ ‘তুমি যদি ধুতরাকে গাছ বলো আবার বটকেও গাছ বলো, তাহলে তো বিপদ! দুটার মধ্যে স্পষ্ট করে ফারাক বোঝাতে হলে তোমাকে বলতে হবে, ধুতরা বীরুৎ আর বট বৃক্ষ। সুতরাং তোমার প্রশ্ন হতে পারে এরকম—উদ্ভিদের নাম আপনি চুপকথা কেন দিলেন?’ ‘অ্যাঁ, বলেন কী! তাহলে তো বলতে হয়—ধুতরা-উদ্ভিদ, বট-উদ্ভিদ!’ ‘বেশি বুঝে ফেলেছ। এর জন্যই তো তোমার বন্ধুরা তোমাকে…।’ বকুলদার কথার ইঙ্গিত শুনেই আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি যাকে গুরু বলে জানি, সেও তা বলে ফেলল! আমার অবস্থা দেখে বকুলদা সাথে সাথে ‘সরি’ বলে ফেললেন। আমিও স্মার্ট কম নই। আগের কথা টানলাম—‘বলছিলেন, চুপকথার নামরহস্য নিয়ে…।’ আমার কথার ওপর কথা চাপিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আসলে উদ্ভিদেরা তো দ্রুত নড়াচড়া করতে পারে না, তার ওপর আবার কথা বলতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের একটা গানে আছে না—‘তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপকথার…।’ তাকে থামিয়ে দিয়ে হেড়ে গলায় আমি গেয়ে উঠলাম—‘পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপকথার।’ ‘দেখলে তো? তুমিও জানো। আসলে আমাদের জানাশোনার মধ্যেই সব থাকে। সেটা বোঝার জন্য খালি একটু মনোযোগ দাবি করে আর কি।’

বকালাপ বাদ দিয়ে এবার সরাসরি কাজের কথা ধরি। ‘কক্সবাজারের গাছপালা… সরি উদ্ভিদ নিয়ে আপনার কাছে জানতে এসেছিলাম।’ বকুলদা সোজা জানিয়ে দিলেন, ‘তুমি এক কাজ কর। সোজা চলে যাও ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে। সেখানে দেশের সব উদ্ভিদের রেকর্ড আছে। আমি আসলে বাগানের উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করি। বনজঙ্গলেরগুলো নিয়ে বলা আমার জন্য ভীষণ কঠিন কাজ। আমি ওদের একজনের নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। তার সাথে যোগাযোগ করে নিয়ো, উনি খুব ভালো জানেন সেখানকার উদ্ভিদ বিষয়ে।

এরপর আর কথা চলে না। কিন্তু ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে যাব কেমনে, পরশুই তো শুক্রবার! মাঝখানে যে বৃহস্পতিবার। স্কুল শেষ করে কখন যাব? কালকে তো দুনিয়ার কাজ। কাপড় ধোও তো জামাকাপড় ইস্ত্রি করো রে, কেডস-সান্ডেল ধোও রে… দুনিয়ার কাজ জমিয়ে রেখেছি। তার চেয়ে বরং হারবেরিয়ামের আঙ্কলটাকে ফোন দিই সময় করে।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই দেখি, পুরা বাসাটা মাথায় তুলে ফেলেছে ভাইয়া আর আব্বু মিলে। ঘটনা কী? আমি আছিয়াকে খুঁজে পেলাম বারান্দায়। আম্মুকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। খামোকা ধমক খেতে কে চায়! আছিয়া দেখি ঘাড় নিচু করে আড়াল থেকে মজা দেখছে। আমাকে দেখেই সটান হয়ে বারান্দার গ্রিল ঝাড়ফুঁক দেওয়ার ভান করল।

কীসের ফোন! সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই দেখি, পুরা বাসাটা মাথায় তুলে ফেলেছে ভাইয়া আর আব্বু মিলে। ঘটনা কী? আমি আছিয়াকে খুঁজে পেলাম বারান্দায়। আম্মুকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। খামোকা ধমক খেতে কে চায়! আছিয়া দেখি ঘাড় নিচু করে আড়াল থেকে মজা দেখছে। আমাকে দেখেই সটান হয়ে বারান্দার গ্রিল ঝাড়ফুঁক দেওয়ার ভান করল। ওকে এখন ঘাঁটালে বিপদ। নরম অথচ ডাঁট-মারা গলায় বললাম, কী রে, কাহিনি কী? আছিয়া ভীষণ নিচু গলায় বলল, ‘আবীর ভাইয়ায় কয় সে আপনার লগে কক্সবাজার যাইব। খালু কয়, তোর কক্সবাজারের গুষ্টি কিলাই, সামনে তোর এসএসসি পরীক্ষা, আর তুই যাবি কক্সবাজারে। বাদ! তুই তো যাবিই না, আদিরও যাওয়া বাদ। কেউই যেতে পারবে না ওখানে, ব্যস!’ আছিয়ার মুখের কথা শেষ না হতেই আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল—‘মানি না! মানি না! আমি যাবই যাব!’ ‘তোর আবার কী হইল, চ্যাঁচাস ক্যান? নতুন করে ভেজাল বাড়াইস না কইলাম খবরদার!’ আমার স্লোগান শুনে আম্মুর গলা ক্রমে চড়তেই লাগল। আমি ভয়ে ভয়ে তজবি টিপলাম। খাইছে! এখন আব্বু যদি আম্মুর সাথে যোগ দেয় তাহলে সব্বোনাশেরও বারোটা বাজবে। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে আস্তে করে বাথরুমে ঢুকে ছিটকারি মেরে দিলাম।

এখন কী হবে! কক্সবাজার যেতে না পারলে আমার সব খাটাখাটনি মাঠে মারা যাবে। ঠান্ডা-মাথায় ভাবার চেষ্টা করলাম—কী করা যায়? ওদিকে সমানে ত্রিপাক্ষিক চিল্লাফাল্লার চোটে ভাবাভাবির কাজটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। চলছে তো চলছেই, থামাথামি নাই। এমন সময় টোকা পড়ল দরজায়: ‘এই বের হ বাথরুম থেকে! দরজা খোল!’ ‘না খুলব না।’ —সাহস করে বলেই ফেললাম কথাটা। কিন্তু তাতে আরও জোরে ধাক্কা পড়ল—‘অ্যাই, তাড়াতাড়ি খোল!’ তারপরই গলা নেমে এলো হঠাৎ করে, ‘আরে খোল তাড়াতাড়ি, পড়ে গেল তো!’ মনে হলো, মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। দরজা খুলতেই ভাইয়া হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল।

ভয়ডর আর কিছু থাকল না। সরাসরি আব্বুআম্মুর সামনে গিয়ে হাজির হতেই আম্মু বললেন, ‘কী? ভয় পেয়ে শেষে বাথরুমে ঢুকতে হয়, গাধা কোথাকার! আবীর তোর সাথে কক্সবাজার যাচ্ছে। ও তোর গার্ডিয়ান। ও যা বলবে, তা-ই করবি। যা, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নাশতা সার, পড়তে বস।’ বাঃ! প্ল্যান মোতাবেক সবকিছু ভালোই এগুচ্ছে দেখছি। ভেতরে ভেতরে হেসে কূল পাচ্ছি না। কিন্তু বাইরে একটা গম্ভীর ভাব ধরে রাখলাম, যাতে কেউ কিছু টের না পায়।

ট্রেনের পুরাটা পথ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া চলল। মনে করেছিলাম, ও সাথে থাকাতে ভালোই হলো, প্ল্যানমাফিক সব কাজ সারা যাবে। কিন্তু ও যে বড়োভাইগিরি ফলাবে, ওটা ভাবতেই থেকে থেকে মেজাজ চড়ে উঠতে লাগল। ঝগড়ার মাঝখানে ওকে একবার বলেও দিয়েছি, ‘তোকে আর কখনোই ভাইয়া বলব না। তোর নাম আবীর, এখন থেকে এ-নামেই ডাকব তোকে, ব্যস! তর্জনগর্জন শুনে আমার চোখের দিকে তাকাবার সাহসই পেল না ও। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলতে পারল, ‘দাঁড়া, ঢাকায় ফিরে তোর বড়োগিরি আমি ছুটাচ্ছি… ফাজিল, বেয়াদব, গোঁয়ারগোবিন্দ!’ ‘কী! আমি গোঁয়ারগোবিন্দ? তুই কী তাহলে? তুই তো মিচকা শয়তান! খালি বড়োভাইগিরি ফলাও!’ আমাদের ঝগড়া শুনে ট্রেনের লক্করঝক্করের মধ্যেও কীভাবে যেন নার্গিস ম্যাডাম হাজির হলেন। সম্ভবত আমার বন্ধুরাই শয়তানি করে কাজটা করেছে। সোজা ধমকাধমকি করে ম্যাডাম শাসিয়ে গেলেন—‘আর একবার যদি দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধে তাহলে দুজনকেই সোজা ঢাকায় চালান করে দেবো!’ ম্যাডাম চলে যাবার পরই আশপাশ থেকে আমার আমার আর ভাইয়ার বন্ধুরা একনাগাড়ে কমেন্ট চালাতে লাগল—‘কোনো কথা নাই, সোজা ঢাকায় চালান করে দেবো! একজন মিচকা, আরেকজন গোবাইজ্জা—হা-হা!’ দাঁতে দাঁত চেপে পুরাটা পথই একজন আরেকজনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে চললাম। তবে মনের মধ্যে একটা আগুন কেবল পুষে রাখলাম, যে যে আমাকে গোবাইজ্জা বলেছে, সবকটাকে সময়মতো আমি দেখে ছাড়ব। একটাকেও বাদ দেবো না!

সকাল ১০টায় পর্যটনের হোটেলে উঠতেই হুকুম এলো, চটপট করে হাতমুখ ধুয়ে নিতে। ক্যাপ্টেন জানাল, নাশতা নাকি কিছুক্ষণ পরেই। ভদ্রলোকের মতো নাশতাটা সারব। তারপর সৈকতে যাওয়ার পথেই তো কাণ্ডটা ঘটাব। অন্তু, সালমান, রাগিবকে আগেই বলা আছে সবকিছু। চক, বাইনোকুলার, কাগজ-কলম, ব্যাগ, পলিথিন আর মোবাইল তো আছেই প্রত্যেকের। ভাইয়া কিছু টের পাওয়ার আগেই ফট করে কাজটা সারতে হবে—ব্যস!

শুরুতেই রাগিব ঘটাল এক কাণ্ড। আরে ছাগল! তুই আর চশমা ভাঙার সময় পেলি না? উচিত শিক্ষা! সে কিনা আবার যাবে বনে ঘুরতে! ও যে প্ল্যান থেকে বাদ, সে কি আর বলতে হয়! আমরা তিনজনই যাব, সমস্যা কী? এসব ভাবতে ভাবতে ফুরুৎ-ফুরুৎ করে নাশতা-শেষের বাঁশি বাজল। বুক ঢিপ-ঢিপ করা অবস্থাতেই উঠলাম আমরা। পরে কী হবে, জানি না। আগে তো কাজটা সারি। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

স্যার-ম্যাডামরা সবার আগে। আমরা ছাত্ররা একদম সিরিয়াল করে। যেন পিঁপড়া আমরা। সার বেঁধে চলতেই হবে! পেছনে ও মাঝে পাহারাদার হিসেবে বিভিন্ন ক্লাসের ক্যাপ্টেনরা। প্ল্যানমাফিক আস্তে করে সটকে পড়ল অন্তু আর সালমান। ওদের পক্ষে সটকে পড়াটা খুব সহজ হলো। আমার মতো ওদের তো আর গার্ডিয়ান নেই এখানে। কিন্তু মনে মনে হেসে নিলাম একচোট। ভাইয়াকে ফাঁকি দেওয়ার মতো সহজ কাজ পৃথিবীতে আর একটাও নেই! পিঁপড়া-পদ্ধতিতে চলার একফাঁকে ভাইয়াকে বললাম হিসু ধরেছে। ভাইয়া তাড়াতাড়ি আমাদের ক্লাস-ক্যাপ্টেনকে ধরল, লাইনে থাকার সময় হিসু করার নিয়ম আছে কি না। ক্যাপ্টেন এরকম প্রশ্নের জবাবে কী বলবে, প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলেও পরমুহূর্তেই সায় দিলো ভাইয়াকে। আমি আর কারো দিকে না তাকিয়ে হিসুর তাগাদা বোঝাতে দূরের ঝোপের উদ্দেশে ছুট লাগালাম। যদি সন্দেহ করে, এই ভেবে পিছন ফিরে আর তাকালামই না। কেমন বাচ্চাদের মতো আমার আচরণ—এই ভেবে ওরা হাসছিল নিশ্চয়ই। ভাবতে ভাবতে খুব দ্রুত ঝোপের আড়ালে গিয়ে ঝাউবনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে কোনোভাবে ওদের চোখের বাইরে চলে যে গেলাম, এটা নিশ্চিত। কারণ বড়ো রাস্তায় চলে এসেছি খুব দ্রুতই। পরের কাজটা সোজা—আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা অন্তু আর সালমানের সাথে মিলিত হওয়া। ডলফিনের মোড় কোথায়, একজনকে জিজ্ঞেস করতেই আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলো। সিএনজি স্টপেজের দিকে যেতেই একের পর এক ফোন আসা শুরু হলো। একবার ভাইয়া তো আরেকবার ক্যাপ্টেন। ভুলেও ধরা যাবে না। আগে পগার পার হয়ে তারপর দেখা যাবে।

উসখুস করতে থাকা সালমান আর অন্তুকে চোখে পড়তই রাস্তা পার হয়ে নিলাম দ্রুত। ওরা যে আমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল, তা বোঝা গেল ওদের তাগাদা দেওয়ার ধরন দেখে। তিনজনে মিলে এক বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে আড়াল নিতেই অন্তু নিজের শার্ট খুলতে খুলতে বলল, ‘অ্যাই, তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম খুলে ফেল! লোকে তো বুঝে ফেলবে আমরা স্কুলে পড়ি। ইশ! ইউনিফর্ম খুলে ফেললেই বুঝি আমরা যে ছাত্র, তা বোঝা যাবে না? মেজাজটা খিঁচড়ে গেল অন্তুর কমান্ড শুনে। আমার বিগড়ানো মেজাজ দেখে অন্তু কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু ওর কথা চাপা পড়ল সালমানের গলার কাছে—‘ঘাউরামি করা ঠিক হবে না। যেটা ভালো হবে, সেটার জন্যই তো বলা হচ্ছে।’ এরপর আর কথা চলে না। ঠান্ডা-মাথায় চিন্তা করে দেখলাম, কথা সত্য। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, সময় হাতে একেবারেই নেই আমাদের। যেকোনো সময় গোয়েন্দাগিরি করতে করতে ভাইয়া আর স্কুলের ছেলেরা চলে আসবে। এ-কথা ভাবতেই দেখি ক্যাপ্টেন আর ভাইয়া সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে আমার ফোনে। যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ফোনটাই দিলাম বন্ধ করে। নে, এখন যত ইচ্ছা ফোন দিতে থাক ছাগলগুলি!

সিএনজি থামল একেবারে ‘দরিয়ানগর সী ভিউ পার্ক’ লেখা সাইনবোর্ডটার ঠিক নিচে। লেখাটা অন্তুর চোখে পড়ল প্রথমে। আমার চোখে পড়বে কী, আমি তো মশগুল ছিলাম সাগর নিয়ে। মেরিনড্রাইভ বলে কথা। দারুণ সুন্দর রাস্তা! একদিকে সাগর, আরেকদিকে পাহাড়। রাস্তা কুচকুচে কালো। মাঝখানে জেব্রার গায়ের মতো সাদা সাদা লম্বা লম্বা দাগ। একবার রাস্তা ছুটে চলছে, আরেকবার ছুটে চলছে সাগর, সাগরের পাড়ে থাকা থোকা-থোকা ঝাউবন। আর হাতের বামে ছুটে চলছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে থাকা লম্বা লম্বা সব গাছ। এই শীতকালেও কী সবুজ চুপকথারা! বিভিন্নরকম সবুজ। কালচে সবুজ, কচি সবুজ, মাঝামাঝি সবুজ—সবুজ আর সবুজ। আমার গায়ে অন্তুর একটা ঠেলা লাগতেই হুঁশে এলাম। ও বলল, ‘দেখেছিস?’ ‘দেখার কী আছে? দরিয়ানগর এসে গেছি।’ ‘আরে মরণ! সে তো লেখাই আছে। সেটা বলি নাই। দেখ নিচে লেখা আছে ‘টিকিট কাউন্টার, ২০ টাকা করে।’ —আমাদের ম্যানেজার সালমান জানান দিলো। কথাটা শোনামাত্র মেজাজ গেল খিঁচড়ে—‘আরে এখানে টিকিট লাগবে কেন? বন দেখতে আবার টিকিট লাগে নাকি, যত্তসব!’ অন্তুর ভালো লাগল না কথাটা। সে হঠাৎই বলে উঠল—‘এর জন্যই তো তোকে সবাই গোবাইজ্জা বলে, বুঝতে পারছিস?’ ‘খবরদার! আরেকবার বলবি তো তোর খবর আছে কিন্তু!’ —এটা বলতেই অন্তু ঠান্ডা গলায় বলল—‘আমি নাই এসবের মধ্যে, চলি।’ প্ল্যান চোখের সামনে ভেস্তে যাচ্ছে দেখে সালমান-আমি দুজনই ওর হাত চেপে ধরে মাফ চাইলাম এ যাত্রায়।

টিকিট কাটতেই দেখি একটা ছেলে, মনে হয় আমাদের বয়সিই হবে, অন্তুর সামনে গিয়ে কী কী যেন বলছে। খুব পুরোনো আর ময়লা লুঙ্গি-পরা। কোনোমতে একজোড়া স্যান্ডেল পা-দুটাকে কামড়ে আছে। গায়ে ডোরা-কাটা টাইট একটা গেঞ্জি। গায়ের রং কুচকুচে কালো। কিন্তু কী যেন একটা আছে ওর মধ্যে। কেমন যে লাগল ওকে স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারলাম না। ওর দিকে বেশিক্ষণ মনোযোগ দেবার কোনো কারণ অবশ্য নেই। আমি আছি আমার চিন্তায়, কখন-না আবার ধরা খেয়ে যাই! যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বনের মধ্যে ঢুকে যেতে হবে আমাদের। মনে হয় অন্তুর ভালো লেগে গেছে ছেলেটিকে। অন্তু তাকে জিজ্ঞেস করল, কত চাও? একবার মাত্র অন্তুর দিকে মাথা তুলে পরমুহূর্তেই তা নিচু করে ছেলেটি বলল, ‘আন্নাগো ইচ্ছামতোন দিয়েন।’ মানে কী! এই ছেলে আমাদের গাইড? ক্ষেপে গিয়ে বললাম, ‘মানি না। আমাদের সাথে ও গেলে আমি যাব না, তোরা যেতে পারিস!’ কথাটা শোনামাত্র সালমান ক্ষেপে গেল—‘তোর রাগ আছে, আমার রাগ নাই? আমি আর অন্তুই যাব। তোর যাওয়ার কোনো দরকার নাই। যা ভাগ!’ মনে মনে এইবার তসবি টিপলাম। ‘খাইছে! এখান থেকে ফিরে গেলে দুদিক থেকেই লস। ওদিকে না আবার ভাইয়ারা এসে পড়ে! কাইজ্জা করার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি পালাই আগে। মূল কাজই তো শুরু করতে পারি নাই এখনো।

বড়োসড়ো এক ডলফিনের ভেতর দিয়ে ঢুকতে হয় দরিয়ানগর সী ভিউ পার্কে। ব্যাগ ঢিলা করে পিঠে চড়িয়ে রওনা হলাম আমরা। সামান্য এগুতেই অদ্ভুত এক গাছ চোখে পড়ল। তেমন একটা পাতা নাই কিন্তু বড়ো বড়ো একেকটা পাতা। ওপরে দুপুরের কড়া সূর্য। পাতার ফাঁক দিয়ে আলো নামছে আমাদের পায়ের পাতায়। একটা ঝাঁকি খেলাম। কোনোদিন তা এমন দেখি নাই। ওপরে আবার চেয়ে দেখি, নিচ থেকে পাতার পুষ্ট শিরা স্পষ্ট করে গোনা যাচ্ছে। একফাঁকে ফোন বের করে দেখি, সাড়ে বারোটা বাজে। তার মানে, আমাদের হাতে ভালোই সময় আছে। বিকালের মধ্যেই ফিরতে পারব হোটেলে। অন্তু আর সালমান চটপট হেঁটে চলছে দুদিকে ঘাস, লতাপাতা বিছানো পথ ধরে। মানুষের যাতায়াত বেশি এ-রাস্তায় বোঝা যায়। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে অদ্ভুত গাছটাকে বিদায় জানাতেই দেখি, ময়লা-জামার ছেলেটি গাছটির তলায় কীসব যেন কুড়াচ্ছে। সালমান-অন্তুকে ডাক দিতে ওরাও আগ্রহ নিয়ে গাছতলায় চলে এলো। ‘আহম্মদ আলি, কী ফল এগুলি?’ আমি ছেলেটাকে যা বলতে যাব, আগেই তা বলে ফেলল অন্তু। ‘ইবা বড়ো ডুমুর গাছ। কাওয়া যায়।’ —কক্সবাজারি ভাষায় আলতো করে জবাব এলো। অন্তুর হাতে না দিয়ে আমার হাতে কয়েকটা বড়ো ডুমুর ধরিয়ে দিলো ও। সত্যিই বড়ো ডুমুর। মাটিতে কলসির মতো বসানো যায়, হেলেদুলে পড়ে যায় না লালচে পাকা ফলগুলো। ওর নির্দেশ পাওয়ামাত্র একটাকে ফাটিয়ে মুখে ঢোকালাম। সালমানকে দেখলাম ফলগুলো চোখের ওপরে ধরে ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে দেখছে। হালকা মিষ্টি, খেতে যে আহামরি-স্বাদের তা নয়। কিন্তু খারাপও বলা চলে না। পাকা কয়েকটা ডুমুর ব্যাগে ঢোকানোর আগে অন্তুর দিকে চাইতেই ও মাথা ডান-বাম করল। ওর আসলে আগ্রহ পাখিতে। ঢাকায় নাকি চড়ুই, কাক, বুলবুলি, শালিক ছাড়া কিচ্ছু দেখা যায় না। যদিও জানি, চোখ-কান খোলা রাখলে অনেক পাখিই দেখা যায়। কিন্তু বাকবিতণ্ডা করার মুড নাই বলে অন্তুকে এ যাত্রায় রেহাই দিলাম।

ওর নির্দেশ পাওয়ামাত্র একটাকে ফাটিয়ে মুখে ঢোকালাম। সালমানকে দেখলাম ফলগুলো চোখের ওপরে ধরে ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে দেখছে। হালকা মিষ্টি, খেতে যে আহামরি-স্বাদের তা নয়। কিন্তু খারাপও বলা চলে না। পাকা কয়েকটা ডুমুর ব্যাগে ঢোকানোর আগে অন্তুর দিকে চাইতেই ও মাথা ডান-বাম করল। ওর আসলে আগ্রহ পাখিতে। ঢাকায় নাকি চড়ুই, কাক, বুলবুলি, শালিক ছাড়া কিচ্ছু দেখা যায় না।

কিছুক্ষণের মধ্যে নির্জনতা পেয়ে বসল আমাদের। হঠাৎই মনে হলো, পাতা পড়ার প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পারছি আমরা। কখন যে পায়ে-চলা পথ বাদ দিয়ে বুনো পথ ধরে এগুতে শুরু করেছি খেয়াল করিনি। গাইড আহাম্মদ আলির পিছন-পিছন সবাই আমরা। সামনে একটা পাহাড় পড়ল। টিলাও বলা যেতে পারে। মোটামুটি খাড়া। ঢাল বেয়ে উঠতে তেমন কোনো কষ্টই হলো না। বুনো ঝোপঝাড় ছাড়াও পাহাড়ের গায়ে মাঝারি আকারের বেশকিছু গাছ। গাছ বলা ভুল হলো, বলতে হবে বৃক্ষ। একটু পরেই আবার ঢাল। মানে পাহাড়টা পাড়ি দেওয়ার শেষের দিকে আমরা। আহাম্মদ আলি ঠিক আমার সামনেই চলছে দুরন্ত ভঙ্গিতে। হঠাৎ দেখি, লুঙ্গিতে গোঁজা ধারালো কাঁচি তার হাতে চলে এসেছে। সামনেই বুনো ঝোপঝাড়ে পথটা ঢাকা বলে সজোরে কাঁচি চালিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। পাহাড় থেকে নামার কিছুক্ষণ পর শুরু হলো ভেজা পথ। বোঝা গেল, এর পরপরই ঝিরিপথ। সামনে যে ঝরনা এসে হাজির হবে সেটা অবশ্য বুঝত পারিনি। শীতের শেষের দিকটায় এসে পানির ধারা কমে গেলেও খুব একটা যে কমেছে, তা বোঝা গেল না। পাহাড়ি কচুতে ছাওয়া ঝরনার আশপাশটা। আর বড়ো বড়ো গাছগুলো কী, তা বোঝা গেল না। তবে একটা গাছ দূর থেকেই আমার চোখকে আটকে রেখেছিল। পুরো গাছ হলুদে ছেয়ে আছে সম্ভবত ফুলে। পাতাও হতে পারে। তবে পাতা কি এরকম হলুদ হয়? শীতকালের শেষদিক এখন, হতেও তো পারে! কীভাবে বুঝব, হারবেরিয়ামের ওই লোকটাকে তো আর ফোন দিতে পারি নাই। প্ল্যান করতে করতেই তো সময় করে উঠতে পারলাম না।

ঝরনার একটানা ঝরঝর আওয়াজে একটা অস্বস্তি আমার বোধ হতে লাগল কেন জানি। মনে হলো, দূর থেকে কোনো একটা শব্দ যেন আমাদেরকে এগুতে দিচ্ছে না। থেকে থেকে অস্বস্তি বাড়তেই লাগল। গাইড আহাম্মদ আলির কথায় অস্বস্তিটা কেটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এমন এক কথায় সেটা গেল, তা না গিয়ে উপায়ই নেই! গা-টা শিরশির করে উঠল আমার। ও বলল, ঝরনার নিচে ওই যে ফাঁকা জায়গাটা দেখা যায়, সেখানে নাকি বছরের পর বছর ধরে কোন এক সন্ন্যাসী ধ্যান করছিল। হঠাৎই একদিন সে, বলা নাই কওয়া নাই ভুস করে গায়েব হয়ে গেল সেখান থেকে! কোথাও আর তাকে কোনোদিন দেখা যায়নি! যাঃ, এমন হয় নাকি? আজগুবি সব গল্প আহাম্মদ আলির! —এই যখন ভাবছি, শুনি কী, ভাইয়ার গলা যেন পাওয়া যাচ্ছে কোত্থেকে। সব্বোনাশ! ধরা খেয়ে গেলাম নাকি আমরা? এখন কী উপায়। অন্তু-সালমানও ঘাবড়ে গেল। আহাম্মদ আলিকে দেখি চুপচাপ আমাদের ভাবগতিক খেয়াল করছে। তার ভেতর কোনো ভাবের নড়নচড়ন নাই! জানবে কী করে, ও তো জানেই না কীসব কাণ্ড আমরা করেছি। আর সমানে তা করে যাচ্ছি একের পর এক। ওর জন্য বেশ খারাপ লাগতে শুরু করল। সে তো নির্দিষ্ট একটা সময়, নির্দিষ্ট একটা জায়গা পর্যন্ত আমাদের ঘোরাতে নিয়ে এসেছে। তার হাতে সময় কম। আরেক পার্টি ধরতে হবে না তার!

এদিকে ভাইয়া আর ক্যাপ্টেনের হাঁকডাক শোনা যেতে লাগল খুব কাছ থেকে। যেকোনো মুহূর্তে আমরা ধরা খেয়ে যেতে পারি, এমন দশা। স্কুলের সব নিয়মকানুন ভঙ্গ তো করেছিই, তার ওপর ভাইয়া আর ক্যাপ্টেনের কাছে আজীবনের জন্য ছোটো হতে হবে। কিন্তু ‘বেরিয়ে যখন পড়েছি ভাই, থামলে তো আর চলবে না’! সিদ্ধান্ত এলো, সামনেই চলতে হবে।

কিছুদূর এগুনোর পর এই প্রথম আহাম্মদের অদ্ভুত মায়াভরা চোখের দিকে চোখ তাক করলাম। আমার মনে হলো, পুরো পরিস্থিতিটা ওর এখন জেনে রাখার দরকার। পুরোটা বলার পর সালমান-অন্তুকে নিয়ে ওকে বোঝাতে লাগলাম—ভাই, এ বিপদ থেকে একমাত্র তুমিই আমাদের উদ্ধার করত পারো। দূরের ওই হলুদে ছাওয়া গাছটার দিকে আঙুল তুলে বললাম, যেভাবেই হোক ওইখানে আমাদের পৌঁছে দিতে হবে। কাজটা আমাদের সারতেই হবে। তোমার বকশিশ আমরা বাড়িয়ে দেবো। অনেক বাড়িয়ে দেবো। প্রস্তাব শুনে আহাম্মদ তার মায়াভরা চোখ হঠাৎই লজ্জায় নিচে নামিয়ে ফেলল। পায়ের আঙুল দিয়ে খামচাতে শুরু করল মলিন স্যান্ডেলজোড়াকে। আমরা যা বোঝার তা বুঝে ফেলেছি। বেচারার টাকার দরকার খুব। আমরা যে তাকে টাকার টোপে ফেলেছি, কথাটা ভাবতেই বিব্রত বোধ করতে লাগলাম।

আহাম্মদ দ্রুত আমাদের বনের গভীর অংশের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। এবং আমরাও সে-কাজটার জন্যই তৈরি ছিলাম একযোগে। ওদিকে ক্যাপ্টেন আর ভাইয়ার ক্রমাগত চিৎকার তো চলছেই। ওই চিৎকার অবশ্য আমাদের খুব কাজে দিচ্ছে। ওরা দুজন যতই হাঁক দিচ্ছে আমাদের ছোটার গতিও বাড়ছে তার সাথে সাথে। আমাদের ধরা খুব কঠিন কাজ হবে ওদের জন্য, কারণ আমাদের আছে আমাদের ত্রাণকর্তা আহাম্মদ আলি!

একটা সরু টানেলের মতো বুনোপথ বেয়ে ছোটোখাটো এক পাহাড়ে উঠতে হলো আমাদের। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় ওঠার পর এই প্রথম ভাইয়া আর ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেলাম আমরা। ওরা আমাদের পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেবল। ‘টিকটিকি কাছাকাছি রে আহাম্মদ!’ বলেই অন্তু তাকে তাড়া দিতে লাগল দ্রুত ছোটার জন্য। আহাম্মদও কম যায় না। অন্তুর কথা শোনামাত্র হাতের কাঁচি দিয়ে পাশের বুনো বাঁশের ঝোপে গিয়ে ফটাফট তিন টুকরা শক্তপোক্ত কঞ্চি কেটে বের করে আনল। আমি তো রীতিমতো আঁতকে উঠলাম আহাম্মদের কাণ্ড দেখে। নিজের ভাইকে পেটাব নাকি এগুলো দিয়ে? সব্বোনাশ! আহাম্মদকে আমরা বোঝাতে গেলাম যে, ওরা আমাদের শত্রু না। একজন আমাদের ভাই, আরেকজন ক্লাস-ক্যাপ্টেন। মারামারিতে যেতে হবে না!

আমাদের শঙ্কা দেখে ও হাসল একগাল। বুঝিয়ে দিলো মারামারির জন্য না, লাঠিগুলো লাগবে পাহাড়ি পথে দ্রুত ছোটার জন্য। দুই পায়ের অতিরিক্ত সঙ্গী হিসেবে কাজ করবে এটি। মানে, পাহাড়ি উঁচুনিচু, এবড়োথেবড়ো পথে ভারসাম্য এনে দেবে। ওর কথা শুনে আমরা আমাদের বেকুবিপনায় একচোট হেসে নিলাম। এই প্রথম আমাদের মনে হলো, আমরা অভিযাত্রী। রোমাঞ্চকর পথের অভিযাত্রী। আমাদের আটকে রাখার কোনো উপায়ই জানা নেই জগতের!

আবার দুজনের হাঁকডাক শুনতে পেলাম আমরা। ‘এই থাম, আর যাইস না।’ ‘বিকাল হয়ে গেছে’। ‘বেশিদূর যাওয়া ঠিক হবে না’। ‘এই বনে নাকি বাঘ আছে’। ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে শুনতে অনভস্ত পায়ে এগুতে লাগলাম আমরা। ক্যাপ্টেনের গলা বুঝি ভেঙে গেছে আমাদের ডাকতে ডাকতে। তার গলার জোর আস্তে আস্তে কমে আসছে শুনে বুঝলাম।

সালমানের দিকে তাকাতেই দেখি, কী-একটা যেন ভাবছে ও। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘বুঝলি একেই বলে ট্র্যাকিং। আমরা এখন ট্র্যকিংয়ে!’ ওর কথা শুনে আমরাও হল্লা দিয়ে উঠলাম দুহাত তুলে। অন্তু যে নাচতে পারে, এই প্রথম বুঝলাম আমরা। কিছুটা চিংড়িমাছের মতো হলেও এ-যাত্রায় ওকে মাফ করা যায়।

একটা জাতীয় দায়িত্ব নিয়ে বনে এসেছি আমরা। কম কথা নয়। বকুলদার কথা তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। ওটার জন্যই তো এতকিছুর আয়োজন করা। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। আমাদেরই সম্পদ, নামেতেও আমাদের পরিচয় লেখা আছে, কিন্তু আমাদের বনে পাওয়া যাবে না, তা তো হতে পারে না। যেভাবেই হোক খুঁজে তাকে বের করতে হবে, করতেই হবে!

সামনের যে পাহাড়টা আমাদের ডিঙ্গাতে হবে, বেশ উঁচু মনে হলো। একটু ভয়ও পেলাম। কারণ ওটার ঢাল বলে কিছু চোখে পড়ল না। দুই পাহাড়ের মধ্যে কিছুমাত্র সমতল জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে। ‘আর কোনো রাস্তা আছে কি না, খুঁজতে হবে তো। ভীষণ খাড়া যে।’ —আমার চিন্তিত ভাব দেখে সালমান-অন্তুও কিছুটা ভয় পেল মনে হলো। আহাম্মদ বলল, ‘আর খোনো ফত নাই আদি ভাই। কাড়া উঠোন লাইগব। আমনেরা কালি গাছগাছড়া দরি তরতর করি উইটবেন। কুনো সমুইস্যা অইতোনো। আল্লার নাম লই শুরু করেন।’ এমন সময় অন্তুর ফোন বেজে উঠল। বলল, ‘রইস ফোন দিয়েছে। কী করব, ধরব?’ আমি কিছু বলে ওঠার আগেই সালমান বলল, ‘মাথা খারাপ! কোনো অবস্থাতেই ক্যাপ্টেন কেন, কারো ফোনই ধরা যাবে না। ক্যাপ্টেনের গুষ্টি কিলাই! মাধবীকে খুঁজতে আসছি। যেমনে হোক খুঁজে বার করতেই হবে। হার মানা চলবে না। সময় তো হাতে আছে এখনো।’ এ-কথাগুলো বলতে বলতে পকেট থেকে ফোন বের করে ও জানাল চারটা বাজে।

এদিকে আহাম্মদের সতর্কবার্তা পাওয়া গেল: ‘এই ফাহাড়ের হরে আর কুনো ফত আঁর জানা নাই। আর ফাহাড়টাও বালা না, ইয়ানোর লোখজনে নানা খুখতা খয়।’ ‘মানে কী! ভূতটুত আছে নাকি?’ —রীতিমতো লাফ দিয়ে উঠল সালমান। আহাম্মদের কথাটা শুনে আমিও যে ভয় পাইনি, তা নয়। চেপে গেলাম তা তিনজনের সামনে। ‘ভূত নো। মাজেমইধ্যে অউগ্গা বুড়া বেডিরে নাকি দেকোন যায় ফাহাড়ডার মইদ্দে। হেতি বাত ফাকায়, হেই ধুয়া দূর তন দেকা যায়। আঁই আসলে দেকি নো কুনুদিন, গেরামবাসী হেতারা কয় আরি। আর এই ফাহাড়ে উডিও নাই কুনো সময়।’ কথাগুলো শোনামাত্র আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। আবার সাথে সাথে মনে পড়ে গেল—আরে! ভয়ের কী আছে? এখন তো দিনের বেলা। বুড়িমায়ের সাথে দেখা হলেই-বা কী? আর আমরা হচ্ছি গিয়ে চার-চারজন। পারবে নাকি আমাদের সাথে! আবোল-তাবোল এইসব ভাবছি, এমন সময় সালমানের চিৎকার—‘ধরে ফেলল রে!’ ঝট করে পেছনে চেয়ে দেখি, ভাইয়া আর ক্যাপ্টেন আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। আহাম্মদ মুহূর্তমাত্র দেরি না করে আমাদের দুজনকে বলল ওপরে ওঠা শুরু করতে। লতাপাতা, শুকনা গাছগাছড়া, সরি, উদ্ভিদ ধরে হুড়মুড় করে ওপরে উঠতে লাগলাম। নিচ থেকে ভাইয়া আর ক্যাপ্টেন অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করল। ভাইয়া আমাদের বোঝাতে শুরু করল, ‘ভাই না আমার তোমরা, নিচে নেমে আসো প্লিজ। আল্লার দোহাই নেমে আসো এখনই।’ ক্যাপ্টেনও বলতে শুরু করল, ‘তোদের কেউ কিছু বলবে না। সব আমি দেখব। প্লিজ তোরা নেমে আয়। টিচারদের আমি সামলাবো। বাড়ির কেউই একথা জানবে না। নেমে আয় জলদি!’ কীসের কী! আমরা ওদের চিড়া-ভেজা কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে খাবি খেতে খেতে, হাচড়ে-পাচড়ে কোনোমতে ওপরে উঠেই পাহাড়ের বাঁকে ঢুকে পড়লাম।

চূড়ায় উঠেই পশ্চিম দিকে তাকাতেই দেখি, ও মা! সাগর! নীল সাগর, বিশাল সাগর। আমাদের বঙ্গোপসাগর! সাথের তিনজনের চোয়াল হাঁ হয়ে ঝুলে পড়েছে দেখে হাসি পেল মনে মনে। কতক্ষণ এরকম দশায় কাটল জানি না, সম্বিৎ ফিরে পেলাম অন্তুর অস্ফুট চিৎকারে। পূর্বদিকে চেয়ে দেখি আরেক নীলের বন্যা বয়ে চলেছে! একটা ভীষণ ভালোলাগায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমরা। দূর-দূর দিগন্ত পর্যন্ত কেবল পাহাড় আর পাহাড়। ছাই-নীল, গাঢ় নীল, হালকা নীলের খেলা যেন আকাশ-বাতাসজুড়ে। বুড়িমায়ের কথা চট করে কেন জানি মনে পড়ে গেল। তার জন্য মায়া লাগতে শুরু করল—আহা! তার বুঝি কেউ নেই এই সংসারে, এই পৃথিবীতে!

সালমান ফোনে সময় দেখে জানাল, ‘সাড়ে পাঁচটা বাজে। আমাদের ফিরতে হবে।’ আহাম্মদ বুঝি তৈরি ছিল কথাটা বলার জন্য। সেও তাড়া দিলো—‘বাই, অওন রওনা ন দিলে রাইত নামি আইসবো। লন ফিরি যাই।’ আমার মাথায় তখন খেলছিল নীল বনলতার ফুলগুলির আকুলি-বিকুলি। ভাইয়াদের তাড়া খেয়ে ওপরে পড়িমরি ওঠার সময় লতাগাছটিকে দেখি। এর আগে বৃক্ষমেলায় দেখেছি, বোটানিক্যাল গার্ডেনেও দেখেছি। কিন্তু বুনো, মানে ওর নিজের পরিবেশে এই প্রথম দেখলাম। আবিষ্কারের আনন্দ যে কী, এই প্রথম টের পেলাম ভালো করে। নিজেকে জয়ী-জয়ী লাগছে এ মুহূর্তে। কিন্তু পরক্ষণেই বিষণ্ন হয়ে গেলাম একটা কথা ভেবে। ‘ওই! কী ভাবিস? চল, নামি। সন্ধ্যা হয়-হয়।’ অন্তুর তাগাদা পেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সালমানও তাড়া দিলো, ‘দেখ, নেটওয়ার্ক নাই এখানে। এখনই চল!’ ওর তাগাদা আমাকে কাতর করতে পারল না মোটেও। আমার হয়েছে উলটা-দশা। ফিরতে ইচ্ছা করছে না একেবারে। বললাম, ‘নেটওয়ার্ক নাই, ভালো হয়েছে। আমাদের ওরা পাবে না আর। চল, সবাই মিলে ওই যে হলুদ গাছটার দিকে যাই।’ আমার কথা শুনে অস্ফুট শব্দ বের হলো একেকজনের মুখ থেকে। অন্তু বলল—‘তুই কি পাগল? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর!’ হাত বাড়িয়ে বললাম—‘কেন সমস্যা কী, ওই তো দেখা যায়।’ ‘সূর্যও তো দেখা যাচ্ছে, যা না ওইদিকে ছাগল কোথাকার! ওইখানে গেলে তুই আর ফিরতে পারবি না। ইনফ্যাক্ট এই কালে পারবি না, পরকালে পারলেও পারতে পারিস।’ আমার জেদ চেপে গেল ওর কথা শুনে—‘তোরা আহাম্মদকে নিয়ে ফিরে যা। আমি একাই যাব। আমি কারো পরোয়া করি না।’ যে-কথাটা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়, সেটাই বলল সালমান—‘তুই আসলেই ঘাউরার ঘাউরা! এরজন্যই তোরে সবাই বলে গোবাইজ্জা!’ আমার জিদ চেপে গেল ওর কথা শুনে—‘আমি গোবাইজ্জা তাই তো? যা, তোরা আহাম্মদকে নিয়ে ফিরে যা। মিশন শেষ না করে আমি ফিরব না।’

তোরা যদি হোটেলে ফিরতে না চাস তাহলে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি চটজলদি দেখেই ফিরে আসব। সত্যি দেরি করব না।’ আমার কপট-বিনয় মনে হয় কিছুটা কাজে এলো। অন্তু আর সালমান কাঁধ ঝাঁকাল কিছুক্ষণ পরপর। আহাম্মদের নিজস্ব কোনো মত নাই।

আহাম্মদ যতই ঝগড়া থামাতে যায়, তিনজনের ঝগড়া ততই চড়তে থাকে। ‘তুই মিশন শেষ করবি মানে কী? মাধবী তো খোঁজাই শুরু করতে পারলাম না। ক্যাপ্টেন আর তোর ভাইয়ার দাবড়ানি খেয়েই তো কূল পেলাম না আমরা! তোর আসলে মতলব কী? খুলে বল।’ —সালমান সাফ-সাফ জানতে চাইল। ওর কথাতেই বিদুৎবেগে এক বুদ্ধি খেলে গেল আমার মাথায়। গরম মেজাজ থেকে সরাসরি নেমে এলাম ঠান্ডা মেজাজে। মিউ-মিউ গলায় বললাম, ‘আমি আসলে ওই গাছটার কাছে গিয়ে খালি একবার দেখে আসতে চাই, কী গাছ ওটা। ব্যস। আর কিছুই না। তোরা যদি হোটেলে ফিরতে না চাস তাহলে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি চটজলদি দেখেই ফিরে আসব। সত্যি দেরি করব না।’ আমার কপট-বিনয় মনে হয় কিছুটা কাজে এলো। অন্তু আর সালমান কাঁধ ঝাঁকাল কিছুক্ষণ পরপর। আহাম্মদের নিজস্ব কোনো মত নাই। বেচারা যে আমার ফাঁদে পাড়া দিলো, বুঝতেই পারল না। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, ওর বকশিশ দ্বিগুণ-ত্রিগুণ করতেই হবে। বেচারা গরিব মানুষ।

সন্ধ্যা হয়ে যাবার আতঙ্কে আমরা তড়িঘড়ি করে, সর-সর করে নামতে শুরু করলাম বুড়িমার পাহাড় বেয়ে। সুর্যের তেজ কমে গেলেও গরমে হাঁসফাঁস শুরু হলো আমাদের। আমার ওপর মেজাজ বিগড়ে থাকলেও ওরা সে-কথা বলতে পারল না। পাহাড়ে ওঠাটা মনে হয় সহজ। নামতে গেলে বোঝা যায়, খুব কঠিন কাজ ওটা। মাধ্যাকর্ষণ-বেটার কাজই হচ্ছে আমাদেরকে নিচের দিকে ঠেলে দেওয়া। বাঁশের লাঠি এক্ষেত্রে দারুণ কাজে লাগল আমাদের। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে নানারকম ফার্নের দঙ্গল। কোনোটা আবার বেশ বড়োসড়োও। মনে হয় এগুলো ট্রিফার্ন। আমি কি আর অত চিনি! একধরনের বেতও দেখতে পেলাম। বাদামি কাণ্ডভর্তি হুকের মতো লম্বা লম্বা কাঁটা, মনে হয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ভাবখানা এমন—আয় কাছে দেখি। আমাকে ধরার সাধ ভালোমতন মিটিয়ে দিই! ঢালগুলাতে অল্পবিস্তর ছোটোবড়ো পাথরও আছে। বর্ষায় এগুলো মস দিয়ে যে ছাওয়া থাকে নিশ্চিত। বুড়ির পাহাড় থেকে নামার পরপরই গাছপালার ফাঁক দিয়ে কোত্থেকে ভূতের মতো এক লোক এসে হাজির। মাথায় দুনিয়ার বাঁশ বোঝাই করে সটান শরীরে দ্রুতবেগে আমাদের অতিক্রম করল সে। তার আগে আহাম্মদের উদ্দেশে কী-একটা কথা বলে গেল শীতলভাবে, বোঝা গেল না। সালমান পায়ের নিচে পানি ভাঙতে ভাঙতে আহাম্মদকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, ‘হেতে হোডেলত ফিরি যাইবার খইছে তড়াতড়ি।’

আমি মনে মনে হাসলাম কিছুক্ষণ। পায়ের নিচে পানি পেয়ে আমাদের যে ভালো লাগছে, কেউ তা মুখে না বললেও বুঝতে পারলাম। তার মানে, সামনেই কোথাও ঝরনা আছে। এবং সে-কথা কিছুক্ষণের মধ্যে জানান দিলো ঝরনাটা নিজোই। একটা বাঁক পেরোলেই ঝরনাটা পাবো, এমন সময় বিরাট দৈত্যাকার এক গাছ আমাদের সামনে যেন পথ আটকে দাঁড়িয়ে রইল। অনেক উঁচু গাছ। ডানে-বামে দুদিকে বেশি ছড়ানো। বটের মতো দেখতে। কিন্তু বট না। সালমান আমাকে তিরস্কার করে বলল, ‘আরে কী গাছ চিনিস! দেখে চিনলি না? এইটা রাবার-বট। ইন্ডিয়ান রাবার!’ এই গভীর বনের মধ্যে কী করে গাছটা এলো, ভেবে পেলাম না। অনেক অনেক ঝুরি ওর এবং বেশ পুরোনো সেগুলো। গাছটার বয়স একশ বছরের বেশি হবে হয়তো।

রাবার-বটকে বামে রেখে কিছুদূর এগুতেই দেখা গেল বিরাট আকারের সব চাউর গাছ। এদের আরেক নাম গোলসাগু। সংসদ ভবনের মানিক মিয়া এভিনিউতে আছে অনেকগুলো। ঝিরির ধারেকাছে জঙ্গইল্লা শাকের দুয়েকটা ঝোপ থাকবেই থাকবে। এখানেও ঠিক তাই দেখলাম। কেন এমন অদ্ভুত নাম এর, বোঝা গেল না। বইতে আমি এর ছবি দেখেছি। মোটেও শাকের মতো না। বড়োসড়ো ঝোপ, মানে কিনা গুল্ম যাকে বলে। লোকে হয়তো এর পাতা শাক হিসেবে খায়।

কুচাই গাছের কয়েকটি ঝোপ দেখেই চিনে ফেলল সালমান। ও নাকি গত কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেটে কক্সবাজারের কী কী গাছ পাওয়া যায়, তা নিয়ে পড়াশোনা করছিল। কুচাইয়ের কাছে গিয়ে দেখি, ভীষণ শক্ত আর ধারালো কাঁটায় বোঝাই লতানো গুল্মটি। সালমান জানাল, এটা নাকি আমাদের দেশের রাধাচূড়া। বলা যায় বুনো রাধাচূড়া। গত বছর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে আমাদের দেশীয় বুনো স্ট্রবেরি দেখেও এরকম আনন্দ পেয়েছিল ও।

এ-গাছ ও-গাছ দেখে একটু সামনে এগিয়ে বাঁক ঘুরতেই ধরা দিলো বিশালকায়, রাজকীয় এক ঝরনা। অনেক অনেক উঁচু থেকে পানি ঝরছে তো ঝরছেই। ঝরনার পানিতে দাপাদাপি করার আর সময় কই? সন্ধ্যা নামার ভয়ে আহাম্মদের নির্দেশে ঝরনার পাশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠতে লাগলাম আমরা। উত্তরদক্ষিণপূর্বপশ্চিম-জ্ঞান আমাদের খুবই করুণ। আহাম্মদই ভরসা। আগে থেকেই বলে রেখেছিল কীভাবে কোন পথ দিয়ে হলুদ গাছটার কাছে যেতে হবে।

ঝরনার পাহাড়টা পার হতে গিয়ে আমাদের জান শেষ হওয়ার দশা। কিন্তু অশোকের কয়েকটি গাছ আমাদের সে-কষ্ট ভুলিয়ে দিলো তার হলুদ-লাল রাশি রাশি ফুল দিয়ে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলাম আমরা অশোকের বড়ো একটা গাছের নিচে। বকুলদার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম ফুলের সময় অশোকের গাছে চড়তে গেলে ভীষণ বিপদ আছে! রাশি রাশি বিষপিঁপড়ায় বোঝাই থাকে ওদের কাণ্ড আর ডালপালা। উঠতে গেলেই সোজা আক্রমণ, কোনো কথা নাই!

অন্তু কিছুক্ষণ পরপর বাইনোকুলার তাক করে পাখি দেখার কাজটা সারছিল। ও একটু এগিয়ে বড়ো বড়ো কয়েকটা গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ল। এত বড়ো বড়ো গাছ খুব কমই দেখেছি আমি। সম্ভবত এগুলো তেলশুর। সালমান কোনো এক ফাঁকে হিসু সারতে গেল। ছোটো আঙুল আমাদের দিকে উঁচিয়ে ধরাতে ব্যাপারটা বোঝা গেল। অশোকের নিচে বড়োসড়ো এক পাথরের ওপর বসে আমি আর আহাম্মদ আলাপ সারতে লাগলাম, দিনের আলো থাকতে থাকতে আদৌ আমরা হলুদ গাছটার কাছে পৌঁছাতে পারব কি না। আহাম্মদ রায় দিলো, কোনোভাবেই সম্ভব না। আরও ছয়-ছয়টা পাহাড় পাড়ি দিতে হবে ওখানে যেতে হলে। পাগলামি বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমাদের ফেরার পথে পা বাড়াতে হবে। নইলে অন্ধকারে, এই গভীর বনের মধ্যে রাত কাটাতে হবে!

আমরা উঠতেই দেখি সালমান ফিরে আসছে। ওকে অন্তুর কথা জিজ্ঞেস করতেই ও কিছু বলতে পারল না। হাতে সময় নাই বেশি। ফিরতে হবে। তাই পাখি-মাস্টারের খোঁজে দ্রুত পা চালালাম তেলশুরের দিকে। তেলশুরের গাছগুলো একটু ঢালের দিকে। বিশাল গাছের আনুভূমিক ডালগুলোও বিশাল। মনে হলো দৈত্যের একেকটি হাত। পাতার ঝিরঝিরানির মধ্যে কী একটা আশঙ্কা চেপে বসল মনে। ঢালের দিকে গভীরভাবে তাকাতেই ধক করে উঠল অন্তুর বাইনোকুলার দেখে। ওটা ঝুলছে কচি সবুজ পাতায় ছাওয়া একটা ঝোপে! অত দূর থেকে বোঝা গেল না কী লতা ওটা। কিন্তু লতাটার কথা ভাবার সময় কই? অন্তু কোথায় গেল, এটা ভাবতেই একটা হিম-হিম অনুভূতি চেপে বসল মনে। তাহলে কি ওর হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল ওটা? ওটা খুঁজতে গিয়েই কি নিচের দিকে নামল? কই, ওকে তো পাচ্ছি না কোথাও। হঠাৎ আহাম্মদের চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম বাঁ-দিক থেকে। দৌড়ে গিয়ে দেখি সালমান আর ও উত্তেজিতভাবে নিচের দিকে কী-একটা জিনিস দেখছে। তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল। পাহাড়ের একেবারে গোড়ার দিকে হাতপা ছড়িয়ে অন্তু চিৎ হয়ে পড়ে আছে! আর তার চারপাশে বেশ কয়েকটি বানর চিৎকার-চেঁচামেচি করছে প্রচণ্ডভাবে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ঢালের খাঁজ ধরে, এ-গাছ ও-গাছ চেপে, খামচে গড়িয়ে পড়লাম গিয়ে সোজা অন্তুর কাছে। সালমান আর আহাম্মদও ততক্ষণে পৌঁছে গেল। আমরা কাছে যেতেই বানরগুলো শিরশির করে দ্রুত সটকে পড়ল। তবে খুব একটা দূরে গেল না ওরা। পাশের বড়ো বড়ো গাছগুলির ডালের ওপর বসে চেঁচাতে লাগল। কানে তালা লাগার দশার মধ্যেই তিনজনে ধরে অন্তুকে চ্যাংদোলা করে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে আনলাম দ্রুত।

অন্তুর জ্ঞান ফিরল মিনিট-পনেরোর মধ্যে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে যখন। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকারে ছেয়ে যাবে পুরো বন। ভেতরে ভেতরে আমরাও টের পাচ্ছি, বনের অন্ধকারের মতো আমাদের মনও গ্রাস হতে লাগল অন্ধকারে। সে অন্ধকার ভয়ের, প্রচণ্ড আতঙ্কের। ঠান্ডাও জেঁকে বসতে শুরু করেছে। অন্তুকে নিয়ে ফিরে যাবার কোনো উপায় নাই। ওর হাড় ভেঙে গেছে কয়েক জায়গায়। পায়েরটা ভয়ানক। কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। কোনোভাবেই নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারছে না ও। অন্তুর এ অবস্থার জন্য একমাত্র দায়ী আমি। আমার জন্যই, আমার গোয়ার্তুমির জন্যই আজ সবার এই দশা। আর থাকতে না পেরে সব কথা খুলে বলে ফেললাম ওদের। বললাম, মাধবীকে পাবো না, এটা মেনে নিতেই পারলাম না আমি। আমাদের দেশি লতা, আমাদেরই একান্ত সম্পদ, ওকে বুনো পরিবেশে পাওয়া যাবে না? এটা একটা কথা হলো! সারা দিন ধরে তো পালাতেই থাকলাম ভাইয়া আর ক্যাপ্টেনের ভয়ে। মাধবী কেন, কোনো একটা গাছকে যে নিজেদের মতো করে পর্যবেক্ষণ করব, সে সুযোগই তো পেলাম না। পালাতে পালাতে যখন বুড়িমার পাহাড়ে উঠলাম সবাই, তখনই আমার মনে হতে লাগল, এ অ্যাডভেঞ্চার মাঠে মারা যাবে নিশ্চিত! কিন্তু মাধবীকে উদ্ধার করতেই হবে আমাদের। বড়োরা যেটা কখনোই পারেনি, সেটা আমারা করে দেখিয়েই ছাড়ব। নামের শেষে ‘বেঙ্গলেনসিস’ যার আছে, তাকে কিনা বাংলার বনে পাওয়া যাবে না, এটা হতে পারে না। বুদ্ধি বার করতে থাকলাম তখন থেকেই। চট করে বুদ্ধিটা পেলাম দূরের ওই হলুদ গাছটার দিকে চেয়ে। হ্যাঁ, ওই গাছটাকেই ট্রাম্পকার্ড বানিয়ে তোদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এ পর্যন্ত নিয়ে এলাম। আমি… আমি সরি দোস্তরা। আমাকে তোরা মাফ করে দিস। সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী!

ঠান্ডাও জেঁকে বসতে শুরু করেছে। অন্তুকে নিয়ে ফিরে যাবার কোনো উপায় নাই। ওর হাড় ভেঙে গেছে কয়েক জায়গায়। পায়েরটা ভয়ানক। কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। কোনোভাবেই নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারছে না ও। অন্তুর এ অবস্থার জন্য একমাত্র দায়ী আমি। আমার জন্যই, আমার গোয়ার্তুমির জন্যই আজ সবার এই দশা। আর থাকতে না পেরে সব কথা খুলে বলে ফেললাম ওদের। বললাম, মাধবীকে পাবো না, এটা মেনে নিতেই পারলাম না আমি।

সব শুনে অবাক হলেও এখন আর করার কিছু নাই ভেবে ওরা চুপচাপ মাথা নিচু করে রইল। এরকম নিস্তব্ধতা ভালো লাগল না। পুরো বনজুড়ে নিস্তব্ধতা। এখানেও নিস্তব্ধতা! আমাদের চমকে দিয়ে এর মধ্যেই আশপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক। সে কী ডাক! রক্ত হিম-করা ভয়ানক সেই ডাক। ক্রমাগত চলতেই থাকল, চলতেই থাকল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। মনে হলো, ওদের প্রচণ্ড ডাকাডাকিতেই বোধহয় বনে সন্ধ্যা নেমে আসে!

শিয়ালের ডাক থামতেই আশপাশ থেকে শুকনা ডালপালা জোগাড় করে স্তূপ করলাম আমি আর আহাম্মদ মিলে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেই অন্তু মজা করল—ডালে ডাল ঘষে আগুন জ্বালাবি নাকি আদিম মানুষের মতো? ওর কথা শুনে ঠোঁটের গোড়ায় বাঁকা হাসি রেখে, ব্যাগে রাখা লাইটার দিয়ে আগুন ধরাতেই সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আগুনের গুণে নয়, আমার ছলচাতুরির গুণে সবার মুখ আলো হয়ে উঠল। অন্তু এত কষ্টের মধ্যেও হেসে বলল, ‘বাঃ বাঃ! হুজুর একেবারে প্রস্তুত হয়েই তবে এসেছিলেন! যাক, তোর ঘাউরামি মাঝেমধ্যে তাহলে উপপকারেও লাগে—হা-হা।’ ওর কথায় আমরা না হেসে পারলাম না। না, সবাই নয়, আহাম্মদ আলি হাসল না।

এই প্রথম আহাম্মদ আলির চেহারায় আতঙ্ক দেখতে পেয়ে আমি অবাক হলাম। সাহসী ছেলেই তো মনে করতাম ওকে। ওকে অভয় দিতে যাব, এমন সময় অন্তু কাতরানির মধ্যেই মুখ খুলল—‘আহাম্মদ, তুমি ভয় পেলে আমাদের কী অবস্থা হবে! আমরা তো দিনের বেলাতেই বনের মধ্যে ভয়ে কাঠ হয়ে যেতাম তুমি সাথে না থাকলে। আর এখন অন্ধকারে, জীবজন্তু-বোঝাই জঙ্গলের মধ্যে তুমি ছাড়া আমরা একেবারে অচল, বুঝতে পারছ?’

আহাম্মদ এবার ওর সব কথা খোলাসা করল। শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সে-সাথে ভীষণ খারাপও লাগল ওর জন্য। ও আসলে একজন রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে নিজের জীবনটা হাতে নিয়ে কোনোমতে সীমানা ক্রস করে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছিল। ছোটো থাকতেই ওর বাবা মারা গিয়েছিল। চাচাদের বাড়িতে কোনোমতে পোকামাকড়ের মতো থাকত মা আর বাকি তিন ভাইবোনসহ। জান্তা সরকারের মিলিটারিরা মা-চাচা-ভাইবোনদের মেরে ফেলেছে তারই চোখের সামনে। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছারখার করে দিয়েছে পুরো গ্রাম। প্রতিবেশি এক পরিবারের সাথে দিরনাত ক্ষুধা আর আতঙ্কের সাথে লড়াই করে তবেই বাংলাদেশে ঢুকেছে। ক্যাম্পে নিয়মকানুনের অত্যাচার দেখে দরিয়ানগরের এখানে গাইডের কাজটা চেয়ে নিয়েছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে, লোক ধরাধরি করে। নিজের পরিচয় তাকে গোপন রাখতে বলেছিল পার্কের লোকজন। তাই আমাদের কাছে ও খুলে বলেনি।

সালমান তার ঘাড়ে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘তুমি অনেক ভালোমানুষ আহাম্মদ। আমরা মনে করেছিলাম এই রাতে বনের মধ্যে থাকতে হবে বলে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। তুমি আসলে খুব সাহসী এক ছেলে। মরণকে হাতে নিয়ে আমাদের দেশে এসেছ, আবার এখন আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছ। তোমার দায়িত্বও আমরা নিলাম। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি আহাম্মদ, আমরাই সব সামলাব। খালি রাতটা ভালোয় ভালোয় পার করতে পারলেই হয়।’ সালমানের কথায় আমার চোখ ভিজে এলো। আমরা এখন চার-চারটি বন্ধু। কোনোকিছুই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের ভয় কীসের? অন্তু শোয়া অবস্থাতেই আহাম্মদকে জড়িয়ে ধরল। সালমান আর আমি বাদ থাকব কেন, আমরাও জাড়িয়ে ধরলাম আহাম্মদকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম, এই শীতকে উপেক্ষা করা আমাদের মতো বীরের কাজ নয়। আহাম্মদ হঠাৎ এক ঝটকায় উঠেই সালমানকে নিয়ে লেগে গেল শুকনা পাতা জোগাড় করতে। বুঝতে পারলাম, ওর মাথায় বুদ্ধি বলে জিনিসটা একটু বেশিই আছে।

রাত বাড়তে থাকলে আশপাশের গাছগুলিতে থাকা বানরের হুশহাশ আর রাতজাগা পাখির ঝগড়াঝাটি ছাড়াও অদ্ভুত-সব আওয়াজ শুনলাম আমরা। কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দের মতো করে কোনো একটা প্রাণী ডেকে উঠল দূরে কোথাও। এরপর আরেকটা। একটার পর একটা ডাকতেই লাগল কিছুক্ষণ। পানির বোতলগুলি খুব যত্নে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হলো, যাতে বানর বা শিয়ালের দল সেগুলি ছিনতাই করতে না পারে। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের আশপাশের আরও তিন থেকে চার জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে। বাঘডাস, বনবিড়াল, সজারু, গুইসাপ তো রয়েছেই, বিষাক্ত সাপেরও অভাব হবে না সতর্ক না থাকলে। বানর আর শিয়াল তা আছেই। পোকামাকড়ের উৎপাত তো থাকবেই। মশার ঘ্যানর-ঘ্যানরে ঘুম আসবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তিনজন মিলে আগুন জ্বালিয়ে পাতার চাদরে ঢুকে পড়লাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাত ১২টার কাছাকাছি। অন্তুকে সবাই মিলে অনুরোধ করলাম ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু ও কোনোভাবেই রাজি হলো না। চারজন মিলে কথা চালাচালি করে বাকি রাতটা পার করা যায় কি না, সে চেষ্টাটা চালাতে লাগালাম আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্তু টুস করে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। সকালে কীভাবে ওকে এই দুর্গম বন থেকে বের করব, তা ভাবতেই দুশ্চিন্তায় মন ছেয়ে গেল। আবার এ ভেবে মনকে বুঝ দিলাম যে, উপস্থিতমুহূর্তেই সেটা ভাবা যাবে। এখন রাতটাকে মোকাবেলা করা যাক।

আমার ঘুম যখন ভাঙল, ধড়মড় করে উঠে দেখি চারদিক অলৌকিক সোনারঙা আলোয় ভরে গেছে। বনের ভোর এমন? এমন আশ্চর্য থ্রিলিং! চারদিক ছেপে গেল পাখির কিচিরমিচিরে। বউকথাকও, কোকিল, সাতভাই, কুটুম, সিপাহি বুলবুলরা হবে হয়তো। গতকাল ওই তাড়া-খাওয়া দৌড়ানির মধ্যেও অন্তু আমাদের শিখিয়েছিল কোনটা কোন পাখির ডাক।

অন্তু কখন যে উঠেছে, টের পাইনি। সালমান আর আহাম্মদ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে দেখে নিজের ওপর আমার রাগ হলো। কেন যে ওদের জাগনা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে। এই যখন ভাবছি, অন্তুর বিড়বিড় শব্দে ওর দিকে ফিরে তাকালাম। প্রথমে বুঝলাম না, দ্বিতীয়বার যখন বলল, লাফিয়ে উঠলাম আমি—‘কী! আগে বলবি না? বাইনোকুলার তো আমিও দেখেছি। একটা লতাঝাড়ে ওটা ঝুলছিল!’ আমার চিল্লাফাল্লায় আহাম্মদ আর সালমানের ঘুম ভেঙে যেতেই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের দুজনের দিকে তাকাল ওরা। আমার ওই কথা শেষ না হতেই অন্তু তড়িঘড়ি করে বলল, ‘আরে বাইনোকুলারের কথা বলছি না তো।’ ‘তো কীসের কথা বলছিস?’ ‘আরে বলছি লতাঝাড়ের কথা। যেখানটায় বাইনোকুলার আটকে ছিল, ওটাই তো মনে হয়…।’ আমাদের আর তর সইল না। সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম—‘ওটা কী?’ অন্তু এবার পুরো কাহিনিটা খুলে বলল। ও যখন তেলশুরের ওদিকটায় বাইনোকুলার তাক করে বেনেবউ দেখছিল তখন তার মনে হলো, আচ্ছা পাখিটা কি বাচ্চা-পাখি, না মেয়ে-পাখি? মাথার দিকটার ফিকে কালো রংটা তো বলছে মেয়ে-পাখি। এই মনে করে আরেকটু জুম করতেই পাখিটা একটু নড়েচড়ে লতার অন্য ডালে গিয়ে বসল। বাইনোকুলার ওদিকে ঘোরাতে যাবে, অমন সময় ওর মনে হলো, আরে কী দেখলাম ওটা! চেনা-চেনা লাগে। এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ও খাদের দিকটায় পাড়া দিয়ে ফেলেছে, তা আর বুঝে উঠতে পারেনি। ব্যস! পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পড় তো পড়, একেবারে ঝোপঝাড় ছিত্তেছার করে, উলটেপালটে, ডিগবাজি খেতে খেতে একদম পাহাড়ের নিচে গিয়ে সোজা আছাড়! পাখি দেখতে গিয়ে ও কী দেখতে পেল, সেটা যখন বলল তখন আমাদের কারোরই আর তর সইল না। অন্তুকে আহাম্মদের কাছে রেখে আমি আর সালমান একছুটে সেখানে পৌঁছে দেখি বাইনোকুলার তখনো ঝুলছে। অন্তুর মতো এবার আর অসতর্ক থাকলাম না আমরা। পা টিপে টিপে, গাছের ডাল ধরে, পাথরের চাঁই আঁকড়ে ধরে দুজন জায়গামতো পৌঁছাতেই আমাদের দুজনের আর কথা সরে না। এ যে আমাদের সেই লতা, যার জন্য আমাদের এত পাগলামি, এত আয়োজন, এত কষ্ট করা! এ জয়ের আনন্দ ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না। পরম শান্তির আনন্দ তা। আমাদের একান্ত অনুভূতির তা।

অন্তুর কী হবে, সে-কথা মনে এলো না বিজয়ের মুহূর্তে। মনে পড়ল, ‘গোবাইজ্জা’ শব্দের মানে আসলে কী? ঢাকায় ফিরে ডিকশনারি-বিশেষজ্ঞ সৌরভ মামার কাছে যেতে হবে বিষয়টার ফায়সালার জন্য।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৬, কুমিল্লায়। পড়াশোনা ঢাকায়। নয়াটোলা মগবাজারের পাঠাগার থেকে বইপড়ার অভ্যাস রপ্ত। এলাকার যুব সংগঠনের দেয়ালপত্রিকার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যজগতে আসা। সাহিত্যসমালোচক ও অনুবাদক। পাঠচক্র পরিচালনা করেন। উদ্ভিদ বিষয়ক লেখালেখি ও গাছগাছালির ছবি তোলা তাঁর প্রাণের বিষয়। ‘আমেরিকার রূপকথা’ তাঁর অনূদিত বই।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।