এবারের বৈশাখ এসেছে ভিন্নতর এক রুপ নিয়ে। গেল দিনে গ্রামে গিয়ে পাড়াতো ভাই নূরুকে বললাম— ঘোড়া কই তোমার? আনো, একটা পাক দিয়ে আসি। প্রায় যায় যায় বসন্তের বাতাবরণে সে হাসে, গায়ে সাদা একখান চাদর জড়ায়ে। বলে— ‘চোত মাসের জারে ঘোড়া তো আমার আউরে গেছে ভাইজান!’ কী কাণ্ড! অথচ এই গ্রীষ্মে, বৈশাখের প্রচণ্ড তাপদাহে ভ্যাপসা-গুমোট গরমে দশ কিলো ছুটে এসেও কেমন কেশর দুলিয়ে হাসত সে। কী বিকট বোটকা গন্ধ! মগজ ফুঁড়ে আমার স্মৃতির মধ্যে সাঁই সাঁই করে ঢুকে যেত। ঋতুর কী আচানক দুর্ব্যবহার। বসন্তকে সামান্য দোলা দিয়ে গ্রীষ্মকে পাশ কাটিয়ে একেবারে বর্ষায় ঠাঁই করে নিতে চাচ্ছে এবারের বৈশাখ।
আহা! কোথায় সেই চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠঘাট। মেঠোপথের দু’পাশে আকন্দ আর ভাঁটফুল? ঘোড়া হাঁকিয়ে ধুলো উড়িয়ে নূরু যাচ্ছে ওকরাওঠার মেলায়। বাবা আয়েজ উদ্দিনকে জাপটে ধরে। আমি ফোকলাবুড়ো বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম এমনই দৃশ্য, নানান জ্যামিতিক আকারে। শুনি, দূরে দূরে আরও মেলা বসেছে। বৈশাখের বিবিধ অনুষঙ্গকে প্রসারিত করে। গড়ে মাসব্যাপী সেসব মেলায় আমি বৈশাখকে দেখেছি বিবিধ রহস্যকে ভেদ করে। মেয়ে-মরদ, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে কে আসেনি সেই ঘটনার সাক্ষী হতে? ওই যে ছাঁচের পুতুল। হাতি-ঘোড়া। লটকে আছে সুতায় বেঁধে। ওদিকে যাত্রা হচ্ছে—আজকের পালা লাইলি-মজনু। আম ধরেছে গাছে গাছে, কচি-কিশোর। তার জন্যই সাদা-বাঁটের লোভনীয় চাকু। মুড়কি-মোয়া-বাতাসা, জিলাপি আর জলকদমা এতটাই যে মনে হতো স্তূপের পর স্তূপ। আহা! রেশমি চুড়ি। লাল ফিতে আর আলতা স্নো। চুলের কাঁটা, বাঁশের বাঁশি। ঘুড়ি-লাটাই। ধুলোর মাঝেই ধুম পড়ে যেত কেনাকাটার। গফুরের চাই লাঙল-জোয়াল। কেউ বা কিনত কাস্তে, ফলা। ঝাঁঝাল লাল মরিচের সাথে মেথি, আদা, রসুনের গন্ধে ঝিমঝিম করত মাথা। এমনই বৈচিত্র্যময় বৈশাখের ঘন সন্ধ্যায় জোনাক পোকার মতো থোকা থোকা কেরোসিনের কুপির সঙ্গে মিলেমিশে থাকত হ্যাজাকের হাস্যোধ্বনি। কী মায়া! কী মানবতা! কী হাসি আর সৌহার্দ্যরে ঝলক দেখেছি আমি। পাকুড় গাছের নিচে আঠার মতো আটকে থেকে রাতভর শুনেছি আলকাপ। গম্ভীরা আর বাঙলার মাটি চিরে উঠে আসা ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি। শুনেছি তন্ত্র-মন্ত্র। দেখেছি সাধু-সন্ত। বাউল, ফকির, সন্ন্যাসী। জাদুর মধ্যে মধুর হাসি।
বৈশাখ কি কেবলই মেলাকেন্দ্রিক? না না, তা হবে কেন! বৈশাখ আসে তার মাহাত্ম্য নিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে। বিগত বছরের সকল মলিনতাকে মুছে ফেলে সে এসে দাঁড়ায় শুভ আর শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে। মন বলে— ওপারে তুমি বাঁধা এপারে আমি শ্যাম।
ঘটনা হলো, এ তো গেল মেলার মধ্যে মেলা-কাহিনি। বৈশাখ কি কেবলই মেলাকেন্দ্রিক? না না, তা হবে কেন! বৈশাখ আসে তার মাহাত্ম্য নিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে। বিগত বছরের সকল মলিনতাকে মুছে ফেলে সে এসে দাঁড়ায় শুভ আর শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে। মন বলে— ওপারে তুমি বাঁধা এপারে আমি শ্যাম। তার আগমনে প্রকৃতি ধন্য হয়। স্তম্ভের মতো বছরের শুরুতে অসহায়কে সাহস জোগাতে সে বলে, ভয় কী? আমি তো আছি, এসে গেছি। আর এই বিশ্বাসকে সাথী করে তাকে আচ্ছামতো খুঁজে পেতে আজও আমি শহর-গ্রাম একাকার করে চষে বেড়াই।
এই যেমন আমাদের মুন্নুর ছেলে বেঞ্জামিন। সদ্য দাড়ি-গোঁফ ওঠা তুর্কি-তরুণ। আমি বলি— তোমার নামটার মধ্যে কি জানি একটা আছে! কেমন গা ছমছম করে। সে মৃদু হাসে। বলে— বাবায় রাখছে। কেন, শুনতে খারাপ লাগে? আমি বলি— তা কেন! আসলে পরিবর্তনের কেমন একটা গন্ধ এসে কানে লাগে। এই যে, যে পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি আমরা এর দু’পাশে সারি সারি গাছ ছিল। ইয়া মোটা মোটা। আমার ছেলেবেলায় দেখেছি। শিমুল, পলাশ, পীতরাজ, বট-পাকুড়, তেঁতুল, ভাঁটকড়ই। আজ সব হাওয়া। সে খানিকটা সাহস বুকে টেনে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে— হ্যাঁ, ছিল বটে। দেখিনি, শুনেছি। নতুন পাকা রাস্তা হলো। টেন্ডারে সব কাটা পড়ছে। গাছ গেছে বাট পাকা রাস্তার কল্যাণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। এটা তো মানেন? বলি— তা মানি। যুক্তি আছে তোমার ভাষণে। তবে যুগের ধুয়া তুলে পুরাতনকে বলি দিয়ে সব যদি নতুন করে করতে চাও তবে শিকড় যে উপড়ে পড়ে বেটা। ধরো, এই যে আমাদের বৌছি, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কুতকুত, কানামাছি— এগুলো আজকাল খেলে কেউ? তুমি বা তোমার পরের প্রজন্ম? সে হাসে। খেলা তো দূরের কথা কাকা, হয়তো নামই শোনেনি দেখেন গিয়ে। দুঃখ হয় বুঝলে বেঞ্জামিন। সে ফেসবুক চালাতে চালাতেই বলে— হুম, তা বটে। আচ্ছা তোমরা ষাঁড়ের লড়াই দেখেছ? মোরগ লড়াই? মনে হয় দেখোনি। বৈশাখে প্রচণ্ড ঝড় হতো বুঝলে, সে কী বিদ্যুৎ-বাজ! কার ছনের চালা, কার ছ্যাঁচার বেড়া যে কার বাড়িতে গিয়ে পড়ত! কার টিন কার তালুকে উড়ে গিয়ে পড়ত! বেঞ্জামিন বলে— সেদিনের সত্যি কবে বিলাই খাইছে, দেখেন না সব কেমন পাকা বাড়ি, শক্ত আর ফকফকা। ওড়াউড়ির বালাই নাই।
কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষকের প্রধান অস্ত্র লাঙল-বলদ। তাকে নিশ্চিহ্ন করে স্থান করে নিয়েছে যন্ত্রচালিত ট্রাক্টর। ডোঙা-সেতির স্থানে বিকট শব্দে পানি উগরে দিচ্ছে শক্তির শ্যালো। বুঝি, সময় এক সহজাত শয়তান।
হাঁটতে হাঁটতে মাঠের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। সবুজের ছোঁয়া এখনও টিকে আছে বটে। তবে বসতি চাপতে চাপতে খেতকে দখল করে নিচ্ছে দিনকে দিন। কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষকের প্রধান অস্ত্র লাঙল-বলদ। তাকে নিশ্চিহ্ন করে স্থান করে নিয়েছে যন্ত্রচালিত ট্রাক্টর। ডোঙা-সেতির স্থানে বিকট শব্দে পানি উগরে দিচ্ছে শক্তির শ্যালো। বুঝি, সময় এক সহজাত শয়তান। এই মাঠে কত প্রকারের ধান হতো জানো? সেই আউশ ধানের পান্তা। বিন্নি ধানের খই। কীভাবে, কখন হারিয়ে গেল কই! বেঞ্জামিন বলে— সে তো এখন আপনাদের শহুরে, সভ্যদের খাবার। সাথে লাগান হাজার টাকার ইলিশ! শুনে আমি অবাক হই। তাকে কী করে বুঝাই এসবই বাংলার চিরায়ত খাবার। কর্পোরেটের কালপ্রিটরা এভাবেই খাদ্যে, খেলায়, আচারে, প্রথাতে, পোশাকে, বিয়ে-পার্বণ, রুচিতে সৃষ্টি করছে কৃত্রিম এক ভেদ। তোমাকে আমার থেকে দিনকে দিন দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ঢুকিয়ে দিচ্ছে জাতের মধ্যে জালিয়াতি। শ্রেণির মধ্যে শোষণ।
দেখো, ছোটবেলায় আমরা কত কেচ্ছাকাহিনি, রূপকথা শুনেছি আমাদের দাদি-নানিদের কাছ থেকে। শিখেছি, জেনেছি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যুৎপত্তি আর তার চলমান ধারা। এখন উপায় আছে? সন্ধ্যা হলেই টিভি তোমাকে দেখাচ্ছে, শোনাচ্ছে অজাত, অচ্ছুত, অশ্লীল, অবাস্তব সব কল্পকথা। তোমার কৃষ্টির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে কষ্টের বোঝা। চিন্তা করে দেখো বেঞ্জামিন, এই যে বৈশাখ, এই যে বাংলার ঋতুুবৈচিত্র্য, কত তার রূপ, কত গন্ধ! পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি। অথচ আমরাই আমাদের সর্বনাশ করে চলছি প্রতিনিয়ত। সংস্কৃতির চোরাফাঁদে পা দিয়ে শুধু বৈশাখ কেন পুরো বাংলাই আজ হুমকির মুখে।
এই যে বৈশাখ, এই যে বাংলার ঋতুুবৈচিত্র্য, কত তার রূপ, কত গন্ধ! পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি। অথচ আমরাই আমাদের সর্বনাশ করে চলছি প্রতিনিয়ত। সংস্কৃতির চোরাফাঁদে পা দিয়ে শুধু বৈশাখ কেন পুরো বাংলাই আজ হুমকির মুখে।
ভেবে দেখো, এই নদীতেই নৌকাবাইচ দেখেছি আমি। আজ নদী নেই। ভরাট হতে হতে খালও নেই। কাজেই নৌকা নেই । নৌকাবাইচও নেই। একতারা নেই তো বাউলও নেই। জারি-সারির মূল্য নেই। শিকড় যদি না থাকে বেঞ্জামিন গাছটা তবে বাঁচে কী করে? তুমি তো মাঝপথ থেকে হঠাৎ কিছু শুরু করতে পারবে না। তোমাকে অতীতনিঃসৃত হয়ে বংশপরম্পরায় তা বয়ে বেড়াতে হবে। কাজেই আমাদের হাজার বছরের অতীত, বিচিত্র ধনে ধন্য অকৃত্রিম প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্যের অপূর্ব লীলাক্ষেত্র এই বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিবিধ সম্পদকে সঙ্গী করেই তোমার-আমার বেঁচেবর্তে থাকা। সময়ের জাদুর চেয়ারে বসে সভ্যতার সংজ্ঞা তোমাকে চুম্বকের মতো টানবে। এক ঢেউ আছড়ে পড়বে অপর ঢেউয়ের ওপরে এটাই সত্যি। তারপরও তোমার সংস্কৃতির আপন ইশারায়, তোমার শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে, তোমার প্রথা-পার্বণকে—তথা বৈশাখকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখনই, আজই শিরদাঁড়াকে শক্ত করতে হবে। অনেক রক্ত ঝরিয়েছি বেঞ্জামিন, অনেক ঘাম। প্রকৃত বৈশাখের বাসনাকে যারা গলাটিপে মারতে চাইছে। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধের দুর্নাম তাকে রোধ করতে চাই শ্রেণিজাগরণ। তুমি তো সেই শ্রেণিরই একজন। সারাগায়ে লেগে আছে তোমার দ্রোহের পালক। এই বৈশাখ তোমার জন্য। তোমাকেই ডাকছে হে বালক!
কবি, প্রাবন্ধিক। জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ। প্রকাশিত গ্রন্থ : ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ), নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ), সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ), রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য), ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ), দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ), কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ), লুপ্ত সভ্যতার দিকে (কাব্যগ্রন্থ)