রবিবার, নভেম্বর ২৪

বইয়ের ভবিষ্যত, ভবিষ্যতের বই

0

বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলতেছেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো।’ তবে বই নিয়া ভবিষ্যতের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যপারে কিছু বইলা যান নাই এই কবি।

আলাপের আগে বই নিয়া চলতি বাজারে যেই ধারণা আছে, তা পরিষ্কার কইরা নেওয়া দরকার। বই একজন লেখকের কাছে সাহিত্য, পাঠকের কাছে জ্ঞানের ভান্ডার। অবসরের সঙ্গী। প্রেমিকের কাছে প্রেম ও প্রেমপত্রের বাহক। আদালতের কাছে রেফারেন্স। প্রকাশকের কাছে খুচরা ও পাইকারি পণ্য, বেচাবিক্রির জিনিস। পেপারমিল ও ছাপাখানার লোকেদের কাছে রুটি-রুজি। শিক্ষিতলোকের দৈনন্দিন যাপনে বইয়ের মেলা কাজ।

বইপত্রের ভবিষ্যত নিয়াও বলার আছে। এই প্রসঙ্গে আলাপের আগে বই নিয়া চলতি বাজারে যেই ধারণা আছে, তা পরিষ্কার কইরা নেওয়া দরকার। বই একজন লেখকের কাছে সাহিত্য, পাঠকের কাছে জ্ঞানের ভান্ডার। অবসরের সঙ্গী। প্রেমিকের কাছে প্রেম ও প্রেমপত্রের বাহক। আদালতের কাছে রেফারেন্স। প্রকাশকের কাছে খুচরা ও পাইকারি পণ্য, বেচাবিক্রির জিনিস। পেপারমিল ও ছাপাখানার লোকেদের কাছে রুটি-রুজি। শিক্ষিতলোকের দৈনন্দিন যাপনে বইয়ের মেলা কাজ।

ফলে, বইপত্রের অতীত ইতিহাস একটু ঘাইটা দেখতে হবে। প্রাচীনকাল থিকাই মানুষ নিজের মনের ভাব স্থায়ীভাবে রাইখা দেওয়ার চেষ্টা কইরা আসতেছেন। আদিম গুহাবাসী মানুষের চিত্রাংকন থিকা এর শুরু। পরবর্তীকালে প্রাচীন এশিয়া, পারস্য, মিশরীয়সহ সব সভ্যতায় এই প্রচেষ্টা লেখালেখির রূপ লাভ করে।

সেই সময়ে লেখা হইতো পাথরে। এইটার আরেক নাম শিলালিপি। গ্রিক, সিন্ধু, অ্যাসিরিয়, সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, মিশরীয়, পারস্যসহ প্রাচীন সব সভ্যতাতে শিলালিপি পাওয়া যাবে। ভারতীয় কবি সোমদেবের ‘হরিকেল’ ও ‘ললিতবিগ্রহ’ নামের নাটক দুইটার শিলালিপি রাজস্থানের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

Book

ছাপানো বই

গাছের বাকলকে কাগজের মতো ব্যবহার করার প্রচলন এক সময় পৃথিবীর সব জায়গাতেই ছিল। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকে শকুন্তলা পদ্মপাতায় দুষ্মন্তকে চিঠি লিখছিলেন।

আমাদের দেশের অনেক প্রাচীন গ্রন্থ তালপাতার উপরে লেখা। বুদ্ধের দেহান্তরের পর ত্রিপিটক তালের পাতায় লেখা হইছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও তালপাতায় লেখার কথা আছে। খ্রিষ্টিয় ২য় শতকে অশ্বঘোষের একখানা নাটক পাওয়া গেছে যা তালপাতায় লেখা।

প্রাচীন গ্রীস, ব্যবিলন ও চীনে কাঠের তক্তার উপর মোম মাখায়ে তাতে ধাতুর শলাকা দিয়া আঁচড় কাইটা লেখালেখি করতে হইত। কতগুলা তক্তা একত্র কইরা যে বই হইত সেইটারে গ্রীক ভাষায় বলা হয় কোডেক্স। ব্যবিলনের অধিবাসীরা নিজেদের জ্যেতিষবিদ্যার পরিচয় লেইখা রাখছে মাটির টালির উপর। এই রকম কয়েকটা মাটির টালি মিলায়া এক একটা বই রচনা করা হইত সেই আমলে। ব্রিক অব বুক লিখা সার্চ দিলে এইরকম বইপত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। ইউরোপের অনেক মিউজিয়ামে এই রকমের ইটের বই রাখা আছে।

আলবেরুণী দেখছিলেন, রেশমি কাপড়ে লেখা একটি রাজবংশ লতিকা ভারতের নগরকোট দূর্গে আছে। চীনেও কাপড়ের তৈরি লিখন দ্রব্যের ব্যবহার ছিল।

পাঠকেরা জানেন, ১০৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনে কাগজ আবিষ্কার হয়। কিন্তু এর আগেই ভারতে তুলট কাগজ আবিষ্কার হইছিল। এইটা মূলত হাতে তৈরি কাগজ, হালকা হলুদ রঙের। তুলা, হরিতাল ইত্যাদি দিয়া এই কাগজ তৈরি হইত। আলেকজান্ডারের সেনাপতি নিয়ারকোস ৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতে আসছিলেন। তিনি এই কাগজ ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করতে দেখেন। চীনা পরিব্রাজক ইৎসিং ৭ম শতকে ভারতে এইটা দেখেন। তবে সর্বপ্রাচীন পাওয়া গেছে ৫ম শতকের। মধ্যযুগে ভারতের মোগল সম্রাটরা এর ব্যাপক ব্যবহার করতেন। একবার সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে শিয়ালকোটে ১ বছরে ৯ লাখ টাকার কাগজ তৈরি করা হয়।

লেখালেখি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হইছে সোনা, রূপা তামার পাতে। লোকেরা একসময় কচ্ছপের খোলে সাহিত্য রচনা করতেন, এর বেশ কয়েকটা নমুনা শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে গেলেই দেখা যাবে।

ফলে, ছাপা কাগজে বাঁধাই করা মলাটের ভিত্রে যে ফর্মা ফর্মা বই আমরা দেখতে পাই, এইটা বইয়ের বিবর্তনের একটা পর্যায় মাত্র। ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া গেলে এই বই আরও সহজতর মিডিয়ামে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন কইরা নিবে তাতে সন্দেহ নাই।

আজকের দিনে বইয়ের দুনিয়ায় সর্বশেষ সংস্করণ হইতে যাইতেছে সফট বুক, যেইটারে বলা যায় বইয়ের ভবিষ্যত। পিডিএফ বা ই-বুক নাম দিয়া আমরা যেইগুলা পড়ার চেষ্টা করতেছি, সফট বুক ব্যপারটা তার কাছাকাছি।

গৌরচন্দ্রিকা শেষ। এইবার মূল প্রস্তাব। আজকের দিনে বইয়ের দুনিয়ায় সর্বশেষ সংস্করণ হইতে যাইতেছে সফট বুক, যেইটারে বলা যায় বইয়ের ভবিষ্যত। পিডিএফ বা ই-বুক নাম দিয়া আমরা যেইগুলা পড়ার চেষ্টা করতেছি, সফট বুক ব্যপারটা তার কাছাকাছি। তবে বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন এমন লোকেদের দাবী, সফট বুক জিনিসটা পাঠক গ্রহণ করেন নাই কিংবা ওইভাবে জনপ্রিয় না।

এইটার একমাত্র কারণ, বাংলা ভাষায় এখনো সফট লিটারেচার নিয়া কাজ শুরু হয় নাই। ইটে লেখা বই কাগজে ছাপায়া দিলেই তার গ্রহণযোগ্যতা একই থাকার কথা না। কচ্ছপের খোলে কবিতা লিখতে বসলেন যেই কবি, তার ভাবনার গভীরতা কাগজে লেখা বইতে খুঁইজা পাওয়া সম্ভব না।

Softbook

সফটবুক

শুধুমাত্র সহজলভ্যতার তাগিদে কাগজের বই ছিল এতদিন সাহিত্যের একমাত্র মিডিয়া। এখন নতুন মিডিয়া আসছে, বাট এই মিডিয়ার উপযোগি সাহিত্য রচনা এখনো রিকগনাইজড না। রবীন্দ্রনাথ ঝরনা কলমে কালি মাখায়ে কাগজে ঘষে যে সাহিত্য রচনা করলেন, তা ইন্টারনেটের পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করতে পারার কোনো কারণ নাই। ফলে, ইন্টারনেট জগতের এই সফট মিডিয়ামটা এখনো বাংলা সাহিত্যের জন্য প্রস্তুত হইয়া ওঠে নাই।

তবে, বিশ্বসাহিত্যের দুনিয়ার চেহারা ভিন্ন। কথাসাহিত্যের দুনিয়ায় এখন ওয়েব ফিকশন নামের একটা নতুন জনরা জনপ্রিয় হইয়া উঠছে, যার বয়স খুব বেশি না। মাত্র ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত পৃথিবীর প্রথম ওয়েব ফিকশন আজকে সাহিত্যের দুনিয়ায় বিস্ময়কর বাজার তৈরি কইরা ফেলছে। ওয়েব ফিকশন লিখা সার্চ দিয়া উইকিপিডিয়াতে দেখা গেল, শুধুমাত্র চায়নাতে ওয়েব ফিকশন বছরে আড়াই বিলিয়ন ইউ এস ডলার ব্যবসা করতেছে।

আজকের পাঠকেরা হার্ড কাভারের বই অপেক্ষা ফোনের স্ক্রিনে অধিক সময় ব্যয় করে থাকেন। এই লোকগুলা ওয়েবে ঢুকে করে কী? দুনিয়ার সব ভাষায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলা সবই টেক্সটভিত্তিক। এই দুনিয়ার পাঠকেরা নিউজপোর্টাল আর পরিচিতদের নিউজফিডকে এরা দৈনন্দিন পড়াশোনার অংশ বইলা মনে করেন। সার্চ ইঞ্জিন গুগলের তথ্যমতে, ইন্টারনেটের যে ট্রাফিক তার ৯২% আসে টেক্সটের কারণে। ফলে, সাহিত্য এইখানে ঢুইকা পরবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

এই মুহুর্তে বিট্রেনের একজন জনপ্রিয় কবি ২৮ বছর বয়সি আর্চ হেডিস, যিনি একজন ইনস্ট্রা পোয়েট। ইনস্টা-পোয়েট আধুনিক সাহিত্য জগতের একটি নতুন অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে যেইসব কবি তাদের কবিতা নিয়মিত পোস্ট করেন তাদেরকেই ইনস্টা-পোয়েট বলা হয়। আর্চ হেডিস, রুপি কৌর এবং ল্যাং লিয়েভ এর মতো কবিরা ইনস্টাগ্রামে তাদের কবিতা প্রকাশ কইরাই খ্যাতিমান হইয়া উঠছেন। এই মাধ্যমে যেইসব কবিদের ফলোয়ার বেশি তারাই জনপ্রিয় হিসাবে বিবেচিত হন। জনপ্রিয় ইনস্টা-পোয়েটদের সঙ্গেই বইয়ের চুক্তি করেন প্রকাশকরা।

Arch Hades 3

ইনস্টা-পোয়েট আর্চ হেডিস

হেডিসের প্রথম কবিতার বই ‘হাই টাইড’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। এইটা রোমান্টিক কবিতার সংকলন ছিল। বইটা কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। তার দ্বিতীয় কবিতার বই “ফুল’স গোল্ড”। এইটাও বেস্টসেলার। সম্প্রতি অনলাইন নিলামে তার একটি কবিতা ৫১ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হইছে।

শুধু কবিতা বা কথাসাহিত্য না, সাহিত্যের অন্যান্য সৃজনশীল শাখাতেও সফট লিটারেচার এখন বড়ো ভূমিকা রাখতে শুরু করছে। টুইটার সম্প্রতি লেখকদের পেইড পোস্ট লেখার সুযোগ কইরা দিছে, যেইগুলা পড়তে চাইলে লেখকদের পয়সা দিতে হবে। ফলে, সফট লিটারেচার সাহিত্যের বাজারে নতুন পুঁজি নিয়া হাজির হইতেছে।

এই সকল তথ্য মাথায় নিয়া ঘুরে বেড়ানোর কারণে একবার শাহবাগে এক সিনিয়র কবি আমাকে প্রশ্ন করেন, ই-বুক লিখা কেউ কোনোদিন নোবেল পাইছেন? আমি তারে বলে আসছিলাম, পাবে। তবে ব্যাপারটা ই-বুক বা পিডিএফ নয়, সফট লিটারেচার খুব দ্রুতই সাহিত্যের দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবে। জনপ্রিয়তার দিক থিকা বিশ্বের ৫ম ভাষা বাংলাতেও এই সাহিত্যের ব্যপক সম্ভাবনা আছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলার উপর নির্ভর করে অনেকটা অগোছালো ও বিক্ষিপ্তভাবে আগায়ে যাইতেছে।

নেক্সট লিটারেচার ইজ সফট লিটারেচার। পাঠক ও মিডিয়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত। এর পরের কাজটা লেখকদের।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক (ফিকশন ফ্যাক্টরি)

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।