আকাশ সামিয়ানার নিচে আমাদের একরৈখিক পথচলা। কোনো ইশারায় পথের সমাপ্তি যেখানে হয়— সেটাই আমাদের গন্তব্য। পথ এবং পথিকের এ অনির্ণয় ও দোলাচল আজীবন থেকেই যায়। নিরঙ্কুশ কোনো কার্যকারণ কেউ খুঁজে পায় না। পথের ধারের যে ঘাসে শিশিরের জল থাকে সকালের রোদে সেও মাটির শরীরকে শীতল করে।মানব মনের বিচ্ছিন্ন অনুভূতি ও ঘোরের এক অভিন্ন দোলাচল কাজ করে সময়ে অসময়ে।
কেউ কেউ না বুঝে ছুটছে এক অনিশ্চিত গতিবিধি মেনে। বিরামহীন এ ছুটে চলার না আছে উদ্দেশ্য না আছে স্পষ্টতার ছোঁয়া। একটা পাখির মতো যদি আশপাশ দেখি ও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি কিছু অনুভূতি ধরা দেয় মনে মনে। হয়তো একটা শাদা বক কিংবা হলুদ পায়ের শালিকের মতো এদের আনাগোনা। এ অনুভূতিরই সমন্বয় ‘কদম ফুলের মহরত’।
গ্রামীণ ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে নদীর জল ও তার স্রোত, মেঘের শরীর ও আরও স্বচ্ছ কোনো পল্লীর মায়াভরা সন্ধ্যা ইত্যাদির ভেতরে যে ব্যঞ্জনা আমি শুনেছি, তা তুলে আনার চেষ্টা করেছি এ কাব্যে। অধিকাংশ কবিতা ২০২০ সালে লেখা, তবে কদম ফুলের মহরত বইয়ের নাম কবিতাটা ২০১৯ সালে লেখা। পনেরোটা বারো লাইনের দুই স্তবক বিশিষ্ট কবিতা হিসেবে লেখা হলেও দীর্ঘ সময় পর কয়েকবার কাঠামো পরিবর্তন ও সম্পাদনা করে চূরান্ত রূপ নির্ধারণ করা হয়েছে।
আবেগ মানুষের ব্যাক্তিগত বন্ধু, বাস্তবতার সাথে নানা রঙের সমন্বয় করতে চাওয়া বিষয়গুলোকেই টুকরো অনুভূতির সাথে মিলন ঘটিয়ে আমি বাস্তবতার দিকে ধাবিত করেছি। একটা ছুঁয়ে যাওয়া আর্তনাদ রঙিন বৃত্তের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বপ্ন, বাস্তবতা, পথ ও চিরসত্য পরিমণ্ডলে চিত্রায়িত করতে চেয়েছি এই কাব্য।
অতীত আমাদের কাছে এক বিরান পাথার, সেখানে শস্য ফলার কথা থাকলেও আমরা এড়িয়ে যাই। যে ফুলের সুবাসে আমাদের প্রাণচঞ্চল থাকার কথা ছিল আমরা সে সুবাসে ফিরি না। অজ্ঞাত সত্যেরা পরম্পরায় পথ ভুলে কোনো দিকে ধাবিত হয় আর খুঁজে নেয় নিবাস, এই বিন্যাসে এগিয়ে যাওয়ার একটা সচেতন অথবা অসচেতন চেষ্টা আছে কবিতাগুলোতে।কবিতার কোলাহলে একটা অসচ্ছলতাও যেন স্বচ্ছতার পথ খুঁজে নেয়, ছুটতে থাকে চূড়ান্ত পথের খোঁজে।
সমান্তরাল পথে চলতে চলতে কখনো মানুষ অজান্তেই ঘোরের বসতিতে প্রবেশ করে, কখনো-বা বের হয়েও আসে। গাছ থেকে যে পাতা ঝরে যায় বা ফুল শুকিয়ে পড়ে মাটির শরীরে তার ভাষা তো মাটিই সবচেয়ে ভালো বোঝে। আমাদের অজান্তে কত নদী চলতে চলতে বাধাগ্রস্ত হয়, সবকিছু আমাদের জানা সম্ভবও নয়, হয়তো জানার চেষ্টাও করি না। অজানা রূপের এক প্রস্তাবিত প্রণয় এ কাব্যে উঠে আসে বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গকে সাথে নিয়ে। গ্রামীন জনপদের স্বচ্ছ আবরণের সাথে কিছুটা সমন্বয় ঘটেছে নগর রহস্যের। বাস্তবতাই বিহ্বল মূর্ছনায় প্রকাশিত হয়েছে আপন মনে।
সখ্য ও সাময়িক রূপভেদে পারিপার্শ্বিকতাকে ছাপিয়ে ওঠার মধ্যেই আনন্দ। মলিন বস্ত্রের বিপরীতে যেমন গূঢ় তত্ত্ব থাকতে পারে তেমনই চাকচিক্যময় পরিবেশে থাকতে পারে মেকীর ছায়া। সবকিছু সাথে নিয়ে সমন্বিত মূর্চ্ছনা সৃষ্টির তাগাদা দিতে চায় কবিতা। এ কাব্যে এমন কিছু বিষয়েরই উপস্থিতি দেখানো হয়েছে যা চিরন্তন, অর্থবহ ও যথাবাস্তব আবেদন রাখে।প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাবর্তন ও পরিমণ্ডলের কলরব যেন বড়ো না হয়ে অন্তরে বাজে এক রূপালি ঋতু্। এমনই এক চাওয়া কাজ করেছে অধিকাংশ কবিতায়।
গৃহনির্মাণের যে শৈলী বা কারুকার্য থাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে মনের ভিত্তিও যেন তৈরি হয় সত্যতা মেনে। মানুষের মন এক সমৃদ্ধ গৃহ। যে আওয়াজ এখানে ধ্বনিত হয় সুস্পষ্ট কোলাহলে—তারই বাণী-বিন্যাস ফুল হয়ে উঠে আসে কাব্যে। প্রকাশভঙ্গী ও মননের পরিচয় সেজে ওঠে কাবিতার শরীরে। এখানে রাতের জোছনার মতো আঁধারে আলোর যে হাওয়া— তেমনই একটা সত্যের প্রতিফলন যেন চমকে উঠতে চায়, যদিও তা দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়ার ব্যাপার কিছুটা।
এই জগৎ সংসারের সব কিছুই ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভাবনার পথের দিকে চেয়ে থাকে। একটা টান সবসময়ই মানুষকে খেয়ালি বা সত্য পথের আলোর দিকে ধাবিত করে। এই ছু্ঁয়ে যাওয়া অনুভূতিরই সমন্বয় ঘটেছে এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে। প্রচলিত অভিজ্ঞানের বাইরে গিয়েও যদি চিরসত্য পথে এগোতে হয় সেটাই শ্রেয়। কবিতা একটা পথ অতিক্রম করতে শেখায়, যে পথে ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা, সত্য, খেয়াল ইত্যাদির সমন্বয় ঘটে অনায়াসে। ‘কদম ফুলের মহরত’-এ একটা পবিত্র সুররের সৃষ্টি করতে চাওয়ার বিষয় কাজ করেছে।
তবুওতো কবিতা এক অনির্ণেয় সংঘাতেরই নাম, বোধ ও চিরবাস্তবতার মুসাবিদা বিশেষ। কবিতার কলাকৌশল ও ভাবের মূর্ছনা একেক জনের কাছে একেক সময় একেকভাবে ধরা দিতে পারে। যাবতীয় ক্লেদ ঝেড়ে ‘কদম ফুলের মহরত’ এর পাতা উল্টালে পাওয়া যেতে পারে স্বচ্ছ চিন্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য বাস্তবতার রূপ।
বিজ্ঞাপন
প্রিয় লেখক, ২০২১ গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আপনার বইটি নিয়ে লিখুন ‘আমার বই’ বিভাগে। লেখা পাঠান আমাদের ইমেইলে। সঙ্গে আপনার এবং বইয়ের পরিচিতিমূলক তথ্য এবং ছবি। লেখা পাঠানোর মেইল : editor.sreebd@gmail.com
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নাটোর জেলায়। বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়নরত। কবিতায় পেয়েছেন ‘জলধি’ তরুণ লিখিয়ে পুরস্কার ২০২১।