মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

মেয়েটি পরিস্থিতির শিকার

0

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রানা হামিদ খুন হয়েছেন বান্ধবীর হাতে।

শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে খবরটি দেখে চমকে উঠি। বিস্তারিত পড়ে আমি স্তম্ভিত। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আরও কয়েকটি পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে চোখ বুলাই। টিভি স্ক্রলেও ভাসছে খবরটি, ছোটো শিরোনামে। সহসা মনে পড়ে কয়েক দিন আগের কিছু ঘটনা।

 

তখন মধ্যাহ্ন বিরতি চলছিল। প্রথমে ওকে চিনতে পারিনি। ও আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল; হয়তো চেনার চেষ্টা করছিল। চেনা চেনা মনে হওয়ায় আমিও কয়েকবার তাকালাম। কিন্তু ওর পাশে অন্তরঙ্গ অবস্থায় একজন বয়স্ক লোককে দেখে আমার মনে সন্দেহ জাগে।

 

২.
সেদিন হঠাৎ বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা। আমরা বসেছিলাম ওদের পাশের সারিতে। তখন মধ্যাহ্ন বিরতি চলছিল। প্রথমে ওকে চিনতে পারিনি। ও আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল; হয়তো চেনার চেষ্টা করছিল। চেনা চেনা মনে হওয়ায় আমিও কয়েকবার তাকালাম। কিন্তু ওর পাশে অন্তরঙ্গ অবস্থায় একজন বয়স্ক লোককে দেখে আমার মনে সন্দেহ জাগে। ভাবলাম, অন্য কারও সঙ্গে আমি বোধ হয় স্নিগ্ধাকে গুলিয়ে ফেলছি।

ছবি দেখা শেষে হল থেকে বের হওয়ার সময় স্নিগ্ধা আমাকে ইশারা করল। কাছে এসে নিচু গলায় বলল, তুমি পলাশ না?

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম, তুমি স্নিগ্ধা। তাই না?

হুম। চিনতে পেরেছ তাহলে।

তারপর ও আমাকে একপাশে টেনে নেয়। একটু আলাদা হতেই আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, কেমন চলছে? কী করো এখন? কোথায় থাকো? এমন বুড়িয়ে গেছ কেন?

একসঙ্গে এত প্রশ্ন শুনে ও থমকে যায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বলল, আগে তোমার কথা শুনি।

আমার কথা কী বলব। চাকরি, সংসার আর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। তবে ভালো আছি বলতেই হবে।

তোমার লেখা তো মাঝে মাঝে পত্রিকায় পড়ি। একটি উপন্যাসও কোথায় যেন পড়েছি। ও মনে পড়েছে। রানার কাছে ছিল। বেশ ভালোই তো লিখো। অথচ দেখো ভার্সিটিতে থাকতে তোমার এই বিশেষ গুণটির কথা আমরা কেউ জানতাম না। কারও কাছে এই ব্যাপারে কখনো শুনিনি।

ওর কথায় আমি সংকুচিত হয়ে যাই। তবু সৌজন্যের খাতিরে ধন্যবাদ দিই। স্নিগ্ধা বলল, জানো পলাশ, আমি একদম ভালো নেই।

কেন? প্রশ্ন করি আমি।

আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। কোথা থেকে যে কোথায় চলে এলাম। অতীতকে মুছে ফেলতে চাই; কিন্তু পারছি না। বারবার মনের কোণে হানা দেয় পুরোনো স্মৃতি। বর্তমান সময়টাও সুখকর নয়।

কথাগুলো বলার সময় স্নিগ্ধার মুখ বিষাদে ছেয়ে যায়; ওকে মনে হয় অনেক দূরের এক মানুষ যেন সমুদ্রের ওপার থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছে।

স্নিগ্ধা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী। ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়নি বা প্রেমে পড়েনি, এমন ছেলে আমাদের ক্লাসে খুব কম ছিল। শুধু আমাদের ক্লাস কেন, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাইয়েরাও ওর প্রতি দুর্বল ছিল। নানা ছুতায় তারা ক্লাসের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ওর চোখ জোড়া। সেই নীল চোখের মণিতে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গের ব্যথায় কতজন যে কষ্টের সাগরে ভেসেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ওর জন্য সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া ছিল সুমন। সুমন ওকে নিয়ে যে কত রকম কাহিনি বানিয়ে বানিয়ে আমাদের শোনাত; স্নিগ্ধাকে পেলে কী কী করত, তা নিয়ে গল্প ফাঁদত। এমনকি বেশ কিছু কবিতা লিখেছিল ওকে নিয়ে। সুমনের এসব গল্প-কবিতা আমরা গিলতাম তন্ময় হয়ে। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ওর জন্য সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া ছিল সুমন। সুমন ওকে নিয়ে যে কত রকম কাহিনি বানিয়ে বানিয়ে আমাদের শোনাত; স্নিগ্ধাকে পেলে কী কী করত, তা নিয়ে গল্প ফাঁদত। এমনকি বেশ কিছু কবিতা লিখেছিল ওকে নিয়ে। সুমনের এসব গল্প-কবিতা আমরা গিলতাম তন্ময় হয়ে। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।

তবে একটি বিষয় সবার চোখে ধরা পড়ত, স্নিগ্ধা ক্লাসের কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলত না। পুরো ভার্সিটি জীবন পার করেছে কোনো সহপাঠীর সঙ্গে কথা না বলে। প্রথম দিকে একবার লিটন নামের আমাদের এক বন্ধু শুধু কেমন আছো জিজ্ঞেস করায় স্নিগ্ধার ঝাড়ি খেয়েছিল। তারপর থেকে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলার সাহস করত না।

স্নিগ্ধার এই আচরণে অনেকে হাসাহাসি করত। কেউ কেউ বলত, ওর প্রেমিক মনে হয় মাথার দিব্যি দিয়েছে—কোনো ছেলের সঙ্গে যেন কখনো কথা না বলে। ও ওই হুকুম তামিল করে চলেছে। পতিব্রতার সঙ্গে মিলিয়ে প্রেমিকব্রতা মেয়ে বলে কেউ কেউ ইয়ার্কি করত আড়ালে। আবার কেউ বলত, ও মনে হয় লেসবিয়াইন। কারণ, ওর একমাত্র বান্ধবী ছিল সুরমা। অথচ সুরমার প্রেমিক ছিল। সুরমা প্রেমিকের হাত ধরে ক্যাম্পাসে ঘুরলেও স্নিগ্ধার প্রেমিককে আমরা কেউ কখনো দেখিনি। সুরমাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেও কখনো কিছু জানা যায়নি।

ভার্সিটি ছাড়ার পর অনেক দিন কেটে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল চাকরিবাকরি আর ঘরসংসার নিয়ে। এর মধ্যে একদিন সুমনের কাছে জানতে পারলাম, স্নিগ্ধা বিয়ে করেছে আমাদের এক সহপাঠী অপূর্বকে। তা-ও ঢাকায় নয়, বিয়ে হয়েছে সিডনিতে। কবে কখন ওরা সিডনিতে গিয়েছিল, তা আমরা কেউ জানতাম না। ফেসবুকের কল্যাণে ওদের যৌথ জীবনের কথা জানতে পেরেছিলাম। ছবি দেখে ধারণা করতাম ওরা বেশ ভালো আছে। কিন্তু এখন ওর পাশে আমি এ কাকে দেখছি? কিছুটা সংকোচ হলেও প্রশ্ন করলাম, অপূর্ব কোথায়?

আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে।

কখন?

বছর তিনেক আগে। তারপরই আমি ঢাকায় চলে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় আর ভালো লাগছিল না।

তোমার পাশে ইনি কে? ওনাকে তো চিনতে পারছি না।

রানা হামিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান। পাশাপাশি কবিতা লেখেন। বিদ্বান ব্যক্তি।

খুব ভালো। তো তোমরা কি বিয়ে করেছো?

না। রানা আমার বয়ফ্রেন্ড। লিভ টুগেদার করছি।

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এ কী শুনছি! ‘লিভ টুগেদার’ শব্দটি ও এমনভাবে উচ্চারণ করল, যেন এটা ইউরোপ কিংবা আমেরিকা। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওকে প্রশ্ন করি, তাহলে ভালো নেই কেন বলছ?

এবার স্নিগ্ধার মধ্যে একটু তাড়াহুড়ো দেখি। আমাকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, তুমি ফোন দিয়ে একদিন আমার অফিসে এসো। তখন সব কথা বলব।

ওর কথায় বেশ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি একজন কথাশিল্পী। সব সময় গল্পের সন্ধানে ফিরি। তাই নিজের কৌতূহল দমন করতে পারলাম না। বললাম, তোমার আপত্তি না থাকলে অফিস শেষে কাল বিকেলে দেখা করতে পারি।

ঠিক আছে বলে স্নিগ্ধা রানা হামিদের হাত ধরে চলে যায়। আমি চেয়ে থাকি নিষ্পলক।

কপোত-কপোতীর মতো ওদের চলে যাওয়া দেখে তাদের সুখী দম্পতি বলেই আমার মনে হয়েছিল। কারণ, এমনভাবে হাঁটতে সচরাচর কোনো দম্পতিকে ঢাকায় দেখা যায় না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে ও নিজেকে অসুখী বলল কেন! আমি সমীকরণ মেলাতে পারিনি।

পরদিন অফিস থেকে একটু আগে বের হয়ে স্নিগ্ধার অফিসে পৌঁছাই। ও আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

 

৩.
পলাশ, তুমি গতকাল জানতে চেয়েছিলে কেন ভালো নেই আমি। প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া আমার জন্য সত্যি কঠিন। এর নেপথ্যে আমার মনে অনেক চিন্তা খেলা করে—স্নিগ্ধা একটানে বলে যায় কথাগুলো।

একটু খুলে বলো। আমি সব শুনতে চাই।

স্নিগ্ধা একটু নড়েচড়ে বসে। তারপরই ওর কাহিনি শুরু করে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি।

তোমাদের ধারণা ছিল, বিশেষ কোনো সমস্যার কারণে আমি ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতাম না। আসলে তা নয়। আমি ক্লাস সেভেন থেকে ভালোবাসতাম শিমুল নামের আমাদের পাড়ার এক বড়ো ভাইকে। শিমুল আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। পরে সে ডাক্তার হয়। তার প্রতি আমি একনিষ্ঠ ছিলাম। বলা যায়, আমার মনে বেশ কিছু সংস্কার গেঁথে ছিল তখন। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর আমার মানসিকতায় বেশ পরিবর্তন আসে। বুঝতে পারি নিজের ভুল। হয়তো ওই সব সংস্কারের কারণে কোনো ছেলের সঙ্গে তখন মিশতাম না। তা ছাড়া কথা বলতে ভালোও লাগত না। তাই লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।

আমার মাস্টার্স পরীক্ষার পরপর ধুম করে শিমুল বিয়ে করে ফেলে। জানতে পেরেছিলাম, সে তার মা-বাবার কারণে রাজি হয়েছিল বিয়েতে; তার মা নাকি মৃত্যুশয্যায় তাকে বাধ্য করেছিল। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একদম ভেঙে পড়ি। আত্মহত্যার কথাও ভাবি বেশ কয়েকবার। মা-বাবার কথা ভেবে তা পারিনি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিই বিদেশ চলে যাওয়ার; বাবা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। একটু চেষ্টায় পেয়ে যাই স্কলারশিপ। একই স্কলারশিপ পায় অপূর্ব। অপূর্বর সঙ্গে দেশে থাকতে আমার কখনো কথা হয়নি; সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর। চরম মানসিক অবসাদগ্রস্ততার কালে অপূর্ব আমার পাশে দাঁড়ায়।

আমি আসলে রাগের মাথায় সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। বিয়ের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা কিছুদিনের মধ্যে টের পাই। কারণ, আমরা দুজন ছিলাম সম্পূর্ণ দুই পৃথিবীর মানুষ। আসলে ভুলটা আমারই ছিল। আমি বারবার অপূর্বর মধ্যে শিমুলকে খুঁজতাম।

ধীরে ধীরে আমি অপূর্বর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই। আমি আসলে রাগের মাথায় সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। বিয়ের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা কিছুদিনের মধ্যে টের পাই। কারণ, আমরা দুজন ছিলাম সম্পূর্ণ দুই পৃথিবীর মানুষ। আসলে ভুলটা আমারই ছিল। আমি বারবার অপূর্বর মধ্যে শিমুলকে খুঁজতাম। অভিযোগ করতাম, ও কেন শিমুলের মতো নয়। বুঝতে চাইতাম না যে, দুজন মানুষ কখনো একরকম হয় না।

বছরখানেকের মাথায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আলাদা হয়ে যাব। অপূর্ব এই নিয়ে আমার ওপর কোনো ধরনের জোরজবরদস্তি করেনি। সে জন্য মনে হয়েছিল, ও আসলে আমাকে ভালোবাসে না। নইলে ভালোবাসার দাবি নিয়ে কেন আমার সামনে একবারও দাঁড়ায়নি। বিষয়টা আমাকে ভীষণ মর্মাহত করে।

তারপর আমি চলে আসি দেশে। অপূর্ব থেকে যায় সেখানে।

ফেরার সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনো বিয়ে করব না। একা একা বেশ ভালোই সময় কাটাচ্ছিলাম। নিজের মতো করে পার করছিলাম দিন। এভাবে চলে যেতে পারত! হঠাৎ একদিন ফেসবুকে পরিচয় হয় রানার সঙ্গে। রানার বিভিন্ন স্ট্যাটাস পড়ে আমি অবাক হতাম। রীতিমতো মুগ্ধ বলা যায়। ওর প্রকাশিত বইগুলো সংগ্রহ করে পড়তাম। বুঝতে পারলাম রানা আর অন্য দশটা মানুষের মতো নয়।

এমন মুক্তমনা পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ আমি জীবনে দেখিনি, যার কাছে নিজের সব কথা অকপটে বলা যায়। আমার জীবনের অনেক ঘটনা তাকে বলেছিলাম। শুনে সে সেদিন খুব হেসেছিল। খেয়াল করলাম, সে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার তীব্র বিরোধী। কথায় কথায় একদিন আমি দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। সে-ও সাড়া দেয় আমার প্রস্তাবে।

তারপর থেকে আমরা প্রায়ই দেখা করি। ফুৎকারে উড়িয়ে দিই বয়সের ব্যবধান। সিদ্ধান্ত নিই একসঙ্গে থাকব। একসময় বুঝতে পারি রানা হামিদ আমাকে সন্দেহ করে। সে নদীর চরের মতো পরিপূর্ণ দখলে রাখতে চায় আমাকে। এখানেই তার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায় আমি জানি না।

আর একটা কথা তোমাকে বলছি। রানা অনেকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এসব দ্বন্দ্বের কারণ একটাই। সে সব নিজের মতো করে চায়। তাঁর চরিত্রের এই দিকটি আমার একদম পছন্দ নয়। প্রায়ই মনে হয়, আবার একটা ভুল করছি।

 

 

৪.
টিভিতে খবরটি দেখে যখন স্নিগ্ধার কথা ভাবছি, তখনই আমার মোবাইলে স্নিগ্ধার কল। স্ক্রিনে নাম দেখে চমকে উঠি। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই হাউমাউ কণ্ঠ। কাঁপা গলায় ও বলে, আমি তোমার বাসার কাছে আছি। আমাকে নিয়ে যাও।

ভয় পেলেও ওকে সাহস দিয়ে বলি, তুমি সাবধান থাকো। আমি আসছি।

নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখি, স্নিগ্ধা কাঁদছে। আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে বারবার। আমাকে দেখে যেন ও অথই সমুদ্রে খড়কুটোর দেখা পেয়েছে যা প্রকাশ পাচ্ছে ওর অভিব্যক্তিতে।

বারবার ওকে শান্ত হতে বলি। আমার স্ত্রীও ওকে আশ্বস্ত করে।

সত্য ঘটনা কী? প্রশ্ন করি আমি।

স্নিগ্ধা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল, আমি কখনো পুরুষ চিনতে পারিনি। যদি ভার্সিটিতে ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম, আজ আমার এই দশা হতো না। তুমি তো জানো, রানা আমাকে অতিমাত্রায় অধিকারে রাখতে চেয়েছিল। আমি কারও সঙ্গে মিশি তা সে মেনে নিতে পারে না; কিন্তু তা হতে দেব কেন? শিমুল বা অপূর্বর বেলায় যে ভুল করেছি, তা আর হতে দিতে চাই না।

গতকাল সন্ধ্যায় রানা বাসায় ছিল না। তখন দেখা করতে এসেছিল আমার সদ্যপরিচিত এক বন্ধু। শোভন। ব্যবসায়ী। অনেক টাকার মালিক। ওর সঙ্গেও পরিচয় ফেসবুকে।

হঠাৎ কলবেলের আওয়াজে আমি চমকে উঠি। দরজা খুলে দেখি, রানা টলছে। আমার ধারণা, সে ড্রিংক করে বাসায় ফিরেছিল। গলা ছিল খুব চড়া। হয়তো বারে কোনো বন্ধুর সঙ্গে ঝামেলা করেছিল। মদ খেয়ে এমন ঝামেলা সে মাঝে মাঝেই করত।

শোভনকে দেখা মাত্র রানার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কোনো ভূমিকা ছাড়াই অকথ্য ভাষায় আমাদের দুজনকে গালিগালাজ করে।

আমি টের পাই, রানার মেজাজ দেখে শোভন ক্রোধে ফুঁসছে। তবে কিছু না বলে শোভন বের হয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে কোমল স্বরে শোভন শুধু বলে, এই অপমানের বদলা আমি নিব।

তুমি তো সেদিন অনেকের সঙ্গে রানা হামিদের দ্বন্দ্বের কথা আমাকে বলেছিলে। কার কার সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। জানতে চাই আমি।

অনেকের সঙ্গে ছিল। সম্পত্তি-সম্পর্কিত বিষয়ে ভাইদের সঙ্গে বিরোধ ছিল; দ্বন্দ্ব ছিল ভার্সিটির এক ছাত্রনেতার সঙ্গে। কয়েকজন কাছের বন্ধুও বৈষয়িক কারণে তাঁর শত্রু হয়ে উঠেছিল। স্ত্রী নীলার সঙ্গে তাঁর বনিবনা ছিল না। তাই আলাদা থাকত তাঁরা; তবে টাকা-পয়সা নিয়ে ফোনে ঝগড়া হতো তাঁদের মধ্যে। নীলা প্রায়ই তাঁকে শাসাতো; দেখে নেওয়ার হুমকি দিতো।

আমি স্নিগ্ধাকে আর কোনো প্রশ্ন করি না। করতে পারি না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার কোলাপাড়া গ্রামে। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: ‘দিব্যপুরুষ’ (উপন্যাস), ‘হরিশংকরের বাড়ি’ (গল্প), ‘বাংলা দেশে বাঙালির দেশে’ (ভ্রমণকাহিনি)। প্রধান সম্পাদক : সম্প্রীতি সাহিত্য পত্রিকা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।