বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

কমলা দাসের গল্প : লক-আপ

0

রত্মামা একটা কিছু নিয়ে জেগে উঠেছে। সে স্বপ্নে দেখেছে যে, বুকের দুধ পান করার জন্য তার শিশু সন্তান কাঁদছে। কিন্তু সন্তানটি তার পাশে নেই। কারাগারের বাতি উজ্জ্বল আলোয় জ্বলছে এবং রাতকে মধ্যাহ্নের মতো আলোকিত করে তুলেছে। সে অন্য আরও দু’জন মহিলার সঙ্গে মেঝেতে শুয়ে আছে। মহিলা দু’জন নেহায়েত রাস্তার মেয়ে, সাধারণ যৌনকর্মী। আগের দিন রত্মামা একজন পুলিশকে বলতে শুনেছে যে, এক সপ্তাহের মধ্যে ওদেরকে ছেড়ে দেবে।

‘কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে না, বাজে মহিলা!’ একজন পুলিশ রত্মামার চুল ধরে টেনে বাঘের মতো গর্জন করে বলল। ‘তুমি কী রাজনীতিবিদ? এখানে এক মাস থাকো, তাহলে জানতে পারবে তোমার রাজনীতি কতটা নোংরা…’

রত্মামাকে মাঝরাতে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কাছ থেকে স্বল্প পরিমানে সহানুভূতি পাওয়ার জন্য সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। তাকে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় হয়তো তার প্রতিবেশিরা বলাবলি করেছে, ‘অই তো! আমরা কি আগে বলিনি, আপনি যেই পথে যাচ্ছেন, আপনাকে শীঘ্রই আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলা হবে।’ অধিকন্তু তার শিশুসন্তানও হয়তো জেগে উঠেছে এবং চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। যেই মুহূর্তে সন্তানটি ঘুম থেকে জেগে উঠবে, ঠিক তখনই সে তার মায়ের বুকের দুধ পান করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। রত্মামার বান্ধবীরা বলেছে, কেন সে বাচ্চাকে স্তন্যপান করা বন্ধ করেনি, যদিও তার শিশু-সন্তানের বয়স নয় মাস। সেই সব দিনগুলোতে সে কখনই ভাবতে পারেনি যে, এক সময় তাকে কারাগারের অভ্যন্তরে সময় কাটাতে হবে। সত্যি, অনেক জায়গায় সে জান সিংয়ের জন্য বক্তৃতা দিয়েছে। কিন্তু সে কখনই হিংসাত্মক কাজ করা কিংবা বিপ্লব বিশ্বাস করত না। তারপরও কারাগারের ভেতর তাকে পুলিশের হাতে নগ্ন হতে হয়েছে এবং স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অমানবিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, এমনকি লাঞ্ছনাও সহ্য করতে হয়েছে। তবে সে শুনতে পেরেছে যে, যদি পুলিশের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে, তবেই তাকে নিস্কৃতি দেওয়া হবে। কিন্তু তার কাছে কী এমন গোপন তথ্য রয়েছে? কিছুই না। সুতরাং লাঠির আঘাতে পা ভাঙার পরেও সে কোনো কথা বলতে পারেনি। এছাড়া লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। অনেকবার এবং প্রায় প্রতিবারই সে জ্ঞান হারিয়েছে। এভাবেই তার জীবনে একের পর এক কালো এবং বর্বর রাত কেটে যেতে থাকে। কিন্তু রাত্তিরে এবং দিনের বেলা কারাগারের বাতিগুলি শক্তিশালী উজ্জ্বল আলোয় জ্বলতে থাকে।

‘আপনি কী ঘুমাতে পারেন না?’ রত্নামার পাশে শুয়ে থাকা মহিলাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করে। মহিলা ভীষণ জোরে মাথা চুলকাচ্ছিল। ‘জঘন্য উকুন!’ সে বলল।

‘আমি শুনেছি যে, তুমি যদি চুলে তুলসী পাতার রস দিয়ে ভালো করে ঘষো, তাহলে উকুন চলে যাবে,’ রত্নামা বলল।

মহিলা উঠে বসে। তার পরনে ফুটকি আঁকা শাড়ি। পানের রসে তার সব দাঁত কালচে হয়ে গেছে।

‘নিশ্চয়ই আপনি শিক্ষিতা,’ মহিলা বলল। ‘আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি লেখাপড়া জানেন এবং ভদ্র পরিবারের নারী।’

রত্নামা হাসির চেষ্টা করে। তার ঠোঁটে ব্যথা এবং ঠোঁট ফুলে গেছে।

‘শুনেছি যে, বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে আপনাকে পাকড়াও করে এখানে এনেছে,’ মহিলা বলল। ‘আপনি যদি বক্তৃতা দেন, তবে তা ভুল। আপনি যখন অভূক্ত থাকবেন এবং যদি কোনো পুরুষের কাছে যান, তা-ও ভুল। আসলে সবকিছুই ভুল। মহিলারা যা করে, তা সবই ভুল।’

‘পুরুষরাও গ্রেফতার হয়,’ রত্নামা বলল। ‘কাল রাতে আমি একজন পুরুষের কান্না দীর্ঘ সময় শুনতে পেয়েছি। নিশ্চয়ই তাকে কঠোর শাস্তি দিয়েছে।’

‘পুরুষদের পিটিয়ে ওরা মজা পায় না। আমাদের উলঙ্গ করে শাস্তি দেওয়ার মধ্যে ওরা আনন্দ উপভোগ করে।’

‘পুরুষরাও গ্রেফতার হয়,’ রত্নামা বলল। ‘কাল রাতে আমি একজন পুরুষের কান্না দীর্ঘ সময় শুনতে পেয়েছি। নিশ্চয়ই তাকে কঠোর শাস্তি দিয়েছে।’

‘পুরুষদের পিটিয়ে ওরা মজা পায় না। আমাদের উলঙ্গ করে শাস্তি দেওয়ার মধ্যে ওরা আনন্দ উপভোগ করে।’

‘আমি শুনেছি যে, আগামি সপ্তাহে তোমরা দু’জন ছাড়া পাবে,’ বলল রত্নামা। ‘তোমরা রক্ষা পাবে।’

‘রক্ষা?’ বারবণিতা বিড়বিড় করে। ‘বছরে আমাদের পাঁচ কিংবা ছয়বার এখানে নিয়ে আসে এবং শাস্তি দেয়। তারপর ছেড়ে দেয়। আমি এখানে অনেকবার এসেছি। কী আর করতে পারি? ঘরে তিন সন্তান… ওরা কী দিনে একটি বারের জন্যও সন্তানদের খাবার দিতে পারে না? সেই জন্যই রাতে কেউ এসে ডাকলে আমি বাইরে যাই এবং তা আমার নিজের আমোদ-আহ্লাদের জন্য নয়।’

রত্নামা আর্তনাদ করে উঠে। তার মাথাও জখম হয়েছে। গুলির গতিতে তীব্র ব্যথা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো অনবরত ছিঁটকে বেরিয়ে আসছে।

ঘরে তিন সন্তান… ওরা কী দিনে একটি বারের জন্যও সন্তানদের খাবার দিতে পারে না? সেই জন্যই রাতে কেউ এসে ডাকলে আমি বাইরে যাই এবং তা আমার নিজের আমোদ-আহ্লাদের জন্য নয়।

‘আমি কী আপনার মাথা টিপে দিব?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করে। রত্নামা না-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তারপরও মধ্য বয়সী বারবণিতা তার কোলের ওপর রত্নামার মাথা রাখে এবং আলতোভাবে কপাল টিপে দেয়। রত্নামার চোখ ভিজে যায়।

‘কাঁদবেন না,’ বলল বারবণিতা। ‘মেয়ে হয়ে জন্মালে সব ধরণের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। দুঃখ-কষ্ট তো থাকবে, কিন্তু তা নিয়ে কী-ইবা করা যাবে? ওদের কেবল বলে দেন যে, আপনি আর কখনও বক্তৃতা করবেন না। তাহলে ওরা আপনাকে ছেড়ে দিবে।’

বুকের দুধে রত্নামার ব্লাউজের সামনের অংশ ভিজে গেছে। তা দেখে বারবণিতার খুব কষ্ট হয়। ‘আহা! নিশ্চয়ই এখন আপনার বেচারা শিশুটি দুধ পান করার জন্য কান্না করছে। শয়তানগুলি! ঈশ্বর যেন ওদের জলবসন্ত রোগ দেয়। অনেক নির্দয় শাস্তি!’

‘আমার মাথায় এবং হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা,’ বলল রত্নামা। ‘কিন্তু ব্যথা আমি সহ্য করতে পারছি না।’ সে আর্তনাদ করে এবং হাত দিয়ে তার উরোজ চাপতে থাকে।

‘আপনার বাচ্চার নাম কী?’

‘মোহানান,’ বলল রত্নামা। ‘আমি ওকে উন্নি ডাকি।’

‘আমার ছোটো ছেলের নামও উন্নি,’ শব্দহীন হাসি মুখে বলল বারবণিতা।


Komola Das

কমলা দাস

কমলা দাস। সমকালীন ভারতীয় প্রথিতযশা নারী লেখকদের মধ্যে কমলা দাস অন্যতম। তিনি একাধারে একজন কথাসাহিত্যিক, কবি এবং কলাম লেখক। তাঁর ছদ্মনাম নাম ছিল মাধবীকুট্টি। তিনি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে ১৯৩৪ সালের ৩১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মালয়ালাম ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর ছোটোগল্প সংকলনগুলো হলো ‘এ ডল ফর দ্য চাইল্ড প্রস্টিটিউট’, ‘পদ্মাবতী: দ্য হার্লট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’, ‘দ্য স্যান্ডাল ট্রিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ এবং ‘দ্য কেপ্ট ও্যম্যান অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। ‘মাই স্টোরী’ তাঁর আত্ম-জীবনী গ্রন্থ। তিনি অল্প সংখ্যক উপন্যাস রচনা করেন। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি পঁচাত্তর বছর বয়সে (৩১ মে ২০০৯) মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।