শুক্রবার, নভেম্বর ২২

চারুলতা কিংবা এক থোকা ম্যাগনোলিয়া : প্রজ্ঞা মৌসুমী

0

তাড়াহুড়োতে ভ্রমণের স্বাদ থাকে না। মাসের পর মাস একঘেয়ে শেষ বাস স্টপ অবধি যেতে যেতে আমরা, সাড়ে সাতটার মানুষগুলো, প্রতিবেশী হয়ে থাকি। অপেরা গ্লাস যেন এই লোকাল বাস। অপেরা গ্লাসের ওপারে ঘড়ির তর্জনী মেনে সানগ্লাস নিয়ে একে একে হয়ে‌ উঠি আমরা প্রধান চরিত্র। তারপর আবার সেই পার্শ্ববর্তী চরিত্র। রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করা আফ্রিকান ছেলেটা নতুন প্রেমে পড়েছে। ভোরের হাওয়ার মতোন ফোনে ‘লাভ ইউ, লাভ ইউ’ ছড়িয়ে দিয়ে সবার প্রথমে নেমে পড়ে ও। ‘দেখা হচ্ছে সোমবারে’— ড্রাইভার চিৎকার‌ ছুঁড়ে পেছনে।‌ কলেজে একবার ধর্মীয় আলোচনা শুনতে গিয়েছিলাম। স্পিকার অনুরোধ করেছিলেন ‘দু’ মিনিট পর বেঁচে থাকবে নিশ্চিত ভাবতে পারছো যারা, হাত তুলো।’ একটিও আত্মবিশ্বাসের হাত উঠেনি সেদিন। অথচ দু মিনিটের অনিশ্চয়তা নিয়ে কত সোমবারের পরিকল্পনা করি আমরা।

অপেক্ষারত স্প্যানিশ মা পুতুলের চিরুনি দিয়ে ছোট্ট মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। সিঁথির দু’ পাশে ফুটিয়ে দিচ্ছে ক্লিপের ফুল, দেখলেই প্লাস্টিকের মৌমাছি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

হঠাৎ আসা দীর্ঘশ্বাসের ভেতর পরের স্টপের দৃশ্যটির জন্য অস্থিরতা নামে— অপেক্ষারত স্প্যানিশ মা পুতুলের চিরুনি দিয়ে ছোট্ট মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। সিঁথির দু’ পাশে ফুটিয়ে দিচ্ছে ক্লিপের ফুল, দেখলেই প্লাস্টিকের মৌমাছি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। প্লাস্টিকই ভাবি যেন বেচারী ভয় না পায়। বাসে মা মেয়েকে বই পড়িয়ে শোনায়। ওদের গল্পে তলিয়ে গিয়ে আমরাও গুনগুন করে হেঁটে যাই জঙ্গলের গভীরে। পেছনে হেঁটে চলে গান ভালোবাসে এমন খেকশেয়াল।

আমাদের মধ্যে সবথেকে বৃদ্ধ লোকটি আইটি অফিসে ক্লিনিং এর কাজ করেন। তবে ভীষণ ভালোবাসেন রান্না করতে। খাবারের আলাপ শুরু হলে দু’ তিনটে মহাদেশের রান্নার টেবিল না ঘুরিয়ে থামবেনই না। এ শহরে একদিন নিজের রেস্তোরাঁ হবে স্বপ্ন দেখেন। আমরাও তাঁর স্বপ্নে প্রতিবেশী হয়ে রেস্তোরাঁয় উনুন জ্বালাই, খুন্তি নাড়ি, তিনটে হৃদয়ের কথা ভাবতে ভাবতে উল্টে দেই‌ ক্রিস্পি অক্টোপাস, ছোট আলু।

ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করা মহিলাটি বিল পরিশোধ না করায় লোক এসে পানির লাইন কেটে দিয়ে গেছে। রাগে দরজায় লাথি দিতে গিয়ে গোড়ালিতে বেদম চোট পেয়েছে, কিছুদিন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে। স্থুলকায় বান্ধবী বয়সী নারীটি এসে জানান দেয়- ‘ওর অ্যাপার্টমেন্টেই গোলাগুলিটা হলো, এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ঢিসুম, সাতটা পুলিশের গাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট ঘিরে রেখেছে, তবু পুলিশ রেকর্ডে নাম আছে এমন লোকদেরও ওরা ভাড়া দেবে, এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচি।’ অথচ সাধ্যের মধ্যে স্বস্তিতে থাকা যায় কটা ঘরই বা আছে এই শহরে! গেল বছর থেকে এ বছর শহরে বাড়িভাড়া বেড়ে গেছে ২.৯%…

যে মেয়েটা হাসপাতালে কাজ করে, তার গালে ব্যাণ্ড-এইড। আমাদের সন্দেহের রেশ টেনে নিয়ে ড্রাইভারই জানতে চায় ‘বয়ফ্রেন্ডের কাজ না তো?’ বাবা একবার ঘুষি দিয়ে বড়মা’র চোখ ফুলিয়ে দিয়েছিল। বড়মা কাচের সানগ্লাসে চোখ ঢেকে কাজে বেরিয়ে যেত। সানগ্লাসটা বুঝি বড়মা’র শখের ছিল না কখনোই… অপেরা গ্লাস ঘুরছে- ব্যাগের থেকে উঁকি দিচ্ছে Odd Thomas, বাঙালি ছেলের কবিতার বইয়ে নগ্ন লিলিথ, হাইস্কুলের ছেলের জট পাকানো ঝাঁকড়া চুল- মামুনকে মনে পড়ে ভীষণ। চুল কাটতে চাইতো না বলে হেড স্যার ওকে চেয়ারে দাঁড় করিয়ে বেত দিয়ে বেদম পিটিয়েছিলেন, একটা ছোট্ট ছেলের নাক টানা, চোখের ‌জল, বেতের সপাং সপাং‌‌, কাটা চুল হুহু হয়ে আনমনে ঝুলে থাকে বিদেশির লাল চুলে…

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েটির কানে ময়ূর দোল, খোলা সোনালি চুল, কন্ঠ শুনেছি বলে জানি হয়তোবা ও ছেলে। যে কোন একটি চুড়ান্ত সত্ত্বায় বাঁধতে না পারার অক্ষমতায়, ভাবতেই ভুলে যাই ভেতরে-বাহিরে ও আসলে আস্ত এক মানুষ।‌‌

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েটির কানে ময়ূর দোল, খোলা সোনালি চুল, কন্ঠ শুনেছি বলে জানি হয়তোবা ও ছেলে। যে কোন একটি চুড়ান্ত সত্ত্বায় বাঁধতে না পারার অক্ষমতায়, ভাবতেই ভুলে যাই ভেতরে-বাহিরে ও আসলে আস্ত এক মানুষ।‌‌ সেবার রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেছিলাম। নিয়ম করে একজন আসতেন অফিস পাড়া থেকে— ন্যাড়া মাথা, কথায় ফ্র্যান্স একসেন্ট, সবুজ চোখ, বড়ো মধুর করে ডাকতেন। অথচ এক না-ভীড় দুপুরে এসে চমকে দিলেন সানগ্লাস খুলে নিয়ে— সামার হ্যাট, লাল লিপস্টিক, গভীর আইলাইনার। অফিসে সেজে যাওয়া বারণ, আজ অফিস ছুটি, ছুটি বাইরের পুরুষটি থেকেও… কী উচ্ছ্বাস নিয়েই না জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আমাকে কেমন লাগছে?’ আমি তখন দোটানায় দিশেহারা যেন কলম্বাস বুঝে গেছে তাঁর মানচিত্রের ভুল। সেদিন তিনিও পারেননি অথবা চাননি পুরোটা সত্যি জানাতে। অন্য পরিচিত সার্ভার আসতেই সানগ্লাসে ঢেকে ফেলেছিলেন পরিচয়টুকু। তাঁকে আর লাল‌ লিপস্টিকে দেখিনি কখনো…

পরের স্টপে দাঁড়িয়ে থাকে দুটো মানুষ। শুরুর দিকে যাদের দেখে আমরা ভাবতাম তুমুল প্রেমিক। অতঃপর জেনেছি ওরা বাবা-ছেলে। প্রতিদিন একই টিশার্ট পরনে, ওঁরা বাসে উঠলেই আমরা কিছুটা নাক কুঁচকে থাকি। কনকনে শীত কালটায় কৌতূহলী আমরা জানতে চাইতাম ‘ঠাণ্ডা লাগে না?’ নিখাদ অহংকার নিয়ে বাবা উত্তর দিতেন ‘আমি নিউইয়র্কের লোক! এই ঠাণ্ডা কিচ্ছু না!’ আমাদের মধ্যে সবথেকে ছোটখাটো লোকটা বিরক্ত হয়ে একদিন বলেই ফেলেছিল – ‘জায়গায় কী যায় আসে! শীত শীতই হয়।’ শীত কমে আসলে হালকা বসন্তের দিকে ওঁদের জ্যাকেট পড়তে দেখি আমরা। নিউইয়র্ক থেকে আসা মানুষটার অবশেষে ‌‌শীত পাচ্ছে দেখে আমরা কেউ স্বস্তি পাই। আবার প্রশ্ন করার সুযোগ ফুরিয়েছে বলে কেউ হই হতাশ।

তারপরের স্টপে কখনো সখনো হুইল চেয়ারে বসা মানুষটা থাকলে বিরক্তি ঢাকতে পারে না ড্রাইভার। উঠাতে—বাঁধতে—নামাতে সিডিউল থেকে পেছনে পড়ে যায় ও পাক্কা দশ মিনিট। তবু ফোঁসগুলো মনে রেখে দিলেই বুঝি পারতো। সানগ্লাসের নিচে কতোটা অস্বস্তি, মন খারাপ ধরে রাখে চেয়ারের মানুষটা কে জানে। কোনদিন দাঁড়িয়ে থাকে ছড়ি হাতে অন্ধ মেয়েটিও। শ্রবণ ক্ষমতা এত ভালো মেয়েটার— একবার কি এক শব্দ শুনেই ড্রাইভারকে বলেছিল বাসে কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। ঠিক- দুু’দিন পর মাঝরাস্তায় বাসটা থেমে গিয়ে কী কাণ্ড।

অন্ধ মেয়েটা আমার ছেড়াকাঁটায় অনেক বছর আগের এক অস্বস্তি নামিয়ে দেয়- হরতালের দিনে বেপরোয়া হয়ে একটা বেবিট্যাক্সিতে উঠে চমকে গিয়েছিলাম। কালো চশমা পড়া সবকটা অন্ধ ভিখারি। অস্বস্তি না, যেন ঘিনঘিন করছিল। উহ, হয়ত তাই এখনও দুঃস্বপ্নটা দেখি— হাজার হাজার সানগ্লাস ঝরে পড়েছে, আমাকে তাড়া করছে। কালো কালো চশমারা আমাকে ছুঁতে পারলে নিংড়ে‌ নেবে সকল অহংকার। আমি পালাতে চাইছি কিন্তু কোথায়? সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক গাদা সানগ্লাস। আমি আতংকে চিৎকার করছি…

শহরটা ছেঁয়ে গেছে সাদা ম্যাগনোলিয়া ফুলে। ছোট্ট মণীষা উচ্ছ্বাস নিয়ে ভাবে গাছকে গয়না পড়ানো হয়েছে। চাইনিজ ছেলেটা সেদিন বলছিল‌ যেতে যেতে ও একশ তিনটে ম্যাগনোলিয়া গাছ গুনেছে। ওর থেকেই জেনেছি বিনয়, আত্মসম্মান, শুদ্ধতা আর নারী সৌন্দর্যের প্রতীক সাদা ম্যাগনোলিয়া।‌‌ বাড়িতে ম্যাগনোলিয়া গাছ থাকলে সুখ স্বচ্ছলতা আসে। পুরনো এক রেওয়াজ ছিল প্রতারক বা ভুল করে পুরনো প্রেমিকার কাছে ফেরা প্রেমিকের হাতে থেকে যেত সাদা ম্যাগনোলিয়া- তার ক্ষমা প্রার্থনার চিহ্ন হয়ে…

সিনিয়র কোটায় ছুঁয়ে থাকা নারীরা আসেন ঝিলিক নিয়ে, বসন্তের মতোন। শেষ বেলায় হাহুতাশের চেয়ে উৎসব জীবনের ছলক দিতে মাতিয়ে রাখেন। কেনাকাটা করা ওঁদের‌ শখ, ওঁদের শপিং ব্যাগ দেখে কত রকম দোকানের ঠিকানা যে শিখেছি। সবচেয়ে সৌখিন, মাতিয়ে রাখা নারীটি আজ যেন বড়ো শান্ত। বাস থেকে নেমে পড়তেই নতুন যাত্রীটি বলে ফেলেন ‘আমার প্রাক্তন স্ত্রী ও। বাস স্টপে এমনভাবে বসেছিল যেন আমি তার কখনোই চেনা ছিলাম না। কী ভয়ানক ব্যাপার ভাবুন।’ চমকে বাইরে তাকাই। অপেরা গ্লাসে উথলে ওঠে ঝলমলে তিনিই একদিন বলেছিলেন ‘হতে হয় নদীর মতোন-নরম অথচ প্রবল।’ সানগ্লাস চোখে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন প্রবল হয়ে। কিছু কিছু সানগ্লাস সম্পর্ককেও ঢেকে দেয় কেমন…

অপেরা গ্লাস সরে যায় অন্য কোন সানগ্লাসের দিকে। আর আমি অনুভব করি— সব নারীর গভীরেই এক নিঃসঙ্গ চারুলতা থাকে। চারুলতাদের জন্য শহরে ম্যাগনোলিয়া ফুটে। যেন প্রত্যাশায় বাসস্টপে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে এক থোকা ম্যাগনোলিয়া হাতে।

অপেরা গ্লাস সরে যায় অন্য কোন সানগ্লাসের দিকে। আর আমি অনুভব করি— সব নারীর গভীরেই এক নিঃসঙ্গ চারুলতা থাকে। চারুলতাদের জন্য শহরে ম্যাগনোলিয়া ফুটে। যেন প্রত্যাশায় বাসস্টপে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে এক থোকা ম্যাগনোলিয়া হাতে। মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে না বলে বুঝি দাঁড়িয়ে থাকে ঐসব গাছ। এই সমুদ্রের শহর যেন সাদা ম্যাগনোলিয়া হাতে পুরনো প্রেমিকার কাছে ফিরে আসা এক বিমর্ষ প্রেমিক। অপেরা গ্লাসে এবার নিঃশ্বাস ফেলে এক থোকা সাদা ম্যাগনোলিয়া। বাসটি ঢেউ হয়ে সাদা নিঃশ্বাস নিয়ে ছুটে চলে একটি বিন্দুর দিকে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২৭শে সেপ্টেম্বর, কুমিল্লায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে সুনামগঞ্জে। মায়ের সাথে প্রবাসে পাড়ি দেয়া আঠারো বছর বয়সে। পরিযায়ী পাখির মতো ঠিকানা খোঁজেন অক্ষরের আকাশে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।