ভ্রসলাভ, পোল্যান্ডের জার্মান শহর
শাকুর মজিদ
এটুকু মাড়িয়ে আমাদের গাড়ি বেরিয়ে পড়ে শহর থেকে। আমরা হাইওয়েতে উঠে পড়ি। ওমর ভাই বলেন, তোমাদের আইটিনারির বাইরে একটা শহর দেখাতে নিয়ে যাব এখন। বিকেলটা খালি পাওয়া গেল, চলো, এখান থেকে ঘন্টাখানেক দূরে একটা জার্মান সিটি আছে। পোল্যান্ডে এসে জার্মান ফ্লেভার নিয়ে যাও।
আমি বলি, শহরের নাম কী?
তিনি বলেন— ভ্রসলাভ [WROCLAW]।
এমন নাম শুনিনি কখনো। আমি সেল ফোনে হাত দেই। এখনি গুগলে ঢুকবো। ওমর ভাই ইংরেজিতে বানান বলেন, WROCLAW । আমি বলি, ওটার নামতো— ‘রকলো’।
ওমর ভাই হাসেন। পোলিশ ভাষায় ‘W’র উচ্চারণ ‘ভ’ এর মতো। যেখানেই ‘W’ পাবা সেখানেই ‘ভ’ দিয়ে উচ্চারণ করবা। আমি WROCLAW কে বলি ‘ভারষ্মাভা’, WROCLAW কে বলা শুরু করি ভ্রত্সলাভ। পোলিশ উচ্চারণ জিহ্বায় তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। যারা দীর্ঘদিন থেকে আছেন, ভাষা শেখার স্কুলে গিয়ে ভাষা শিখেছেন, তাদের কথা আলাদা। আমাদের ওমর ভাই ২৯ বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন, রাশিয়ায় ছিলেন ৯ বছর, ২০ বছর ধরে আছেন পোল্যান্ডে। রাশিয়ান বা পোলিশ ভাষা তার মুখে খইয়ের মতো ফোটে। আমি এক ‘W’র উচ্চারণ ঠিক মতো করতে পারি না। আমার তাতে কোনো সমস্যা নাই। আমার ইংরেজি কেউ না বুঝলেও আগামী ৫ দিন আমার কোনো সমস্যা নাই। আমাদের সাথে ওমর ভাই আছেন।
পোল্যান্ডের হাইওয়েগুলো সত্যিই সুন্দর। এই হাইওয়েতে উঠে মনে হওয়ার কোনো কারণই নাই যে, পোল্যান্ড এখনো একটা দরিদ্র ইউরোপীয় দেশ। কুড়ি বছর আগে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে যখন ছিল
পোল্যান্ডের হাইওয়েগুলো সত্যিই সুন্দর। এই হাইওয়েতে উঠে মনে হওয়ার কোনো কারণই নাই যে, পোল্যান্ড এখনো একটা দরিদ্র ইউরোপীয় দেশ। কুড়ি বছর আগে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে যখন ছিল, তখনকার পোল্যান্ড আমার দেখা হয়নি। এখনকার যে পোল্যান্ড আমি দেখছি, তা আমার দেখা, অন্য ইউরোপীয় বড়ো ও ধনী শহরগুলোর মতো।
সামান্য একটা গ্যাস স্টেশনে এসেও আমরা মুগ্ধ হই। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, তার মাঝখানে একটা গ্যাস স্টেশন। খুব বেশি গাড়ির যে আনাগোনা তাও না। বেশ নীরব নিথর। অথচ গাড়িতে তেল বা গ্যাস ভরতে আসা কোনো চালক বা যাত্রী যদি মনে করেন এই অবসরে এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন, তার জন্যও দেখি চমৎকার আয়োজন। মাঠের এক কোনে কতগুলো বেঞ্চি বসানো। তার একটিতে ফাইবার গ্লাসের ছাদও। বৃষ্টি-বাদলা বা তুষারপাত থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার কী চমৎকার আয়োজন। বিদেশের এতোসব যতোই দেখি, নিজের দেশের জন্য ততোই আফসোস হয়। আমরা একটা বেঞ্চির ওপর বসে থাকি। অটোমেটিক মেশিন থেকে মুদ্রার বিনিময়ে নেমে এসেছে ৭ কাপ এক্সপ্রেসো কফি। আমাদের সামনে সবুজ মাঠ।
সামান্য একটা গ্যাস স্টেশনে এসেও আমরা মুগ্ধ হই। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, তার মাঝখানে একটা গ্যাস স্টেশন। খুব বেশি গাড়ির যে আনাগোনা তাও না। বেশ নীরব নিথর। অথচ গাড়িতে তেল বা গ্যাস ভরতে আসা কোনো চালক বা যাত্রী যদি মনে করেন এই অবসরে এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন, তার জন্যও দেখি চমৎকার আয়োজন।
পোল্যান্ডের সবুজটাও অনেক সতেজ। এটা হয়তো এ সময়ের কারণে। এপ্রিল-মে’তে গাছপালা খোলে। শীতকালে নাকি গাছের দিকে তাকানোও যায় না। আবার গ্রীষ্মে তার নতুন রূপ। আমরা এই নতুনের মুগ্ধতাকে উপভোগ করি। এক সময় আমাদের এ যাত্রার নিয়ন্ত্রক ওমর ফারুক ভাই একটা শহরের ভেতর গাড়ি পার্কিং করে আমাদের নেমে যেতে বলেন। আমরা এসে পড়েছি সেই ঐতিহাসিক শহর ভ্রসলাভ-এ।
হাজার বছরের পুরনো এই জনপদ। ১২৪২ সালে এই জনপদ শহরের মর্যাদা পেয়েছিল। সেই থেকে এখনো আছে। এক সময় এই শহরটি বণিকদের শহর ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য নাম ডাক ছিল। জার্মানীর অন্তর্ভুক্ত ছিল কখনো, কখনো বা পোলান্ডের। যে মানচিত্রেই তার জায়গা হোক না কেন আদিকাল থেকেই এ শহরের প্রায় ৮০ ভাগ নাগরিকই জার্মান। এখনও এই শহরে পোলিশ ভাষার চেয়ে জার্মান ভাষার চলই বেশি।
আমাদের গাড়ি পার্ক করা থাকে। আমরা নেমে পড়ি এবং আতঙ্কিত হয়ে যাই ওমর ভাইয়ের কথায়। তিনি বলেন প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটলেই আমরা সিটি স্কোয়ারে চলে যেতে পারব। বলে কী!
এক কিলোমিটার হাঁটা আমার জন্য অনেক অনেক কষ্টের। তার ওপর সাথে আছে ক্যামেরা, ট্রাইপয়েড। কেউ আমার ট্রাইপয়েড ধরেন বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ তাদের হাতে রাখার সুযোগ নাই, আমাকেই বয়ে বেড়াতে হয়।
ভাবতে অবাকই লাগে, ৮শ বছর আগের নগর পরিকল্পনায় এমন প্রশস্ত সড়ক পথ রেখেই তারা শহর বানিয়েছিলেন। ৮শ বছর পর এখনও বর্তমান নাগরিকদের জন্যে যথেষ্ট যুগোপযোগী।
গথিক রীতিতে বানানো দালান কোঠার মাঝখানে প্রায় দুশো ফুট প্রশস্ত সড়ক। পাথুরে ইট বিছানো এই সড়কের মাঝখানের আইল্যান্ডে বড়ো বড়ো গাছ। এখান দিয়েই শত শত মানুষের পায়ে হেঁটে চলা। এখানে কেউ গাড়ি নিয়ে যাবে না। কলের গাড়ি না চললেও ঘোড়ার গাড়ি আছে। চাইলে ভাড়া করা যায়। জার্মান কোচওয়ান ইউনিফর্ম পরে ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘোড়ার গাড়ির আকারটাও দারুণ। আমাদের দেশের ভ্যানগুলোর মতো চারটা চাকার ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে পাটাতন। তার ওপরে হুড। রোদ বা বৃষ্টি ঠেকানোর জন্য এমন আয়োজন। আর এই হুড ওয়ালা চার চাকার বাহনটিকে অনায়াসে চালিয়ে বেড়ান জার্মান গাড়োয়ান।
আমার ঘোড়ায় চড়ার শখ নাই, ঘোড়াওয়ালার ছবি তোলায় আনন্দ।
হাঁটতে হাঁটতেই একসময় টের পাই পুরো ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো ও পুরনো মার্কেট স্কোয়ারে আমরা প্রায় এসে পড়েছি। ৬শ ফুট বাই ৫শ ফুট আয়তক্ষেত্রাকার একটা খোলা চত্বরের চারপাশে দালানকোঠা। তার কিছু স্রেফ আবাসিক ভবন, কিছু রাজকীয় দাপ্তরিক। যেহেতু এই মার্কেট স্কোয়ারকে কেন্দ্র করেই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এখানকার অভিজাত নাগরিক জীবন যাপিত হতো, সে কারণে সে সবের সব অনুষঙ্গই এখানে ছিল।
আমরা যে জায়গাটি এসে নামি সেটা মোটামুটি জমজমাট। কিন্তু কোলাহল নাই। কেমন যেন শান্ত সৌম্য একটা গম্ভীর পরিবেশ।
ঐতিহ্যময় এই নগর কেন্দ্রটি দেখার জন্য যেহেতু দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটকের আগমন হয়, সে কারণে এই নাগরিক চত্বরকে চকমকে রাখা হয়েছে। পায়ে হাঁটার পথ বা ঘোড়ার গাড়ির পথ, এ দুটোকে ভাগ করার জন্য বসানো হয়েছে এমন গোলক আকারের পাথর। ফুটপাথের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বামন আকারের ভাস্কর্য। মিনিয়েচার স্কেলে বানানো মনুষ্য ও পশুর এমন রুপ দেখে মুগ্ধ হন দর্শক পর্যটক।
এসব নাগরিক চত্বরে প্রায়ই নানা রকমের ভেক্ধারী ভিক্ষুকদের দেখা যায়। এখানেও তেমন। এক সুদর্শন যুবককে দেখেছিলাম অতিরিক্ত মেকআপ নিয়ে ফুটপাতে বসে গল্প করছে। তার হাতে ছিল একটা লাঠি। লোকটিকে দেখেই মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই এই লোক কিছুক্ষণ পর বাটি একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে।
এসব নাগরিক চত্বরে প্রায়ই নানা রকমের ভেক্ধারী ভিক্ষুকদের দেখা যায়। এখানেও তেমন। এক সুদর্শন যুবককে দেখেছিলাম অতিরিক্ত মেকআপ নিয়ে ফুটপাতে বসে গল্প করছে। তার হাতে ছিল একটা লাঠি। লোকটিকে দেখেই মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই এই লোক কিছুক্ষণ পর বাটি একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে।
এখানে এসে দেখি ঠিক তাই। মুখের মধ্যে একটা বাঁশি পুতে কাঁধের ওপর একটা লাঠি নিয়ে মূর্তি হয়ে আছে। আমার ক্যামেরা তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু কিছুতেই তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন নাই।
আমার পাশে লাভলু ভাই। তিনি বলেন, দাঁড়া, আমার কাছে কয়েন আছে, ওর বাক্সের ওপর ২ ইউরোর একটা কয়েন ফেললেন তিনি। ২ ইউরোর কয়েন যথেষ্ট ভারী। ঝন করে শব্দ হয়। আর এই শব্দে সম্বিৎ ফিরে পান ধ্যানরত এই মূর্তি। তার সমস্ত অবয়ব এক সাথে নড়ে-চড়ে ওঠে। তিনি হাত বাড়িয়ে দেন লাভলু ভাইর দিকে। হ্যান্ডশেক করে তাকে কাছে নিয়ে যান। তার হাতে এতক্ষণ যে লাঠি ছিল সেটার হাতল ধরে টান দিতেই বেরিয়ে এলো মখমলের ব্রাশ। এই ব্রাশ দিয়ে তিনি চুল আঁচড়ে দিলেন লাভলু ভাইর এবং এরপর কয়েকটা ঘুর্ণন দিয়ে চমৎকার কিছু অঙ্গভঙ্গি করার পর আবার স্থির হয়ে যান এই ভিখারী মানব। আবার তার মুখের মধ্যে বাঁশি।
সোয়াঘন্টা পরে আমরা আবার ঘরে ফিরে আসি।
সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে আমরা সবাই বেশ ক্লান্ত। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া দরকার। কাল সকালে আমরা যাব হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখতে। ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিটি দেখেছিলাম অনেক আগে। সেই ছবিটি পুরো দেখা যায় না। অর্ধেক দেখে বন্ধ করে দিতে হয়। মানুষ হয়ে মানুষের ওপর এমন অমানষিক আচরণ কী করে করা সম্ভব হয়েছিল তাদের?
কাল যাব সেসব দেখতে। আজ ঘুমাই।
ধারাবাহিকটির অন্য পর্বগুলো পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৩
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৪
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৫
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৬
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।