সাদত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) উর্দু ভাষার একজন বিখ্যাত লেখক। এতটাই বিখ্যাত যে, তাঁর পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই। তবু নতুন পাঠকদের যারা এখনো মান্টোকে পাঠ করেননি তাদের জন্য সামান্য নোক্তা দিতে হয়। মান্টো দেশপরিচয়ে ভারতীয়, আবার পাকিস্তানিও। মাত্র তেতাল্লিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের একুশটি বছর লেখালেখির পেছনে উৎসর্গ করেছেন। এর ভেতর কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ, ২২টি ছোটোগল্পের বই, একটি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ, দুটি স্মৃতিকথা, কয়েকটি বেতার নাটক ও বেশ কিছু চিত্রনাট্য লিখেছেন। পাক-ভারতের বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিবের জীবনকাহিনি নিয়ে সোহরাব মোদির পরিচালিত ছবি ‘মির্জা গালিব’ এর চিত্রনাট্যও মান্টোর লেখা। ‘আটদিন’ নামক ছবিতে মান্টো নিজে অভিনয়ও করেছেন।
১৯১২ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের শহর অমৃতসরে যে মান্টোর জন্ম তিনি জীবিকার টানে বোম্বেতে এসে থিতু হোন ১৯৩৬ সালে। তারপর এই শহর তাঁর এতটাই আপন হয়ে উঠে যে, নিজেই বলতেন— ‘মে চালতা ফিরতা বম্বাই হু’; মানে আমি ভ্রাম্যমান বোম্বাই শহর। কিন্তু সাতচল্লিশের দেশভাগের কারণে আর সবার মতো তাঁকেও প্রিয় শহর মুম্বাই থেকে ছিটকে পড়তে হয়। ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ১৯৪৭ এর দেশভাগ তাকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করে। সে সময় মান্টো মুম্বাইয়ের সিনেমাজগতে চাকরি করতেন। দাঙ্গা আর দেশভাগের কারণে সেখান থেকে চাকরিহারা হয়ে সব হারানোর বেদনা নিয়ে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে করাচি হয়ে লাহোরে চলে আসতে হয় তাকে। সেখানে আগে থেকে থাকা স্ত্রী সাফিয়া ও তিন মেয়ের সঙ্গে মিলিত হোন মান্টো, ভারতের সবচে’ খ্যাতিমান উর্দু ছোটোগল্পকার। পেছনে পড়ে থাকে আপন পিতা-মাতা ও একমাত্র পুত্র আরিফের কবর। খণ্ডিত হয়ে পড়েন মান্টো, দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিমান এক গল্পকার।
মুম্বাই ছেড়ে লাহোরে হিজরত করা ও তার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মান্টো ‘ঠান্ডা গোশতের মামলা’ প্রবন্ধে নিজেই লিখেছেন, ‘বোম্বাই ছেড়ে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে করাচি হয়ে লাহোর এসেছি। তিন মাস যাবত দারুণ টানা-পোড়েনের মধ্যে কাটাই। বুঝতে পারতাম না কোথায় বসে আছি, করাচিতে আমার বন্ধু হাসান আব্বাসের বাড়িতে, বোম্বেতে, নাকি লাহোরে। লাহোরে কয়েকটি হোটেলে কায়েদে আজম ফান্ডের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নৃত্যগীতের আসর লেগেই আছে।
তিন মাস যাবৎ আমার চিন্তা বা কল্পনা রাজ্যে কোনো স্থিতিশীলতা আসেনি। কখনো করাচির দ্রুতগামী ট্রাম, গাধার গাড়ি, আবার বোম্বের বাজার ও অলিগলি, অনেক সময় লাহোরের জমজমাট হোটেলের দৃশ্য আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। সারাদিন চেয়ারে বসে কল্পনা রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। অবশেষে বোম্বে থেকে যে টাকা সঙ্গে এনেছিলাম তা বাড়িতে ও বাড়ির অদূরে ‘ক্লিফটন পান্থশালায়’ নিঃশেষ হয়ে গেছে। এবার আমার টনক নড়ে। এবার আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম, আমি লাহোরের উপকণ্ঠে অবস্থান করছি। ভাবতে থাকি কিছু একটা করতে হবে। খবর নিয়ে জানতে পারি, দেশবিভাগের পর ফিল্ম কোম্পানিগুলোর নিভু নিভু অবস্থা। চিত্রনির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কারবার কোম্পানীর অফিসের সম্মুখস্থ সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। জমি বরাদ্দের তোড়জোড় চলছে। মুহাজির ও অমুহাজিররা ধরপাকড় করে কারখানা ও দোকানপাটের জন্য এলটমেন্ট নিচ্ছে। আমাকে জমি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এই লুটপাটে অংশগ্রহণে আমার মন সায় দেয়নি।’ (অনুবাদ: জাফর আলম)
মান্টো ভারতে যে চরম মুসলমান বিদ্বেষ আপন গতিতে দেখেছেন তা তাঁকে অস্থির করে তোলে। মুসলিমদের ভাতে-পানিতে মারার, একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, হুমকি-ধামকি দিয়ে দেশ থেকে তাড়ানোর যে চক্রান্ত মান্টো দেখেছেন তা তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। প্রিয় বন্ধু অভিনেতা শ্যাম যখন বললেন মুসলমান হওয়ায় তাঁকে হত্যা করে ফেলতে পারেন তখন মান্টো ভীষণ আঘাত পান। বিখ্যাত অভিনেতা অশোক কুমার ছিলেন মান্টোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুসলিম পরিচয়ের কারণে চাকরিহারা মান্টোকে অশোকও কোনো সাহায্য করতে পারেননি। সব ছেড়ে, এমনকি ইসমত চুগতাইয়ের ‘প্রেমছোঁয়া বন্ধুত্ব’ ছেড়েও তাঁকে হিজরত করতে হয় পাকিস্তানেই।
পাকিস্তানে এসে আর জীবনের ছন্দ মেলাতে পারেননি মান্টো। অবসাদ, দারিদ্র, অভাব আর দুষ্টচক্রে পিষ্ট মান্টো আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষটি আশ্রয় নেন চোলাই মদের। মদ ছাড়তে লাহোর পাগলা গারদেও তাকে কয়েক মাস থাকতে হয়।
বৃটিশ ভারতের পরাধীন মান্টো স্বাধীন পাকিস্তানে এসেও স্বাধীনতার দেখা পাননি। পেয়েছেন ডানাকাটা পাখির স্বাধীনতা। অখণ্ড ভারতে শুধু লেখালেখির কারণে তাঁর উপর তিনটা মামলা হয়। স্বাধীন শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানে হয় আরও তিনটা। অভিযোগ একই, অশ্লীলতা। পাকিস্তানে আসার পর মান্টোর যে গল্পটি প্রথম প্রকাশ পায় তা হলো ‘খোল দো’। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প। দাঙ্গায় স্ত্রী হারানো পিতা সিরাজুদ্দিন কন্যা সকিনার খোঁজে পাগল প্রায়। সাকিনার দৈহিক বিবরণ দিয়ে এর-ওর কাছে কন্যার তালাশ করেন। একদল স্বদেশী স্বেচ্চাসেবকের কাছে মেয়ের বিবরণ দিয়ে সন্ধান চাইলে স্বেচ্ছাসেবকদলটি মেয়ের সন্ধান পেলে তাঁর কাছে পৌঁছে দেবে বলে আশ্বস্ত করে। ফসলের খেতের ভেতর সিরাজুদ্দিনের বিধ্বস্ত কন্যাটিকে খুঁজে পেলে তাঁকে বাবার কাছে পৌঁছে দেবে বলে সঙ্গেও নিয়ে আসে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদলটি। কয়েকদিন পর স্ট্রেচারে করে সেই স্বেচ্ছাসেবীদেরই কয়েকজনকে আধ-শোয়া এক অচেতন তরুণীকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখলে আশায় পিছু নেন সিরাজুদ্দিন। ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বুঝতে পারেন তরুণীটি এখনো বেঁচে আছে। ডাক্তার কক্ষে আলো আসার জন্য সিরাজুদ্দিনকে জানালাটি দেখিয়ে বলেন, ‘খুলে দাও’। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের ফিতা খুলে দিয়ে দু’ পা ফাঁক করে দেয়! এত অসংখ্যবার সাকিনা বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে যে, ‘খুলে দাও’ শব্দ দুটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার হাত সেলোয়ারের ফিতায় গিয়ে ঠেকে।
মান্টোর বন্ধু আহমাদ নাদিম কাসমি সম্পাদিত উর্দু সাময়িকী ‘নাকুশ’-এ এই গল্প ছাপা হলে পাঠকমহলে আলোড়ন উঠে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই আলোড়নকে জননিরাপত্তার জন্য ‘খাতরাহ’ (ক্ষতিকর) মনে করেন। সরকার বাহাদুর ‘নাকুশ’ সাময়িকীটিই ছয় মাসের জন্য প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেন।
‘খোল দো’ গল্পটি মান্টোর পাকিস্তানে হিজরতের পর প্রকাশিত গল্প হিসেবে প্রথম হলেও এটিই প্রথম লিখিত গল্প নয়। মান্টোর পাকিস্তানে লিখিত প্রথম গল্প হলো ‘ঠান্ডা গোশত’। মান্টোর বন্ধু আরিফ আবদুল মতিন সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী ‘জাবিদ’ এর ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের বিশেষ সংখ্যায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রকাশের মাসাধিককাল পর ‘জাবিদ’ পত্রিকার অফিসেও পুলিশ অতর্কিত হামলা চালিয়ে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে এবং লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশকের উপর মামলা ঠুকে দেয়। অভিযোগ সেই একই— অশ্লীলতা।
‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পের প্রেক্ষাপটও ১৯৪৬ এর দাঙ্গা। দাঙ্গায় মুসলমানের খুনে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিং ঘরে ফিরে কোনোভাবেই আপন স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করতে গিয়ে সহজ হতে পারে না। স্ত্রীর সন্দেহ হয় অন্য কোনো লেড়কির সঙ্গে ঈশ্বরের দহরম-মহরম চলছে কিনা। তীব্র ঈর্ষায় ঈশ্বরেরই কৃপাণের আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াবস্থায় ঈশ্বর স্বীকার করে দাঙ্গার সময় একজন বেহুঁশ মুসলিম বালিকাকে সে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারে আসলে যাকে সে ধর্ষণ করছে সে জীবিত কেউ নয়, লাশ, বালিকার শবদেহ!
আখ্যানের তীব্র সংবেদনশীলতা কিংবা গল্পকৌশল কোনোটিরই ধার না ধেরে বরাবরের মতো অশ্লীলতার অভিযোগে মান্টোর উপর নেমে আসে মামলার খড়গ। ‘আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে, আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়’ গল্পের এমন বেহুদা ব্যাখ্যা ও আপত্তি তুলে মামলা ঠুকে দিলে লাহোর আদালত ১৯৫০ সালের ১৬ জানুয়ারি তারিখে তাঁকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন শত টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও একুশ দিন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। অবশ্য আপিল করলে ১০ জুলাই তারিখে বরাবরের মতো এ মামলা থেকেও মান্টো বেকসুর খালাস পান।
‘ঠান্ডা গোশত’ পড়ে যদি কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন তাহলে তার কোনো মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আসলে কবির কবিতা, শিল্পীর চিত্র ও লেখকের গল্প শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ মানুষের জন্য রচিত। আমার গল্প স্বাস্থ্যবান ও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের জন্য যারা নারী-পুরুষের সম্পর্ক বাঁকা চোখে দেখেন না। পৃথিবীতে এমন লোকও আছেন যারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও নোংরা ও অশ্লীলতার গন্ধ খোঁজে পান। কিন্তু এইসব লোকের যথাযথ চিকিৎসা করানো উচিত।
মান্টো তার ‘ঠান্ডা গোশতের মামলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ঠান্ডা গোশত গল্পের পটভূমিকা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ভিত্তিতে রচিত। কিন্তু এর মূল ভিত্তি মানবিক মনস্তত্ত্ব। মানুষের মানস যৌনচেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ‘ঠান্ডা গোশত’ পড়ে যদি কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন তাহলে তার কোনো মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আসলে কবির কবিতা, শিল্পীর চিত্র ও লেখকের গল্প শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ মানুষের জন্য রচিত। আমার গল্প স্বাস্থ্যবান ও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের জন্য যারা নারী-পুরুষের সম্পর্ক বাঁকা চোখে দেখেন না। পৃথিবীতে এমন লোকও আছেন যারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও নোংরা ও অশ্লীলতার গন্ধ খোঁজে পান। কিন্তু এইসব লোকের যথাযথ চিকিৎসা করানো উচিত।
‘ঠান্ডা গোশত’ গল্প একটি বাস্তব চিত্র। এতে অত্যন্ত নির্ভিকভাবে একটি মানবিক সমস্যার বাস্তব রহস্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এতে যদি কোনো প্রকার অশ্লীলতা বা নোংরামি দেখতে পান তার জন্য গল্পের চরিত্রের মানসিকতাই দায়ি, লেখক নয়। কোনো রচনার কয়েকটি শব্দকে পৃথক করে দেখে অশ্লীল আখ্যা দেওয়া অযৌক্তিক। শেষ কথা হচ্ছে, বাদীপক্ষ আমার গল্প ‘ঠান্ডা গোশত’ এর কোনো প্রকার সাহিত্যিক সমালোচনা করেনি, তা করলে আমি আনন্দিত হতাম। গল্পে যদি কোনো প্রকার শিল্প দুর্বলতা, শব্দ যোজনা ও শব্দ চয়নে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তা ধরে দিলে খুশির ব্যাপার হতো। অথচ আমি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। আমার বিরুদ্ধে আভিযোগ, আমি গল্প লিখে মানুষের অনুভূতিকে আহত করেছি। এর বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আশ্চর্যের বিষয়, ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্প পড়ে পাঠকের মনে ঘৃণা ও ভীতি সঞ্চারের পরিবর্তে ক্ষোভ জমতে পারে। তাছাড়া ঈশ্বর সিং-এর এইরূপ ভয়াবহ শাস্তিলাভ সত্বেও মানুষের মনে ও কল্পনায় নোংরা মনোভাব কিভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারে?’ (অনুবাদ: জাফর আলম)
‘আমার লেখনী আপনাদের তেতো মনে হয়; কিন্তু এ পর্যন্ত যে সব মিষ্টি ঘটনা মধুর করে রচিত হয়েছে তা কি মানবতার কোনো উপকারে এসেছে? নিমের পাতা তেতো সত্য কিন্তু তা রক্ত পরিষ্কার করে এতে কোন সন্দেহ নেই।’
মান্টোর পরিচয় তাঁর লেখা ছাড়া অন্য কোনোভাবে দিলে তা যথাযথ হয় না। যদিও উদ্ধৃতি বড়ো দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তবু আরও একটা উদ্ধৃতি দিয়েই তার পরিচয় পর্ব শেষ করছি। এ অংশেরও অনুবাদ করেছেন জাফর আলম। মান্টো তার ‘গল্পলেখক ও অশ্লীলতা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘যারা ভাবেন আধুনিক লেখকরা সাহিত্যে যৌনসমস্যার সৃষ্টি করছে, তারা ভুল করছেন, কেননা আসলে যৌন সমস্যাই আধুনিক সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। এই আধুনিক সাহিত্যে যখন আপনারা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান তখন আঁতকে ওঠেন। সত্যকে যতই চিনি মিশিয়ে খান না কেন, এর তিক্ততা দূর হবে না। আমার লেখনী আপনাদের তেতো মনে হয়; কিন্তু এ পর্যন্ত যে সব মিষ্টি ঘটনা মধুর করে রচিত হয়েছে তা কি মানবতার কোনো উপকারে এসেছে? নিমের পাতা তেতো সত্য কিন্তু তা রক্ত পরিষ্কার করে এতে কোন সন্দেহ নেই।’
স্যাম চাচাকে লেখা চিঠি ও মান্টোর মাজেজা
১৯৫১ সাল। সময়টা কোরিয়ার যুদ্ধের। পাকিস্তানকে কোরিয়ায় সেনা পাঠানোর আহ্বান করে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান এ আহ্বান প্রত্যাখান করে। এই প্রত্যাখানের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিল্প-সাহিত্য বলয়ের সহমর্মিতা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্র। কোল্ড ওয়ারে রাশিয়া ও আমেরিকা– দুই শিবিরে বিভক্ত পাকিস্তানি কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নানাভাবে দলে ভেড়ানোর তদবির ও তৎপরতা চালায় আমেরিকা।
একদিন লাহোরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কিন অফিস United State Information Service (USIS) এর অফিসার মিস্টার স্মিথ একজন পাকিস্তানি স্টাফকে সঙ্গে নিয়ে মান্টোর বাসায় হাজির হোন। স্মিথ মান্টোকে অনুরোধ করেন USIS এর ম্যাগাজিনের জন্য কিছু লিখতে। মান্টো বলেন, আমি কেবল একজন উর্দু সাহিত্যের লেখক। ইংরেজিতে লিখি না। স্মিথ আশ্বস্ত করেন, লেখা উর্দুতেই প্রকাশিত হবে। তার উর্দু লেখাই চাই। উত্তরে মান্টো বলেন, আমি শুধু তাই লিখব যা আমি চাই। স্মিথ বলেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। লেখার ক্ষেত্রে মান্টো স্বাধীন।
লেখার সম্মানীর প্রশ্নে স্মিথ বলেন, প্রতিটি লেখার বিপরীতে USIS তাকে পাঁচ শ রুপি সম্মানী দেবে। মান্টো তা নাকচ করে দেন। তিনি দুই শ রুপির বেশি নিতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। শেষমেষ স্মিথের চাপাচাপিতে তিন শ রুপি নিতে রাজি হোন মান্টো। টাকাপয়সা নিয়ে আর কোনো বাতচিত করে তাকে বিরক্ত না করতেও বলে দেন।
কয়েকদিন পর হাস্যোজ্বল মুখে মান্টো USIS অফিসে গিয়ে হাজির হোন। থলে থেকে একটি খাম বের করে সিনিয়র মার্কিন অফিসার মিস্টার উইথুস এর হাতে দেন। খাম খুলে তো উইথুসের আক্কেলগুড়ুম! খামের ভেতর ‘স্যাম চাচাকে লেখা মান্টোর প্রথম চিঠি’। প্রথম চিঠিতে মান্টো তীব্র বিবমিষার সঙ্গে দাঙ্গা ও দেশভাগের অসারতা নিয়ে আলোচনা করেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক পাকিস্তান ও ইংরেজদের শাসন-শোষণ অত্যন্ত শ্লেষের সঙ্গে তুলে ধরেন। নাটের গুরু আমেরিকার ভণ্ডামীকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বাকস্বাধীনতার দাবিদার আমেরিকাও গডজ লিটল এক্টর নামের উপন্যাসে অশ্লীলতার দায়ে আমেরিকান লেখক আরস্কিন কল্ডওয়েলের উপর মামলা করে দেয়। মান্টো তার প্রথম চিঠিতে এ প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন চাচাজান, তার উপন্যাস নিয়ে সাত স্বাধীনতার দেশে অশ্লীলতার দায়ে মামলা হয়েছে শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছি। আপনাদের ওখানে তো সবই নগ্ন। আপনারা তো সবকিছুরই খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখেন। তা ফল হোক বা আওরত, যন্ত্র কি জানোয়ার, বই কিংবা ক্যালেন্ডার। আপনারা তো নগ্নতার সম্রাট। আমার ধারণা ছিল আপনাদের দেশে পবিত্রতার নামই হবে অশ্লীলতা।’
তারপর একেএকে আরও আটটি চিঠি লিখলেন মান্টো। এসব চিঠিতে এমন এক দেশ আর সাম্রাজ্যবাদীগোষ্ঠী নিয়ে মান্টো কথা বলছেন, নাইন-ইলেভেনের পর যাদের সাম্রাজ্যবাদী নখর আরও তীব্র হয়েছে। পুরো বিশ্বের উপর দারোগার ছড়ি ঘোরাচ্ছে এই গোষ্ঠিটিই। আজ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র বাকওয়াজ তুলে পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দেওয়ার ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে যে দেশটি মান্টো সেই দেশটির পূণ্যের ফিরিস্তি টেনে বলছেন, ‘আপনি তো বহু পূণ্যের কাজ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। আপনি হিরোশিমাকে দুনিয়া থেকে মুছে দিয়েছেন। নাগাসাকিকে ধোঁয়া ও ভাগাড়ে পরিণত করেছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে জাপানে লাখ লাখ আমেরিকান শিশুর জন্ম দিয়েছেন।’ এইসব জানিয়ে মান্টো স্যাম চাচার কাছে ভাতিজা হিসেবে আবদারের ভাষায় ভারত-পাকিস্তানের ভেতর যে যুদ্ধের উসকানি ও উত্তেজনা তৈরি করে মোড়লরাষ্ট্রটি ফায়দা লুঠে তা দেখিয়ে দিয়ে চমৎকার চপেটাঘাত করেছেন। মান্টো লিখছেন, ‘আমেরিকান ওভারকোট এক দারুণ জিনিস। এ বস্তুটি ছাড়া আমাদের লেন্ডা বাজার একেবারে অসম্পূর্ণ। কিন্তু আপনি পায়জামা পাঠান না কেন? আপনারা কি পায়জামা তৈরি করেন না? নাকি হিন্দুস্তানে পাঠিয়ে দেন? আপনি বড়ো চালাক চাচাজান। এদিকে কোট পাঠান, ওদিকে পায়জামা। যুদ্ধ বাঁধলে আপনার কোট, আপনারই পায়জামা এবং আপনারই পাঠানো অস্ত্র-বারুদ দিয়ে লড়াই হবে।’
যে পাকিস্তানের তখনকার অংশ এই বাংলাদেশও, সেই পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সমস্যা নিয়ে সাহিত্যভাষায় কখনো প্রচণ্ড বিবমিষায়, কখনোবা কৌতুকরসে বর্ণনা করে গেছেন দেশভাগ ও ভারত-পাকিস্তান নিয়ে আমেরিকার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের বয়ান। কখনো সরাসরি, কখনো অর্থবহ ইঙ্গিতের মাধ্যমে। মান্টো এই চিঠিগুলোতে ধর্ম ও রাজনীতির এমন বহু তর্কিত বিষয়ে চাবকিয়েছেন যেসব বিষয় আজও সমান সত্য, আজও বাস্তব।
যেসব কথা বলা জরুরি অথচ এক অভূতপূর্ব দুঃসময়ের মাঝখানে বসে যা করার সাহস আমাদের নাই সেসব অবিশ্বাস্য সাহসী আর জরুরি কথামালাই মান্টোর মুখে শোনা যায় চিঠিগুলো পড়লে। উপমহাদেশের তীব্র তেজী আর ত্যাড়া এই লেখকের চিঠিগুলো তাই সময়ের তাগিদেই আমাদের পড়তে হয়। আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধে বিভক্ত দুনিয়ার তৃতীয় বিশ্বের একজন বাসিন্দা হিসেবে মান্টো যা লিখে গেছেন তা আজকের সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল ও তাদের দেশীয় দালাল শ্রেণিটিকে চিনতে দারুণভাবে সাহায্য করে। বৈশ্বিক রাজনীতির বহু অন্ধকার দিক ফকফকা হয়ে যায় এতে। নামে চিঠি হলেও আদতে এগুলো চিঠি নয়, ইতিহাসের অমূল্য এক খতিয়ান। যা দক্ষিণ এশিয়ার একজন সেরা গল্পকারের হাত দিয়ে চমৎকার গল্পের ভাষায় লিখিত।
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক সালেহ ফুয়াদের জন্ম জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জে। বেড়ে উঠেছেন সিলেটে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোয় কর্মরত রয়েছেন। সালেহ ফুয়াদ আরবি, উর্দু ও ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে থাকেন সচরাচর। পদ্মভূষণপ্রাপ্ত বিখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘সালমান রুশদি ও মিছিলের রাজনীতি’ উর্দু থেকে অনূদিত তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনূদিত দ্বিতীয়গ্রন্থ ‘ইনতেজার হুসেইনের শ্রেষ্ঠগল্প’। অনুবাদ করেছেন ইনতেজার হুসেইনের ম্যানবুকার হ্রস তালিকাভুক্ত উপন্যাস ‘বাস্তি’ ও বিখ্যাত উর্দু ছোটোগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ‘স্যাম চাচাকে লেখা মান্টোর চিঠি’।