সেইরাতে আমরা ঘরের মেঝেতে শুয়েছিলাম। আর গুটিপোকাদের কুটকুট করে খাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ওরা তাকে রাখা তুঁতগাছের পাতা খায়। নৈঃশব্দ্যের ভেতর সারারাত ওদের কুটকুট শব্দ পাওয়া যায়।
আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। কেননা অনেকদিন আমার মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল, আমি অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে গা-হাত-পা ঢিলে করলেই বুঝি আত্মাটা শরীরের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। বহুদিন এ ধারণা নিয়ে ছিলাম। রাতের বেলা যখন ঘুম ভেঙে যেত—ভাবতাম, আত্মাটা বেরিয়ে গিয়েছিল বটে, তবে জেগে ওঠামাত্র আবার শরীরে ফেরত এসেছে। চেষ্টা করতাম ব্যাপারটা নিয়ে না ভাবতে। কিন্তু ভাবনাটা এসেই যায়। বিশেষত রাতের বেলা যখন মাত্রই ঘুমাতে যাব তখন। অনেক কসরত করে বন্ধ করতে হয় এই ভাবনা। আমি মোটামুটি যখন নিশ্চিত যে আসলে এরকম কিছুই হয় না, কোনো আত্মা শরীর থেকে বাইরে বের হয় না, তখন থেকে—সেই গ্রীষ্ম থেকেই একটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলাম।
শুয়ে শুয়ে জেগে থাকার সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখার অনেকগুলো কৌশল আছে আমার। শুয়ে ভাবতে থাকি, কৈশোরে ফিরে গিয়েছি আমি, স্রোতের মাঝে ট্রাউট মাছ ধরছি। খুব সাবধানে, সবিস্তারে এই মাছ ধরাধরি চলে মাথার ভেতর। জলের নিচে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির আড়ালে, গভীর গর্তে, স্বচ্ছ অল্পজলে ট্রাউটগুলো ধরি, কখনো ছুটে যায় বড়শি থেকে। দুপুরবেলা মাছ ধরা বন্ধ রেখে খাবার খেয়ে নিতাম স্রোতের উপর গাছের গুঁড়ির উপর বসে, বা তীরে গাছের তলায় বসে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া ধীর গতিতে সারতাম আর নিচের স্রোত দেখতাম। প্রায়ই আমার বড়শির আধার ফুরিয়ে যেত। কারণ গোটা দশেক পোকা টিনের কৌটায় ভরে মাছ ধরতে নামতাম আমি। ওগুলো দ্রুতই ফুরিয়ে গেলে আরো আধারের দরকার হতো। তীরে মাটি খুঁড়ে কেঁচো বা পোকা পাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। ঘাস থাকত না ওখানে, শুধু স্যাঁতস্যাঁতে, সিডার গাছের ছায়ায় রোদহীন মাটি। প্রায়ই কোনো পোকা পাওয়া যেত না। তখন অন্যকিছু আধার হিসেবে ব্যবহার করতাম। একবার জলাভূমিতে কোনো আধারই খুঁজে পেলাম না, তখন আগের ধরা ট্রাউট মাছটি কেটে বড়শিতে গেঁথে দিয়েছিলাম।
মাঝে মাঝে জলাভূমির ভেতর লতাগুল্মগুলোতে পোকা পাওয়া যেত, ঘাসে বা ঘাসের তলায় যা পেতাম ওগুলোই ব্যবহার করতাম। লতাপাতার ফাঁকে ঘাসের ডগার মতো পা-ওয়ালা পতঙ্গও পাওয়া যায়। পুরনো গাছের গুঁড়ির পচে যাওয়া অংশে কীট পাওয়া যেত বাদামী রঙের, ওগুলো বড়শির সাথে থাকত না, ঠান্ডা পানির স্রোতে খুলে যেত। আবার মাঝে মাঝে গুঁড়ির বাকলের ভেতর ভালো ভালো পোকা পাওয়া যেত। গুঁড়ি উঁচু করলেই সুড়ুত করে মাটিতে সরে যেতে চায় ওগুলো। একবার স্যালামান্ডার ব্যবহার করেছিলাম গুঁড়ির নিচে পেয়ে। স্যালামান্ডারটিও আকারে বেশ ছোটো, দ্রুতগতির, গায়ের রঙ সুন্দর ছিল। ছোটো ছোটো পা দিয়ে বড়শির হুক আঁকড়ে ধরে রাখে ওরা। এরপর আধার হিসেবে স্যালামান্ডার ব্যবহার করিনি কখনো, যদিও ওগুলোর দেখা পেতাম প্রায়ই। ঝিঁঝিঁপোকাও ব্যবহার করিনি ওগুলোর অদ্ভুত আচরণের জন্য।
মাঝে মাঝে খোলা তৃণভূমির উপর দিয়ে স্রোত বয়ে যেত কোথাও, তখন শুকনো ঘাসে ঘাসফড়িং ধরতাম। সেগুলো বড়শিতে গেঁথে স্রোতে ছুঁড়ে দিতাম। প্রথমে ভাসতে থাকত, এরপর কোনো ট্রাউট এসে উঁকি দিয়ে টেনে নিত। রাতের বেলা চার পাঁচ রকম স্রোতে মাছ ধরতাম কখনো কখনো। যতটা সম্ভব স্রোতের উৎসের কাছাকাছি গিয়ে স্রোতে বড়শি ফেলতাম। যদি দ্রুত কিছু মাছ পেয়ে যেতাম, কিন্তু হাতে সময় তখনো প্রচুর আছে, তখন আবার বড়শি ফেলতাম। উজানের দিকেও মাছ ধরেছি। কত কত রাতে মনের ভেতর একটা স্রোত তৈরি করে মাছ ধরতে নামি। ব্যাপারটা এমন যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি। আমি ওগুলোর নাম দিই, ট্রেনে চেপে গিয়ে, মাইলের পর মাইল হাঁটি স্রোতের কাছে পৌঁছুতে।
সেই রাতগুলোতে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুয়ে শুয়ে মনে করতাম। যুদ্ধে যাবার আগ মুহূর্ত থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।
কোনো কোনো রাতে, ভাবনার ভেতর আমি মাছ ধরতে যেতে পারতাম না। শান্ত জেগে থাকি, বারবার প্রার্থনা করি পরিচিত সমস্ত মানুষের জন্য। এটা অনেক সময় নিয়ে নেয়। বিশেষ করে যখন এ জীবনে চেনাজানা প্রতিটি মানুষকে স্মরণ করতে হয়—ছোটোবেলা থেকে শুরু করে, যেখান থেকে মনে পড়ে—প্রথম কোথায়, কে কে ছিল, আমি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, বাবা মায়ের বিয়ের কেকের বাক্স উঁচু তাকের উপর রাখা, বাবার এলকোহলভর্তি কাচের বোতলে রাখা সাপ—ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যেত ওগুলোর রঙ… অতদূর পর্যন্ত ভাবতে পারলে অনেক মানুষের কথাই মনে পড়ে। এরপর তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে প্রার্থনা শুরু করলে এক সময় সকালের আলো ফুটে ওঠে। তখন ঘুমিয়ে পড়া যায়, যদি দিনের বেলা ঘুমানোর সুযোগ থাকে আর কী।
সেই রাতগুলোতে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুয়ে শুয়ে মনে করতাম। যুদ্ধে যাবার আগ মুহূর্ত থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। দাদাবাড়ির চিলেকোঠার কথা মনে পড়ে। সেখান থেকে ভাবতে ভাবতে এক সময় যুদ্ধে পৌঁছে যাই—এখানে এসে একবার ভাবনা থামে।
আমার মনে আছে, দাদাজান মারা যাবার পর নতুন একটা বাড়িতে চলে যাই আমরা। মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল বাড়িটা। যেসব জিনিস আনা হয়নি, ওগুলো পুরনো বাড়ির পেছনে একত্র করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আগুন ফুঁসলে উঠত এলকোহলের ছোঁয়া পাওয়া মাত্র। এলকোহলে রাখা সাপগুলোও পুড়িয়ে ফেলা হয়। সে আগুনে কোনো মানুষ ছিল না, শুধু জিনিসপত্র। মনে নেই কে পুড়িয়েছিল ওগুলো। তবে ভাবনা চলতে থাকে, নতুন কোনো মানুষের কথা মনে পড়ামাত্র ভাবনা থামিয়ে তাদের জন্য প্রার্থনা শুরু করি।
নতুন বাড়ির কথা মনে পড়ে। মা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত সবকিছু। বাবা শিকারে গেলে মা তখন বেজমেন্ট পরিষ্কার করে রাখত। মা একবার অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল বাড়ির পেছনে স্তূপ করে। বাবা শিকার থেকে ফিরে আসেন, ঘোড়া থেকে নামেন। রাস্তার পাশে তখনো অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জ্বলছিল। আমি বাবার সাথে দেখা করতে বাড়ির বাইরে বের হই। বাবা তখন শটগান আমার হাতে তুলে দিয়ে আগুনের দিকে তাকান, জিজ্ঞাসা করেন আমাকে, ‘এগুলো কী?’
বারান্দার চেয়ারের কাছ থেকে মা জবাব দেয়, ‘বেজমেন্ট পরিষ্কার করলাম, সোনা।’ সে দাঁড়িয়ে ছিল মুখে হাসি নিয়ে। বাবা আগুনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটাতে লাথি হাঁকান, এরপর ঝুঁকে ছাইয়ের ভেতর থেকে কিছু বের করলেন। ‘একটা ঝুরি নিয়ে এসো, নিক,’ আমাকে বললেন। আমি বেজমেন্ট থেকে একটা ঝুরি এনে বাবার হাতে দিই। বাবা ছাই থেকে পাথরের কুড়াল, ছুরি ও কিছু তীরের ফলা সাবধানে সরিয়ে ছাইগুলো ঝুড়িতে তুলে রাস্তার অন্যপাশে ফেলে দিয়ে এলেন। শটগানের লেদার হোল্ডার, ব্যাগপত্র, ঘাসের উপর পড়ে ছিল, বাবা এসে ওখানেই নামিয়ে রেখেছিলেন ওগুলো।
‘বন্দুক আর ব্যাগগুলো ঘরের ভেতরে নিয়ে রাখো, নিক, আর আমাকে একটা কাগজ এনে দাও,’ বলছিলেন তিনি। মা বাড়ির ভেতরে চলে গেলে আমি ভারী শটগান এবং দুটো ব্যাগ তুলে ভেতরে যেতে লাগলাম।
‘এক এক করে নাও,’ বাবা বললেন। ‘সবগুলো একসাথে নেবার দরকার নেই।’
আমি ব্যাগ দুটো নামিয়ে শুধু শটগানটা নিয়ে ভেতরে গেলাম। একটা খবরের কাগজ হাতে বাবার অফিসঘরে ফিরলাম। সবগুলো কালচে পাথুরে জিনিস কাগজে মুড়িয়ে নিলেন বাবা। ‘সেরা ফলাগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে,’ বললেন তিনি। এরপর বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন মোড়ানো কাগজ নিয়ে। আমি বাইরে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে রইলাম, একটুপর ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে ভেতরে চলে গেলাম।
…এটুকু মনে করতে করতে দুজন মানুষের কথা মনে পড়ল। আমি তাদের জন্য প্রার্থনা করলাম।
কিছু রাতে আমি প্রার্থনাও ভুলে যাই। খানিকটা প্রার্থনা পড়ার পর বাকিটুকু ভুলে গেলে হাল ছেড়ে দিই, অন্য কিছু করার চেষ্টা করি। একরাতে আমি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিদের নাম ধরে ধরে মনে করার চেষ্টা করলাম। এরপর পাখি, এরপর মাছ, এরপর দেশের নাম, এরপর শহর, এরপর খাবার, এরপর রাস্তার নাম। শিকাগোর নাম মনে পড়ল। এরপর এক সময় এলো যখন আর কিছু মনে করবার বাকি নেই। তখন কিছুই ভাবা যায় না, শুধু গুটিপোকার কুটকুট শব্দগুলো শোনা যায় কান পেতে। এমন কোনো রাত নেই যখন পোকাগুলো শব্দ করে না। আমার সাথে যদি বাতি থাকত তাহলে ঘুমাতে ভয় পেতাম না। আমি জানতাম আত্মা কেবল অন্ধকারেই শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তাই অনেক রাত আমি বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছি। শরীর ক্লান্ত, সহজেই ঘুম পেয়ে যেত। অনেক রাত ছিল, ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু যেসব রাতে কথাটা মনে পড়ত, সেসব রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কান পেতে গুটিপোকাগুলোর পাতা খাওয়ার শব্দ শুনতাম। রাতের বেলা শুয়ে থেকে শব্দগুলো স্পষ্ট শোনা যেত। আমি শুয়ে থাকি, চোখ খোলা, শুনছি।
উনিশশো চৌদ্দ সালে তারা ওকে সৈনিক হিসেবে নিয়ে নেয়। ও তখন পরিবারের সাথে দেখা করতে বাড়ি এসেছিল। ইংরেজি বলতে পারে বিধায় ওরা ওকে আমার কাছে পাঠায়। আমার নড়াচড়ার শব্দ শুনছে ও, টের পাই।
ঘরটিতে আরো একজন জেগে ছিল।
দীর্ঘক্ষণ আমি ওর জেগে থাকার শব্দ শুনতে পাই। এই জেগে থাকাটা লুকাতে পারছে না ও। সম্ভবত নিঃশব্দে জেগে থাকার অভ্যাস নেই আমার মতো। খড়ের উপর বিছানো কম্বলে শুয়ে ছিলাম আমরা। যখনই সে পাশ ফিরে শোয়, খড়ের মধ্যে শব্দ হয়। আমাদের তৈরি করা কোনো শব্দে গুটিপোকাগুলো ভয় পায় না, নিজের মনে পাতা খেতে থাকে। বাইরে, সাত কিলোমিটার পেছনে যুদ্ধের লাইন থেকে আসা শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সে শব্দ আর এই অন্ধকার ঘরের শব্দগুলোর মাঝে অনেক তফাৎ। জেগে থাকা বাকি লোকটা শব্দ না করে শুয়ে থাকতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। আবার পাশ ফিরে শু’লো। আমিও নড়লাম, যাতে ও বুঝতে পারে যে আমি জেগে আছি। দশ বছর শিকাগোতে বাস করেছে ও। উনিশশো চৌদ্দ সালে তারা ওকে সৈনিক হিসেবে নিয়ে নেয়। ও তখন পরিবারের সাথে দেখা করতে বাড়ি এসেছিল। ইংরেজি বলতে পারে বিধায় ওরা ওকে আমার কাছে পাঠায়। আমার নড়াচড়ার শব্দ শুনছে ও, টের পাই। আবার কম্বলের ভেতর নড়াচড়া করলাম।
‘ঘুম নেই, সিনর টেনেন্ট?’ জিজ্ঞাসা করে ও।
‘নাহ।’
‘আমিও ঘুমাতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘জানি না, ঘুম আসছে না।’
‘সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ, সব ঠিক। এমনি ঘুম আসছে না।’
‘কিছুক্ষণ গল্প করতে চাও?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘নিশ্চয়ই। এই জঘন্য জায়গায় শুয়ে আমরা কী নিয়ে গল্প করতে পারি?’
‘জায়গাটা ভালোই।’
‘নিশ্চয়ই,’ ও বলল। ‘ঠিকঠাক।’
‘শিকাগো সম্পর্কে বলো কিছু,’ আমি বললাম।
‘একবার বলেছি আপনাকে,’ বলল ও।
‘তোমার বিয়ের গল্পটা বলো।’
‘ওটাও বলেছি আপনাকে।’
‘সোমবার স্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছ না?’
‘হ্যাঁ, ও আমাকে সব সময়ই লেখে। ভালো টাকা কামাচ্ছে।’
‘ফিরে গিয়ে ভালো একটা থাকার জায়গা পাবে তাহলে।’
‘হ্যাঁ, জায়গাটা ভালোই চালিয়ে নিচ্ছে ও। অনেক পয়সা কামাচ্ছে।’
‘অন্যদেরও কি জাগিয়ে দেব কথা বলার জন্য?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘না, ওরা শুনবে না। শুয়োরের মতো ঘুমায় একেকটা। আমি অন্যরকম,’ বলল সে। ‘আমি নার্ভাস।’
‘আস্তে বলো,’ আমি বললাম। ‘সিগারেট খাবে?’
অন্ধকারের ভেতর আমরা সিগারেট খেতে লাগলাম।
‘আপনি তেমন ধূমপান করেন না, সিনর টেনেন্ট।’
‘না, ছাড়ার চেষ্টা করছি।’
‘বেশ,’ বলল ও। ‘এভাবে ছাড়া যায় না। আপনি তবু মাঝে মাঝে ধূমপান করেন, যাতে মিস না করতে হয় জিনিসটাকে। সেই অন্ধ লোকটির গল্প শুনেছেন, ধোঁয়া দেখতে পেত না বলে ধূমপান করত না কখনো?’
‘আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘আমারও মনে হয় এটা গাঁজাখুরি গল্প,’ সে বলল। ‘আমি একজনের কাছ থেকে শুনেছি। আপনি তো জানেন, শোনা কথা কীভাবে বদলায়।’
দুজন চুপ করে রইলাম সামান্য, গুটিপোকাগুলো কুটকুট শব্দ করে পাতা খাচ্ছে।
‘ওই বিশ্রী পোকাগুলোর শব্দ পাচ্ছেন?’ জিজ্ঞাসা করল সে। ‘ওদের চিবানোর শব্দ শোনা যায়।’
‘চিবানোর শব্দ, হ্যাঁ, হাস্যকর,’ বললাম আমি।
‘আচ্ছা, বলুন তো সিনর টেনেন্ট, আপনি আসলেই কেন ঘুমাতে পারছেন না? আমি আপনাকে কখনোই ঘুমাতে দেখিনি। আপনার সাথে যখন থেকে আছি, রাতের বেলা আপনাকে ঘুমাতে দেখি না একদিনও।’
‘আমি জানি না, জন,’ বললাম। ‘বাজে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে গত বসন্ত থেকে। রাতের বেলা ঘুম হয় না।’
‘একদম আমার মতো,’ বলল সে। ‘আমি এই যুদ্ধের ভেতর একদিনও ঘুমাতে পারিনি। আমি একটু বেশিই নার্ভাস।’
‘ঠিক হয়ে যাবে হয়তো।’
‘সিনর টেনেন্ট, বলুন তো আপনি কেন এই যুদ্ধে আসতে গেলেন?’
‘জানি না, জন। আসতে চেয়েছিলাম, তাই হয়তো।’
‘চেয়েছিলেন?’ সে বলল, ‘অর্থহীন একটা কারণ দেখালেন।’
‘আমাদের জোরে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না,’ বললাম।
‘ওগুলো শুয়োরের মতো ঘুমায়। ইংরেজিও বোঝে না। কিচ্ছু জানে না ওরা। যাই হোক, যুদ্ধ শেষ হলে কী করবেন, দেশে ফিরে যাবেন?’
‘খবরের কাগজে একটা চাকরি নেব।’
‘শিকাগোতে?’
‘হয়তো।’
‘ব্রিসবেনের এই সাংবাদিক কী লিখেছে, পড়েছেন? আমার স্ত্রী এগুলো কেটে আমাকে পাঠায়।’
‘হ্যাঁ।’
‘কখনো সাক্ষাৎ হয়েছে?’
‘না, তবে আমি তাকে দেখেছি।’
‘আমি এই লোকের সাথে দেখা করতে আগ্রহী। বেশ ভালো লেখে। আমার স্ত্রী ইংরেজি পড়ে না। কিন্তু খবরের কাগজ রাখে, তার লেখাগুলো কেটে আমাকে পাঠায়।’
‘তোমার বাচ্চাকাচ্চা কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। এক মেয়ে ক্লাস ফোরে উঠল। আপনি জানেন সিনর টেনেন্ট, আমার যদি বাচ্চাকাচ্চা না থাকত তাহলে আমি এখানে আপনার অধীনে থাকতাম না, ওরা আমাকে যুদ্ধের লাইনে পাঠিয়ে দিত।’
‘আমি খুশি যে তোমার বাচ্চাকাচ্চা আছে।’
‘আমিও। ওরা লক্ষী মেয়ে। কিন্তু আমি একটা ছেলে চাই। মেয়েগুলো নিশ্চয়ই ছেলের শখ পূরণ করতে পারবে না।’
‘তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো এখন।’
‘এখন ঘুমাতে পারব না। ঘুম কেটে গেছে। সিনর টেনেন্ট, আমি আপনার না ঘুমানো নিয়ে চিন্তিত।’
‘আমি ঠিক আছি, জন।’
‘ভাবা যায়, আপনার মতো একজন তারুণ্য ভরপুর মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না?’
‘আমি ঘুমিয়ে পড়ব। একটু সময় লাগবে শুধু।’
‘আপনার এই অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। একজন জেগে থাকা ব্যক্তি একা থাকতে পারে না। আপনার কি কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়?’
‘না, জন। ওরকম কিছু না।’
‘সিনর টেনেন্ট, আপনি বিয়ে করে ফেলেন। তাহলে দেখবেন আর চিন্তা নেই।’
‘জানি না।’
‘আপনার বিয়ে করা উচিত। কাউকে বেছে নিচ্ছেন না কেন, অনেক অর্থবিত্তের মালিক কোনো ইতালীয় মেয়েকে বেছে নিন। আপনি চাইলে যে কেউ রাজি হয়ে যাবে। আপনি যুবক, সুদর্শন, কয়েকবার লাইনে গিয়ে আহতও হয়েছেন।’
‘আমি ওদের ভাষাটা ভালো জানি না।’
‘যথেষ্ট জানেন। ভাষা চুলোয় যাক। ওদের সাথে আপনার কথা বলতে হবে না। স্রেফ বিয়ে করে ফেলেন।’
‘আমি ভেবে দেখব।’
‘আপনি অনেক মেয়েকেই চেনেন, তাই না?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘বেশ। এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি টাকা যার আছে, তাকে বিয়ে করুন। খুব ভালো স্ত্রী হবে আপনার।’
‘আমি ভেবে দেখব।’
‘ভেবে দেখতে হবে না সিনর টেনেন্ট, করে ফেলুন।’
‘আচ্ছা।’
‘একজন মানুষের অবশ্যই বিয়ে করা উচিত। এটা নিয়ে কখনো অনুশোচনা হবে না। প্রত্যেকরই বিয়ে করা প্রয়োজন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো এবার ঘুমানোর চেষ্টা করা যাক।’
‘ঠিক আছে, সিনর টেনেন্ট। আবার ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আপনি আমার কথাটা মনে রাখবেন।’
‘আমার মনে থাকবে,’ বললাম। ‘এখন একটু ঘুমাও, জন।’
‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘আশা করি আপনারও ঘুম হবে, সিনর টেনেন্ট।’
কম্বল মুড়িয়ে শোবার শব্দ পেলাম ওর, এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা। ওর স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কানে এলো। তারপর নাক ডাকতে শুরু করল। দীর্ঘক্ষণ ওর নাক ডাকার শব্দ শুনলাম। এরপর নাক ডাকার শব্দ শোনা বাদ দিয়ে গুটিপোকাগুলোর কুটকুট করে পাতা খাবার শব্দ শুনতে থাকি। ধীরে ধীরে খায় পোকাগুলো। ভাববার নতুন একটা জিনিস পেয়েছি। অন্ধকারের মাঝে চোখ খুলে শুয়ে শুয়ে এ যাবৎ আমার চেনা সমস্ত মেয়েদের নাম এবং তারা স্ত্রী হিসেবে কী রকম হতে পারে, তাই ভাবতে থাকি। ভাবনাটা আগ্রহ উদ্দীপক। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্য আমার মাছ ধরা আর প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটাল। শেষে আবার ট্রাউট মাছ ধরতে গেলাম আমি। কারণ প্রতিটি স্রোত আলাদাভাবে দেখতে পাই আমি। সব সময়ই এতে নতুন কিছু থাকে। আর মেয়েগুলোকে ভাবলে কিছুক্ষণ পর ওদের মুখ ঝাপসা হতে শুরু করে, এরপর মিলিয়ে যায়। সবগুলো মেয়ে যখন ঝাপসা হয়ে গেল, আমি সবগুলো ভাবনাই বাদ দিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলাম। জনের জন্য প্রার্থনা করলাম। অক্টোবরে ওর র্যাংক একটিভ সার্ভিস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি খুশি যে, এজন্য ওকে যুদ্ধে পাঠানো হবে না, নয়ত ওর জন্য খুব দুশ্চিন্তা হতো আমার।
কয়েক মাস পর সে মিলানের এক হাসপাতালে আসে, আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়। আমি তখনো বিয়ে করিনি শুনে সে ভীষণ হতাশ হয়। আমি জানি, ও জানলে কষ্ট পাবে যে আমি তারপর বহুদিন বিয়েশাদি করিনি। সে তখন আমেরিকা ফিরে যাচ্ছিল। বিয়ের ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। সে জানত, বিয়ে সব সমস্যা সমাধান করে দেবে।
কবি ও অনুবাদক। জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১; মানিকগঞ্জ। রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতোকোত্তর। সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘তীরন্দাজ’ ও ‘অকালবোধন’-এ। প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতাগ্রন্থ : ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [২০১৬, অনুপ্রাণন]; অগ্রন্থিত ওহী [২০১৯, তিউড়ি]। অনুবাদগ্রন্থ : ললিতা – ভ্লাদিমির নবোকভ [২০১৬]; ইসমাইল কাদারে’র কবিতা [২০১৭, তিউড়ি]; সেরা ২০ ছোটগল্প – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে [২০১৮, পাঞ্জেরী]; দক্ষিণে – সালমান রুশদি [২০১৮, চৈতন্য]; আমক – স্তেফান সোয়াইগ [২০১৯, জেব্রাক্রসিং]