শনিবার, ফেব্রুয়ারি ২২

জমির দলিল বিক্রি করা হবে : কবীর রানা

0

দূর। দূর সে গোলাপ শুকিয়ে যাওয়ার মতো। দূর সে নদী শুকিয়ে যাওয়ার মতো। একটা গোলাপ শুকিয়ে যাওয়ার পর, একটা নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর যত দূরে তারা যায় ঠিক ততটা দূর কিংবা তারও অধিক দূর। গোলাপের গন্ধ আহরণের পর, নদীর পানি পান করার পর, দূরের পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছে সে। আহারের পর যদি হাত ধোয়া থাকে তবে সে হাত ধোয়। তার হাত ধোয়া পানি থেকে নেমে আসে নদী। এ নদী বয়ে গেছে আমাদের শহরের পাশ দিয়ে। এখন সকাল একটা বড়ো রাত দীর্ঘ রাত হত্যা হয়ে সকাল হয়ে যায়। এই সকালে শহরের তরুণেরা নদীর পাশে এসে অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের জন্য সূর্যোদয় দেখার জন্য। সূর্য কি কি বয়ে আনে। আনে অসংখ্য কিছু, তবে সবকিছু বলা না গেলে বলা যাক কিছু কিছু। কেউই কোনো কিছুর সবটুকু বলে না সবটুকু দেখে না। এই যে জীবন, আমাদের, যে মৃত্যুকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য, সেও সবটুকু ভাসাতে চায় না। পিছনে রেখে যেতে চায় বেশিরভাগ, রেখে যাওয়া হোক আর না হোক। রেখে যাওয়া জিনিসকে অমরতা বললে আপত্তি কারো নাই। যেহেতু সবাই অমরতা চায় সূর্যোদয় দেখতে দেখতে, ভালোবাসা চায়, প্রেম চায়, গোলাপ থেকে কাটা সরাতে চায় সূর্যোদয় দেখতে দেখতে, অমরতা ভাবতে ভাবতে।

এ শহরের নাম আছে। নাম সে নিজেই গ্রহণ করেছে কাউকে দেওয়া লাগেনি। এ শহরে সাতটা পথ এক জায়গায় মিলিতে হওয়ার কারণে তার নামকরণ হয়েছে সাতমাথা শহর। এ শহরের বাসিন্দারা পথ নোংরা করতে ভালোবাসে। তারা পথ নোংরা করার জন্য নানারকম নোংরা করার পদ্ধতি শিখেছে খুব শৈশব থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, বিদ্যালয় থেকে, বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিক্ষক থেকে। এ শহরের পথগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে কারো ইচ্ছে হবে এ শহরের নাম বদলে দেওয়ার। হয়তো সে সাতমাথাকে বলতে চাইবে সাত ময়লার শহর কিংবা শত ময়লার শহর।

এ শহরের ঝাড়ুদারদের বাস করার জন্য একটা বিশেষ অঞ্চল আছে। যার নাম এ শহরের লোকজন দিয়েছে মেথরপট্টি। মেথরপট্টির মেথরদের নিজস্ব কোনো জমি নাই। তাদের নামে কোনো জমি নাই। এ শহরে এই নিয়ম খুব চালু আছে যে, যাদের নামে কোনো জমি নাই তারা এ নগরীর বাসিন্দা নয়। তারা যুগের পর যুগ এ শহরে বাস করলেও এ শহরের বাসিন্দা বলে স্বীকৃত হবে না।

এই কথা এখন স্থগিত থাক। সূর্যোদয়ের আগে এ শহরের পথগুলোকে পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ুদার নিয়োগ করা আছে। তাদের যেকোনো নামে ডাকা যেতে পারে। তবে শুধু একজনের নাম এখানে বলি। যার নাম বলবো তার নাম মানিক। সে এই শহরের অনেক ঝাড়ুদারদের একজন। এ শহরের ঝাড়ুদারদের বাস করার জন্য একটা বিশেষ অঞ্চল আছে। যার নাম এ শহরের লোকজন দিয়েছে মেথরপট্টি। মেথরপট্টির মেথরদের নিজস্ব কোনো জমি নাই। তাদের নামে কোনো জমি নাই। এ শহরে এই নিয়ম খুব চালু আছে যে, যাদের নামে কোনো জমি নাই তারা এ নগরীর বাসিন্দা নয়। তারা যুগের পর যুগ এ শহরে বাস করলেও এ শহরের বাসিন্দা বলে স্বীকৃত হবে না।

মেথরপট্টির সামনে একটা বড়ো খাল ছিল। যে খালে মেথরেরা গোসল করত এবং তাদের কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করত। এ শহরের রাজনীতি এবং অর্থনীতি খুব শক্তিশালী হয়ে উঠলে এ খালটা ভরাট হয়ে যায়। মেথরদের এই সমস্যা খুব হয় যে, তারা গোসল করার জন্য এবং কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার জন্য তাদের যেতে হয় দূরের কোনো ময়লা পানির খালে, যে খাল শহর থেকে দূরে।

মেথরেরা দাবি করে, ছোটো দাবি। তারা একদিন কিংবা কয়েকদিন তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দলবদ্ধভাবে মিছিল করে দাবী জানায় তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক তাদের নামে জমি না থাকা সত্ত্বেও। তারা বলে তারা কখনও এ শহরের জমির মালিক হবে না কিন্তু তাদের দেওয়া হোক নাগরিকত্ব সনদ। তারা বলে নাগরিকত্ব সনদ পেলে তাদের হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণ হবে। তারা বলে নাগরিকত্ব সনদ তাদের নিকটে স্বাধীনতার সনদ। তাদের ভূমি নাই, না থাক, তবুও তারা নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক বলে মনে করবে। তারা বলে ময়লার ইতিহাস এবং তাদের ইতিহাস সমান বয়সী। সভ্যতার চাইতে ময়লা প্রাচীন; বলা ভালো ময়লা প্রাচীনতম সভ্যতা। মানুষের ভেতরে ময়লা সভ্যতার চাইতে আর কোনো বড়ো সভ্যতা নাই। যে সকল মেথরেরা আবর্জনা হয়ে গেছে বয়সের কারণে, তারা বলে যুগে যুগে ময়লা সভ্যতা টিকে থাকে। তাদের কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে বলে, ময়লা সভ্যতা দিয়েই পৃথিবীর সত্যিকারের সভ্যতা গড়ে উঠেছে।

জমিগুলো শৃঙ্খলিত হওয়ার সময়ে বলি, এ শহর দালালদের জন্য বিখ্যাত। নানরূপ জমির দালাল আছে এ শহরে। জমির দালাল, ইতিহাসের দালাল, অর্থনীতির দালাল, রাজনীতির দালাল, ধর্মনীতির দালাল, শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের দালাল, আরও আরও নানা দর্শনের দালাল। এ শহরের মেয়র এসব দালালদের নিয়ে একটা কমিটি করে দেয় মেথরদের নাগরিকত্ব দেওয়া কিংবা না দেওয়া প্রসঙ্গে। এ সকল দালালদের নানা রকম আইনের বই আছে। তারা সেসব বই পাঠ করে এই সিদ্ধান্তে যায় যে, এই মেথরেরা জমি পাবে না, তবে জমির দলিল কিনতে পারবে। তারা বলে জমি না পেলেও জমির দলিল কিনতে পারলে তাদের এ শহরের নাগরিকত্ব সনদপত্র দেওয়া যেতে পারে। তারা এটা সাতমাথা শহরের মেয়রের কাছে পেশ করে। মেয়র খুব আনন্দিত হয় যে এ শহরে অনেক গুণী দালাল আছে যারা যেকোনো সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা রাখে। মেয়রের এ সময় মনে হয় মেথরদের সঙ্গে তার একবার দেখা করে তাদের সামনে এই নতুন নিয়মটা ব্যাখ্যা করে বলা উচিত। সকল মেথরকে নোটিশ দিয়ে এক জায়গায় জমায়েত করা হয়। এ সকল দালালদের সঙ্গে নিয়ে মেয়র সাহেব মেথরদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলে। সে বলে, এ শহর একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। যে সিদ্ধান্তের ফলে মেথরেরা এ শহরের নাগরিক হবে এবং তারা স্বাধীনতা পাবে। যদিও কীভাবে নাগরিক হবে এবং কীভাবে স্বাধীন হবে এ বিষয়টা বেশ দুর্বোধ্য। দুর্বোধ্য জিনিস সব সময় মানুষের ভালো লাগে। যেমন ভালো লাগে রহস্যময় কোনো কিছুকে। মেথরদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মেয়র সাহেব একটা বাস্তব উদাহরণ দেন। তিনি জানান এ শহরের সবচাইতে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি গত পনেরো বছর ধরে নিজের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পড়ে থাকা ময়লা কাগজ সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করছেন। তার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে লেখা থাকবে। তেমনি লেখা থাকবে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কথা, যে হাজার বছরের মেথরদের অপ্রাপ্তি আজকের দিনে পাওয়া গেল। মেথরেরা জমির দলিল কিনতে পারবে যদিও জমি তারা পাবে না, তারা স্বাধীনতা পাবে যদিও তারা জানে না কিসের স্বাধীনতা। মেথরেরা মেয়রকে ফুলের মালা পরাতে চায়। কিন্তু এ সময় মাইকে ঘোষণা করা হয় যে, মেয়রের মেয়ের বিদেশ যাত্রা দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই মেয়র সাহেব ফুলের মালা আজকে গ্রহণ করতে পারবে না। তবে কোনো একদিন অবশ্যই ফুলের মালা গ্রহণ করবে। ঘোষক আরও জানায় ইতিহাসে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটার পরে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে, ফুলের মালা গ্রহণ না করেই মঞ্চ ত্যাগ করতে হয়েছে বিদেশ যাত্রার জন্য।

মানিক মেথরপট্টির সবচেয়ে বয়স্ক রাস্তা ঝাড়ুদার। খুব শৈশব থেকে সে শিখেছে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া। তার বাবা তাকে শিখিয়েছে কিভাবে সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে নির্দিষ্ট রাস্তায় গিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হয়, ঝাড়ু দিতে হয়। তার পরিবারে এখন রয়েছে তার স্ত্রী এবং তার মেয়ে প্রতিমা। আজ রাতে খেতে খেতে সে, তার স্ত্রী এবং তার কন্যা প্রতিমা এই সিদ্ধান্তে যায় যে তাদের কাছে যে টাকা জমা আছে তা দিয়ে তারা একটা জমির দলিল কিনবে এ শহরের নাগরিক হওয়ার জন্য। তারা ঠিক জানে না এক দলিলে তিন জনের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে কি না। যদিও তারা জানে তারা জমির মালিক হবে না। কারণ এ দলিলের বিপরীতে কোনো জমি নাই।

কয়েকদিনের ভেতর এ শহরে বেশ কয়েকটা জমির দলিল বিক্রি করার দোকান হয়ে যায়। এ শহরে এত জমির দালাল ছিল আগে তেমন টের পাওয়া যায়নি। কারো মনে হতে পারে এ শহর জমির দালালের শহর, জমির দালালীর শহর। তারা নানা রকম বিজ্ঞাপন দিয়ে জমি ছাড়া দলিল বিক্রির প্রচারণা চালায়। তারা নিজেদের দালাল বলে না। তারা লেখে আবাসন ও স্বাধীনতা কোম্পানি। যারা দালাল নয় তারা কেউ কেউ এ সকল কোম্পানিকে বলে, বইয়ের বিদ্যা ধার করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

মানিক মেথর, তার স্ত্রী এবং তার কন্যা প্রতিমা সবাই মিলে সিদ্ধান্তে যায় জমির দলিল কেনার জন্য তার স্ত্রী এবং তার কন্যা প্রতিমা রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ নেবে। পৌরসভা জানায় এক পরিবারের তিনজন রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ পাবে না। সর্বোচ্চ দুজন পেতে পারে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ। তবে একজন শহরের বাড়িগুলো থেকে ময়লা সংগ্রহের কাজ নিতে পারে। তখন তার নাম ঝাড়ুদার থাকবে না হবে ময়লাওয়ালা এবং সুশীল সমাজের ভাষায় হবে পরিচ্ছন্নকর্মী। মানিক মেথর হয়ে যায় মানিক ময়লাওয়ালা কিংবা মানিক পরিচ্ছন্নকর্মী। তিনজন কাজ করা শুরু করলে মানিকের পরিবারের আয় বেড়ে যায়। তারা প্রতি মাসে কিছু টাকা জমায় জমি ছাড়া জমির দলিল কেনার জন্য।

প্রতিমা এ শহরের যে এলাকার রাস্তা ঝাড়ু দেয় সে এলাকার নাম সবুজবাগ। প্রতিমা তার বাবার নিকট থেকে শিখেছে কিভাবে রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। সে দেখে শহরের মানুষজন কত ভাবে রাস্তা ময়লা করার নোংরা করার পদ্ধতি জানে। শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী সবাই নিজ নিজ পরিবার থেকে শিখেছে রাস্তা ময়লা করার কৌশল। প্রতিমা আসলে রাস্তার ময়লা করার বিষয়টাকে কৌশল বলে জ্ঞান করে। রাতের বেলা বাবার সঙ্গে সে শহরের ময়লা বিষয়ক কথা বলে। তার বাবা এবং সে বোঝে কথা বলতে বলতে, এ শহরে বাড়িগুলো আসলে ময়লা উৎপাদনের কারখানার মতো। তার বাবা মাঝে মাঝে শিক্ষিত লোকের মতো কথা বললে, প্রশ্ন জানা লোকের মতো কথা বললে এই কথা আলোচনা হয় যে, ময়লা শত রকমের হয়। ঐতিহাসিক ময়লা, রাজনৈতিক ময়লা, নৈতিক ময়লা, অর্থনৈতিক ময়লা, ধর্মীয় ময়লা প্রভৃতি।

প্রতিমার শারীরিক সৌন্দর্য কিংবা ঝাড়ু দেওয়ার সৌন্দর্য কার প্রথম নজরে আসে জানা যায় না। তবে এই কথা বলা যায় যে, প্রতিমার ঝাড়ু দেওয়া দেখতে কিংবা প্রতিমাকে দেখতে সবুজবাগের রাস্তাগুলোতে অনেক তরুণ ভিড় করে। এ সকল তরুণেরা আগে সারারাত জেগে সকাল শেষ হলে ঘুম থেকে জাগতো। কিন্তু প্রতিমার ঝাড়ু দেওয়ার সৌন্দর্য দেখার জন্য তারা এখন সূর্যোদয়ের পূর্বে বিছানা ছাড়ে, বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসে। তারা তাদের মায়েদের জানায় সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে ওঠা ভীষণ স্বাস্থ্যকর একটা বিষয়। দীর্ঘজীবী হওয়ার জন্য জীবনযাপনের যে কটা পদ্ধতি আছে তার মধ্যে একটি সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে জেগে ওঠা। তারা ঘুম থেকে জেগে হাঁটে সবুজবাগের পথগুলোতে, যেখানে প্রতিমা রাস্তা ঝাড়ু দেয়। তারা বোঝে না কিভাবে একজন ঝাড়ুদার তরুণী এত সৌন্দর্য তার শরীরে ধারণ করতে পারে। তাদের এ সময় মনে হয় ময়লার ভেতরে সৌন্দর্য মাঝে মাঝে জন্ম নেয়। তারা তাদের বাড়িতে তাদের মায়েদের বলে মনে হয়, তাদের বাড়ি থেকে ময়লার সঙ্গে অনেক সৌন্দর্য ফেলে দেওয়া হয়। এখন থেকে তাদের মায়েরা যেন ময়লা পরীক্ষা করে ময়লাওয়ালাকে দেয়। নতুবা ময়লাওয়ালার ঘরে কিভাবে জন্ম হয় প্রতিমার। তাদের ঘরের সৌন্দর্য ময়লার সঙ্গে ফেলে দেওয়ার কারণে ময়লাওয়ালার ঘরে জন্ম হয়েছে প্রতিমার।

এ শহরের মানুষদের ভান থাকে। ভানের ভিতরে হয়তো কিছুটা জ্ঞানও থাকে। তাই তারা তাদের শহরের পাশে যে নদী বয়ে চলেছে তার পাশে হাঁটার জন্য চমৎকার রাস্তা তৈরি করে পিচ দিয়ে। শহরের সবাই এখন স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে ওঠে। কেউ কেউ সবুজবাগে প্রতিমার রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া দেখতে যায়। আর অনেকে নদীর পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটে সূর্যোদয় দেখার জন্য এবং শরীর ঠিক রাখার জন্য। দীর্ঘ জীবন কে বা না চায়—ভাবে তারা।

শহরের নদীকে বাঁচাতে হবে নর্দমা হতে দেওয়া যাবে না। তারা রাস্তায় রাস্তায় নানা রকম পোস্টার লাগায়। তারা নানা রকম শ্লোগান লেখে সে সকল পোস্টারে। নদী বাঁচাও, শহর বাঁচাও। শহরের প্রাণ ঠিক কোথায় যদিও তারা তা জানে না। তারা আসলে এই শ্লোগান শিখেছে বিদেশি একটা পত্রিকা থেকে।

শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের সকল প্রবাহ যুক্ত ছিল এই নদীর সঙ্গে। এর ফলে নদীকেও মনে হতো ময়লার নদী। কিংবা বড়ো নর্দমা। শহরের পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করে এই দাবিতে যে, শহরের নদীকে বাঁচাতে হবে নর্দমা হতে দেওয়া যাবে না। তারা রাস্তায় রাস্তায় নানা রকম পোস্টার লাগায়। তারা নানা রকম শ্লোগান লেখে সে সকল পোস্টারে। নদী বাঁচাও, শহর বাঁচাও। শহরের প্রাণ ঠিক কোথায় যদিও তারা তা জানে না। তারা আসলে এই শ্লোগান শিখেছে বিদেশি একটা পত্রিকা থেকে। এ শহরের বেশিরভাগ জ্ঞান আমদানি নির্ভর। তারা সবকিছুই আমদানি করে জ্ঞান বিষয়ক। অনেকে তো বলে এ শহরের মানুষদের মাথার ভেতরে রয়েছে পৃথিবীর বড়ো বড়ো মেথর পট্টি। মাথার ময়লা দূর করার জন্য যদিও তারা কোনো ঝাড়ুদার রাখেনি কিংবা কোনো ময়লাওয়ালা রাখেনি। এ শহরের শিক্ষকেরা যদিও শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদেরকে বলে তাদের মাথায় ময়লা ভর্তি, গোবর ভর্তি।

সামনে নির্বাচন। শহরের মেয়র নদীর ময়লা পরিষ্কার করার জন্য একটি ‘ময়লা নদী পরিষ্কার কমিটি’ গঠন করে। সাতমাথা শহরের যে বিশ্ববিদ্যালয়, তার নন্দনতত্ত্বের অধ্যাপক সৈয়দ জাফর এ কমিটির প্রধান হন। এছাড়া নদী বিষয়ে গবেষণা করে যারা বিখ্যাত হয়েছেন তারাও থাকেন এ কমিটিতে। তারা গবেষণা করে দেখে যে, পরিবেশ নষ্ট করা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং জন্মগত প্রবণতা। পৃথিবীর সকল নদী কোনো না কোনোভাবে দূষিত হয়ে গেছে বা দূষিত হয়ে আছে মানুষের দ্বারা। তারা বুঝতে পারে না এ শহরের দশ লক্ষ লোকের মলমূত্র এবং অন্যান্য পারিবারিক আবর্জনা কোথায় ফেলা যেতে পারে কিংবা কোথায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তারা মেয়রকে জানায় নির্বাচনের আগে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার বিষয়। তারা বলে এখন থেকে এদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আর সেটি হলো পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগ। কেউ কেউ বলে এ কমিটির, এরকম বিষয় অনেক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তবে এসব বিষয় শুধু কেবল কয়েকটি পরিভাষা আবিষ্কার করতে পেরেছে। এর বেশি কিছু করতে পারেনি। তবে তাদের জীবিকার উপায় হয়েছে এসব বিষয়ে কথাবার্তা বলে এবং লেখালেখি করে।

প্রতিমার ঝাড়ু দেওয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শহরের সর্বত্র। বেশিরভাগ তরুণ তাকে দেখার জন্য সূর্যোদয়ের আগে অপ্রয়োজনে কিংবা প্রয়োজনে হাঁটাহাঁটি করে সবুজবাগের রাস্তাগুলোয়। বাড়ির ও বাড়ির মানুষদের মানসিক সৌন্দর্য ও শান্তি বৃদ্ধির জন্য এরকম নন্দনতত্ত্ব এ শহরে চালু আছে যে বাড়িতে ফুলের বাগান তৈরি করা। কারও কারও প্রতিমাকে দেখে ফুল দিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু একজন মেথরের মেয়েকে ফুল দেওয়ার রীতি এ শহরে না থাকলে তা তারা করতে পারে না। তখন তারা সিদ্ধান্তে যায় রাস্তার দুপাশে যে নর্দমাগুলো আছে, তার পাশ দিয়ে ফুল গাছ লাগিয়ে দিবে।তারা গোলাপ ফুল ছাড়া আর তেমন কোনো ফুল চেনে না। তারা শহরের বাইরে সবুজ নার্সারিতে যায় গোলাপ ফুলের গাছ কেনার জন্য। কোনো শ্রমিক না নিয়ে নিজেরাই তারা গোলাপ ফুলগুলোকে নর্দমার পাশে রোপন করে। এবং অপেক্ষা করে কবে এ সকল গোলাপ গাছ থেকে গোলাপ ফুল প্রস্ফুটিত হবে, রং ও গন্ধ বিলোবে। তারা এ সকল গাছের ভীষণ যত্ন নেয়। এ সকল গাছের যত্ন তারা তাদের পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বেশি নেয়। তারা ভাবে গোলাপফুল ফোটানো পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরতম কাজ। উদ্ভিদবিদ্যা বইয়ে তারা গোলাপফুল নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছিল। ব্যবহারিক পরীক্ষায় তারা জবাফুল ব্যবচ্ছেদ করেছিল। তারা এখন অনুভব করে ফুল আসলেই ব্যবচ্ছেদের বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাভাবে ফুলকে ব্যবচ্ছেদ করে আসছে । তারা সূর্যোদয়ের পর সবুজবাগের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এখন মূলত ফুল বিষয়ক আলোচনা করে। তাদের একজন বলে তাদের একজন আত্মীয় গদখালীতে ফুলের চাষ করে বিদেশে ফুল রপ্তানি করার জন্য। সে আরও জানায় গদখালী এদেশের অর্ধেকেরও বেশি ফুল সারাদেশে সরবরাহ করে। তাদের সে সময় মনে হয় ফুল ব্যবহৃত হয় মূলত রাজনৈতিক কারণে। ফুলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ভালবাসার রাজনীতিকে, অর্থনীতির রাজনীতিকে, দেশের রাজনীতিকে, ক্ষমতার রাজনীতিকে, ধর্মের রাজনীতিকে, ব্যবসায়ের রাজনীতিকে, দোকানদারের রাজনীতিকে।

একদিন খুব বৃষ্টি হয়। দু’দিন খুব বৃষ্টি হয়। দু’দিনই ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল। এ শহরের তরুণেরা এ দুদিন সূর্যোদয়ের পর সবুজবাগের রাস্তাগুলোতে আসতে পারেনি প্রতিমার ঝাড়ু দেওয়া দেখতে। আজ এসেছে, সূর্যোদয়ের পর। কী বিস্ময়! এত ফুল কোথা থেকে এলো। নর্দমার দুদিকে শুধু গোলাপা আর গোলাপ। এ শহর গত কয়েক শত বছরে যত গোলাপ ফোটাতে পারেনি কিংবা দেখেনি গত দুদিনে তার চাইতে বেশি গোলাপ ফুটেছে সবুজবাগের নর্দমার দুপাশে। প্রতিমা রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে। প্রতিমা কি গোলাপ পছন্দ করে? তাকে প্রশ্ন করবে কে? কেউ না। তারা লক্ষ্য করে কিছু কিছু গোলাপ রাস্তার উপরে এসে পড়েছে। প্রতিমা বুঝতে পারে না রাস্তার উপরে চলে আসা গোলাপগুলো ঝাড়ু দিয়ে ফেলে দিবে কিনা। তরুণগুলো প্রতিমাকে বলে সে যেন রাস্তার উপরে চলে আসা গোলাপের ডাল ও গোলাপগুলো ঝাড়ু দিয়ে ফেলে না দেয়। তারা প্রতিমাকে বলে গোলাপ তো আর ময়লা নয়। গোলাপ সুঘ্রাণ ছড়ায়। শহরের সবুজবাগ এবং তার আশেপাশের লোকজন টের পায় তাদের বাতাসে গোলাপের গন্ধ। একজন কবি, যে দুই লাইন চার লাইনের কবিতা লেখে, যে পারস্যের কয়েকজন কবি দ্বারা অনুপ্রাণিত, সে বলে পত্রিকায় লিখে, পারস্যের গোলাপ এখন চাষ হচ্ছে সাতমাথা শহরের বিভিন্ন রাস্তার নর্দমার পাশে। একজন ভাষাবিজ্ঞানী পত্রিকায় লিখে জানায় পন্কে সবচেয়ে ভালো গোলাপ জন্মায়। তাইতো নর্দমার পাশে এত সব সুন্দর গোলাপ ফুটেছে। এতদিন অনেক ধর্মতত্ত্ববিদ তরুণদের কোনো গুণ খুঁজে পায়নি। একজন ধর্মতত্ত্ববিদ পত্রিকায় লিখে জানায় এ শহরের তরুনেরা বদলে গেছে। তাদের রুচি বদল হয়ে গেছে। তারা ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। দেশীয় ঐতিহ্য এবং বিশ্ব ঐতিহ্যে তাদের এখন সংযুক্তি আছে। গোলাপ ফোটানোর চাইতে আর কি বা ভালো কাজ হতে পারে।

মানিক, তার স্ত্রী এবং তার মেয়ে প্রতিমা বসে আছে মোমবাতির চারপাশে। মেথরপট্টিতে বৈদ্যুতিক লাইন নাই। গ্যাসের লাইন নাই। তারা হারিকেনের আলোয় রাত পার করে, অন্ধকার দূর করে। তারা আলোচনা করছে কত টাকা তারা এ যাবত জমিয়েছে দলিল কেনার জন্য। মানিক গণনা করে টাকা। প্রতিমাও গণনা করে টাকা। তারা দেখে এই টাকায় দলিল কেনা যাবে কিনা। তারা জানে দলিল কিনলেও তারা কখনও জমি পাবে না। তবে দলিল কিনলে তারা এ শহরের নাগরিক হতে পারবে। এ শহরে স্বাধীনতা তারা নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে। তারা সিদ্ধান্তে যায় আগামীকাল তারা কয়েকজন দলিল বিক্রি করা দালালের কাছে যাবে। তারা যে টাকাটা জমিয়েছে সেটা দিয়ে একটা দলিল কেনা যাবে কিনা সেটা বুঝতে চাচ্ছে।

পরদিন তারা তিনজন দলিল বিক্রি করা দালালদের দোকানে যায়। তারা জিজ্ঞেস করে এক দলিলে তিনজনের নাম দিয়ে দলিল কেনা যাবে কিনা। দালাল জানায় এক দলিলে তিন জনের নাম দিয়ে দলিল কেনা যাবে তবে তার মূল্য একজনের নাম থাকা দলিলের চাইতে বেশি। দালাল তাদের তিনজনের নাম থাকা দলিলের দাম বলে। তারা তিনজন হিসাব করে দেখে যে টাকা তারা জমিয়েছে তা দিয়ে একটা দলিল কেনা যাবে। যে দলিলে তিনজনের নাম থাকবে। দালালকে নাম ও ঠিকানা দিয়ে বলে আসে আগামীকাল তারা দলিল কিনবে পুরো টাকা দিয়ে।

জমির দলিল কেনার পরে মানিক ও তার পরিবার খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে যায়। তাদের পরিবারে এর চাইতে আনন্দের দিন কখনও আসেনি আগে মনে হয় তাদের নিকটে। মানিক তার স্ত্রীকে এবং প্রতিমাকে বলে আজ তারা তাদের জীবনের সেরা দিন বলে মনে করছে। এই দিনটাকে তারা উপভোগ করতে চায় ভালো খাবার খেয়ে এবং শহরের বাইরে গিয়ে। তারা শহরের বাইরে যায় হেঁটে হেঁটে। আজ বাতাস খুব সুন্দর। আজ আকাশ খুব সুন্দর। আজ দলিল খুব সুন্দর। আজ চারপাশের গন্ধ খুব সুন্দর। তারা ভাবে তারা এতদিন ধরে ঝাড়ু দিয়েছেন বাতাস, ঝাড়ু দিয়েছে আকাশ। হাঁটতে হাঁটতে তারা শহরের বাইরে চলে এসেছে। একটা দিঘির পাড়ে তারা এসে বসেছে। এই দিঘির নাম সংসার দিঘি। তারা জানে এ দিঘির সুনাম সারা দেশজুড়ে। প্রতিটা পরিবার জানে এ দিঘির নাম। অনেক পরিবার তাদের পরিবারের সবচেয়ে সুন্দর দিনটা কাটাতে আসে এই দিঘিতে। কে খনন করেছিল এ দিঘি। কে দিয়েছিল এ দিঘির নাম সংসার দিঘি। একবার মানিককে কেউ বলেছিল এ দিঘির ইতিহাস। যদিও এর নাম দিঘি কিন্তু এতে কোনো জল থাকে না। তবে এর সৌন্দর্য এর চারপাশের তালগাছের সারি। আসলে বেশিরভাগ লোক এখানে আসে তালগাছের সারি দেখতে। জীবনের ভীষণ আনন্দময় মুহূর্তগুলো অনেকে এখানে এসে কিছুক্ষণের জন্য থাকতে চায়। তাই পানি না থাকা সত্ত্বেও লোকে এটাকে দিঘি বলে মেনে নেয়। যেভাবে সংসারে কোনো জল না থাকা সত্ত্বেও তাকে সংসার বলে মেনে নেয়।

জমি বিষয়ক গবেষণা হঠাৎ করেই বেশি বেশি শুরু হয় এ শহরে, যখন জমি ছাড়া দলিল বিক্রি চলতে থাকে। একদিন সাতমাথা শহরের পত্রিকায় ছাপা হয় এই খবর যে, এ শহরের দলিলের সঙ্গে জমির কোনো সম্পর্ক নাই। সবারই দলিল আছে কিন্তু কোন দলিলের কোন জমি কেউ বুঝতে পারছে না। সম্ভবত জমির দলিলের সঙ্গে জমির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এই খবরটা সবার ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করে।আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা ভেবে পায় না এটা কী করে সম্ভব যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্ব পুরুষেরা নানারূপ সম্পর্ক ও জমির আইন তৈরি করেছে দলিলের সাহায্যে। জমি কীভাবে দলিলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। কী করে জমি নিজেকে দলিল থেকে আলাদা করে ফেলে। তারা ভাবে যদি এরকম হয় তবে একটা সময় এদেশের লোকজনের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকবে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকবে না। কিংবা কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো কিছু সম্পর্ক থাকবে না। টাকার সঙ্গে দ্রব্যের সম্পর্ক থাকবে না। স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহের সম্পর্ক থাকবে না। পিতা মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক থাকবে না। আইন ব্যবস্থা ভেতরে ভেতরে কবে ঝরে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সমাধিস্থ হয়ে গেছে, হায়! সাতমাথার মেয়র তাদের এ বিষয়টা, এ চিন্তাটা সরকারকে জানায়। দেশের রাষ্ট্রপতিকে জানায়। রাষ্ট্রপতি এবং তার মন্ত্রীরা এ বিষয়টা জানার পর ভীষণ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে না কীভাবে এটা ঘটে গেছে ভেতরে ভেতরে। যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক না থাকে, যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক না থাকে, তবে কীভাবে তারা থাকবে রাষ্ট্রপতি হয়ে, মন্ত্রী হয়ে।

রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে যায় যে, তারা একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি তৈরি করবে আইনবিদদের দ্বারা যারা এই বিষয়টা সমাধান করবে। সবকিছু আগের মতো যেন সম্পর্কযুক্ত থাকে সে বিষয়ে তাদের কাজ করতে হবে।

আইনবিদদের দ্বারা গঠিত তদন্ত দল প্রথমে যায় সাতমাথা শহরে। তারা নানা জনের সঙ্গে কথা বলে, নানা স্থানে যায় বিষয়টার সত্যতা জানার জন্য। কথা বলে বুঝতে পারে বিষয়টা পুরোপুরি সত্য। এখানকার জমির সঙ্গে জমির দলিলের সম্পর্ক নাই, এখানকার পরিবারের সঙ্গে পরিবারের মানুষের সম্পর্ক নাই, এখানকার সমাজের সঙ্গে সমাজের মানুষের সম্পর্ক নাই, এখানকার বিবাহের সঙ্গে দম্পতিদের সম্পর্ক নাই, এখানকার স্বামীদের সঙ্গে স্ত্রীদের সম্পর্ক নাই, এখানকার সন্তানদের সঙ্গে পিতা মাতার সম্পর্ক নাই। এবং তারা আরও বুঝতে পারে সত্যিই রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নাই, সরকারের সঙ্গে কিংবা রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক নাই। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক নাই। আইনের সঙ্গে বিচারের সম্পর্ক নাই। তারা চিন্তা হারিয়ে ফেলে। নিজেদের কাছে নিজেদের তাদের নির্বোধ বলে প্রতিপন্ন হয়। কীভাবে এই অবস্থায় পৌঁছালো বিষয়টা তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের পাঠের ভেতরে, জ্ঞানের ভেতর, বিদ্যার ভেতর এমন কোনো শক্তি নাই যার সাহায্যে তারা সেটা বুঝতে পারে। তাদের মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে তারা তাদের জ্ঞান এবং বুদ্ধিকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেনি। জং ধরা শব্দটা এ সময় তাদের মনে হয়। তাদের মনে হয় পুরো সিস্টেমটা পরিবর্তন না করলে এরকমই থেকে যাবে সবকিছু।

গাছ কাটা দেখতে; বলা ভালো গোলাপ গাছ কাটা দেখতে এ শহরের অনেক লোক ভিড় করে। কিন্তু কী বিস্ময় এখানে যে, গোলাপ গাছগুলো কাটার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বড়ো হয়ে উঠছে গোলাপ গাছ। তারা এবার কোদাল দিয়ে গোলাপ গাছগুলো উপড়ে ফেলতে চায়। তারা গোলাপ গাছগুলোকে উল্টে ফেলে। কিন্তু আবারও বিস্ময় এই যে, সেখান থেকে আবারো গোলাপ গাছের জন্ম হচ্ছে, জন্ম হচ্ছে গোলাপের ফুল।

তারা রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার আগে ভাবে দুটো জায়গায় তারা পুনরায় পরিদর্শনে যাবে। তারা প্রথমে যায় সংসার দিঘিতে। সংসার দিঘিতে গিয়ে তারা পুনরায় বিস্মিত হয়। নাম দিঘি তবে সেখানে কোনো জল নেই। চারপাশে তাল গাছ দিয়ে ঘেরা এ দিঘি। সন্দেহ নাই দিঘির সৌন্দর্য অপরিসীম। তারা বিবেচনা করে জলের সঙ্গে দিঘির তবে সম্পর্ক নাই। এরপর তারা যায় সাতমাথা শহরের সবুজবাগ মহল্লায়। এ মহল্লার পথগুলো তারা পরিদর্শন করে। পথের দু’পাশের নর্দমার ধারে ফুটে আছে অসংখ্য গোলাপ। তাদের কাছে মনে হয় এরূপ সুন্দর গোলাপ তারা কখনও দেখেনি। তবে তারা খেয়াল করে গোলাপ গাছগুলো রাস্তাগুলোকে ক্রমে ক্রমে ঢেকে দিচ্ছে। যদি রাস্তাগুলো এভাবে গোলাপ দ্বারা আবৃত হয়ে যায় তবে এখানকার লোকজন কীভাবে এ পথ দিয়ে চলাচল করবে। কারণ গোলাপের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা এদেশের মানুষের এত বেশি যে তারা কখনও গোলাপফুলের উপর দিয়ে হাঁটবে না। তবে তারা কীভাবে যাবে নিজেদের গন্তব্যে। তারা তাৎক্ষণিক একটা সিদ্ধান্তে যায় যে এ শহরের প্রশাসন এবং পুলিশকে জানাবে তারা যেন খুব দ্রুত গোলাপ গাছগুলোকে কেটে ফেলে পুরাতন পথ ঠিক রাখার জন্য, পুরাতন হাঁটা ঠিক রাখার জন্য, পুরাতন নিয়ম ঠিক রাখার জন্য।

প্রশাসনে পুলিশ চলে আসে সবুজবাগ মহল্লার ওই পথগুলোতে। তারা গাছ কাটার সেই সমস্ত শ্রমিকদের নিয়ে আসে যারা দীর্ঘদিন ধরে নানরূপ গাছ কেটে আসছে। গাছ কাটা দেখতে; বলা ভালো গোলাপ গাছ কাটা দেখতে এ শহরের অনেক লোক ভিড় করে। কিন্তু কী বিস্ময় এখানে যে, গোলাপ গাছগুলো কাটার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বড়ো হয়ে উঠছে গোলাপ গাছ। তারা এবার কোদাল দিয়ে গোলাপ গাছগুলো উপড়ে ফেলতে চায়। তারা গোলাপ গাছগুলোকে উল্টে ফেলে। কিন্তু আবারও বিস্ময় এই যে, সেখান থেকে আবারো গোলাপ গাছের জন্ম হচ্ছে, জন্ম হচ্ছে গোলাপের ফুল। অনেকবার চেষ্টা করেও যখন তারা গোলাপ গাছ উৎপাটন করতে পারে না তখন তারা হতাশ হয়। তারা কাজ থামিয়ে দেয়। যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তারা ভাবে পুরো বিষয়টা নিয়ে। সেখানে এ সময় হাজির হয় প্রতিমা, যে এই রাস্তাগুলো ঝাড়ু দেয়। তাকে দেখে সবাই চুপ করে যায়। প্রতিমা সবার চিন্তার ভেতরে প্রবেশ করে। সবাই ভাবে তারা সবাই যেন মেথরপট্টিতে বাস করছে। মেথরপট্টির মেথরদের জমির দলিলের সঙ্গে যেমন জমির সম্পর্ক নাই তেমনি তাদের জমির সঙ্গেও তাদের দলিলের কোনো সম্পর্ক নাই। আরও কত কত যে তাদের সম্পর্কহীনতা তার কিছু কিছু স্মরণ করে এখন তারা। তাদের সম্পর্ক নাই পরিবারের সঙ্গে, সম্পর্ক নাই সমাজের সঙ্গে, সম্পর্ক নাই রাষ্ট্রের সঙ্গে, সম্পর্ক নাই কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো কিছুর।

বৃষ্টি আসছে সংসার দিঘির আকাশ থেকে। জলের সঙ্গে যে দিঘির সম্পর্ক নাই সেদিক থেকে একটা মেঘ বৃষ্টি নিয়ে আসছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ।  উপন্যাস : কেউ মরছে না

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।