তারপর হলো কী শোনো। তন্ময় বুনো জন্তুর মতো এমন ক্ষেপাই ক্ষেপল, হুট করে জেরিনকে তালাক দিয়ে বসল। জেরিনের রাগ-ক্ষোভ মুহূর্তে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেল। বেভোলের মতো বসে পড়ল খাটে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তন্ময় তাকে তালাক দিয়েছে। যেন তন্ময় নয়, তন্ময়ের রূপ ধরে রয়না দিঘির পাড়ের বটগাছের জিনটা তার সামনে দাঁড়িয়ে। যেন এক্ষুণি সে তার গলা চেপে ধরবে। যুগপৎ ভয় আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল জেরিন। যাওয়ারই কথা। দুই বছরের প্রেম, কালানিপুর বাজারের শ্রীলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোতলায় দিনের পর দিন ডেটিং, তারপর মহা ধুমধামের বিয়ে। ছয় বছরে স্বামী-স্ত্রীতে বহুবার মান-অভিমান হয়েছে, ঝগড়া-বিবাদও হয়েছে, কিন্তু কখনো এতটা চরম পর্যায়ে যায়নি। বেশিরভাগ ঝগড়া হয়েছে বাড়িতে তন্ময়ের দেরি করে ফেরা নিয়ে। তার বিরুদ্ধে জেরিনের এই একটাই অভিযোগ। কখনো রাত এগারোটায়, কখনো বারোটায় বাড়ি ফেরে তন্ময়। আর রোজই বাইরে থেকে খেয়ে আসে। এসেই ঘুম। এক ঘুমে পরদিন দশটা। গা-গোসল ধুয়ে খেয়েদেয়ে মোটরবাইকটা নিয়ে আবার ভোঁ। বেচারি জেরিন সারাদিন একা।
একা হবে কেন? তার ছেলেমেয়ে আছে, শ্বশুর শাশুড়ি আর ননদেরা আছে; তাদের নিয়েই তো থাকতে পারে।
স্বামীর অভাব কি অন্য কেউ পূরণ করতে পারে? কোন মেয়ে না চায় স্বামী কাছে থাকুক, তাকে আদর-সোহাগ করুক, এদিক-সেদিক ঘোরাতে নিয়ে যাক। মেয়েরা ধনসম্পদে গলে না, গলে আদর-সোহাগে।
তা অবশ্য ঠিক। মেয়েদের মন খুব নরম হয়। তা তন্ময় বাড়ি ফিরতে এত দেরি করে কেন?
বোঝো না, চেয়ারম্যানের বেটা। আকায়েদ চেয়ারম্যান নামডাকওয়ালা লোক। কালানিপুরের দু-দুবারের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে সরকারি দলের উপজেলা কমিটির সহসভাপতি। তন্ময় যুবনেতা। কত কিছু মেন্টেইন করতে হয় তাকে। বন্ধু-বান্ধব, বিয়েশাদি, ওয়াজ-ওরশ, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি কখনো কখনো ছোটখাটো শালিস-দরবারও। ঠিকাদারি তো আছেই। তার ওপর ভাড়া দেওয়া দুটি পিকআপ ভ্যানের দেখভাল। ব্যস্ততার কি শেষ আছে তার? ইচ্ছে করলেই তো শুয়ে-বসে থাকতে পারে না।
বুঝতে পেরেছি। সংসারের প্রতি উদাসীন।
কিন্তু তন্ময় এটাকে উদাসীনতা বলতে নারাজ। তার কথা হচ্ছে, সে তো মদ-ইয়াবা খেয়ে, জুয়া খেলে, মেয়েলোকের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করছে না; সে টাকার পেছনে ঘুরছে। বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকলে তো টাকা হেঁটে হেঁটে ঘরে আসবে না। টাকার জন্য ছুটতে হয়। ছুটে ছুটে টাকা ধরতে হয়। এই টাকা তো কেবল তার জন্য নয়, জেরিনের জন্যও, তাদের দুই সন্তানের জন্যও।
অবশ্য তার কথায়ও যুক্তি আছে। কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল যে এতটা চটে গিয়েছিল?
কী আর হবে, রাত দেড়টায় ফিরেই ঘুম। সকালে এক কথা থেকে দুই কথা, দুই কথা থেকে তিন কথা। কথা বাড়তে বাড়তে হুট করে জেরিনের গায়ে তুলে বসল হাত। জেরিনও হাত গুটিয়ে রাখল না, দু-হাতে জোরসে ধাক্কা মারল তন্ময়কে। দরজার কোণায় লেগে তন্ময়ের পা গেল কেটে। স্বামীর গায়ে হাত! তন্ময়ের কি আর মাথা ঠিক থাকে! খাটের স্ট্যান্ডটা ভেঙে জেরিনকে দিল মার। জেরিনের চিৎকারে ছুটে এলো তার শাশুড়ি আর ননদেরা। রাগে-ক্ষোভে জেরিন তখন তন্ময়কে দিয়ে বসল একটা গালি। তন্ময় স্ট্যান্ডটা নিয়ে আবার মারতে যাবে, অমনি তার মা ধরে ফেলল তাকে। আর তখনই সে বলে বসল, তোরে তালাক দিলাম। তিন তালাক। আজ থেকে আমার ভাত তোর জন্য হারাম।
কী কাণ্ড! তার মাথায় কি ভূত চেপেছিল?
ভূতই চেপেছিল বটে। মানুষের তো ভালো-মন্দ দুটি সত্তা। মন্দটাই হচ্ছে ভূত। এই ভূত ঘুমিয়ে থাকে। জেগে উঠলে মানুষটি আর মানুষ থাকে না, হিংস্র জন্তুর অধম হয়ে ওঠে।
ঠিক। তন্ময়ও তখন জন্তু হয়ে উঠেছিল।
হুঁ। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই তবদা। তন্ময়ের মা কষে এক চড় মারল ছেলের গালে। স্ট্যান্ডটা বাইরে ছুড়ে জেরিনের গোত-গোষ্ঠী ধরে গালাগাল করতে করতে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে গেল তন্ময়। জেরিন বসে থাকে নির্বাক। মনে পড়ে আরাফাতের কথা। কামরুল মেম্বারের ছেলে আরাফাত। সারাক্ষণ তন্ময়ের পিছে পিছে থাকে। কদিন আগে জেরিনকে সে বলেছিল, ভাবী, ভাইকে একটু দেইখা-শুইনা রাইখেন। আপনার আঁচলে বাইন্ধা রাখলে কোথাও যাইতে পারবে না। কথাটা তখন রসিকতা হিসেবে নিয়েছিল জেরিন। এমন রসিকতা তো আরাফাত প্রায়ই করে। কিন্তু সেদিন তন্ময় রাত দেড়টায় বাড়ি ফেরায় জেরিনের সন্দেহ হয়েছিল। এখন সন্দেহটা সত্যি মনে হচ্ছে। তন্ময় নিশ্চয়ই অন্য কোনো মেয়েতে মজেছে। সে কারণেই রাত করে বাড়ি ফেরে। এখন তাকে তালাক দিয়ে রাস্তা খালি করেছে।
তন্ময় কি আসলেই অন্যদিকে চোখ-কান দিয়েছিল?
মনে হয় না। তেমন ছেলে নয় সে। কিন্তু জেরিনের মনের সন্দেহ দূর করবে কে? আরাফত তো তার মনে ইঁদুর ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই ইঁদুর কুটকুট করে তার মগজ কাটছিল।
আরাফাত এ কাজটা কেন করল?
সে তো বাচাল। খালি বেহুদা কথা বলে। জেরিনের কাছে একটু পাত্তা পেতে চেয়েছিল আরকি।
এই ধরনের বাচালকে থাপড়ানো উচিত। এরা খালি ভেজাল লাগায়। জেরিনের উচিত ছিল কানের ফট্টি গরম করে দেওয়া।
সে আরাফাতের বাচালতা বুঝতে পারেনি। পারলে ঠিকই গরম করে দিত। যে মেজাজের মেয়ে সে! ক্লাস টেনে পড়ার সময় এক ছেলে একবার তাকে খারাপ কথা বলেছিল। সে স্যান্ডেলটা খুলে কষিয়ে মারল ছেলেটার গালে। এই ঘটনার পরপরই তন্ময়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক। তার এমন সাহসিকতা তন্ময়ের খুব পছন্দ হয়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জেরিনের সামনে বাইক থামিয়ে সরাসরি বলল, আমি কিন্তু স্যান্ডেলের বাড়ি খেতে পারব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
জেরিন কী বলল?
শ্রীলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোতলায় ডেটিং। দুজন যখন দোতলায় উঠত, দোকানের মালিক ভূপেনচন্দ্র তখন কোনো কাস্টমারকে উঠতে দিত না। কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দু-ঘণ্টা থাকত দুজন। বের হওয়ার সময় ভূপেনের হাতে তন্ময় পাঁচ শ টাকার একটা নোটা ধরিয়ে দিত। ভূপেন তো খুশিতে গদগদ।
কী বলবে? হেসে ফেলল। তন্ময়ের সরলোক্তি তার ভালো লাগল। ব্যস, মোম গলে গেল। দশ দিনের মাথায় শ্রীলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোতলায় ডেটিং। দুজন যখন দোতলায় উঠত, দোকানের মালিক ভূপেনচন্দ্র তখন কোনো কাস্টমারকে উঠতে দিত না। কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দু-ঘণ্টা থাকত দুজন। বের হওয়ার সময় ভূপেনের হাতে তন্ময় পাঁচ শ টাকার একটা নোটা ধরিয়ে দিত। ভূপেন তো খুশিতে গদগদ।
আহারে! এমন প্রেমের সম্পর্ক কিনা এভাবে ভেঙে গেল! তারপর?
তারপর কী, তালাক খেয়েছে, এখন তো আর স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারবে না জেরিন। পরদিন তার ভাই এলো তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে যাবে না। সে থাকলে স্বামীর বাড়িতেই থাকবে, নইলে গলায় দড়ি দেবে।
খুব জেদি মেয়ে। কিন্তু তার এই জেদ তো সমাজ-নমাজ মানবে না।
কেন মানবে? সমাজ-নমাজ কি মানুষের মন বোঝে? কিন্তু জেরিন সমাজ-নমাজ বোঝে না, সে স্বামীকে চায়, স্বামীর ঘরে থাকতে চায়। তার এক কথা, মানুষের জীবন একটা, প্রেম একটা, বিয়েও একটা। তন্ময় অন্য কোনো মেয়েকে ঘরে আনলে সে বটি দিয়ে খুন করে ফেলবে। তারপর সে আত্মহত্যা করবে।
তন্ময়কে সে আসলেই ভালোবাসে।
তা তো বটেই। খুব ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তো সবসময় কাছে পেতে চাইত। কাছে পাওয়ার জন্যই তো জ্বালাতন করত। অবশ্য এত জ্বালাতন সে না করলেও পারত। স্ত্রীর জ্বালাতনে স্বামী একবার অতীষ্ঠ হয়ে উঠলে দাম্পত্যে অশান্তি নামে।
তার ভাই ফিরে গেল?
তা ছাড়া কী করবে? স্বামীর প্রতীক্ষায় রইল জেরিন। দুদিন কেটে গেল, তন্ময়ের খবর নেই।
গেল কোথায়?
জেরিন এসে তার কলার ধরে টানতে টানতে ভেতর ঘরে নিয়ে গেল। দুই গালে আচ্ছামতো থাপড়াতে লাগল। তন্ময় চুপ। একটিবার বাধা দেয় না, চোখ তুলে তাকায় না। জেরিন তাকে মারে আর বলে, আমারে তালাক দিছস? আমারে রাখবি না তোর ঘরে? আমারে ছাইড়া অন্য মাইয়ারে বিয়া করবি?
হয়তো কোনো বন্ধুর বাড়ি। গিয়ে অবশ্য ভালোই করেছে। বাড়িতে থাকলে ঝামেলা আরো বাড়ত। দুদিন পর যখন ফিরল তখন সে একেবারে শান্ত। যেন সব রাগ-ক্ষোভ দূরে কোথাও রেখে এসেছে। ছেলে আর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তখন জেরিন এসে তার কলার ধরে টানতে টানতে ভেতর ঘরে নিয়ে গেল। দুই গালে আচ্ছামতো থাপড়াতে লাগল। তন্ময় চুপ। একটিবার বাধা দেয় না, চোখ তুলে তাকায় না। জেরিন তাকে মারে আর বলে, আমারে তালাক দিছস? আমারে রাখবি না তোর ঘরে? আমারে ছাইড়া অন্য মাইয়ারে বিয়া করবি? আমি তোরে ছাইড়া দিমু ভাবছস? আমি বিষ খামু, তোরেও খাওয়ামু। দুজন একসাথে কবরে যামু।
তন্ময় এবার মাথা তোলে। জেরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া জাগে। মনে পড়ে যায় শ্রীলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সেসব দিনের স্মৃতি। স্মৃতির ভারে সে উতলা হয়ে ওঠে। আচমকা জড়িয়ে ধরে জেরিনকে। বলে, আমারে মাফ কইরা দাও জেরিন। জেরিন এক ঝাটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তন্ময় আবার তাকে জড়িয়ে ধরে। ধরেই জোর কান্না। এবার জেরিনেরও কান্না পায়। দুজনের কান্নার শব্দে বাড়ির সবাই সামনের ঘরে জড়ো হয়। ছেলে আর মেয়েটিও কাঁদতে থাকে। আকায়েদ চেয়ারম্যান উঠানে দাঁড়িয়ে ছেলেকে গালাগাল করে, হারামজাদার মাথায় পচা গোবর। সংসারই যদি করবি তালাক দিলি ক্যান? এখন আমি কী করব? সমাজ আমারে ছাড়বে? মানুষ আমারে আর ইজ্জত-সম্মান দেবে?
তন্ময় বেরিয়ে এসে বাবার পায়ে পড়ে বলে, আমার মাথা ঠিক ছিল না বাবা, আমারে মাফ কইরা দেন।
চেয়ারম্যান গলা দ্বিগুণ চড়ায়, ঠিক ছিল না ক্যান? মাথায় কি শুয়োর ঢুকছিল হারামজাদা?
তন্ময় পা ছাড়ে না। ছেলের দশা দেখে চেয়ারম্যানের বুকটা ভিজে যায়। একমাত্র ছেলে, আদর-স্নেহ একটু বেশিই করে। জেরিনের ব্যাপারে তার মত ছিল না। যতই সুন্দরী হোক, তার বাপ তো এক সময় ফেরিওয়ালা ছিল। গ্রামে গ্রামে ঘুরে হাড়িপাতিল বেচত। জেরিনের দুই ভাই বিদেশ যাওয়ার পর তাদের দিন ফেরে। বাড়িতে দালান ওঠে, মাঠে জায়গাজমি হয়, ফয়েজ মিয়া বাজারে ক্রোকারিজের দোকান দেয়। কিন্তু তাই বলে তো তার অতীত মুছে যায়নি। চেয়ারম্যান চেয়েছিল ছেলে কোনো বড়ঘরে বিয়ে করুক। এম.এ বি.এ পাস মেয়ে। অথচ করল কিনা ফেরিওয়ালার ম্যাট্টিক ফেল মেয়েকে। সে কারণে বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ছেলেবউয়ের মুখ দেখেনি। সারাজীবন না দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু জেরিন তো সংসারী মেয়ে। বুদ্ধিমতিও। অল্পদিনের মধ্যেই বাড়ির চেহারা পাল্টে দিল, সংসারের রূপ বাড়িয়ে তুলল। ব্যস, মজে গেল চেয়ারম্যান। পুত্রবধূ নয়, জেরিনকে নিজের মেয়ে হিসেবে কবুল করে নিল।
ইস্, কী সুখের সংসারটা রসাতলে গেল!
কিন্তু চেয়ারম্যানের মাথায় অন্য চিন্তা। চিল্লাফাল্লা করতে করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। সোজা চলে গেল বোর্ডঅফিসে। দুপুরে আরাফাতকে দিয়ে বাড়িতে বাজারখর্চা পাঠাল। রাতে ভালো রান্নাবান্না করতে বলল। স্বামীর কথামতো তাই করল তন্ময়ের মা। গরুর মাংস, মাসকালাইয়ের ডাল, মুরগির রোস্ট, ইলিশ ভাজা, ডিম ভুনা, পোলাও।
বাড়িতে এমন ঝামেলা রেখে ভালো রান্নাবান্না কেন?
আছে আছে, কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। সমস্যা হয়েছে, তার সমাধান করতে হবে না? চেয়ারম্যান ঠান্ডা মাথার লোক। ঠান্ডা মাথায় সব সমস্যার সমাধান করে। তার উদ্দেশ্যটা বোঝা গেল রাতে, এশার নামাজের পর যখন সে মৌলবি আজহার উদ্দিনকে নিয়ে বাড়ি এলো। নিজহাতে বেড়ে মৌলবিকে খাওয়ালো। মৌলবি টা মেরে মেরে খায় আর রান্নার সুনাম করে। খাওয়া শেষে মৌলবি যখন মোনাজাত ধরতে যাবে তখন হাজার টাকার একটা নোট তার পাঞ্জাবির বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে চেয়ারম্যান বলে, কেবল আপনার অছিলাতেই আমার মতো গুনাহগার বাঁচতে পারে হুজুর।
মৌলবি দু-হাত তুলে বলে, আল্লাহ মালিক। গুনাহগার কে নয় চেয়ারম্যানসাব? গুনাহগার আমরা সকলেই। আমাদের সবাইরে আল্লাহ মাফ করুন।
না হুজুর, কথা সেটা না। শরমের কথা কী বলব, আপনার ভাতিজা একটা কেলেঙ্কারি কইরা ফালাইছে। হারামজাদা এতটা খচ্চর আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ঘরে কিনা এমন খচ্চর জন্মাল!
তন্ময়? কী করেছে সে?
রাগের মাথায় বউকে তালাক দিয়া ফালাইছে।
বলেন কী!
জি হুজুর।
কী মুসিবতের কথা!
বলেন তো এখন কী করি?
বউমা এখন কোথায়?
ঘরেই আছে।
কী আর করবেন, তাড়াতাড়ি বাপের বাড়ি পাঠায়া দেন।
কিন্তু হুজুর, ছেলে তো বউয়ের লগে সংসার করতে চায়।
মৌলবি তার লম্বা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, তাইলে তো হিল্লা করতে হবে।
না না হুজুর, ওসব হিল্লা-মিল্লা বাদ দেন। এলাকায় আমার মান-ইজ্জত কিছু থাকবে না। আপনি এমন একটা ব্যবস্থা করেন যাতে শরীয়তও রক্ষা হয়, সংসারও রক্ষা হয়।
হা হা হা। কী যে বলেন চেয়ারম্যানসাব! তা কি আর সম্ভব!
আপনি চাইলেই সম্ভব। একটা উপায় বের করেন দয়া করে। বলেই এক হাজার টাকার আরেকটি নোট মৌলবির পকেটে গুঁজে দিয়ে চেয়ারম্যান বলে, জেরিন আমার মেয়ে। আমি চাই না সে এক দিনের জন্যও এ ঘর ছেড়ে অন্য কারো ঘরে যাক।
জানালাপথে বাইরে তাকায় মৌলবি। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, তন্ময় বাড়ি আছে?
তন্ময় দরজার বাইরেই ছিল। বাবার ডাকে ভেতরে ঢুকল। আজহার মৌলবি তাকে পাশে বসিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে, শোনো বাবা, রাগ হচ্ছে পশুর স্বভাব। সকল সর্বনাশের মূল। কখনো এমন রাগ করতে নাই যার কারণে নিজের ক্ষতি হয়।
জি, আছে।
একটু ডাকেন।
তন্ময় দরজার বাইরেই ছিল। বাবার ডাকে ভেতরে ঢুকল। আজহার মৌলবি তাকে পাশে বসিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে, শোনো বাবা, রাগ হচ্ছে পশুর স্বভাব। সকল সর্বনাশের মূল। কখনো এমন রাগ করতে নাই যার কারণে নিজের ক্ষতি হয়।
তন্ময় মাথা নোয়ায়।
মৌলবি বলে, কাল তো শুক্রবার। গ্রামের সবাই মসজিদে হাজির থাকবে। নামাজের পর তোমার ব্যাপারটা নিয়া বসব। তোমারে শুধু একটা কাজ করা লাগবে।
তন্ময় চট করে মৌলবির পা দুটো চেপে ধরে বলে, আমি সব করতে রাজি। জেরিন অন্য কারো ঘরে যাবে, এটা আমি মানতে পারব না হুজুর।
তালাক দেওয়ার সময় এটা মাথায় ছিল না?
এমন ভুল আর কক্ষণো করব না হুজুর।
যাই হোক, শোনো। বৈঠকে আমি দুইটা প্রশ্ন করব তোমারে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলবে, জি হুজুর। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলবে, জি না হুজুর। মনে থাকবে?
তন্ময় মাথা কাৎ করে বলে, জি হুজুর, মনে থাকবে।
জুমার নামাজের পর মসজিদের বারান্দায় গ্রামবাসী বসল। ঠাঠা গরমের দিন। সবাই ঘামছে। সবার চোখেমুখে কৌতূহল। জায়গা হচ্ছে না বলে অনেকে বারান্দার বাইরে দাঁড়িয়ে। অপরাধীর মুখ নিয়ে চেয়ারম্যান বসেছে আজহার মৌলবির পাশে। কোণার দিকে মাথা নুইয়ে বসে আছে তন্ময়। মৌলবি তাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা তন্ময়, তুমি কি তোমার বউরে তালাক দিছ?
তন্ময় মাথা নুইয়ে রেখে জবাব দেয়, জি হুজুর।
কী মুশকিলের কথা! কেন যে তোমরা এসব করো! কিন্তু একটা কথা বাবা, তোমারে তো শুক্রবারেও মসজিদে দেখি না। নামাজ-কলমা পড়ো? পাঁচ কলমা জানো?
তন্ময় এবার মাথা তুলে মিনমিনে গলায় বলে, জি না হুজুর।
উপস্থিত সবার উদ্দেশে মৌলবি বলে, শুনলেন তো সকলে? বেটা পাঁচ কলমা জানে না। যে পাঁচ কলমা জানে না সে তো মুসলমানই না। তার আবার তালাক কী?
২৬.০২.২০২১
স্বকৃত নোমান বাংলা ভাষার কথাশিল্পী। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর, ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায়। জ্ঞানার্জন ও লেখালেখিকে জীবনের প্রধান কাজ বলে মনে করেন। প্রকাশিত উপন্যাস : রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা, মায়ামুকুট, উজানবাঁশি। গল্পগ্রন্থ : নিশিরঙ্গিনী, বালিহাঁসের ডাক, ইবিকাসের বংশধর, বানিয়াশান্তার মেয়ে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে আরও বই। এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারসহ ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়। বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।