‘পশ্চিমা বিশ্বে ভারতের আর্টফিল্ম তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক ও উৎসাহের সঙ্গে গৃহিত হয়েছে, ইউরোপিয়ো আর্টসিনেমার রীতিনীতির সঙ্গে মিল থাকাতেই এটা হয়েছে, পশ্চিমা দর্শকের চলচ্চৈত্রিক গঠন সম্পর্কিত যে বোঝাপড়া, সেখানে ভারতীয় আর্টফিল্ম কোন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে নি বা চ্যালেঞ্জ জানায়নি।’
—রোজি থমাস (থমাস ১৯৮৫:২৩)
পশ্চিমা বিশ্বে ভারতীয় আর্টফিল্মের কদর প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যুক্তি তুলে ধরেন ভারতের আর্টফিল্ম যেহেতু ইউরোপিয়ো ঘরানার তাই সেদেশের মানুষের বেশি বেগ পেতে হয়নি সেসব ছবি বুঝতে। এক পর্যায়ে তিনি উদাহরণ দেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র। এটা ঠিক, ইতালির নয়াবাস্তববাদী চলচ্চিত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ কিন্তু ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক ও কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রবার্ট পল উড ওরফে রবিন উড বলেন ভিন্ন কথা।
এই প্রবন্ধের লক্ষ্য রবিন উড লিখিত আকরগ্রন্থ ‘অপু ট্রিলজি’, যে বইখানা চিন্ময় গুহ অনুবাদ করেছেন সেটার বাহির ও অন্দর ঘুরে দেখা। উপরের বাহাস উপলক্ষ্য মাত্র। তো সেই উপলক্ষ্য ধরেই সামনে এগুনো যাক।
ভিন্ন কী কথা বলেন উড? বইয়ের প্রবেশিকাতে উড সত্যজিতের ছবি প্রসঙ্গে প্রধান দুই সমালোচনার কথা বলেন, এসব সমালোচনা যে পশ্চিমা ‘শত্রু’ পক্ষের লোকেরা করেন তা উল্লেখ করতে ভোলেন না উড। তিনি বলেন প্রথম সমালোচনা হলো ছবিতে ঢোকা যায় না, মানে বোঝা যায় না। আর দ্বিতীয় সমালোচনা হল ছবির গতি বা টেম্পো— ধীর।
পাশ্চাত্য দর্শকের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির অনেককিছুই অপরিচিত। তাছাড়া ভারতকে গভীরভাবে না জানার কারণে ভারতীয় ছবি বোঝাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। (উড ১৯৭১:১৫) উড প্রথম সমালোচনার জবাব এভাবেই দেন। দ্বিতীয় সমস্যা টেম্পো বা গতি। উড বলেন, ‘সত্যজিতের ছবিগুলি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মুখ্য আপত্তি হচ্ছে তাদের গতি মন্থরতা।’ (উড:১৬) আরও কিছুদূর এগিয়ে উড বলেন, “পাশ্চাত্যে আমরা ক্লাসিক আমেরিকান চলচ্চিত্রের টানটান কাহিনি-কাঠামোর সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে গেছি— যেখানে কোনো দৃশ্য তার বক্তব্য রাখার পর খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়। ইউরোপীয় ‘আর্ট’ সিনেমার বুদ্ধিনির্ভর গঠনভঙ্গিও আজ আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে, তাঁর মূল বক্তব্য অনুধাবনে ক্রমাগত অসমর্থ হয়েও আমাদের মনে হতে থাকে যে, আমরা সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছি.. .” (উড:১৬-১৭)
পশ্চিমা সমালোচক ও দর্শক সম্পর্কে উডের এই বক্তব্য রোজি থমাসের বক্তব্যের ঠিক উল্টো। থমাস বলেন সত্যজিতের করা ছবিগুলোর মতো ভারতীয় ‘আর্ট’ ফিল্ম পাশ্চাত্যে সাদরে গৃহিত কারণ ওসবের গঠন পশ্চিমা ‘আর্ট’ সিনেমার মতোই। কিন্তু উড বলছেন, সত্যজিৎ শিল্পের শিক্ষা প্রধানত গ্রহণ করেছেন পাশ্চাত্য চলচ্চিত্র থেকে, জঁ রেনোয়া, ডি সিকা, জন ফোর্ড, বার্গম্যান, এঁদের কাছ থেকে। তারপরও সত্যজিতের কাজ ‘যে-কোনো সাংস্কৃতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে’।(ঐ: ১৬) তারমানে উল্লিখিত পশ্চিমা নির্মাতাদের সঙ্গে মিল নয় বরং স্বাতন্ত্র চোখে পড়ে সত্যজিতের নির্মাণে।
জন্মসূত্রে কানাডিয়ো নাগরিক ও রায় পরিবারের বন্ধু, চলচ্চিত্র পণ্ডিত গাস্তঁ রোবের্জও কিন্তু রোজি থমাসের ঠিক উল্টো কথা বলেন। তাঁর সওয়াল জবাবের মাঝেই সেটা পরিষ্কার: ‘রায়ের ত্রয়ী কি তবে পশ্চিমাকৃত ভারতীয় সিনেমা? একদম না। না যে, সেটার কারণ, গতির কারণে বিদেশি দর্শকদের কাছে ত্রয়ী বিরক্তির উদ্রেগ করে। অধিকাংশ পশ্চিমা দর্শক অপুর ছবিগুলো বুঝতে শুরু করে দুই কি তিনবার দেখার পর থেকে। ছবির ধীরগতির কারণে তারা প্রথমে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না।’ (রোবের্জ ২০০৭: ৪২)
উড ও রোবের্জ দুজনই পশ্চিমা, তাদের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় থমাসের অনুধাবন পুরোপুরি সত্য নয়, অর্ধসত্য। সেই বিচারে আধা মিথ্যা। সত্যজিৎকে বোঝার ক্ষেত্রে থমাসের মতো উপরউপর নয়, দরদ দিয়েই সত্যজিতের চলচ্চিত্র পাঠ করেছেন উড ও রোবের্জ। আলোচ্য বই যেহেতু রবিন উডের ‘অপু ট্রিলজি’ তাই তাঁর দৃষ্টিতে ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ নিয়েই আমাদের এই প্রবন্ধের চড়ুইভাতি।
সংখ্যাতত্ত্বের কারবার যারা করেন তাদের কাছে অপুত্রয়ীর মৃত্যুসংখ্যা আগ্রহ তৈয়ার করতে পারে। কারণ তিন ছবিতে দু’জন করে মোট ছয় জনের মৃত্যু আমরা দেখি কিংবা শুনি। যদিও রবিন উড উল্লেখ করেছেন পাঁচ জনের মৃত্যুর কথা। গাস্তঁ রোবের্জও তাই।
১.
সংখ্যাতত্ত্বের কারবার যারা করেন তাদের কাছে অপুত্রয়ীর মৃত্যুসংখ্যা আগ্রহ তৈয়ার করতে পারে। কারণ তিন ছবিতে দু’জন করে মোট ছয় জনের মৃত্যু আমরা দেখি কিংবা শুনি। যদিও রবিন উড উল্লেখ করেছেন পাঁচ জনের মৃত্যুর কথা। গাস্তঁ রোবের্জও তাই। ‘পথের পাঁচালী’তে প্রথম মৃত্যু হরিহরের পিসি ইন্দিরের, এরপর অপুর বোন দুর্গা, ‘অপরাজিত’তে তৃতীয় মৃত্যু হরিহরের, চতুর্থ সর্বজয়া, আর ‘অপুর সংসারে’ পঞ্চম মৃত্যু অপুর স্ত্রী অপর্ণার এবং শেষ মৃত্যুটি ছিল অপুর শ্বাশুড়ি, মানে অপর্ণার মায়ের। ষষ্ঠজন বিয়োগের খবর আমরা পাই অপু যখন তার ছেলে কাজলকে দেখতে যায় তখন, অপুর শ্বশুড়ের মুখ থেকে। অবশ্য আরো একটি সম্ভাব্য মৃত্যুর দেখা আমরা পাই ত্রয়ীর শেষ খণ্ডে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অপু যখন রেলগাড়ির নিচে আত্মহত্যা করতে যায়। কিন্তু আব্রাহামের কোরবানি দিতে যাওয়া পুত্রের নিচে যেমন দুম্বা এসে হাজির হয়েছিল, তেমনি অপুর মৃত্যু যেন উড়ে গিয়ে রেললাইনের ধারে এক শূকরের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। মৃত্যু কিংবা সম্ভাব্য মৃত্যুসংখ্যা যাই হোক, দেশী বিদেশি সকল সমালোচকই জোর দিয়েছেন বা দিতে হয়েছে এই মৃত্যুর উপর, পাশাপাশি জন্মও উঠে এসেছে আলোচনায়। জীবনের চক্রই বলুন আর সরলরেখা, অপুত্রয়ীতে জন্ম ও মৃত্যুর এই নিত্য আসা যাওয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্ব বহন করে। আর সেজন্যই আলাদা করে সেটার উপর জোর দেন উড। অপুত্রয়ীর অন্যান্য ছোটোছোটো ঘটনার সঙ্গে কিভাবে জীবনের এই অমোঘ বিষয়টি জড়িয়ে আছে সেটার আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা আমরা পাই উডের লেখায়। তিনি বলেন, ‘ট্রিলজির মুখ্য চরিত্রটি (অপু) ক্রমশ কেন্দ্রায়িত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু এসে তার সবচেয়ে কাছের মানুষদের একে একে সরিয়ে নেয়। ট্রিলজিতে পাঁচটি প্রয়োজনীয় মৃত্যু ঘটেছে।’ (উড ১৯৭১: ২৫-২৬)
মৃত্যুগুলো লক্ষ্য করার মতো। প্রত্যেকবারই বিচ্ছিন্নতার মুহূর্তে মৃত্যু হানা দিয়েছে অপুত্রয়ীতে। উড বলছেন, ‘সব ক্ষেত্রেই এই অনুপস্থিতি ক্ষতির অনুভবকে— মৃত্যুর আকস্মিকতা, চূড়ান্ততা এবং জীবনের ভয়ংকর অনিরাপত্তার সামনে মানবিক অসহায়তাকে— অনেক বেশি তীব্র করে তোলে।’ (উড ১৯৭১:২৬) দুর্গা যখন মারা যায় তখন পিতা হরিহর ছিল না, সর্বজয়া যখন দেহত্যাগ করে তখন পাশে অপু ছিল না আবার অপর্ণা যখন মারা যায় তখনো অপু থাকতে পারেনি স্ত্রীর কাছে। এত যে মৃত্যু, শোক তারপরও উড বলছেন, ‘ভয়ংকর মৃত্যুগুলির একটিও সামগ্রিকভাবে নঞর্থক নয়। গোটা ট্রিলজিতে প্রায় সর্বদা ধ্বংসের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে সৃষ্টি, এবং প্রতিটি মৃত্যুই সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে ‘অগ্রগতি’র দিকে সূচিত হয়েছে। দুর্গার মৃত্যু পরিবারটির গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার চূড়ান্ত কারণ। অপুর যাত্রাপথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে সর্বজয়ার মৃত্যু। এবং সবচেয়ে যন্ত্রণাময় যে মৃত্যু, অপর্ণার, তাকে টেনে নিয়ে এসেছে মানবিক পরিপূর্ণতা ও গভীরতার দিকে, যার ফলে সে শিশুটিকে সানন্দে গ্রহণ করতে পেরেছে। … জীবন সম্পূর্ণভাবে আবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সঙ্গে এসেছে অগ্রগতি।’ (উড ১৯৭১:২৬)
মৃত্যু ও অগ্রগতিই উডের আলোচনার মূল কেন্দ্র। মৃত্যু আলোচনায় ‘পথের পাঁচালী’তে এসে উড কয়েকটি দৃশ্যের ব্যাখ্যা দেন নিজের মতো করে। যেমন বৃদ্ধা ইন্দির যখনই ফ্রেমে ঢুকছেন বা বেরুচ্ছেন তখনই সত্যজিৎ পশুজগতের (কুকুর, বিড়াল) কাউকে না কাউকে রাখছেন মিজোঁসিনে। উডের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বৃদ্ধা ইন্দির যেকোনো সময়েই পরপাড়ে পাড়ি জমাতে পারেন, মানে মৃত্যু যেকোনো সময় আসতে পারে জরাজীর্ণ বৃদ্ধার শরীরে, কিন্তু তার প্রতি কারো কোনো বিশেষ নজর নেই। গৃহকর্তী সর্বজয়াও তার প্রতি উদাসীন। অভাবের সংসার, তার উপর আবার দূর সম্পর্কের পিসি। সবমিলিয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু যেন কুকুর বিড়ালের মতোই ‘সর্বদা নৈমিত্তিক, অলক্ষিত।’ (উড ১৯৭১ : ৪০)
‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে মৃত্যু যেমন আছে তেমনি আছে প্রগতি। ট্রেনের মোটিফ আকারে ফিরেফিরে আসাকে উড কখনো কখনো উল্লেখ করছেন প্রগতি কিংবা প্রগতির দূত বলে। উডের ‘প্রগতি’ প্রযুক্তিগত নয়, গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার ‘প্রগতি’, এই ‘প্রগতি’ অপুর বড়ো হতে থাকা এবং সেই বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন এবং নিজের জীবনের প্রতিটি ধাপ পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ‘প্রগতি’। ছেলেবেলা থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যুবকে, যুবক থেকে পরিণত পুরুষে। অপু এই ট্রিলজির প্রাণ, মৃত্যুসমূহ তার চারপাশ ঘিরে থেকেছে শুধু এটা প্রমাণ করতে অপু তারপরও বাঁচতে চায়।
অপুর চিন্তা ও চেতনার প্রগতি চিহ্নিত করতে উড উল্লেখ করেন ‘পথের পাঁচালী’র শেষভাগের কথা। যখন অপু দেখে, দুর্গা সত্যিই প্রতিবেশীর মালা চুরি করেছিল, তখন সে মালাটি সবার অলক্ষ্যে ছুড়ে ফেলে দেয় পুকুরে। দুর্গা তখন আর নেই, তাই বোনের দোষ ঢাকতে অপু মালাটি কাউকে না বলে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দেয় কচুরিপানাভর্তি পুকুরে। উড বলেন, ‘… এখানে— সমগ্র ট্রিলজিতে এই প্রথম— আমরা অপুকে একটি সচেতন, নৈতিক মতে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার সম্মুখীন হতে দেখি।’ (উড ১৯৭১ :৪৯) মৃত্যুকে সঙ্গী করে অপুর ‘প্রগতি’কে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন উড।
উড বলেন, ‘তাঁর দ্বিতীয় ছবি অপরাজিত’, পথের পাঁচালী-র পরবর্তী পর্যায় হিসেবে খানিকটা নিরাশ করলেও অপুর সংসার-এ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের বেশী সার্থক।’ (উড ১৯৭১ : ৫১) যদিও ভিন্ন কথা বলেন অস্ট্রেলিয়ো চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক জন ডব্লিউ হুড। তিনি মনে করেন ‘অপরাজিত’ ছবির বয়ান গঠন (narrative structure) ‘অপুর সংসারে’র চেয়ে জটিল। (হুড ২০০৮: ৪৫) যাহোক, সরল জটিল মিলিয়ে এই পর্বে দেখা যায় অপু শহুরে জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
এরপর অপুর পরিবার থেকে গ্রাম থেকে পাড়ি জমায় বেনারসে। এই ‘প্রগতি’র মাধ্যমেই শুরু হয় ত্রয়ীর দ্বিতীয় পর্ব ‘অপরাজিত’। এই পর্বটি নিয়ে উড কিছুটা হতাশ। তিনি বলেন ত্রয়ীর অন্য দুটির তুলনায় এই দ্বিতীয় পর্বটির বুনোট সরল, তাই তেমন চুলচেরা বিশ্লেষণ দাবি করে না। উড বলেন, ‘তাঁর দ্বিতীয় ছবি অপরাজিত’, পথের পাঁচালী-র পরবর্তী পর্যায় হিসেবে খানিকটা নিরাশ করলেও অপুর সংসার-এ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের বেশী সার্থক।’ (উড ১৯৭১ : ৫১) যদিও ভিন্ন কথা বলেন অস্ট্রেলিয়ো চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক জন ডব্লিউ হুড। তিনি মনে করেন ‘অপরাজিত’ ছবির বয়ান গঠন (narrative structure) ‘অপুর সংসারে’র চেয়ে জটিল। (হুড ২০০৮: ৪৫) যাহোক, সরল জটিল মিলিয়ে এই পর্বে দেখা যায় অপু শহুরে জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এখানে তার বন্ধু হয়। আবার বন্ধুদের একজনের কাছে সে ইংরেজিও শেখে। অপু এই পর্বে পুরোহিত বাবার কথকতা দূর থেকে দেখে কেবল; কিন্তু তার পুরোহিত হওয়ার কোনো ইচ্ছা পরিচালক আমাদের দেখান না। উড বলেন, ‘অপরাজিত-তে শিশুটির কাছে হরিহর সাধারণ দৃশ্যাবলীর এক অংশমাত্র, তা ছাড়া আর কিছু নয়।’ (উড ১৯৭১: ৫৫)
এক পর্যায়ে অসুস্থ্য বাবার মৃত্যুতে অপু ও সর্বজয়াকে ফিরতে হয় গ্রামে। কিন্তু শহর থেকে গ্রামে যাওয়া কিন্তু পশ্চাৎপদতা নয়, অপুর জন্য তো নয়ই। কারণ এই গ্রামে গিয়েই খণ্ডকালীন পৌরহিত্য করে সে পড়ালেখা শুরু করে। এরপর ভালো ফল করে অর্জন করে কলকাতায় লেখাপড়া করার বৃত্তি। অতএব হরিহরের মৃত্যুই অপুকে এনে দেয় এই ‘প্রগতি’। ছবির এই পর্যায়ে দেখা দেয় মা ও ছেলের দ্বন্দ্ব। বিধবা সর্বজয়ার কাছে অপু সবেধন নীলমনি, একমাত্র ছেলের দিকে তাকিয়েই তার দিন কাটে। এখন এই ছেলে যদি কলকাতা চলে যায় সে বাঁচবে কেমন করে? শেষ পর্যন্ত বাঁচা আর হয় না। সন্তানের আসার অপেক্ষায় মারা যায় মা। কিন্তু যে টান অনুভব করত অপু মায়ের জন্য, পড়ালেখায় খানিকটা ছেদও পড়ত এই আবেগের টানে, মায়ের মৃত্যুতে সেই টান শেষ হলো। উড বলেন, ‘অপু তো অপরাজিত। ছবির অন্তিম লগ্নে তার জয় মূর্ত হয়— দুঃখ ও গ্লানির ওপর এক নিঃশব্দ বিজয়।’ (উড ১৯৭১ : ৬৮) এখন আর কলকাতায় লেখাপড়া বা অন্য কাজ করার সময় মন পড়ে থাকবে না গ্রামে, মায়ের কাছে।
মা নেই, বাবা নেই, বোন নেই, বন্ধুদের কাছ থেকেও স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছে অপু। এ যেন পালিয়ে বেঁচে থাকা, নাগরিক জীবনে আধপেটা খেয়ে জীবিকার সন্ধানে দিনরাত ছোটাছুটি। এমন সব দৃশ্যের ভেতর দিয়েই শুরু হয় ত্রয়ীর শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’। অপু গরীব, ঘরভাড়া শোধ করার অর্থ নাই কিন্তু লেখক হয়ে উঠবার বাসনা পোষে সে। উপন্যাস লেখা শুরু করে অপু। হঠাৎ একদিন পলাতক অপুকে খুঁজে পায় কলেজ জীবনের বন্ধু পুলু। অপু তাকে জানায় উপন্যাস লেখার কথা। উপন্যাসের মূল চরিত্র জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত সয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চায়। অপুর কথা শুনে পুলু বলে ‘এতো আত্মজীবনী’। অপু হাসে। এরপর বন্ধুর অনুরোধে মামাত বোনের বিয়েতে খুলনা যায় অপু। সেখানে আবিষ্কার হয় মামাতো বোনের বর পাগল। অতএব দায়িত্ব এসে পড়ে অপুর কাঁধে। বিয়ের লগ্ন চলে গেলে বিপাকে পড়বে মেয়েটি তাই বন্ধুর অনুরোধে বন্ধুরই মামাত বোন অপর্ণাকে বিয়ে করে অপু। অবশ্য বিয়ে করার আগে মৃদু আপত্তি যে সে করেনি তা নয়। তারপরও শেষতক অপু কেন রাজি হলো বিয়েতে?
উড বলছেন, বিয়ে করার পেছনে একটি কারণ হতে পারে অপুর একাকিত্ব। আবার আত্মজৈবনিক উপন্যাসে প্রেমের উপস্থিতির দিকে ইশারা করে উড বলেন, অতৃপ্ত বাসনাই অপুকে তাড়িত করে ঐ বিয়ে করতে, যেহেতু তার জীবনে বোন দুর্গা ও মা সর্বজয়া ছাড়া আর কোনো নারীকে সে কাছ থেকে দেখেনি।
বিয়ের পর কলকাতায় নিজের গরীবখানায় অপর্ণাকে নিয়ে আসে অপু। শুরু হয় সংসার। দারিদ্র আছে কিন্তু দুঃখ নেই। সংসারধর্ম পালন করতে করতেই একদিন অপু অপর্ণার চোখে দেখে কাজল। সত্যজিৎ ইঙ্গিত দেন অপর্ণা মা হতে চলেছে। গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের কাছে থাকতে অপর্ণা চলে যায় খুলনায়। বিরহপর্ব। দুজন দুজনকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যখন তীব্র হয়ে উঠছে তখনই খবর আসে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গেছে প্রিয়তমা স্ত্রী অপর্ণা। এই খবর শোনার পর অপুর অনুভূতিকে সত্যজিৎ যেভাবে পর্দায় তুলে ধরেন দক্ষতার সঙ্গে সেটির প্রশংসা করেন উড : ‘ক্যামেরা এগিয়ে আসে অপুর চিন্তান্বিত মুখের ওপর। চরিত্রদের আবেগের মুহূর্তে সর্বদাই সত্যজিতের ক্যামেরা পিছিয়ে আসে, যাতে তাদের ‘নিরপেক্ষভাবে’ ধরা যায়, যেখানে প্রকাশ পায় সংযম ও সূক্ষ্মতা। কিন্তু এখানে ক্যামেরার এই অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি আমাদের ধাক্কা দেয় ‘ (উড ১৯৭১ : ৯২)
স্ত্রীর মৃত্যু ও সন্তানের জন্ম, দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকারণের সম্পর্ক অর্থাৎ কাজল জন্মেছে বলেই স্ত্রী অপর্ণা মারা গেছে এমন অনুভূতি নিয়ে নিজের কাছ থেকে, সন্তানের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে থাকে অপু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরে আসতে হয়, কর্তব্য কিংবা ভালোবাসার টানে, নিজের ছেলে কাজলের কাছে। শেষদৃশ্যে দেখা যায় অপু নিজেকে পিতা হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে হাজির করে পুত্রের সামনে। কাজলও সেটা মেনে নেয়। বন্ধুরূপ বাবার সঙ্গে সে তার নিজস্ব যাত্রা শুরু করে। জন ডব্লিউ হুড এ জায়গাটা ধরে চমৎকার কথা বলেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধতন্ত্র ও ভারতীয় ধ্রুপদী শিক্ষার দোহাই দিয়ে তিনি বলেন, পরিশেষে অপু অনুধাবন করতে পেরেছে কাউকে পাওয়ার বাসনা বা অধিকার প্রতিষ্ঠা, দুঃখকষ্ট ছাড়া হয় না।’ (হুড ২০০৮:৬০) তাই অধিকার ফলাতে যাওয়ার দরকার নাই। তাতে কষ্টই পেতে হয়। এর আগে তার জীবনের মৃত্যুগুলোই এই অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী। সুতরাং পুত্রের ওপর পিতার অধিকার প্রতিষ্ঠার কষ্টকর পথে না হেঁটে অপু বন্ধুর পথেই হাঁটল। শেষাঙ্কের অপুকে শুদ্ধ হুডই নন, গাস্তঁ রোবের্জও তুলনা করেন সিদ্ধার্থ অথবা বুদ্ধের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিভূতিভূষণ অপুকে ‘অবোধ’ হিসেবে ছেড়ে দিলেও সত্যজিৎ তাঁর অপুকে নির্মাণ করেন আধুনিক ‘বোধিসত্ত্ব’ হিসেবে। (রোবের্জ ২০০৭: ৪৩)
আগেই বলেছি, অপুত্রয়ীতে মৃত্যু এক অনিবার্য পরিণতি। এই মৃত্যুর মিছিল পেরিয়ে অপু শেষপর্যন্ত যেখানে নতুন জীবনের সন্ধান পায়, যে জায়গায় ছেলেকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে অপু, সেখানেই ইতি টানেন সত্যজিৎ রায়। এই নতুনের যাত্রাপথেই শেষ হয় পথের গান। ‘এটা বিশেষভাবে লক্ষ করার ব্যাপার যে মৃত্যু ট্রিলজির এতখানি অংশ জুড়ে থাকলেও ছবিগুলির কোথাও কোনো শোকাচ্ছন্নতা নেই।’ (উড ১৯৭১:৯৩) উড বলেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে, মৃত্যু ততটা রহস্যময় নয় যতটা এক কঠিন সত্য, চূড়ান্ত বিচার ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ না করে যার সঙ্গে ঘর করতে শিখতে হয়’। (উড ১৯৭১:৯৩) উড উল্লেখ করেন সত্যজিতের মত রস্সেলিনির ছবিতেও গুরুত্ব পেয়েছে মৃত্যু প্রসঙ্গ। মৃত্যু সংক্রান্ত দুই নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিও অল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করেন উড। মজার তুলনা টানেন রোবের্জ। তিনি বলেন হলিউডের ছবিতেও আকছার মৃত্যু দেখা যায় কিন্তু সেগুলোর একটিকেও আসল মৃত্যু বলে মনে হয় না। (রোবের্জ ২০০৭: ৪৪)
২.
বইয়ের ভূমিকাতে সত্যজিতের ত্রয়ী ছাড়াও ‘তিনকণ্যা’ ও ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উড তুলনা টানেন সংগীতের। উড বলেন, “… প্লট ও চরিত্রের ওপর এই ঝোঁক সত্যজিতের শিল্পের ‘বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রে’র দিকগুলির (pure cinema aspects) সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবিতে ভারসাম্য ও বিশিষ্টতা এনে দেয়। এবং এই বৈশিষ্টগুলি ছবিকে সাহিত্যের চেয়ে সংগীতের কাছে নিয়ে আসে।” (উড ১৯৭১: ২২) অবশ্য সত্যজিৎ নিজেও সংগীতের সঙ্গে নিজের কাজের তুলনা করেছেন: ‘ছন্দ গতি নৈঃশব্দ মিলিয়ে চলচ্চিত্রের যে একটা সাংগীতিক দিক আছে সে সম্বন্ধে আমি সবসময়ই সচেতন। আমি মোৎসার্টের ভক্ত। চারুলতা ছবির মেজাজ ও গঠনশৈলীতে মোৎসার্টের প্রভাব আছে।’ (ঐ)
সত্যজিতের কাজকে নিবিড়ভাবে পাঠ করে উড যেমন সংগীতের সঙ্গে সাযুজ্য পান তেমনি ট্রিলজির কয়েকটি জায়গা তাঁর কাছে দুর্বল বলেও মনে হয়। উড উদাহরণ টেনে বলছেন ‘অপুর সংসারে’ অপুর পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ানো এবং এক পর্যায়ে নিজের উপন্যাসের পাতাগুলোকে পাহাড়ে চড়ে ছড়িয়ে দেয়ার কথা। একেবারে শেষভাগে দাদামশায় যখন কাজলকে মারতে যায় আর অপু তাকে বাধা দেয়, এই জায়গাগুলো উডের কাছে ‘জবরজং’ ঠেকে। চরিত্রদের অবস্থান ও আড়ষ্টতা নিয়েও সমালোচনা করেন উড।
প্রশংসা, পর্যবেক্ষণ, সমালোচনা ও নিজস্ব ব্যাখ্যা, সব মিলিয়ে ‘অপু ট্রিলজি’ আমি বলব রবিন উডের এক নিবিড় সাহিত্যকর্ম, যার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে অসীম ধৈর্য্য ও চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা। পশ্চিমা সমালোচকের চোখে ভারতীয় চলচ্চিত্র দর্শন পাঠ এবং তুলনামূলক পাঠ, লাভজনক কিনা বলতে পারব না তবে বিষয়টা যে আনন্দের তাতে কোনো সন্দেহ নাই। পরিশেষে বলব, চিন্ময় গুহের অনুবাদ সাবলীল। রবিন উড যেন বাংলাতেই লিখেছেন!
পাঠসূত্র:
- উড, রবিন (১৯৭১), ‘অপু ট্রিলজি’, অনুবাদ: চিন্ময় গুহ, পারুল (২০১২), কলকাতা
- Thomas, Roosie (1985), ‘Indian Cinema: Pleasure and Popularity’, collected in ‘The Bollywood Reader’ (2008), edited by Rajinder Dudrah and Jigna Desai, McGraw-Hill, UK.
- Roberge, Gaston (2007), ‘Satyajit Ray’, Manohar, New Delhi.
- Hood, John W. (2008), ‘Beyond the World of Apu: The Films of Satyajit Ray’, Orient Longman Private Limited, New Delhi.
প্রথম প্রকাশ : অন্যদিন, বর্ষ ১৮ সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ২০১৩
জন্ম ২২ সেপ্টেম্বর, ঢাকায়। ২০০৫ সাল থেকে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন আরটিভি, বৈশাখী টেলিভিশন ও এটিএন নিউজে। স্নাতক সম্পন্ন করেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে। আর স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে, নরওয়ে সরকারের বৃত্তি নিয়ে। মাঝে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা’, ‘চলচ্চিত্র বিচার’, ‘শাহবাগ: রাজনীতি ধর্ম চেতনা’, ‘বিবিধ অভাব: লিওনার্দো লালন লাকাঁ’, ‘বলিউড বাহাস’ প্রভৃতি।