বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

কুসুমকুমারী দাশের কথা

0

জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ (১৮৭৫-১৯৪৮) বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। উনিশ বছর বয়সে কুসুমকুমারীর বিয়ে হয় সত্যানন্দ দাশের সঙ্গে। গৈলা গ্রামের বৈদ্য জাতের বহু নামকরা পরিবারের মতো কুসুমকুমারীর পরিবারের পরিচিতিও ছিল উজ্জ্বল। চন্দ্রনাথ দাস এবং ধনমণির তিন কন্যার বড়ো জন কুসুমকুমারী, অন্যরা হেমন্তকুমারী এবং সুকুমারী। প্রিয়নাথ তাঁদের একমাত্র পুত্র। পরিবারটি ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিয়েছিলেন বলে গ্রামে থাকা তাঁদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছিল; এ-কারণে বরিশাল শহরে স্থায়ী আবাস গড়তে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন তাঁরা। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি ছিলেন জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ। চন্দ্রনাথ বরিশালে এসে কিছুকাল সর্বানন্দের বাড়িতে বসবাস করেছিলেন, কুসুমকুমারীর সঙ্গে সর্বানন্দের মেজ পুত্র সত্যানন্দ দাশের বিয়ের যোগ এ-সূত্রেই।

চন্দ্রনাথ ছিলেন কবি, কন্যা কুসুমকুমারী পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চন্দ্রনাথ রচিত হাসির গান, ক্ষেপার গান, সাময়িক চিত্র নামে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিতভাবে লেখালেখি করতেন।

কুসুমকুমারী বরিশালে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। স্কুলটি একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে বোর্ডিং-এ জায়গা না পেয়ে তিনি একপর্যায়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে কিছুকাল থেকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিং-এ লাবণ্যপ্রভা বসুর তত্ত্বাবধানে চলে আসেন। ১৮৯৪ সালে প্রবেশিকা শ্রেণিতে পড়তে পড়তে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। যবনিকা ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার।

কুসুমের স্বামী সত্যানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন ইন্সটিটিউট-এর প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বিয়ের পর এক চিঠিতে (১৯০০ সালে) স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘সন্তানপালনব্যতীতও একটা কিছু ব্রত গ্রহণ কর— একখানা কিছু লিখিতে আরম্ভ কর।’

কুসুম অবশ্য তার আগেই লেখালেখিতে নিয়মিত হয়ে গেছেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ১৮৮৫ সালে কলকাতা থেকে শিশুদের মাসিক ‘মুকুল’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে প্রথম বছরে কুসুমকুমারীর কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়। এর মধ্যে একটি কবিতার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত—

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ হইতে হবে’— এই তার পণ।

মায়ের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ লিখেছিলেন— ‘মা-র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ।’
হ্যাঁ। ঠিক তাই। সহজ বিশ্বাস, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মহত্তম অনুভব, সভ্যতার সঙ্কট নিয়ে চিন্তা, প্রেম এবং জীবনের অনেক মৌলিক প্রবনতা নিয়ে কুসুমকুমারী দাশ কবিতা লিখেছেন।

তাঁর কবিতার লাইন —

নিশীথে স্বপন-ঘোরে সুপ্ত ধরণীর—
অনাবৃত বক্ষে আজ হয়েছি বাহির (নিশীথে)

অথবা—

এই ভুবনের ওপার হতে আজ
যে গান এল ভেসে সুরে-সুরে
উদাস করা সেই রাগিণী ধরে
হৃদয় আমার থাকবে দূরে-দূরে। (ওপারের সুর)

শরৎকালের শিউলিঝরা ভোরের মতো স্নিগ্ধতা এনে দেয় কোনো কোনো কবিতা—

কত পাপ, অপরাধ, কত অবহেলা—
অভাগা বলিয়া তবু ছাড় নাই মোরে,
আজ যদি এলে কাছে, একান্তে নিরালা,
তোমারি করিয়া মোরে লহ চিরতরে। (দেবতার প্রতি)

জীবনানন্দ দাশ তাঁর লেখা ‘আমার মা’ এবং ‘আমার মা-বাবা’ নিবন্ধে নিজের পিতা-মাতাকে নিয়ে আন্তরিক এবং নিজের চেতনার সঙ্গে বিজড়িত যেসব কথা বলেছেন সেখানে এই দুইজন অন্তরালের মানুষের অকলুষ ছবি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

কবিতার পাশাপাশি কুসুমকুমারী দেবী ডায়েরিও রেখে গেছেন। ‘দৈনন্দিন লিপি’ নামে প্রকাশিত এই ডায়েরিটি ভূমেন্দ্র গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। অনেকটা আত্মচিন্তায় তন্ময় কুসুমকুমারীর জীবনের হেমন্তবেলার নানা সুর যেমন এই ডায়েরিতে মেলে, তেমনি অতীতের স্মৃতিময় দিন আর প্রাত্যহিক জীবনের জাগ্রত রথেরও সেখানে দেখা মেলে। ডায়েরিতে কবিতা আছে, ইহলোক, পরলোক, পরমাত্মার মোহ, দর্শন, ইতিহাস…সব কিছুরই কম-বেশি উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন তাঁর ছিমছাম পরিবারের কথা। নানান ইচ্ছার কথা। আশা-দুরাশা, জীবনের বহুবিধ লগ্নের সুন্দর স্মৃতিকথা। তাঁর বেদনা, বিচ্ছিন্নতা, চিৎকার, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি, অভিমান, ঝরা-ফুলের গন্ধ; সব কিছু যেন লুটিয়ে আছে পাতায় পাতায়।

জীবনানন্দের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটি ছিল অত্যন্ত কাছের। প্রখর বুদ্ধিমান এবং প্রতিভাবান পুত্রটির ঘরোয়া নাম ছিল মিলু। মায়ের অতি আদরের বড়ো পুত্র। পুত্রের কবিতা লেখার দিকে মায়ের ছিল সযতœ দৃষ্টি। ছেলে যখন বেকার, তাঁর থিতু হওয়া নিয়ে কুসুমকুমারীর উদ্বেগ ডায়েরির অনেক জায়গায় চোখে পড়ে।

কলকাতায় ছেলে যখন বি.এ অনার্স কিংবা এম.এ ক্লাশে পড়ছে তখনকার কিছু চিঠিতে দেখা যায়, পাঠ্যবই কেনা, পড়া, সেগুলো সংগ্রহ করার বিষয়গুলিও জীবনানন্দ মায়ের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে ঠিক রাখছেন। মিলুর শরীর শিশুবয়সে একবার খুব খারাপ করল; সবার বাধার মুখে অল্পবয়সী মা ঠিকই ছেলেকে নিয়ে চেঞ্জে চলে গেলেন। এত সব কিছুর উল্লেখ আসলে এ-কারণেই যে, ভালোবাসার মহিমা কেবল মাতা-পুত্র, সম্পর্কের এই নামের মধ্যে লুকিয়ে নেই, আছে জীবনের নানান গল্পের ফাঁক-ফোকরে।

পরিবারটির মাথার ওপর আকাশটুকু সবসময় সংহত ছিল না; ঈষান কোণে মেঘের আনাগোনা যেন ছিল নিত্যসঙ্গী। দারিদ্র্যের অকরুণ সমস্যার সঙ্গে কুসুমকুমারীর পরিবারটিকে যুদ্ধ করতে হয়েছে একটা লম্বা সময়। ডায়েরির একটি এন্ট্রিতে বিষাদের গল্পগুলো এভাবে প্লাবিত হয়েছে—

০৯.০৬.১৯৪৩
যে দিন-কাল ঘনাইয়া আসিয়াছে—দারিদ্রের ক্রন্দন ও মরণ, মধ্যবিত্তের হাহাকার। কি হবে পরিণাম। খাওয়া আরো কমাইতে হইবে। যেটুকুতে জীবন ধারণ হয়, তাহাই যথেষ্ট। কাহারও সাহায্য করিতে পারি না, বিধাতা, সহায় হও।

মা সম্পর্কে জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘আমরা তাঁর সন্তান—ইউনির্ভাসিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছি অনেক দিন হতে চলল। কিন্তু কার কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা? আমি অন্তত তিন জন মানুষের কাছে। এক জন বাবা, এক জন মা, আর এক জন ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাস্টার আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।’ আমরা দেখতে পাচ্ছি, জীবনানন্দ পিতা এবং শিক্ষকের পাশাপাশি তাঁর মায়ের কথা বলছেন যিনি তাঁর জীবনে আলো জ্বালিয়েছিলেন। জীবনানন্দ আরও লিখেছেন, তিনি তাঁর মাকে পড়ায় এবং নানান আলোচনায় অংশ নিতে দেখেছেন। দেশি-বিদেশি ঔপন্যাসিকদের কোথায় কী ভালো, এসব কিছু তিনি মায়ের কাছেই সবার আগে জেনেছিলেন। সে-তালিকায় যেমন রবীন্দ্রনাথ আছেন, আছেন শেলি-ব্রাউনিং, বৈষ্ণব পদাবলীও। দিনরাত সংসারের কাজে জড়িয়ে থেকেও তাঁর মা নিয়মিত কবিতা লিখতেন সেটিও তিনি এ-লেখায় স্মরণ করেছেন। মায়ের কবিতা সম্পর্কে স্মৃতিমুক্তির নিরিখে জীবনানন্দ বলেছেন, হয়তো কুসুমকুমারী দেবী সংসারের কাজে ব্যস্ত আছেন, এ-সময় ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, আজই কোনো কবিতা চাই, কুসুমকুমারী এক হাতে খুন্তি, আরেক হাতে কলম চালিয়ে ঠিকই একটি কবিতা লিখে তখনই দিয়ে দিতেন। এমন একটি স্বতন্ত্র ছবির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি সমস্ত জীবন ভরে নিমগ্ন থেকে নিবিড়ভাবে কুসুমকুমারী দেবী সংসারে যেমন, নিজের লেখার কাজেও ছিলেন কর্তব্যনিষ্ঠ। কুসুমকুমারী ছাত্রী হিসেবে কৃতী ছিলেন সে-বিষয়ে পুত্র জীবনানন্দ লিখেছেন। পরীক্ষায় পারদর্শিতার জন্য কুসুমকুমারী যেসব বই পুরস্কার পেয়েছিলেন তার দু-একটি শৈশবে নেড়ে-চেড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন জীবনানন্দ। তাঁদের তখনকার সময়ের জীবনবেদের তাৎপর্য যে কুসুমকুমারী খুব ধরতে পারতেন এবং সেই কীর্ণ সময়ের যোগে মায়ের কবিতাও যে কোনো ক্ষেত্রে মহৎ হয়ে উঠেছিল তার উল্লেখ জীবনানন্দের লেখা ‘আমার মা-বাবা’-তে পাওয়া যায়। এই লেখায়ই আমরা জানতে পারি কুসুমকুমারীর কবিতা নিয়ে ‘কাব্যমুকুল’ নামে একটি গ্রন্থ তখন প্রকাশিত হয়েছিল। মায়ের কাব্যের বিচার ভবিষ্যৎ সময়ে হবে বলে জীবনানন্দ ভাবনা রেখে গেছেন।

নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘কবিতার কথা’য় জীবনানন্দ কবিকে শেষ পর্যন্ত তার প্রতিভার কাছে বিশ্বস্ত থাকতে বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন তাতে করে কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে সে কবিতা মূল্যায়িত হবে— সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্য দরকার পড়বে সেই বিশেষ কবিতার। ভোরের কলরবের মতো উজ্জ্বল কুসুমকুমারীর কবিতা নিয়েও জীবনানন্দের অনুধাবন যেন একই।

কুসুমকুমারী ডায়েরিতে লিখেছিলেন—

কত আশা, কত ভাষা, কত ভালবাসা
রেখেছিলে তাঁরি পায়, বেঁধেছিলে বাসা—
মহান আনন্দ-পুরে—স্বীয় মহিমায়
ধরণীর সুখ দুঃখ তুচ্ছ করি হায়
গেলে চলে অস্তাচলে লোক-লোকান্তরে
দূর দূরান্তর হ’তে হরিব তোমারে
আমার মানস লোকে, যুগ যুগ ধরে…

কুসুমকুমারী দাশ জীবনের বিবর্ণ সময়গুলোকে অম্লান করে গেছেন, লেখায়, কবিতায়। নীল অপরাজিতা ফুল আকাশে লীন হয়ে পুরো পৃথিবীকে মাঝখানে রেখে বুঝে নিতে চায় নিজের রঙের উজ্জ্বলতা, কুসুমকুমারীর কবিতার বিষাদও যেন নিরুত্তাপ অন্ধকার থেকে আলো নিয়ে বোবা অন্ধকারকে দিগবিজয় রঙে রাঙিয়ে দিতে চায়। এসব কবিতা অতীত থেকে ভেসে এসে এখনো নিজের শিখা কেবল জ্বালিয়েই যাচ্ছে। একাগ্রতা নিয়ে পড়লে দেখা যায় বর্ণময় কবিতাগুলো এখনো সবদিক আলো করে আছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম-বেড়ে ওঠা ফেনীতে। লেখালেখির শুরু দৈনিক পত্রিকায়। মূলত ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ করেন। লেখালেখিতে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা এবং জীবন তাঁর আগ্রহের জায়গা। প্রায় দু্ই দশক ধরে চাকরি করছেন আর্থিক খাতে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।