কে?
মাসুদের আসল নাম মাসুদ আমেদ। এই আসল নামেরও একটা আসল আছে। তা হলো মাসুদ আহমেদ। ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনের সময় আহমেদ কিভাবে জানি আমেদ হয়ে যায়। রেজিস্ট্রেশন কার্ড হাতে পেলে নামের ভুল দেখে সে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর যায় কেরানি স্যারের কাছে। সব শুনে কেরানি স্যার বলে, হাত পাত। মাসুদ হাত পাতে আর হাতের উপর সপাং সপাং সপাং তিনবার বেত পড়ে। রক্ত জমে লালাভ হাতের তালু আর টলমল চোখ নিয়ে সে ক্লাসে চলে যায়। তিন-চার দিন পর বাবা অলি আহমেদকে গিয়ে আহমেদ আর আমেদ সংশ্লিষ্ট জটিলতা খুলে বললে প্রচণ্ড বকাঝকায় তার কান বন্ধ হয়ে আসে। যেখানে বংশের সকল পুরুষলোকের নামের শেষে আহমেদ, সেখানে মাসুদের নামের পরে আমেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না অলি আহমেদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে তার আফসোস যায় না। বকাঝকার দিনে মাসুদের স্কুলে যেতে দেরি হয় আর পিটি স্যার তাকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখে। রোদের কাছেই সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড যেখানে কেরানি স্যারের ঝকঝকে ফিনিক্স সাইকেল রাখা। সেদিন কেরানি স্যার আর সাইকেল চালিয়ে যেতে পারে না, দুহাতে ঠেলে নিতে হয়। সাইকেল ঠেলার দৃশ্য মাসুদকে খুব আনন্দ দেয়। এমনিতেই সে এসব স্যার-ম্যারদের পছন্দ করে না। তার উপর এই আনন্দ তার বুকের ভেতর আরও বেশি ঘৃণার চাষাবাদ করে। কিন্তু, বলতে কি, অনেক সময় এমন হয় যে মানুষ যা ঘৃণা করে বা বাকি জীবন যা ঘৃণা করে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তাই তার জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। মাসুদ এই জীবনের দানে শিক্ষকতাকেই টাকা রোজগারের উপায় হিসেবে পায়। এরপর সেই ঘৃণার কি হয় তা একমাত্র সেই বলতে পারবে। মাসুদ যেদিন প্রথম কাজে যোগ দিতে যায় তার অনেক বড়ো বড়ো দাঁড়ি থাকে, মাথায় থাকে টুপি। টুপির গল্প অবশ্য ভিন্ন। সেদিন চুল ঠিক করতে গিয়ে দেখে তালুর উপর কতগুলো চুল দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রথমে পানি দিয়ে চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। এরপর তেল দেয়। কিছুতেই চুল শুয়ে পড়ে না, দাঁড়িয়েই থাকে। টুপি মাথায় দিয়ে বসে থাকে। এর ফলাফল হয় উল্টো। আরও কিছু চুল দাঁড়িয়ে যায়। ছোটোবেলা থেকেই মাসুদের বিশ্বাস মানুষের চুল দাঁড়িয়ে থাকা মানে তার বাথরুম পেয়েছে। মাসুদ চায় না প্রথম দিনেই তার ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করুক তাদের স্যারের বাথরুম পেয়েছে। অগত্যা সে টুপি পরেই স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু তার মনে হয় শার্ট প্যান্টের সাথে টুপি ভালো লাগছে না, সে পাঞ্জাবি পাজামা পরে নেয়। পথে যেতে যেতে বুঝতেই পারে না সেদিন থেকে তার সব পরিচয় ঢেকে গিয়ে যে পরিচয়ে সবাই তাকে চিনবে তা হলো ১নং কড়ইতলা সপ্রাবির হুজুর স্যার। যে স্কুলে কি না একদিন সে বইখাতা সব ফেলে রেখে চলে এসেছিল, আর যাওয়া হয়নি।
ছোটোবেলা থেকেই মাসুদের বিশ্বাস মানুষের চুল দাঁড়িয়ে থাকা মানে তার বাথরুম পেয়েছে। মাসুদ চায় না প্রথম দিনেই তার ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করুক তাদের স্যারের বাথরুম পেয়েছে। অগত্যা সে টুপি পরেই স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কেন?
খুব সামান্য আর অগুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনার পর মাসুদের জীবনে প্রথমবারের মতো ভালো হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় আসে। ততদিনে সে ১নং কড়ইতলা সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক হয়ে গিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত এক সরকারি নির্দেশনা থেকে যাতে বলা হয়েছে, প্রধান শিক্ষকদের ফেসবুক আইডি থাকতে হবে এবং তাদের যাবতীয় কার্যক্রম ওইখানে পোস্ট করতে হবে। মাসুদ আর তার স্কুলের এক নতুন টিচার শ্যামা ম্যাডাম মিলে দুই দিন পরে শহরে গিয়ে অল্প দামের একটা টাচ ফোন কিনে নিয়ে আসে। শ্যামা ম্যাডামই তাকে সবকিছু শিখিয়ে দেয় আর ফেসবুকে আইডি খুলে দেয়। এরপর থেকে সময় পেলেই সে ফেসবুকে ঢোকে। কয়েকদিনের ভেতর ফেসবুকের সব রহস্যের অনেকটাই সে বুঝে যায়। সে দেখতে পায় এখানে তার পরিচিত আরও অনেক লোকজন আছে। অনেকের বন্ধু হয়, তাদের কার্যকলাপ দেখে। অনেকের সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলে। বিভিন্ন হাসির ভিডিও দেখে। নবী, রাসূল, ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও, ছবি এসবে লাইক দেয়। আবার লুকিয়ে লুকিয়ে ছোটো ছোটো জামা কাপড় পরা মেয়েদের ভিডিও, ছবি এসবও দেখে। তার কাছে ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগে না তার প্রোফাইল ছবি। আইডি খোলার দিন কি ছবি দেবে ভেবে না পেয়ে স্কুলের ছবি দিয়েছিল। পরে দেখা গেলো স্কুলের নামও পড়া যাচ্ছে না ঠিক করে। তাছাড়া ফেসবুকে তো সবাই নিজের ছবি দেয়। একদিন মাসুদ নতুন পাঞ্জাবি পরে আর তার বউ বাচ্চাদের নতুন জামা কাপড় পরতে বলে। বাড়ির পাশে নদীর পাড়ে যায় তারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে ছবি তুলে দেয়ার মতো লোক পায় না। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় তার বউ ছবি তুলে দেবে। ছবি কিভাবে তুলতে হয় শিখিয়ে দেয় সে। ছোটো মেয়েটাকে কোলে নিয়ে দূরে কিছু দেখানোর মতো পোজ দেয় মাসুদ। পাশে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকগুলো ছবি তোলা হয়। বাড়ি ফিরে দেখা যায়, কোনো ছবিতে মাসুদ চোখ বন্ধ করে আছে আবার কোনোটাতে তার ছেলের মুখের অর্ধেক দেখা যাচ্ছে না। একটা ছবি খুঁজে পায় যেখানে সব ঠিক থাকলেও সে যেদিকে দেখাচ্ছে মেয়ে বা ছেলে কেউই সেদিকে তাকাচ্ছে না। তারা তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। সেই ছবিটাই প্রোফাইল ছবি দেয়। তার ফ্রেন্ডলিস্টের মানুষেরা এই ছবি দেখে খুব খুশি হয়েছে বলেই মনে হয়। অনেকেই লাইক, লাভ এসব দেয়। দুই একজন ফুলের ছবি দিয়ে কমেন্ট করে। আবার কেউ সুন্দর, ভেরি নাইচ, নাইস এসব লেখে। এর মধ্যে একটা কমেন্টে মাসুদের চোখ আটকে যায়। জুলকারনাইন জাকারিয়া লিখেছে, ‘মাসুদ, ভালো হয়ে যাও। হা হা হা।’ কিছুই বুঝতে পারে না সে। তাকে এই ভালো হয়ে যেতে কেন বলছে। সে খারাপইবা কি করল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটাকে দেখে সে। খারাপ কিছু খুঁজে পায় না। যে কমেন্ট করেছে মানে জুলকারনাইন, বিএসসি ক্লাসে পড়ার সময় সে তাদের কলেজের জিএস ছিল, পরে হয়েছিল তার বন্ধু। এ ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে। কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা। সেই সময় তো সে খারাপ কিছু করেছে বলে তার মনে হয় না। বরং জুলকারনাইনই তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিল। বিষয়টা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু কিছুতেই যায় না। একবার মনে হয় সে গত দিন দু-একটা মাঝারি টাইপ অশ্লীল ভিডিও দেখেছে। তাও ইচ্ছে করে দেখেনি। তার সামনে চলে এসেছিল বিধায় সে দেখেছে। কিন্তু তা অন্য কেউ জানার কথা না। এমনকি হয় যে সে কি করছে, কি দেখছে সবই অন্যরা দেখতে পায়।
একবার মনে হয় সে গত দিন দু-একটা মাঝারি টাইপ অশ্লীল ভিডিও দেখেছে। তাও ইচ্ছে করে দেখেনি। তার সামনে চলে এসেছিল বিধায় সে দেখেছে। কিন্তু তা অন্য কেউ জানার কথা না। এমনকি হয় যে সে কি করছে, কি দেখছে সবই অন্যরা দেখতে পায়।
সে ক্লাস থ্রির সামনে গিয়ে ক্লাস নিতে থাকা শ্যামা ম্যাডামকে ডাকে। জানতে চায় বিষয়টা। ম্যাডাম জানায় যে এরকম সম্ভব না। তবে কমেন্ট করলে তা অন্যরা দেখে থাকতে পারে। মাসুদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কারণ সে কখনোই কোনো কমেন্ট করে না। বড়োজোর লাইক দেয়। তাও আল্লাহ, রাসূল আর ইসলাম সংক্রান্ত না হলে দেয় না। এরপরেও তার মন খুঁতখুঁত করে। কি খারাপ করল আর কেন তাকে ভালো হতে বলা হচ্ছে এসব তার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। সেদিন স্কুল থেকে সোজা বাড়ি চলে যায়। ছেলে মেয়ে দুটাকে পড়াতে বসে মেজাজ গরম হয় তার। খেতে গিয়েও মন দিয়ে খেতে পারে না। রাতে ঘুমানোর আগে ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢোকে। দেখতে পায় জুলকারনাইনের কমেন্টে অনেকেই হাসির চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। আবার একজন কমেন্ট করেছে, ‘হ্যাঁ মাসুদ, ভালো হয়ে যাও। হাহাহা।’ পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই ভালো হওয়ার বিষয়টা নিয়ে বিস্তর ভাবে। এরপর সারাদিনে অনেকবার মনে পড়লেও ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব কমে যায়। অনেকদিন পর এই বিষয় তার কাছে আবারও গুরুত্ব পায় শুক্রবারে মাছ বাজারে গিয়ে। নিয়মিত যার কাছ থেকে মাছ কেনে সে আবার তার ছোটোবেলার বন্ধু। সেদিন বড়ো একটা রুই মাছ কেনে। টাকা দেয়ার পর মাছঅলা বন্ধু তাকে পাঁচশো টাকার নোট বদলে দিতে বলে। টাকা হাতে নিয়ে সে দেখে মাঝখানে টেপ দিয়ে জোড়া দেয়া। বদলে দেয়ার মতো টাকা তার কাছে ছিল না। সে বিব্রত হয়ে বলে যে তার কাছে টাকা নেই আর। মাছঅলা টাকা নিয়ে বলে, আচ্ছা যা। এরপর একটু থেমে চোখে কেমন একটা হাসি নিয়ে বলে, ‘মাসুদরে, তুই ভালো হয়ে যা’। আশপাশের যারা শোনে সবাই হেসে ওঠে। সেদিন স্কুলে টিফিনের ফাঁকে মাসুদ শ্যামা ম্যাডামকে ডাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যে তাকে মানুষজন ভালো হয়ে যেতে বলে কিন্তু সে বুঝতে পারে না কি কারণে। ম্যাডাম হাসতে থাকে আর মোবাইল বের করে একটা ভিডিও দেখায়। ছোটো একটা ভিডিও যেখানে একজন মন্ত্রী একজনকে বলছে, ‘মাসুদ, ভালো হয়ে যাও’। সে ভিডিওর ভেতরের মাসুদকে ভালো করে দেখে। তারই মতো অবস্থা। বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে অসহায় যেন নিজের সাথে এক রকম যুদ্ধাবস্থায় আছে। ম্যাডাম মাসুদ আমেদকে বোঝায় যে এই ভিডিও ভাইরাল আর এজন্যই মানুষ মজা করে তাকে ভালো হয়ে যেতে বলছে। সে অনেক কষ্ট করে হাসে। এটা কেমন ব্যাপার ভাবতে পারে না। একজন মানুষকে ভালো হয়ে যেতে বলার মাঝে কি মজা খুঁজে পায় মানুষ তা বোঝার চেষ্টা করে। তার মনে হয় যে এটা কোনো মজা না। মানুষ আসলেই তাকে ভালো হয়ে যেতে বলছে। কিন্তু খুঁজে পায় না যে সে কোন দিক থেকে ভালো হবে। অফিস রুমে যখন কেউ নেই তখন ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবে। বিশেষত্বহীন জীবন। এই জীবনকে তার শুধু কয়েকটা অঙ্ক আর সংখ্যা মনে হয়। এর আবার কি ভালো খারাপ থাকতে পারে! আরও ভালো করে ভাবে। এতগুলো সংখ্যার ভেতর কিছু আলাদা মনে হয়। সেগুলো হাজিরা খাতার পেছনে লেখে।
৫
স্কুলের বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাসুদ ক্লাস ওয়ানের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওয়ান টু এর ছুটি হয়ে গিয়েছে। ফাঁকা ক্লাসরুমে ডানদিকে সামনের বেঞ্চের কোনায় গিয়ে বসে। ওয়ানে থাকতে ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল সে। এই জায়গায়ই প্রতিদিন বসতো। তার মনে পড়ে, সেদিনও এখানেই বসেছিল। পাশের বেঞ্চের কোনায় বসেছিল পরীরানি। মেয়েদের ক্যাপ্টেন। সেদিন ক্লাসে ঢুকেই পরীরানি তাকে একটা চকলেট দিয়েছিল। তার বাবা নাকি বিদেশ থেকে এনেছে। লাল চকলেট। এমন স্বাদের চকলেট যেন সে জীবনে প্রথমবার খেলো। পরীরানি তার দিকে ফিরে বলে, দেখি তোর জিভ। সে জিভ দেখালে পরীরানি হেসে কুটিকুটি হয় আর সবাইকে বলে বেড়ায়, দ্যাখ দ্যাখ মাসুদের জিভ লাল। মাসুদ নিজে তার জিভ দেখে না বিধায় বুঝতে পারে না তার জিভ কতটুকু লাল। পরীরানিকে আবার জিভ দেখায়। আবার হেসে কুটিকুটি হয়। এরপর আবার যখন জিভ বের করে তা ভেতরে নেয়ার আগেই তার গালে একচড় এসে পড়ে। মাসুদ একদিকে হেলে যায় আর কানের ভেতর ভোঁ করে ওঠে। কখন যে ক্লাস টিচার রায়বাবু এসে ক্লাসে ঢুকেছেন সে বুঝতেই পারেনি। সোজা হতে না হতে আরেক চড় এসে পড়ে আর শুনতে পায়, ‘মেয়েদের জিভ দেখানো হচ্ছে? এই বয়েসেই লুইচ্চামি? বেয়াদ্দপ। কত বড়ো সাহস তোর!’ সমস্ত ক্লাস চুপ হয়ে যায়। দুচোখ ফেটে পানি আসে মাসুদের। লজ্জায় মাথা নিচু করে বেঞ্চের পায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভেতরে একজন লুইচ্চা আর একজন বেয়াদব সংশ্লেষ হতে হতে অনবরত তাপ নিঃসরণ করে। এই তাপ ভেতরে বাইরে এক দোজখের সৃষ্টি করলে ভেতরে বসে বসে মাসুদ পুড়তে থাকে। টিফিনের সময় এলে সবাই ক্লাস থেকে বের হলেও সে বের হয় না। উঠে যাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছা নেই, শক্তি নেই। সারা শরীর ভেঙে তার ঘুম আসে। এরই মধ্যে তার প্রচণ্ড পেশাব পায়। সন্তর্পণে স্কুলের পেছনে গিয়ে সে পেশাব করে আসে। টিফিন শেষে একে একে সবাই যখন আসে তখন কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এখানে মুত, এখানে মুত, মাসুদ মুতে দিছে, ওই, মাসুদ প্যান্টের মইদ্যে মুতে দিছে।’ মুহূর্তে হইহই পড়ে যায়। স্যার এসে এত হইচই দেখে ফার্স্ট বেঞ্চের সবাইকে একচোট পিটিয়ে নেয়। মাসুদও বাদ যায় না। ঘটনা দেখে তাকে ছুটি দিয়ে দিলে বাড়ি গিয়ে সোজা পুকুরে নেমে পড়ে। স্কুলের ড্রেস না খুলেই কেন পুকুরে নেমেছে এর উত্তর কাউকে দিতে পারে না। দুইদিন পর মাসুদ স্কুলে গেলে ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘এই লুইচ্চা মাসুদ আসছে, লুইচ্চা মাসুদ আসছে’। আবার বলতে থাকে, ‘মুতরা। মুতরা। মুতরা।’ এই দুই মিলে একসময় শ্লোগানে রূপ নেয়। তখন সবাই মিলে বলতে থাকে, ‘লুইচ্চা মাসুদ মুতরারে, মুতরা মাসুদ লুইচ্চারে’। পরীরানিকেও দেখা যায় সবার সাথে সুর মিলিয়ে এই বলছে। আর নিতে পারে না সে। কান্না শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় সব বইখাতা ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। ওই ক্লাসরুমে, ওই স্কুলে তার আর কখনোই যাওয়া হয় না। এছাড়াও আরেকটা ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে অনেক অনেক দিন তাকে কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখা যায় না।
১৭
সেদিন স্কুলের কিছু স্টেশনারি কেনার জন্য মাসুদকে শহরে যেতে হয়। সবগুলো লাইব্রেরি আর স্টেশনারি দোকান কলেজ রোডে। ইন্টার পাশ করার পর শহরে এসে এই রোডের পাশেই একটা মেসে উঠেছিল। উদ্দেশ্য ছিল মেডিকেল ভর্তির কোচিং করা। কোচিং করেছিলও কিন্তু মেডিকেলে টেকেনি। কোথাও টেকেনি। শেষে ভর্তি হয়েছিল গভঃ কলেজে বিএসসি ক্লাসে। কলেজে মাঝে মাঝে ক্লাস হয়। বাকি সময় অলস বসে থাকে সবাই। সেখানে মাসুদও বসে থাকে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে একদিন পরিচয় হয় জুলকারনাইন জাকারিয়ার সাথে। উপজেলা চেয়ারম্যানের বোনের ছেলে। বয়সে বছর তিনেক বড়ো হলেও পড়ত তাদের সাথেই। পরপর দুইবার ফেল করে বিএসসি প্রথম বর্ষ পার হতে না পারলেও কলেজের জিএস হতে পারে। একদিন এমপি গ্রুপ আর চেয়ারম্যান গ্রুপের মারামারির মাঝখানে পড়ে মাসুদ যখন বুঝতে পারে না কোনদিকে যাবে তখন লম্বা চুল আর মেরুন শার্ট পরা এক ছেলেকে মার খেয়ে ড্রেনে পড়ে থাকতে দেখে টেনেটুনে তুলে মসজিদের ভেতর নিয়ে যায়। তারপর কলেজের পেছনের দেয়াল টপকে সদর হাসপাতালে। কয়েকদিন পরে রাত দশটার দিকে জুলকারনাইনকে মাসুদের মেসে বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে গুপ্তদার ছোটোগল্পের বই পড়তে আর মাসুদকে রান্নাঘরে ডিম ভাজতে দেখা যায়। মাসুদ একসময় আবিষ্কার করে পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও জুলকারনাইনের বাস্তবিক জ্ঞান ভালো। আর জুলকারনাইন আবিষ্কার করে মাসুদের বাস্তবিক জ্ঞান কম হলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। সে আরও আবিষ্কার করে যে নারীদেহ সম্পর্কে মাসুদের কোনো ধারণাই নেই। মাসুদকে এই ধারণা দেয়াকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করে আর সেই দায়িত্ববোধ থেকে একদিন তাকে ওল্ড টাউনের নাজমা হোটেলে নিয়ে যায়। হোটেলের ২০৩ নং রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, যা ব্যাটা ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, ম্যাথ, বায়োলজি সব আজ একসাথে বুঝে নে। এই বলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। রুমে ঢুকে মাসুদ দেখে কালো সায়া আর হলুদ ব্লাউজ পরা এক মেয়ে চেয়ারে বসে আছে। সে মেয়ে কেমন, কালো না সাদা, মোটা না পাতলা, লম্বা না খাটো কিছুর দিকেই তার নজর যায় না। শুধু দেখে একটা মেয়ে বসে আছে। পরনে শাড়ি নেই। এরকম হোটেলের রুমে একা কোনো মেয়ের সাথে থাকলে কি করতে হয় এই ব্যাপারে তার মোটামুটি ধারণা থাকলেও সেই ধারণা ওই মুহূর্তে কোনো কাজে আসে না। আজকেই ফার্স্ট নাকি, জিজ্ঞেস করে মেয়েটা। মাসুদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মেয়েটা হাসে। বলে, তাইলে আজকা আর ওই কামে যাওয়ার কাম নাই, বসেন, হাত-মাত ধরেন, গপ-সপ করেন। মাসুদ সাহস পেয়ে খাটের কোনায় গিয়ে বসে। মেয়েটা যখন পাশে এসে বসে কি করবে বুঝতে পারে না। হাত ধরবে না নাকি ধরবে না এসব ভাবতে ভাবতে নাম জানতে চায়। মেয়েটা বলে, ‘নাম? উম্মম… পরী।’ নাম শুনে মাসুদের পরীরানির কথা মনে পড়ে। এতদিন পরে এসে মনে হয় সেদিনের লাল চকোলেট নেয়াই উচিত হয়নি। তার কানে বাজে, ‘লুইচ্চা মাসুদ মুতরারে’। মনে হয় সেই দোজখ তার উপর আবার নেমে এসেছে। দোজখের আগুন-গরমে একে একে সে তার সকল কাপড় খুলে ফেলে আর সহ্যের বাইরে থাকা এক অব্যাখ্যায় যন্ত্রণায় কাঁদতে শুরু করে। পরী কিছু না বুঝেও তাকে এসে জড়িয়ে ধরে। মুহূর্তেই যেন সব গরম উধাও হয়ে যায়। সে অনেকক্ষণ চুপচাপ মেয়েটাকে জড়িয়ে থাকে। এসময় চারিদিকে ধুপ ধাপ দৌড় ঝাপের শব্দ শোনা যায়। পরী এক ঝটকায় তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, পুলিশ হতে পারে। মাঝে মাঝে পুলিশ আসে। সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর টাকা খেয়ে ছেড়ে দেয়। মাসুদ দ্রুত কাপড় পরে নেয়। দরজা খুলতে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে বন্ধ। বন্ধ দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার আনুমানিক তিন মিনিটের মাথায় বাইরে থেকে দরজা খুলে পুলিশ ঢোকে আর তাদের দুইজনকেই থানায় নেয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে উঠে মাসুদ দেখে অনেক মেয়ের ভেতরে সে একাই ছেলে। পরের দিন তার বাবা অলি আহমেদ তাকে নিতে আসে। অনেক সময় পর মাসুদকে তার বাবার সামনে আনা হয়। এক কনস্টেবল ভোঁতা মুখ করে ফিরিস্তি দেয় এই ধরনের কেস কতটা খারাপ, কিভাবে লাইফ শেষ করে দেয়, কি করে তারা মাসুদকে লাইফ শেষ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, এই সেই…। অলি আহমেদ পকেট হাত দিয়ে যা পায় হিসেব না করেই দিয়ে দেয়। টাকা হাতে নিয়ে কনস্টেবল খুব আগ্রহ নিয়ে পরামর্শ দেয় মাসুদকে যেন বিয়ে করিয়ে দেয়া হয়। অলি আহমেদ ছেলেকে মেসে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। জীবনে প্রথমবারের মতো মাসুদকে তার বাবা কিছুই বলে না।
শুধু দেখে একটা মেয়ে বসে আছে। পরনে শাড়ি নেই। এরকম হোটেলের রুমে একা কোনো মেয়ের সাথে থাকলে কি করতে হয় এই ব্যাপারে তার মোটামুটি ধারণা থাকলেও সেই ধারণা ওই মুহূর্তে কোনো কাজে আসে না। আজকেই ফার্স্ট নাকি, জিজ্ঞেস করে মেয়েটা। মাসুদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মেয়েটা হাসে। বলে, তাইলে আজকা আর ওই কামে যাওয়ার কাম নাই, বসেন, হাত-মাত ধরেন, গপ-সপ করেন। মাসুদ সাহস পেয়ে খাটের কোনায় গিয়ে বসে।
২৮
শহর থেকে বাসায় ফিরে মাসুদ গোসল করতে গিয়ে দেখে সাবান নেই। বউ পারভিন বানুকে সাবান দিতে বললে জানতে পারে যে সাবান আছে সাবানের জায়গায়। সাবানের জায়গায় কিছুই খুঁজে পায় না। বউয়ের উপর মেজাজ খারাপ হয়। এরকম মেজাজ প্রতিদিনই খারাপ হয়। পারভীন বানুর মতো এমন সুন্দর মানুষ দুনিয়ায় খুব বেশি পাওয়া যায় না বলে তার ধারণা। কিন্তু আচার আচরণ ততটাই অসুন্দর। আড়ালে আবডালে মাসুদ তাকে খানকি ডাকে। অথচ এই খানকির সাথে তার দেখা হওয়ার কথাই ছিল না, তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল হনুফার সাথে। তার মনে হয়, সবই হনুফার অভিশাপ। বিএসসি পাশ করে যখন চাকরি হয় না আর, এ-বাড়ি ও-বাড়ি গিয়ে অঙ্ক পড়াত সে। সবচেয়ে বেশিদিন পড়িয়েছে হনুফাকে। একটা সময় হনুফা সায়েন্স ছেড়ে দিয়ে ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হয়। ওই গভঃ কলেজেই। হনুফা বুঝতে পারে যে ইতিহাসে সে অঙ্কের চেয়েও দুর্বল। এই দুর্বলতা কাটাতে আবারও মাসুদকে নিয়োগ দেয়া হয়। পড়াতে গিয়ে তার কাছে ইতিহাসকে অঙ্কের চাইতে বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হয়। তার কাছে আরও ইন্টারেস্টিং লাগে হনুফার চেহারার গড়ন, দেহের গঠন, হাসির ধরন এইসব। আরও যা কিছু ইন্টারেস্টিং সবই তার আবিষ্কার করা হয়ে যায়। জীবনের যে অংশটা ইন্টারেস্টিং থাকে না তা হলো, তার চাকরি হয় না। চাকরি কেন হয় না তার উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে ওঠে সে। পথে ঘাটে মাঠে সবাই যেন তার চাকরির পেছনেই পড়ে থাকে। ভাইয়েরা, বোনেরা, ভাইয়ের বউরা আস্তে আস্তে অবহেলা করতে থাকে। ঠিক করে কেউ কথা বলে না। প্রায় দিন তার জন্য বাসায় তরকারি থাকে না। যেদিন থাকে সেদিন আবার ডাল থাকে না। যেদিন থেকে তার বাবা মাকেও তার উপর বিরক্ত মনে হয়, সেদিন মাসুদ ভাবে চাকরির ধান্ধা ছেড়ে কোনো দোকান-ফোকানে চাকরি নিয়ে নেবে। চলতে পারলেই তার হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের কথা সে কাউকে জানাতে পারে না। এরমধ্যে একদিন সে হনুফাকে কলেজে দিয়ে আসতে গেলে জুলকারনাইনের সাথে দেখা হয়। সে মামার ঠিকাদারি ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে, আবার সিরিয়াসলি রাজনীতিও করে। চেয়ারম্যানের ভাগ্নে থেকে সে এখন এমপির ভাগ্নে। মাসুদের চাকরি-বাকরি না হওয়া তাকে চিন্তিত করে। চিন্তিত চেহারায় সে মাসুদের কাছে হনুফার কথা জানতে চায়। আর সে কিভাবে মাসুদকে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের চাকরি দিতে পারে তা জানায়। সন্ধ্যাবেলা তার অফিসে যেতে বলে। মাসুদ সেদিন বিকেলেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদে আবেদন করে জুলকারনাইনের অফিসে চলে যায়। জুলকারনাইন মাসুদকে বলে হনুফাকে তার ভালো লাগার কথা। আর মাসুদ বোঝাতে চায় এই মুহূর্তে তার একটা চাকরি কত দরকার। এ-ও বলে যে তার সরকারি চাকরির বয়স আর মাত্র এক বছর আছে, এরপর সে কি করবে তা জানে না। জুলকারনাইন তাকে আশ্বস্ত করে যে এইসব চাকরি দেয়া তার মামার কাছে কোনো বিষয় না। তখন মাসুদ বলে হনুফার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা তার জন্য ব্যাপারই না। একদিন পড়ানো শেষে মাসুদ হনুফার বাবার সাথে কথা বলে। বলে যে জুলকারনাইনের মতো ছেলে আর পাওয়া যাবে না, অল্প বয়সেই কোটিপতি, মামা এমপি, বংশধর ছেলে। এসব শুনে হনুফার বাবা আগ্রহবোধ করে। ভেতর থেকে সবই শুনতে পায় হনুফা। ছুটে এসে বাবার সামনেই মাসুদকে থাপ্পড় মেরে বসে। আর বলে, ‘কুত্তাচোদা, চিটিং তুই একটা।’ মাসুদের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরে জুলকারনাইনের সাথে হনুফার বিয়ে হয়। প্রীতি উপহার হিসেবে মাসুদ দেয় একটা ফিরনি সেট। তারপর কবজি ডুবিয়ে খায়। খেতে খেতে গরুর মাংস আনতে বলে বেয়ারাকে। একবাটি মাংস এনে দিলে সে দেখতে পায় পুরো বাটিতে হাড্ডি ছাড়া কিছু নেই। মনে মনে বলে, সব শালা চিটিংবাজ। বলতেই তার কেমন জানি লাগে। কিছুতেই গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না।
৩২
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাসুদের কাজ বন্ধু সুজনের স্টুডিওতে আড্ডা দেয়া। সেদিন জুলকারনাইনের কমেন্টে সবার আগে হা হা দেয় সুজন। যার ফলে আড্ডা দিতে যায় না সে। তার বদলে ব্রিজের দুয়ারে গিয়ে বসে থাকে। এই ব্রিজ থেকেই রায়বাবু লাফ দিয়ে পড়েছিল একদিন। মাসুদ যেদিন ১ নং কড়ইতলা সপ্রাবিতে জয়েন করতে যায় দেখতে পায় সেই রায়বাবু এখন হেডস্যার। রায়বাবুর কিছু মনে থাকার কথা না থাকলেও মাসুদের সবই মনে থাকে। সামনে গেলেই তার নিজেকে লুইচ্চা বলে মনে হয়। দীর্ঘদিন নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সামান্য বাঁকা হয়ে যায় সে। চাইলেই যেন মাথা সোজা করতে পারে না। সেরকম নিচের দিকে তাকিয়ে একদিন অফিস রুমে গিয়ে চমকে যায় সে। ক্লাস টু এর এক বাচ্চা মেয়ের ছুঁতে মানা সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গে হাত চালিয়ে যাচ্ছে রায়বাবু। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নীরবতা ভেঙে রায়বাবু জানতে চায় সে কী চায়। আমতা আমতা করতে করতে মাসুদ মাথা তুলে সোজা হয়ে যায় আর গিয়ে কষে এক চড় মারে। তারপর বের হয়ে যাবে এসময় তার কি জানি হয়। চিৎকার করে সবাইকে ডেকে ঘটনাটি বলে দেয়। ছোটো মেয়েটি আকস্মিকতায় কাঁদতে শুরু করে। আশপাশের মানুষজনও এসে জড়ো হয়। এক সময় রায়বাবুর গায়ে কিল ঘুষি চলতে থাকে। কে একজন এর মাঝে হিন্দু মুসলমান প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। মালাউনরে ধইরা জবাই কর বলে লাফিয়ে ওঠে কয়েকজন। ঘটনা ক্রমেই খারাপের দিকে গেলে মাসুদের অনুশোচনা হতে শুরু করে। সে মানুষদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে এর উপযুক্ত বিচার হবে বলে আশ্বাস দেয়, কিরা কসম কাটে। যেহেতু সে হুজুর স্যার, মানুষ তার কথা মেনে নেয়। সবাই চলে গেলে রায়বাবু তার ভাঙা চশমাটা হাতে নিয়ে কাপড়ের এখানে ওখানে রক্ত, কাদামাটির দাগসহ স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়। মাসুদ পেছনে গিয়ে তাকে রিকশায় তুলে দেয়। ব্রিজের কাছে গিয়ে রিকশা থেকে নেমে পকেট হাতড়ে কোনো টাকা খুঁজে না পেয়ে বলে, টাকাটা হুজুর স্যার থেকে নিয়ে নিও। তারপর রিকশাঅলার সামনেই ব্রিজের উপর থেকে লাফ দেয়। উল্টা দিক থেকে আসা তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেলে আশপাশের যে কয়জন দেখে ঘটনাটা—তারা দৌড়ে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই খবর মাসুদকে নিজের কাছে অপরাধী করে দেয়। আর কেউ না জানুক সে তো জানে, এর কোনো কিছুই হতো না যদি সে চড় দেয়ার পর চুপচাপ মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে আসত। রায়বাবুর এই আত্মহত্যাকে তার কাছে খুন মনে হয় আর নিজেকে খুনী। সেদিন থেকে মাসুদের মনে অনুশোচনার একটা মিনার মাথা উঁচু করে থাকে আর প্রায়ই তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে চায়।
৩৯
রাতে ভাত খাওয়ার পর মাসুদ বারান্দায় অন্ধকারে বসে ফেসবুক দেখতে দেখতে একটা লেখায় চোখ আটকায়। সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের ভালোবাসা নিয়ে লেখা। মাসুদের বাবা-মাও তাকে খুব ভালোবাসতো। ছোটোবেলায় একবার স্ট্রং ডায়রিয়ায় প্রায় অর্ধমৃত হয়ে গিয়েছিল সে। রাতের বেলা কোনো রিকশা বা টেম্পু না পেয়ে বাবা তাকে কোলে নিয়ে চার মাইলের বেশি পথ দৌড়ে মেইন রোডে উঠেছিল। পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল তার মা। দুইজনকেই সেই চার মাইল পথ হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছিল। এই দুজনের জন্য তেমন কিছুই করা হয় না তার। একদিন সন্ধ্যায় তার বাবা জানতে চায় সে কেমন আছে। তারপর বলে, আজ একটা কাক জানালার পাশে বসে কাঁদছিল। কোনো অমঙ্গল এলেই নাকি কাক এমন জানালার পাশে কাঁদে। এসবই যে কুসংস্কার তাও বলে। বলতে বলতে বিছানায় বসতে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। মাসুদ ছুটে গিয়ে ওঠাতে গিয়ে দেখে কিছুতেই ওঠানো যাচ্ছে না। বছর খানেক বাদে একদিন তার মাকেও ঘুম থেকে ওঠানো যায় না। এরপর থেকে তার ভাইবোনদের সাথে সম্পর্কের সুতাগুলো ধীরে ধীরে পুরোনো হয়। কখন যে নরম হয়ে এইসব সুতা ছিড়তে থাকে তা সে টের পায় না। একদিন দেখা যায় বাড়ির উঠানে তারা সম্পত্তির হিসেব নিকেশ নিয়ে বসে আর তার চেনাজানা ভালো মানুষ ভাইবোনদের অচেনা আর কেমন যেন হিংস্র মনে হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মাসুদ কি করণীয় বুঝতে বুঝতেই দেখে বাড়ির পেছনের ভাঙাচোরা ঘরটা আর কিছু বাঁজা জমি তার ভাগে এসে জমা-খারিজ, নামজারি এসবের জন্য এক কোনায় বসে আছে। যেহেতু তার পড়াশোনা, জানশোনা এসব বেশি সবার হয়ে এসব কাজ তাকেই করতে হয়। কাজ শেষে দেখা যায় বাড়ির মূল ঘরটা আর সামনের বিশাল জমি তার নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যায়। কিভাবে কি হয় সে বুঝতেই পারে না। ভাইবোন সবাই এসে জানতে চাইলে সে অন্যমনস্ক হয়ে যা বলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় সে অনেক ক্লান্ত আর এসব তার কিছুই ভালো লাগছে না। সে তার মা বাবার কথা বলে চিৎকার করে কাঁদে। বোঝাতে চেষ্টা করে এসব কিভাবে হলো তার কিছুই সে জানে না। রেজিস্ট্রি অফিসও জানে না। খুঁজে দেখা যায় কিভাবে কি হলো কেউই কিছু জানে না। কেন সে কিছুই জানে না এজন্য তাকে ওই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যেতে হয়। অনেক অনেক দিন পরে যখন এসব কথা সবাই ভুলে যায়, একদিন ফজর ওয়াক্তে দেখা যায় মাসুদের বাবার বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। সকালে গিয়ে ছাইভস্ম ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না। তার ভাইয়েরা হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের বউয়েরা গলা ফাটিয়ে বিলাপ করে। এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে সে দেখে পোড়া জানালার পাশে একটা কাক কাঁদছে।
এত বড়ো আধুনিক ভবন কিভাবে কি হবে বুঝে পায় না। উপজেলা অফিসে যাবে কি যাবে না এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তার ভালো হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত বিষয় আশয় হারিয়ে যায়। সেখানে তার যাওয়া লাগে না। উপজেলা অফিসই তার স্কুলে চলে আসে।
এই সময়
ভালো হওয়া বা না হওয়া নিয়ে যে এক দীর্ঘ চিন্তার জাল ছড়ায়, সে জালের গিঁট খুলতে খুলতে মাসুদের জীবনে বেশ কিছু দিন যোগ হয়। তার জীবন এখন যে সংখ্যায় চলছে তা হলো ৪৬। এরই মাঝে একদিন খবর আসে ব্রুনাই এর সুলতান দেশের কিছু প্রাইমারি স্কুলে আধুনিক ভবন করে দেবে। সেই স্কুলগুলোর একটি ১ নং কড়ইতলা সপ্রাবি। ঘটনা এতটুকু হলে ঠিক ছিল। কিন্তু এই যে ভবন নির্মাণ তার শর্তই হচ্ছে সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবে প্রধান শিক্ষক, সহায়তায় থাকবে উপজেলা প্রশাসন। এটা জেনে মাসুদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সে জীবনে একটা খেলনা মাটির ঘরও বানাতে দেখেনি, এত বড়ো আধুনিক ভবন কিভাবে কি হবে বুঝে পায় না। উপজেলা অফিসে যাবে কি যাবে না এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তার ভালো হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত বিষয় আশয় হারিয়ে যায়। সেখানে তার যাওয়া লাগে না। উপজেলা অফিসই তার স্কুলে চলে আসে। অফিস রুমে বড়ো বড়ো সব মিটিং হয়। খানাপিনা হয়। সব সিদ্ধান্ত উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী অফিসার, শিক্ষা অফিসার এরাই নেয়। মাসুদ বসে বসে এর ওর দিকে তাকায়। কুটকুট করে বিস্কুট খায়। তার কাছে কিছু জানতে চাইলে লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ায়। তাদের স্কুলের পাশে বড়ো এক ধানী জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মাসুদের কাজ পড়ে জমির মালিককে জানানো। জানাতে গিয়ে দেখে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা নিতান্ত গোবেচারা এক লোক এই জমির মালিক। তাকে বোঝাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তার জমিতে বিশাল স্কুল হবে আবার কিছু টাকা পাওয়া যাবে জেনে রাজি হয়ে যায়। মাসুদের জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয় সে বড়ো কিছু একটা করছে। তার এমন ব্যস্তসমস্ত সময়ে একদিন শিক্ষা অফিসার এসে তাকে একা রেখে অফিস রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। বলে যে তারা সবাই যেহেতু টাকার জন্যই চাকরি করে এই সুযোগে অনেক টাকার মালিক হয়ে যাওয়া যাবে। এ-ও বলে যে চেয়ারম্যান, নির্বাহী অফিসার সবার সাথে কথা হয়েছে। এখন শুধু সে বাকি। টাকার অঙ্ক শুনে মাসুদের দম আটকে যায়। কিন্তু তার মন টানে না। এত টাকা দিয়ে জীবনে কি হবে বুঝতে না পেরে খাবি খায়। বলে যে, দরজাটা খুলে দেই। এমন বড়ো বড়ো সব লোকের প্রস্তাবে না বলার সাহস বা সামর্থ কোনোটাই তার ছিল না। এরপর থেকে দিনরাত সে টাকার হিসাব করে। টাকা পেলে কি করবে তার হিসাব করে। হিসাব করতে করতে অনেক রাত সে ঘুমায় না। এসব কিছুই সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় একদিন মিটিংয়ের সময় জমির কথা উঠলে। চেয়ারম্যান বলে যে তারা জমির টাকা দেখাবে অনেক বেশি কিন্তু মালিককে দেবে অনেক কম। বাকি টাকা তার ভাগ করে নেবে। যেহেতু জমির মালিক অশিক্ষিত আর কম বোঝে সে কিছুই বলতে পারবে না। এসময় মাসুদের ভেতর থেকে কোনো ভালো কথা আর আসে না। তার মনে হয় নিতান্ত গোবেচারা সেই জমির মালিক লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে তার সামনে বসে আছে মতামত শোনার জন্য। সামনে যারা বসে আছে তাদের ঊর্ধ্বতনের মতো ভাব নিয়ে ভারি গলায় সে বলে, জমির টাকা যা তাই দিতে হবে। কোথা থেকে এই সাহস আসে কেউ বুঝতে পারে না। চেয়ারম্যান আর নির্বাহী অফিসার তাকে হুমকি দিয়ে বসলে জীবনে প্রথমবারের মতো মাসুদ প্রচণ্ড রেগে যায়। সে কিছুতেই এই প্রস্তাবের খসড়ায় স্বাক্ষর দেয় না। সামান্য এক হেডমাস্টারের সাহস দেখে সবাই অবাক হয়। চেয়ারম্যান তার কলার ধরে ফেলে দিলে আলমারির পাশ লেগে কপাল ফেটে যায়। কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে বের হয়ে তালা আটকে দেয় দরজায়। সেই মুহূর্তে তার পেশাবের বেগ পায়। এবার সে ভুল করে না। পাজামার গিঁট খুলে অনেক সময় নিয়ে বন্ধ দরজার উপর পেশাব করে। তারপর হেঁটে গিয়ে ওয়ানের ক্লাস রুমে গিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে। কপাল থেকে রক্ত পড়ে তার সাদা পাঞ্জাবি লাল হয়ে যায়। সেদিকে খেয়াল নেই। মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুক ওপেন করে। জুলকারনাইনের সেই কমেন্টে হা হা দেয়। তারপর তার ফেসবুক জীবনের প্রথম স্ট্যাটাস লিখতে বসে। সে লেখে, ‘মাসুদ ভালো হতে চায়। কিন্তু তাকে কেউ ভালো হতে দেয় না’। কী মনে করে মুছে ফেলে। তারপর লেখে, ‘মাসুদ কখনোই ভালো হবে না। তোরা চোদা খা।’

জন্ম ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে হলেও ফেনীতে বেড়ে উঠা। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমানে একটি সরকারি দপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।