শনিবার, নভেম্বর ২৩

কবন্ধযাত্রা : অমিত রেজা চৌধুরী

0

Utsob-Songkha_Motifপ্রান্তর জুড়ে পড়ে আছে উঁচু উঁচু সব হাড়, ঘাটতি বাজেট পর্যন্ত দীঘল সব হাড়! যেন আকাশ থেকে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে এসব কঙ্কাল, অসংখ্য ডকু-ফিকশনের মতো। তাদের নিচ দিয়ে হিমালয়কন্যা করতোয়া বয়ে যায়, খানিকটা বিশাইনদী বয়ে যায়, বেহাত বিপ্লব বয়ে যায়, হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় দুই নবপরিণীতা। একসময় নতুন বিয়ে হলে মানুষ নাকি আত্মগোপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, আর এখন? শনিবার শনিবার ব্রাহ্মীশাক খেলেই যে বিস্মরণের থাবা থেকে আপনি বাঁচবেন, তা তো নয়, বরং আমরা দৃশ্যের আধেক ফুটিয়ে তুলতে থাকি অন্য কোথাও! অসমাপ্ত ঢেউয়ের মতো, দেরিদা পুনঃপাঠের মতো, বিশাল সব হাড় জোড়া দিয়ে দিয়ে পৌনঃপুনিকতার মতো অন্তত ব্যক্তিগত ধারণার ভেতর ছোটো ভাইয়ের তীব্র অভিমান পর্যন্ত ছুঁতে চাওয়া একটা ফুলের কঙ্কাল গড়ে তোলা যায় কি না। যেন হাড়ের সাথে হাড়ের দূতিয়ালি একটা কসমিক ছক, মৃত্তিকার নিচে দরিয়ার নিচে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাচীনতম নগরীর ছক, বহু বিয়োগগাথা এঁকে এগিয়ে ফের নিজের গমনরেখা ধরে না ফিরতে পারা গোখুরের ছক হলো এইসব হাড়ের ব্যাজস্তুতি। তুমি নিজেই বাথান নাকি বাথানে চির আটকে পড়া সংকীর্তন দল, ভাবতে থাকো।

একটা গোপন শিয়া মসজিদ থেকে আরেকটা গোপন কাদিয়ানী মসজিদের দূরত্ব যতটা, নদীতে তলিয়ে যাওয়া একটা গোরস্তান থেকে সরকারিভাবে জায়গা বেদখল হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়া আরেকটা গোরস্তানের মাগরিব ওয়াক্তের দূরত্ব তার চেয়ে অনেক গভীর।

আততায়ী বৃষ্টির রজনিতে তুমি ছাতাহাতে পর্কের কাবাবের বন্ধ দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছ, একজন সাধারণ নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের নিরপত্তাবিধান কতটা বিমূর্ততামুক্ত হওয়া দরকার?

প্রতিটি মুহূর্তে কেন তাকে ভুতুড়ে, সেমেটিক সব অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে মৃত্যুভয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাঘ্র-খাঁচায়-বন্দি ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হবে?

কিংবা বাঁশঝাড়ের মাথায় যে শিশু এখনো জন্মই নেয়নি, কিংবা বর্শা ও হারানো জোয়ান ছাওয়ালের ছবি সিথানে রেখে ঘুমাতে যাওয়া যে বয়োঃবৃদ্ধা শহিদ হয়েছেন বহু বছর আগেই, তাদেরও বৃহৎ ঘনায়মান কাঁচির সব উৎকণ্ঠার আলোচুরির ত্রাসের ভিতরে থাকতে হলো আজ।

একটা নক্ষত্র থেকে আরেকটা নক্ষত্রের গুরুত্ব যতটা ডার্কমেটারের সম্ভাবনায় নির্ধারিত, একজন নীতিনির্ধারকের থেকে আরেকজন নীতিনির্ধারকের দূরত্ব তারও বেশি পুঁজিনিয়ন্ত্রিত।

খয়েরি বৃষ্টির রাত এগারোটায় তুমি আব্বার বর্ষাতিটা গায়ে চাপিয়ে চুদির ভাই ওয়ালেদ উকিলের সাইনবোর্ডের নিচে একটু আড়াল তৈরি করে সিদ্ধির সিগারেট ধরাতে গিয়ে ভাবছ, পুলিশ একজন মানুষের বন্ধু হয় কী করে? ইয়েলো সাংবাদিক আপনার আপনজন হয় কী করে? খানকির পোলারা তো রিয়ালিজমকে অ্যাবসার্ড না করে তোলা পর্যন্ত রেইপ থামায় না! তারা আপনার বন্ধু?

একজন মানুষের স্বজন কাথহলীবাসী হয় কী করে?

মানুষ ঘরে নীল জানালা বানায় কেন?

জানালার বাইরে আর কী কী প্রতীক ও তামাশা তোমায় এ দুঃসময়ে আন্দোলিত করে?

কুকুরের বিয়ানো বাচ্চামহোদয়দের মতো এত মানুষের বেঁচে থাকার দরকারটাই বা কী?

তুমি তো তার সালতামামিই রাখলে না, প্রিয় উদ্‌বেগ, উদ্‌বেগজনক প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বেঁচে থাকা আজ কী বিভীষিকাময়! আঠারো শতকের বহু-বিবাহপ্রথার ন্যায়, বোবা ইন্টারপ্রেটারের প্রতিহিংসার ন্যায় মরাও তাহলে হরেক রকম? এবং সবটা দূর-নিয়ন্ত্রিতও নয়?

মকারির ছলে নব্য বুদ্ধিজীবিতার মাঝ দিয়ে যিনি ছোবল মুছে চলেছেন ইতিহাসের, তার বেঁচে থাকাটা কি বিধবার সুনির্দিষ্ট স্বমেহনের মতো? কিংবা ক্যাবারে ড্যান্সারের বাতিল অন্তর্বাস সংগ্রহ করা যার আয়ু, বেঁচে থাকাটা তার কাছেই বা কেমন? বাঁচা তাহলে অনেক রকম? ঘুমানো মানুষের কাছেও বাঁচা অনেক কিসিমের? মৃত মানুষের কাছেও? অর্থবাচকতা-কাতর কিছু আবিল চিহ্ন-বুদ্বুদের ন্যায় কত কত উদগ্র, চিমসে আর কাল্পনিক বাঁচা হলো আমাদের! তুমি তো তার সালতামামিই রাখলে না, প্রিয় উদ্‌বেগ, উদ্‌বেগজনক প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বেঁচে থাকা আজ কী বিভীষিকাময়! আঠারো শতকের বহু-বিবাহপ্রথার ন্যায়, বোবা ইন্টারপ্রেটারের প্রতিহিংসার ন্যায় মরাও তাহলে হরেক রকম? এবং সবটা দূর-নিয়ন্ত্রিতও নয়? তাহলে কেন মরে মানুষ? মরা আদপে কী? পুনশ্চ, মৃত্যুটাই বা কার ঘটে? মরার ধারণাও সেক্ষেত্রে সত্যের মতো নাজুক? যেমন তোমার অনুপস্থিতিজুড়ে আমির খৌসরুকে সামা গাইতে গাইতে তীব্র প্রেমে, সৌরবিষে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছি, ভরা মজলিশ থেকে! আজকের ডার্টি পলিটিক্সের বাইরে সেই যুগে, তুকতাক ছাড়া রাজদ্রোহী সাব্যস্ত হওয়া ছাড়া কীভাবে সম্ভব ছিল সেসব স্থানান্তর, ব্যক্তির আচমকা গুম হয়ে যাওয়া? এবং, এবং কিছু প্রশ্নচিহ্নকে আমরা ঐতিহাসিক আভিজাত্যের ন্যারেটিভে পুষ্পচিহ্নিত হয়ে উঠতে দেখতেই ভালোবাসি, চিরটাকাল। এ-ও নিদারুণ ভয়ংকর এক সামষ্টিক জাজমেন্ট।

অথচ ফুলের ছলনার অনেক দূরে
মন মরে গেলে,
আন্ডাররেটেড ব্যান্ডের গান ঘুরেফিরে শুনি,
একটা ব্যাহত জাতিধারার অবদমিত হৃদয় বোঝার জন্য।

মন মরে গেলে,
ইনসুলিনের মাত্রা বদলাতে গিয়ে আব্বা ভুল করে
থমথমে কুয়ায় গ্রেট জহির রায়হানকে
মুক্তিযুদ্ধের বেহাত তথ্যসহ ফিরে আসতে দেখেছিলেন।

মন মরে গেলে,
একটা পলিটিক্যাল সাবোট্যাজের কাছাকাছি পৌঁছে
লুসিড ড্রিমের মাধ্যমে বুঝতে চাইলাম,
নিয়ন্ত্রণের বাইরে আদৌ কি কিছু আছে?

মন মরে গেলে,
টেগার্টের ডায়েরি তুলনামূলক ইতিহাস হিসাবে সমাদৃত হয়,
এ তল্লাটে চীনা বামঘেঁষা তাত্ত্বিকের
মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার পালটা ন্যারেটিভের পাশাপাশি।

এই আতঙ্কের চণ্ড দুনিয়া, মজ্জাপায়ী এই বাঞ্চোতদের দুনিয়া আমার আর ভাল্লাগে না, আব্বা। ক্রমশ বায়ুমীমাংসার মতো, আমার অশ্রুজন্মে কবে আবার ফিরে পাব তোমায়, বলো আব্বা? আম্মা আর আমার সব সোনালুকথা, পুরোনো অঙ্গার আর আদালত চত্বর সব মুছে যাচ্ছে, মুছে যাওয়া ঠেকাতে পারছি না, আলো কেন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, আব্বা? এই বঙ্গদেশে এই সাক্ষাৎ হাবিয়ায় কে আর আমাদের বাউলগানের আলেয়ায় জারি রাখবে, বলো আব্বা?

মন মরে গেলে আর কী-ই বা থাকে, বলো আব্বা? আমি তো তোমার প্রভাতসঞ্চয়কে রি-কলোনাইজেশনের নখর থেকে বাঁচাতে পারছি না! এই আতঙ্কের চণ্ড দুনিয়া, মজ্জাপায়ী এই বাঞ্চোতদের দুনিয়া আমার আর ভাল্লাগে না, আব্বা। ক্রমশ বায়ুমীমাংসার মতো, আমার অশ্রুজন্মে কবে আবার ফিরে পাব তোমায়, বলো আব্বা? আম্মা আর আমার সব সোনালুকথা, পুরোনো অঙ্গার আর আদালত চত্বর সব মুছে যাচ্ছে, মুছে যাওয়া ঠেকাতে পারছি না, আলো কেন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, আব্বা? এই বঙ্গদেশে এই সাক্ষাৎ হাবিয়ায় কে আর আমাদের বাউলগানের আলেয়ায় জারি রাখবে, বলো আব্বা?

এদিকে
ক’বছর চামড়ার ব্যবসায় কৃত্রিম ধস নেমেছে,

ক’বছর হাইব্রিড শস্যের উৎপাদন বাড়লেও মানুষের রোগবালাইয়ে খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে,

ক’বছর ক্রিকেটে আমরা অনেক উন্নতি করেছি,

ক’বছর চাইল্ড অ্যাবিউজমেন্ট-বিরোধী এনজিও মুভমেন্টের চেয়ে সমকামিতায় পাবলিকের বুলিং বেড়েছে,

ক’বছর নিকট বিদেশ নিয়ে আমরা আরও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছি,

ক’বছর বিদেশি সংস্থা ও আরপির বিক্রয় জটিলতা নিয়ে আলাপ আমরা বিলিয়ার্ড বোর্ডের জুয়ায় বেশি করে তুলছি

পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সংসারে, দেশে
যন্ত্রের পাশাপাশি অসম্পর্করা কি স্পর্শকাতর হয়ে উঠবে এবার?

একটা মানুষের গভীর বেদনায় সহসা জেগে ওঠা দানিকেনের সত্য প্রতিষ্ঠা করবার জন্য বাজারের সব শেয়ার বেচে দেওয়া,

কেউ না হোক, সূচালো এক্যুরিয়ামের মাঝে একটা জলজ বনসাঁই হয়ে তুমি তার সালোক-সংশ্লেষণগুলি টুকে রেখো।

শ্যালো লিভিং ছাড়া আজকাল বেঁচেবর্তে থাকা লাগাতার রক্তআমাশয়ের মতো গণঅভ্যুত্থানে বেকায়দা হয়ে উঠেছে, অল্পবয়সী ফুপু শাশুড়িকে জর্জেটের দামি ফিনফিনে শাড়ি গিফট করলে বুইড়া ফুপাশ্বশুর আমার বউরে ডাইকা নিয়া দু-ফোটা চোক্ষের পানি ফেললেন, না পারতে শরিয়ত শুনাইয়া ঠারে ঠারে আমারে সাবধানও করলেন, যাবেন কই? সিরিয়াস আপনি হতেই পারবেন না, এতটাই স্বাধীনতা, এমনকি ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ টিউলিপফুলের বাগিচা পেরিয়ে ফুলকপির আড়তের মতোই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। তবু আমাদের সতত উৎকণ্ঠা, নিজের আয়নাজন্মে ট্রমাটাইজড আত্মগোপন, সুদের হারভীতি কমছে না, পাহাড় গায়েব কমছে না, ট্যালেন্টহান্ট কমছে না, খনিজ ও বন্দরডাকাতি কমছে না, জিডিপি পাচার কমছে না, কোচিং সেন্টারের আশ্বিনে কল সেন্টারের পাথর কমছে না, জনপ্রিয় ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে বাধা কমছে না, রিহ্যাব সেন্টারের সংখ্যা কমছে না। যেহেতু আমরা ভালো আছি, সেহেতু আমরা শ্যালো লিভিং করি। যেহেতু আমরা সাত দশ এক একাত্তরের সারেঙ্গী, সেহেতু আমাদের অসংখ্য দেওয়াল, দেওয়ালধসে মৃত্যু। যেহেতু আমাদের মেঘলা আসমানে সচরাচর বর্ষাকাল ডিম পাড়ে, সেহেতু বৈদেশিক ঋণের বোঝা ইস্পাতের খুলি বানিয়ে সহনশীলতা বাড়াও, এবং স্থির বিশ্বাস রাখো যে গোলাপি গুড়িয়ারা, নক্ষত্রের ভস্ম বা আমাদের অনুচ্চ স্বর ঠিক প্রাণ ফিরে পাবে। নেভার মাইন্ড, বসন্তকাল আসবেই, বসন্ত এসে গেছে নিশিপাওয়া মাঠে, চিরসখা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা কবিতায় অমিত রেজা চৌধুরীর উত্থান নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে, বগুড়ায় বসবাস করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা— বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিচরণ অবাধ। একসময় দেশের প্রথিতযশা লিটলম্যাগাজিনগুলোয় লিখেছেন নিয়মিত। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথেও ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এখনও সেই বিশ্বাস লালন করেন। কী এক অজ্ঞাত কারণে গদ্যরচনার জগৎ থেকে এখন অনেকটাই দূরে অবস্থান করেন। কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।