লেখালেখি আত্মঘাতী পেশা। প্রত্যক্ষ লাভ বিবেচনা করলে আর কোনো পেশাই এত সময়, এত পরিশ্রম, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা দাবী করে না। এমন পাঠক খুব বেশি আছেন বলে মনে হয় না, যিনি একটি বই শেষ করে নিজেকে প্রশ্ন করেছেন— এই দুই শ পৃষ্ঠার জন্যে লেখককে ঠিক কি মূল্য দিতে হয়েছে? কত মানসিক যন্ত্রণা আর পারিবারিক বিপর্যয় তাঁকে পোহাতে হয়েছে, কাজটির জন্যে কতটুকু মাসোহারা তিনি পেয়েছেন? যারা জানেন না, তাদের সুবিধার জন্যে সংক্ষেপেই বলি— একজন ক্রেতা বইয়ের দোকানে যে দাম দিয়ে আসেন, তার মাত্র দশ শতাংশ হচ্ছে লেখকের কামাই। অর্থাৎ যে পাঠক কুড়ি টাকা দিয়ে বই কিনছেন, লেখকের রুটিরুজিতে তার অবদান দুই টাকা। বাকিটুকু নিয়ে নেন প্রকাশক, যিনি ঝুঁকি নিয়ে বইটি ছেপেছেন, আর নেন বইয়ের পরিবেশক আর দোকান মালিক। এই বেইনসাফি আরও প্রবল মনে হবে যখন আপনি জানতে পারবেন যে, সেরা লেখক সাধারণত তারাই, যারা লেখেন কম অথচ ধূমপান করেন বেশি। দুই শ পাতার বই লিখতে ন্যূনতম দুই বছর সময় আর ঊনত্রিশ হাজার দুশো সিগারেট যে খরচ হবে, সে তো অতি স্বাভাবিক। হিসেব অতএব খুবই সহজ— বই লিখে লেখক যে টাকা কামাতে পারবেন, বিড়ির খরচই পড়ে যায় তার চেয়ে ঢের বেশি। এই জন্যেই এক লেখকবন্ধু বলেছিলেন— ‘বুঝলে, প্রকাশক পরিবেশক বইবিক্রেতা সব বড়োলোক হয়ে গেল, আর আমরা লেখকরাই রয়ে গেলাম ফকির।’
আজকের ডাকসাইটে ট্রুম্যান কাপোটিকে যখন কেউ মনেও রাখবে না, তখনও তার বই কিনে পড়বে লোকে। সেই কাম্যু ছদ্মনামে ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখে পয়সা উপার্জন করতেন, যেন তার বইলেখায় কোনো বাধা না পড়ে।
অনুন্নত দেশে বইয়ের বাণিজ্য আরও দুর্বল তাই পরিস্থিতি সেখানে আরও সঙ্গীন। কিন্তু সমস্যাটি ওদের একচেটিয়া নয়। সফল লেখকদের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেহেশতের মতো। কিন্তু সেখানেও পেপারব্যাক সংস্করণের লটারি জিতে রাতারাতি বড়োলোক বনে যাওয়া প্রতিটি লেখকের বিপরীতে আছেন কয়েক শ চলনসই গোছের লেখক, যারা দশ পার্সেন্টের বরফশলাকা চুঁয়ে চুঁয়ে মুখে পড়বে সেই দণ্ডভোগ করছেন যাবজ্জীবন।
আমেরিকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার সর্বশেষ উদাহরণ হলেন ঔপন্যাসিক ট্রুম্যান কাপোটিl তার বই ‘ইন কোল্ড ব্লাড’ প্রথম কয়েক সপ্তাহেই রয়্যালটি কামিয়েছে আধ মিলিয়ন ডলার, সিনেমা-স্বত্ত্বের জন্যেও পেয়েছে একই পরিমান টাকা। ওদিকে আছেন আলবেয়ার কাম্যুর মতো লেখক— আজকের ডাকসাইটে ট্রুম্যান কাপোটিকে যখন কেউ মনেও রাখবে না, তখনও তার বই কিনে পড়বে লোকে। সেই কাম্যু ছদ্মনামে ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখে পয়সা উপার্জন করতেন, যেন তার বইলেখায় কোনো বাধা না পড়ে। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে জেতা নোবেল পুরস্কার তাকে সাংসারিক বিপর্যয় থেকে ক্ষণিকের উপশম এনে দিয়েছিল মাত্র। প্রায় চল্লিশ হাজার ডলারের যে নগদ পুরস্কার পেয়েছিলেন তা দিয়ে সেই আমলে বড়োজোর একটি বাড়ি কেনা যেত, বাচ্চাদের খেলার বাগানসহ। আর উদ্দেশ্যমূলক না হলেও কাম্যুর চেয়ে উত্তম কারবার করেছিলেন জঁ-পল সার্ত্র। নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে তিনি সঙ্গত কারণেই স্বাধীনচেতা হিসেবে বিশেষ সুনাম কামিয়েছিলেন, ফলে তার বইয়ের কাটতিও বেড়ে যায় বেশ।
বিগতদিনের দানসাগরদের জন্যে আজও আকুতি করেন অনেক লেখক। মুক্তহস্ত নবাবের বদান্যতায় আয়েসে ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারতেন অতীতের শিল্পীরা। সেই পৃষ্ঠপোষকরা কিন্তু এখনো আছেন, যদিওবা কিঞ্চিৎ ভিন্ন বেশে। রাঘব-বোয়াল কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে আজকাল, শিল্পী এবং শিল্পের সমর্থনে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে। কখনো সেটা ট্যাক্সের বোঝা লাঘবের উদ্দেশ্যে, কখনোবা জনসমক্ষে তাদের যে রাক্ষুসে হাঙরমূর্তি তৈরি হয়েছে সেটা নিরসনের লক্ষ্যে, আর কচিৎ কদাচিৎ বিবেকের জ্বালা মেটাতেও এহেন কাজ ওরা করে থাকে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে লেখককে রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মচারী বানিয়ে রাখার যে সমাজতান্ত্রিক সমাধান, পৃষ্ঠপোষণ তার পাল্টা জবাব। তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের সমাধানটিই সঠিক হওয়া উচিত, কারণ ফড়িয়া-দালালের শোষণ থেকে লেখককে এটি মুক্তি এনে দেয়।
কিন্তু আমরা লেখকরা তো সাধারণত যা করতে ভালো লাগে তাই করে ফেলি, সুতরাং অমূলক হলেও মনে সন্দেহ জাগে— পৃষ্ঠপোষক কি আমাদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করবেন? অনভিপ্রেত কোনো সমঝোতার জন্ম দেবেন? আমার নিজের কথা যদি বলি, কোনো রকম বকশিশ ছাড়াই আমি লিখতে পছন্দ করি। সম্ভাব্য নিগ্রহ-নিপীড়ণের প্রচণ্ড ভয়ই এর পেছনে একমাত্র কারণ নয়— আরেকটি কারণ হলো আমি যখন লিখতে বসি, শেষ পর্যন্ত কার সাথে গিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাব, সেটা নিয়ে কোনো মাথা ঘামাই না। শেষমেষ গিয়ে যদি দেখি যে মালিকের মতের সাথে অমিল হয়ে গেছে, সেটা বড্ড অন্যায় হবে। আর লেখকের বিপরীত, দ্বান্দ্বিক স্বভাবের কল্যাণে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও সমূহ। আর দৈবাৎ যদি মতের মিল হয়েও যায়, আমি মনে করি সেটাও একটা ঘোরতর অনৈতিক ব্যাপার হবে।
পুঁজিবাদী পিতৃশাসনের অন্যতম উদাহরণ পৃষ্ঠপোষকতার এই ব্যবস্থা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে লেখককে রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মচারী বানিয়ে রাখার যে সমাজতান্ত্রিক সমাধান, পৃষ্ঠপোষণ তার পাল্টা জবাব। তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের সমাধানটিই সঠিক হওয়া উচিত, কারণ ফড়িয়া-দালালের শোষণ থেকে লেখককে এটি মুক্তি এনে দেয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এই ব্যবস্থা যত না অবিচারের প্রতিকার করার চেষ্টা করছে, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুতর বিপদের জন্ম দিচ্ছে। অন্তত আজ অব্দি অভিজ্ঞতা তাই বলছে, সামনে আরও কদ্দিন তা চলবে কে জানে।
সম্প্রতি রদ্দি-মার্কা দুই সোভিয়েত লেখককে সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে সুদূর সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছে, খারাপ লেখার দোষে নয়, বরং সরকার-হুজুরের সাথে দ্বিমত পোষণের অভিযোগে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে অপরিপক্ক শাসনব্যবস্থার অধীনে লেখালেখি করতে যাওয়া ঠিক কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ।
সম্প্রতি রদ্দি-মার্কা দুই সোভিয়েত লেখককে সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে সুদূর সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছে, খারাপ লেখার দোষে নয়, বরং সরকার-হুজুরের সাথে দ্বিমত পোষণের অভিযোগে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে অপরিপক্ক শাসনব্যবস্থার অধীনে লেখালেখি করতে যাওয়া ঠিক কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে সেই প্রশাসন যদি এই চিরন্তন সত্যটুকু মেনে নিতে না পারে যে লেখকরা আসলেই দস্যুর জাত, নতুন জুতার চেয়েও আমাদের বেশি বিঁধে রাজনৈতিক মতবাদের বেড়ি, এমনকি আইনের বিধিনিষেধও। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে স্রেফ ভালো লেখা ছাড়া একজন লেখকের অন্য কোনো বিপ্লবী দায়িত্ব থাকতে পারে না। যে কোনো সরকারের অধীনেই হোক না কেন, একলা-চলো নীতি লেখকের জন্যে একটি অপরিহার্য এবং অপ্রতিকার্য শর্ত, কারণ লেখক যদি প্রথার দাস হন, খুব সম্ভবত তিনি দুর্জন, এবং সুনিশ্চিতভাবেই বাজে লেখকও বটে।
আমরা লেখকরা তাহলে কেন লিখি? অবধারিতভাবে এর উত্তর যত আন্তরিক হতে যাবে, ততই নাটুকে শোনাবে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ যেভাবে কৃষ্ণাঙ্গ, বা একজন ইহুদি যেভাবে ইহুদি, একজন লেখক ঠিক সেভাবেই একজন লেখক। সাফল্য আমাদের উৎসাহিত করে ঠিক, পাঠকের অনুগ্রহ আমাদের উদ্দীপনা এনে দেয়— কিন্তু এ সব কিছুই যে উপরি পাওনা। একজন প্রকৃত লেখক যে কোনো উপায়েই হোক তার লেখা চালিয়ে যাবেন, জুতোর শুকতলি যদি ক্ষয়ে যায় তবুও, তার বই যদি কেউ না কেনে তখনও।
নিরানন্দ এই আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে মৌলিক প্রশ্নটি করতেই হয়— আমরা লেখকরা তাহলে কেন লিখি? অবধারিতভাবে এর উত্তর যত আন্তরিক হতে যাবে, ততই নাটুকে শোনাবে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ যেভাবে কৃষ্ণাঙ্গ, বা একজন ইহুদি যেভাবে ইহুদি, একজন লেখক ঠিক সেভাবেই একজন লেখক। সাফল্য আমাদের উৎসাহিত করে ঠিক, পাঠকের অনুগ্রহ আমাদের উদ্দীপনা এনে দেয়— কিন্তু এ সব কিছুই যে উপরি পাওনা। একজন প্রকৃত লেখক যে কোনো উপায়েই হোক তার লেখা চালিয়ে যাবেন, জুতোর শুকতলি যদি ক্ষয়ে যায় তবুও, তার বই যদি কেউ না কেনে তখনও। এটি আসলে এক ধরণের মনোবৈকল্য, এবং সমাজের একটি গুরুতর ব্যাধি বুঝতে আমাদের সাহায্য করে— কেনই বা এত নারী-পুরুষ ক্ষুধা-পেটে স্বেচ্ছামরণ বেছে নিয়েছেন, তাও এমন এক কাজের জন্যে যেটি শেষ বিচারে (একটুও ঠাট্টা করছি না কিন্তু) কারো বিন্দুমাত্র কাজেই আসে না।
(Desventuras de un escritor de libros; প্রথম প্রকাশ জুলাই ১৯৬৬)
জন্ম উগান্ডায়। ব্লগার এবং অনুবাদক। পেশায় অর্থনীতিবিদ। পড়াশোনা করেছেন যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে। বর্তমানে বিলেতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ হিসেবে কর্মরত আছেন। স্প্যানিশ এবং রুশ সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিপুল আগ্রহের কারণে দুটি ভাষাই শেখার চেষ্টা করছেন।