শুক্রবার, নভেম্বর ২২

প্রবুদ্ধসুন্দর কর-এর দশটি কবিতা

0

যৌথ


ভ্রামরী প্রাণায়ামের মতো
তোমার সুগন্ধ নাকে টেনে
মুখ দিয়ে বের করে দিই।
গুঞ্জনের এই ধ্বনি শুনে
লোকে ভাবে, প্রণয় আসন্ন।
লোকে যাকে প্রণয় ভেবেছে
তা মূলত যৌথ ধ্বংসধ্বনি।


সেলিব্রিটি


মিডিয়া ডাকিনী ঘোর। গ্রিক পুরাণে উল্লেখ আছে।
তাদের স্যাবার্টে ফিসফিসানি চলে, তৈলাক্ত বাঁশের
খুঁটিতে তোমাকে কতটুকু ওঠাবে নামাবে।
সামান্য কলার লোভে তোমার বিক্রীত ল্যাজের কলাপ দেখে
মিষ্টিবৌদিরাও খুব তালি দিয়ে ওঠে
শিস দেয় শখের পাঠক।
এইসবই অমরত্ব ভেবে ভেবে তুমি যত বন্ধু হারিয়েছ
স্তাবক জুটেছে এরও ঢের কিছু বেশি।
তোমার অবিচ্যুয়ারি লেখা হয়ে গেছে
মৃত্যুর তারিখ শুধু উল্লেখের বাকি।


মাস্ক


গত মার্চ মাস থেকে আমি শুধু হাত ধুয়ে যাচ্ছি
আর মুখে মাস্ক কাউকেই চেনার উপায় নেই
পার্বত্য সীমান্তে কারা যেন যুদ্ধমহড়ায় ব্যস্ত
মানুষের শ্বাস লেগে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী
মানুষের স্পর্শে নাকি আর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই
শবপোড়া ভস্ম আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দশদিক
এই দুঃসময়ে আলিঙ্গনহীন আমিও জেনেছি
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জিন পিং একই ধাতব মুদ্রার
এপিঠ ওপিঠ আর যতদূর মুদ্রাটি গড়িয়ে
যেতে থাকে ঠিক ততদূরই মহান সাম্রাজ্যবাদ।


শবব্যবচ্ছেদপত্র


পাখিদের গান মূলত তাদের ক্ষুৎকাতরতার ধ্বনি
পাখিদের যৌন আর্তির ধ্বনিকে আমরা গান ভেবে থাকি।
ক্ষুধার কোমল আর কড়ি থেকে শীৎকার ও শ্বাসাঘাত
এভাবেই ভোরে ও সন্ধ্যায় সংগীতমুখর হয়ে ওঠে।
পাখিদের মতো পাহাড়ের উচুঁ থেকে পুরুষেরা
খাদে শুয়ে থাকা নারীদের আগ্নেয় ক্লিভেজ থেকে
নিঃসৃত আলোয় কেন সহসা ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে
এ রহস্য নিয়ে পুরুষবিশারদেরা আজও কিছুই বলেননি।
পাখিদের শবব্যবচ্ছেদপত্রে তাই কারণ হিসেবে
পুরুষের পালকের কোনো উল্লেখ থাকে না।


নেপথ্য


মৃত্যু ও দুঃখের দৃশ্যে আজও বাজে করুণ বেহালা
প্রণয়মুহূর্তে বাজে সেতারের ঝালা
রবীন্দ্রনাথের গানে নেপথ্য বাদক
দক্ষ হাতে ছড় টানে বিদগ্ধ এস্রাজে
যৌনতার দৃশ্যে আজও স্যাক্সোফোনই বাজে।


বেবী সাউ


যদিও সতীর্থ আমরা, তবু তাকে দেখিনি কখনো
দূরাভাষে তার সাথে একদিন কথা হয়েছিল।
শুনেছি, বি এডের একঘেয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সনেট লিখেছে
এলিজাবেথান নাকি পেত্রার্কান সেসব সনেট জানতে ইচ্ছে করে খুব।
সান্ধ্যপ্রার্থনা শুরুর আগে জামসেদপুর থেকে যেন প্রতিদিন
পরপর তিনবার শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে আগরতলার শহরতলিতে।
একদিন আমাদের ঠিক দেখা হয়ে যাবে নন্দন পাহাড়ে
মানিকপুর অথবা ত্রিকূট পাহাড়, উশ্রী ফলসের পথে।
বিগ্রহকে পাশাপাশি প্রণামের আগে যেন দুজনে গেয়েছি
“সত্যপুরুষ চৌথে পদবাসা সন্ত ন ক্যা উঁহা সদা বিলাসা
সো ঘর দরসায়া গুরু পুরে বীণ বাজে জঁহা অচরজ তুরে”।
প্রতিভাবান কবিকে নিয়ে প্রথম লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন
সেই সূত্রে অতৃতীয় এ আমার অপ্রতিভ সামান্য লিখন ।


গান


কলাবতী আনন্দের রাগ, তবু এই রাগে
একটি দুঃখের গান কিশোরের কণ্ঠে যেন ভেসে আসে আজও।
শিবরঞ্জনী রাগের সুরে আরোপিত হয়ে আছে অজস্র বিষাদগীতি
তবু মহম্মদ রফির গলায় এই রাগাশ্রিত
এক আনন্দের গান আজও মুখে মুখে ফেরে।
গীতিকারের চেয়েও সুরকার সূক্ষ্ম আততায়ী
অমৃত ও বিষ মিশিয়ে সে পেতে রাখে স্বরলিপিফাঁদ
যাতে এসে ধরা পড়ে ব্যবহৃত হয় কত গায়ক গায়িকা
শ্রোতাকে খুনের দায়ে যাদের যাবজ্জীবন গেয়ে যেতে হয়।
ব্যথা আর আনন্দের. দু -ফোঁটা অশ্রুর কাছে
সেইসব কণ্ঠশিল্পীদের আজীবন শাস্তি ও স্বীকৃতি ম্লান হতে থাকে।


ক্ষীণ


তোমার আরোগ্য নেই, আগেও বলেছি
মৃত্যুভয় ঝেড়ে ফেলো। প্রতিটি সৃষ্টিরই
ধ্বংস আছে। সূর্যও ক্রমশ প্রায় ক্ষীণ।
পঞ্চাশোর্ধে বাণপ্রস্থ, যাকে গৃহ ভাবো
তা মূলত বনপথ। একা চারণের।
যে ঔষধ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে আজ
তার গায়ে লেখা থাকে মৃত্যুর তারিখ


ঝোঁক


বিপ্লবে অনাস্থা আছে বলে ক্ষমা কোরো
কখনোই মাড়াইনি প্রতিবিপ্লবের ছায়া।
স্থিতাবস্থায়ও বিশ্বাস নেই
প্রতিকবিতার দিকে তাই সামান্য ঝুঁকেছি।


রেডিয়ো স্টেশন


জঙ্গলের ভেতর কোথাও পরিত্যক্ত এক রেডিয়ো স্টেশন কোনও একদিন খুঁজে পেলে জেনো, স্তব্ধতাই এর সিগনেচার টিউন।

নৈঃশব্দ ব্যতীত, হাহাকার, বিলাপ, অশ্রুপাতের ধারাবিবরণী ২৩৬.৪ মিটারব্যান্ড তথা ১২৬৯ কিলোহার্টজে প্রচারিত হয়নি কখনও অধিবেশনের শুরুতে বা শেসে ঘোষিত হয়নি স্টেশনের নাম।

জঙ্গলের ভেতর কোথাও স্তব্ধতার সিগনেচার টিউন শুনতে পেলে জেনো, আত্মকুণ্ডয়নমুগ্ধ এই স্টেশনের ধ্বংসাবশেষই আকাশবাণী প্রবুদ্ধসুন্দর।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৭ জানুয়ারি ১৯৬৯। পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত কবিতার বই : ডার্করুম মঘানক্ষত্র, ইন্দ্রজাল কমিকস, মায়াতাঁত, নৈশ শিস, আত্মবিষ, যক্ষের প্রতিভূমিকা, অসুস্থ শহর থেকে, অ্যাসিড বালব্, স্বনির্বাচিত কবিতাআমার অ্যাম্বুশ (গদ্যগ্রন্থ)। সম্পাদিত কবিতাসংকলন: উত্তরপূর্বের তরুণ কবিদের শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা উত্তরপূর্বের কবিতা, ত্রিপুরার বাংলা কবিতা

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।