আদতে এই বইতে রয়েছে ভিন্ন কিছুর ইশারা। মারণরক্তে প্রবাহিত ফানাফানা শব্দের হিমায়িত গোপন কোলাজে মিলবে প্রাণ-প্রকৃতি, আবেগ-অনুভূতি, বাঁচামরা, জটিল দৃশ্যের গভীর থেকে তুলে আনা লাল কুণ্ডলীর অণু-দৃশ্যায়ন কিংবা নিকটকে দূরে ফেলার থকথকে আরাধনা। বলা যেতে পারে, বেদন-সংবেদের মহিমায় চেনারূপকে ভেঙে-চুরে নতুন রূপে দেখার এ আমার গূঢ় প্রণোদনা।
তখনও অতিমারির আভাস ফুটে ওঠেনি পৃথিবীতে। লিখন-কারখানায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে শব্দ। ঝকমারি দোলনায় তার কোনো দোলাচল নেই। নিষ্ফলা খেতের কিনারে কুয়াশা-ভাষা এসে ফিরে যাচ্ছে। কামনাশূন্য মায়াঞ্জলি ধোঁয়া-ধূসর কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের ওপারে। রক্তজবার বাগান লালে লাল। যেন এক বৃহৎ লুপ্ত-গালিচা বুক পেতে বসে আছে। কার জন্য? কে জানে? শীত যায়। বর্ষা যায়। গ্রীষ্ম যায়। সে আসে না। ঝটফটানি। রেললাইন রেললাইন। ঝকাঝক ঝকাঝক। যেন এক মৌন হাহাকারের মাঠ থেকে ধীর কদমে বুকের কাছে এসে টোকা মারে হিম যন্ত্রাংশের ভাষাবলয়। অনুচ্চ পাখায় মেলে ধরে তার যাতনার যতি।
২০১৭ সাল থেকে লেখা শুরু হয় এই পাণ্ডুলিপির। ছেদ-বিচ্ছেদে এগুতে থাকে কবিতাগুলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। মহাবিষাদের এক গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতে উঁকি মারে। পঙ্ক্তির ফাৎনা একবার ডোবে, আবার ভুস করে ভেসে ওঠে। আলো-আঁধার, শিউলির গন্ধ, ডুমুর বাগান পেরিয়ে ছুটতে থাকে পা। চলে। চলতেই থাকে। এ যেন অধরাকে ধরার এক বিপুল সাধনা। সাধন চলে। ভোজন চলে। পা চলে। ট্রেন চলে। ঢাকা যায়। রাজশাহী আসে। সমুদ্রে যায়। পুকুরে ভাসে। ধান পোড়ে। শ্রমিক পেটায়। যন্ত্র চলে। দম আসে, নির্দম থাকে। এই মানব শরীর হিম হয়ে যায়।
অভিজ্ঞতাকে আমি মহান বক হিসেবে মানি। শাদা বক। শান্তি ফিনকির এক ধ্যানগুহা। ভাষাজাদুর এক শান্ত মেদুরে লেখা এই কবিতাগুলো একটু রয়েসয়ে, স্থির মনে পাঠ করলে তার স্বরূপ উন্মোচন করে। ঘরের দরজা পার করে ঘোরের জানালা খুলে দিতে পারে। রক্তারক্তি, জোঁকের জাকামদানিতে ভরা এই সমাজে এর মূল্য শূন্য ছাড়া আর কিছু নয়। বাজারে-মাজারে গান ভেসে যায়। কে বড়ো, কে ছোটো—এই ঢোল না বাজিয়ে কোনো মহাবৃক্ষের কাছে নিজেকে সমর্পিত করাকে শ্রেয় মনে হয়। নদীমাতার বিশাল স্নেহে বেড়ে উঠতে উঠতে এই গ্রন্থের কাব্য, আছড়ে পড়ে প্রমিতপাগলের সেই জির্ণ কুটিরে রাখা মৌনমুকুরে—ধীর গুঞ্জনে…
আমার সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ ‘ডুমুরের আয়ু’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের বইমেলায়। আর ‘হিম যন্ত্রাংশ’ চার বছর বিরতি দিয়ে প্রকাশনার মোড়ক পরলো। আদতে এই বইতে রয়েছে ভিন্ন কিছুর ইশারা। মারণরক্তে প্রবাহিত ফানাফানা শব্দের হিমায়িত গোপন কোলাজে মিলবে প্রাণ-প্রকৃতি, আবেগ-অনুভূতি, বাঁচামরা, জটিল দৃশ্যের গভীর থেকে তুলে আনা লাল কুণ্ডলীর অণু-দৃশ্যায়ন কিংবা নিকটকে দূরে ফেলার থকথকে আরাধনা। বলা যেতে পারে, বেদন-সংবেদের মহিমায় চেনারূপকে ভেঙে-চুরে নতুন রূপে দেখার এ আমার গূঢ় প্রণোদনা।
ফুলদানিতে গুঁজে রাখা জীবনে নানা ছলদৃশ্য আসে। তরমুজ ফালির মতো সেই দৃশ্যগুলো সাজিয়ে রাখার এক গুপ্ত প্রণোদনা পাই ‘হিম যন্ত্রাংশ’ কবিতাবইয়ের পাণ্ডুলিপি গোছানোর সময়। দীর্ঘ এক বছর চলে পাঠ এবং সংযোজন-বিয়োজন। কাব্যকরাতে কেটে ফেলতে হয় অনেক কবিতা। যা চিরমহাশূন্যে হারিয়ে যায়। আর ফিরবার তার কোনো ইশারা নেই। বিশে বিষময় ২০২০। চূড়ান্ত হয় পাণ্ডুলিপি। রাত্রি গড়িয়ে সূর্যস্নানে নিজেকে মেলে ধরতে এই অতিমারির বইমেলায় এসেছে—‘হিম যন্ত্রাংশ’। প্রিয় পাঠক, মানবযন্ত্রের যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে একটু নিশ্বাস নিয়ে পাতা উলটান হিম যন্ত্রাংশের। আর চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধ এক প্রজাপতিকে কল্পনা করুন।
বিজ্ঞাপন
প্রিয় লেখক, ২০২১ গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আপনার বইটি নিয়ে লিখুন ‘আমার বই’ বিভাগে। লেখা পাঠান আমাদের ইমেইলে। সঙ্গে আপনার এবং বইয়ের পরিচিতিমূলক তথ্য এবং ছবি। লেখা পাঠানোর মেইল : editor.sreebd@gmail.com
কবিতা ও গল্প লেখেন। লেখালেখির ঝাউবাংলোয় মগ্ন থাকাই তার আরাধ্য। জন্ম ও বেড়েওঠা পদ্মাপারের রাজশাহীতে। জীবন-নির্বাহের জন্য কাজ করেন গণমাধ্যমে। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৫ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে ‘ডুমুরের আয়ু’ গ্রন্থের জন্য বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রকাশিত গল্পের বই ‘সান্ধ্য মাংসের দোকান’।