শিরিন নেশাত। ইরানি ভিজুয়্যাল আর্টিস্ট, বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তার জন্ম উত্তর-পশ্চিম ইরানের কাজভিন শহরে, উনিশশ সাতান্ন সালে। শিরিন মূলত চলচ্চিত্র, ভিডিও এবং আলোকচিত্রের মতো শিল্প মাধ্যমে তার কাজের জন্য সমধিক পরিচিত। তার শিল্পকর্ম বা সৃষ্টিসমূহ ইসলামী তথা প্রাচ্য ও পশ্চিমা বা পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যকার বিভাজন, নারীবাদ, পুরুষতান্ত্রিকতা, অনাদিকাল ও নয়াযুগ, সামাজিক ব্যবস্থা, জনজীবন, ব্যক্তিজীবন এমনতর বিষয়গুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ইতোমধ্যে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভেনিস বিয়েনালে গোল্ডেন লায়ন, ভেনিস ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে সিলভার লায়ন, গুয়াঙযু বিয়েনালে গ্রা প্রিঁ ইতাদি। উইম্যান উইদাউট ম্যান (২০০৯), রোজা (২০১৬) এবং লুকিং ফর অউম কুলথুম (২০১৭) এই চলচ্চিত্রগুলোর পরিচালক হিসেবে বিশ্বব্যাপি চলচ্চিত্রমোদীদের প্রংশসাসিক্ত হলেও শিরিনের বিভিন্ন মাধ্যমের সৃষ্টিগুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তার অডিও-ভিজ্যুয়াল ইনস্টলেশন টার্বুলেন্ট (১৯৯৮), র্যাপচার (১৯৯৯), সলিলোকুই (১৯৯৯), তুবা (২০০২) অত্যন্ত চিন্তাশীল এবং শৈল্পিক প্রয়াস।
ফেমিনিস্ট স্টাডিজ জার্নালের জন্য শিরিন নেশাতের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন স্কট ম্যাকডোনাল্ড। ছাপা হয় ২০০৪ সালের শরৎ সংখ্যায় Between Two Worlds: An Interview with Shirin Neshat শিরোনামে। ২০০৩ সালে স্কট এই সাক্ষাৎকারটি কয়েক কিস্তিতে; সরাসরি শিরিনের সঙ্গে দেখা করে, ফোনে এবং ই-মেইলের মাধ্যমে গ্রহণ করেন।
স্কট ম্যাকডোনাল্ড: সলিলোকুই-এ আমরা দেখতে পাই এমন এক তরুনীকে যে দুটি ভিন্ন পৃথিবীর মধ্যে আটকে আছে। এর কেন্দ্রিয় নারী চরিত্রটিতে তুমিই অভিনয় করেছ তাই এটাকে খুব ব্যক্তিগত আখ্যান বললে অত্যুক্তি হবে না। আমরা জানি তোমার জন্ম ইরানে এবং কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছো, তারপরও আরও বিশদে এই ইতিহাসটা জানতে পেলে কৃতজ্ঞ হবো।
শিরিন নেশাত: আমি ইরানের কাজভিন নামের একটি ছোটো ধর্মীয় শহরে জন্মগ্রহণ করি, যা এখন বেশ বড়োসড় এক শহরে পরিণত হয়েছে। এই শহরের দৃশ্যপট আর দশটা মরুভূমি-শহরের মতোই, যদিও এই শহরের ঘন্টাখানেক দূরত্বেই ক্যাস্পিয়ান সাগর। আমার বাবা একজন সুপরিচিত চিকিৎসক, শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। খামার এবং কৃষিকাজের প্রতি বাবার ছিল মাত্রাতিরিক্ত আবেগ। তার ছায়াতেই আমার বেড়ে ওঠা। বাবা সবসময়ই বলতেন যে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হয়ে ওঠো, ঝুঁকি নিতে শেখো, জানতে শেখো। দুনিয়াটা ভালো করে দেখার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, যেমনটি তিনি সর্বদা মনে করতেন। তুলনায় আমার মা ছিলেন একেবারে সাধারণ ইরানি নারী, যার পড়াশোনা সামান্যই এবং পরিবার ও গার্হস্থ্য জীবনের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিশোরী বয়েসে ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করার জন্য রাজধানী শহর তেহরানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাকে যার শেষটা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই বটে।
স্কট: কি ঘটেছিল?
শিরিন: আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা খুব উষ্ণ আর আন্তরিক পারিবারিক আবহে, কিন্তু মিশনারি স্কুলটা পুরোপুরি ক্যাথলিক নানদের দ্বারা পরিচালিত এবং বিষয়টা আমাকে খুব কঠিন অভিজ্ঞতার দিকে নিয়ে গেল। আমার মনে হতো যে আমি বন্দিশিবিরে আটকে আছি। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম এবং ক্ষুধামন্দা পেয়ে বসে শরীরে। দেড় বছর পরে যখন নিজের শহরে ফিরে গেলাম, বেশিরভাগ লোকই আমাকে চিনতে পারেনি, কারণ আমার ওজন এতোটাই কমে গিয়েছিল। ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তুরের শুরুতে, অভিভাবকদের একাংশ মনে করত যে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা একটা দারুণ ব্যাপার। বেশিরভাগ উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাঠাতে শুরু করে, আমার বাবাও তার ছেলে-মেয়েদের বিদেশে ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে পাঠান। যদিও আমার দুই বোন পড়াশোনা ফেলে রেখে ইরানে ফিরে এসে বিয়ে করে থিতু হয়, কিন্তু আমি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনাটা চালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলাম। এ-নিয়ে বাবা অবশ্য খুব গর্বিত ছিলেন এবং মৃত্যুর আগে প্রায়ই এটি নিয়ে কথা বলতেন।
স্কট: বার্কলেতে কীভাবে শেষ হলো?
শিরিন: যুক্তরাষ্ট্রে যখন আসি ততদিনে আমার বোনেরা লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকা শুরু করেছে। প্রথম এক বছর হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু শীঘ্রই বোনরা ইরানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, ফলে আমি একা হয়ে যাই। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া আমার কখনোই পছন্দ হয়নি। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় একবার সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে যাই এবং এর প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের প্রেমে পড়ে যাই, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে সৈকত এলাকাতেই আমি থাকব। সেখানকার একটা প্রায় অখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডোমিনিকান কলেজে ভর্তি হই। কিছুদিন পর বার্কলেতে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। ওখানে আমি বিএ, এমএ এবং এমএফএ শ্রেণিগুলো অধ্যয়ন করি। তবে সত্য বলতে আমি কখনও ভালো শিক্ষার্থী ছিলাম না, যাকে বলে অনুল্লেখ্য শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তাই পড়ে যেতে হবে বিষয়টা এরমকই ছিল আমার কাছে। আসলে এই ধারার পড়াশোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, ফলে বার্কলেতে দু’বছর আমি এখন যাকে মাঝারিমানের শিল্প বিবেচনা করা হয় তেমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাটিয়েছি। এমএফএ নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে একযোগে শিল্পসৃষ্টি ছেড়ে চলে যাব, এবং প্রায় দশ বছর পর নব্বই সালের দিকে আবারও শিল্প সৃষ্টির কাছে ফিরে আমি।
স্কট: কোন বিষয়টি তোমাকে শিল্প সৃষ্টি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল? এবং আবার ফিরলে কীভাবে?
শিরিন: আমি অনুভব করেছিলাম যে আমার ধারণাগুলি বিভ্রান্ত এবং যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তাছাড়া, আমি যে শিল্প ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছিলাম তা আসলেই আমাকে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউইয়র্কে চলে আসি তখন নিউইয়র্ক শহরের সমসাময়িক শিল্প চেতনা দেখে ভড়কে যাই, বুঝতে পারি যে শিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা শিল্পী জীবন বেছে নেওয়ার মতো পরিপক্কতা আমার তখনও তৈরি হয়নি। তো এরপর টানা দশ বছর স্টোরফ্রন্ট ফর আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার নামের একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, আমার প্রাক্তন বর কং পার্ক ওটার প্রতিষ্ঠাতা। আমি তাকে বহু কিউরেটরিয়াল প্রোগ্রামে সহায়তা করেছি তবে যার বেশিরভাগই প্রশাসনিক কাজ বলা চলে। স্টোরফ্রন্ট ছিল একটি অলাভজনক সংস্থা, যা শিল্পকলা ও স্থাপত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানাদি উপস্থাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি অত্যন্ত আন্তঃশৃঙ্খল, পাশাপাশি স্থাপত্যের ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক উভয় পটভূমির মানুষকে একত্রিত করার জন্য উৎসর্গীকৃত। শিল্পী, স্থপতি, দার্শনিক, সংস্কৃতি সমালোচক, এমনকি কখনও কখনও বিজ্ঞানী, এমন বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। সেখানে কাজ করাটা আমার কাছে সত্যিকারের শিক্ষায় পরিণত হয়েছিল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেকে বুঝে উঠতে, পেশাদার হতে এবং আমার নিজস্ব ধারণা ও পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। উনিশশ আটানব্বই সালে আমি স্টোরফ্রন্ট ছেড়ে চলে আসি। আমার শিল্প জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠার পেছনের কারণটি ছিল বারো বছরের অনুপস্থিতির পরে নব্বই সালে ইরানে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত। এই ভ্রমণ আমাকে একটি শৈল্পিক মনোযোগ দিয়েছে: মূলত ইসলামী বিপ্লব এবং সেই বিপ্লবের সাথে নারী সম্পৃক্ততা। অবশেষে আমি এমন একটি বিষয় খুঁজে পেয়েছি যার প্রতি আমি উৎসাহ বোধ করি, তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ধারার শিল্পসৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমার বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির সাথে নিজেকে পুনঃসংযোগ করার অজুহাত পেয়েছি। সেই থেকে, কাজের এই নিজস্ব ধারাটি প্রাকৃতিক নিয়মেই বিবর্তি হয়েছে, একটি বিষয় অন্যটিকে পরিচালিত করেছে।
স্কট: ইরানে ফিরে আসার পর তোমার প্রথম দিককার কাজগুলো সম্পর্কে কিছু বলতে যদি।
শিরিন: আমার প্রথম শৈল্পিক কাজ ছিল আলোকচিত্রের সিরিজ, উইম্যান অফ আল্লাহ (১৯৯৩-১৯৯৭), বিপ্লব এবং ‘শাহাদাত বরণ’ এই ধারনাগুলোকে উপজীব্য করে। এই সিরিজটি মূলত পারফরম্যান্স ভিত্তিক এবং আমি নিজেই এটিতে আলোকচিত্রের বিষয় হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলাম। আলোকচিত্রগুলো বেশ সাদামাটাই ছিল: নারী শরীর সহ বেশ কয়েকটি বিষয় বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল সেখানে, ইসলামি সংস্কৃতিতে এটি অত্যন্ত মারাত্মক একটি বিষয়, যা লজ্জা, পাপ এবং যৌনতা সম্পর্কে ধারণা দেয়; টেক্সট, আমি ক্যালিগ্রাফির আশ্রয় নিয়েছি– ইরানি নারী লেখকদের কবিতা নিয়েছি সেখানে; অস্ত্রশস্ত্র, স্পষ্টতই যা সহিংসতার প্রতীক; এবং অবশেষে পর্দা বা হিজাব, অত্যন্ত বিতর্কিত, যা একই সাথে দমন-পীড়ন এবং মুক্তির প্রতীক যা পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। উনিশশ নিরানব্বই সালে ইতালির মার্কো নোয়ার এডিতোরে-তে ‘উইমেন অফ আল্লাহ’ সিরিজের সবগুলো ছবিই গ্রন্থিত হয়েছে।
স্কট: ইরান ত্যাগ করার সময় তোমার বয়স কত ছিল?
শিরিন: সতেরো। আমি উনিশশ পঁচাত্তর সালে ইরান ছাড়ি; বিপ্লব হয়েছিল ঊনআশি সালে, এবং নব্বইয়ের আগ পর্যন্ত ফিরে আসিনি, ফলে তুমি বুঝতেই পারছো যে ততদিনে সংস্কৃতির একটি বহুল এবং কঠিন রূপান্তর ঘটে গেছে। বিপ্লবের সময়টা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেনি এমন অনেক ইরানির মতো আমিও এই পরিবর্তনে বেশ মর্মাহত হয়েছি।
স্কট: তোমার পরিবারকে ইমলামি বিপ্লব কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
শিরিন: অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে, এর ফলে সকলেই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তবে বলা ভালো যে অন্যদের তুলনায় আমাদের পরিবার কিছুটা কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, অবশ্য এই পরিবর্তনটি বাবার বেশ বড়ো ধরনের ক্ষতি করেছিল। বাবা সারা জীবনই খুব পরিশ্রম করেছিলেন এবং শেষদিকে যখন অবসর নিতে চলেছেন তখনই তাঁর সমস্ত ভাতা-সুবিধা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেল, তিনি তার জীবনের সবচে কম মাইনেতে চাকরি জীবন শেষ করলেন। চিকিৎসা সেবা এবং কৃষিকাজে নিরলস অবদানের জন্য কাজভিনে তিনি সামাজিক অবস্থান এবং দারুণ সম্মান অর্জন করেছিলেন। তবুও, জীবনের শেষ বছরগুলিতে, তাঁর বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সহায়-সম্পত্তি যা ছিল তা রক্ষার লড়াই করতে করতে। যে মানুষটি বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন, বিপ্লবের পরে মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগ পর্যন্ত ইরানের বাইরে আর পা রাখতে পারেননি, ওইসময় আমি গোটা পরিবারকে তুরস্কে পুনর্মিলনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ততক্ষণে বাবা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
স্কট: আচ্ছা। আলোকচিত্র নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।
শিরিন: হ্যাঁ, নব্বই দশকের শুরুতে আমি যখন ঘন ঘন দেশে আসতাম, তখন নানা অভিজ্ঞতায় বিমূঢ় হয়ে যাই। বিপ্লবের প্রভাব দেখে যুগপৎ ভাবে আমি মুগ্ধ ও আতঙ্কিত দুইই হয়েছি। এমন অনেক বিষয়ই ছিল যা আমি ততটা বুঝতে পারতাম না কিন্তু মরিয়া ছিলাম সেসব বোঝার জন্য। যেমন ধরো, বিপ্লব কীভাবে এবং কেন সংগঠিত হয়েছিল এবং এই পরিবর্তনের পিছনে মূল দার্শনিক ও আদর্শিক ধারণাগুলি কী ছিল ইত্যাদি। এক অর্থে, এই বিষয়টির সাথে যোগসূত্রতা জনগোষ্ঠীর সাথে আমার দূরত্ব অদ্ভুতভাবে কমিয়ে দিয়েছে এবং নিজেকে জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে মনে করিয়েছে। তখন থেকে এটি একটি আশ্চর্যজনক প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করছে; প্রতিটি অভিজ্ঞতা এবং প্রশ্ন আরও অনেক কিছুতে পরিচালিত হয়েছে। পরবর্তীতে ‘উইমেন অফ আল্লাহ’ সিরিজ অনুবাদ করার সময় বেশকিছু সমস্যা এবং প্রশ্ন উঠে আসে। এক্ষেত্রে আমার প্রতিক্রিয়া সবসময়ই এরকম ছিল, ‘কোন প্রসঙ্গে এই কাজটি করা হয়েছিল তা আপনাদের মনে রাখতে হবে। আমার কোনো শিল্পজীবন ছিল না; আমার কোনো দর্শকও নাই ফলে আমি দর্শকদের কথা ভাবিনি; এটি আমি আমার জন্যই তৈরি করছিলাম।’
স্কট: আমি ধরে নিয়েছি যে ফারসি জানা কেউ যখন এই ছবিগুলি দেখে তখন তারা লেখাগুলো পড়তে পারে এবং কবিতাটিও ধরতে পারে?
শিরিন: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ইরানিরা যে কেবল কবিতাটির অর্থ পড়তে ও বুঝতে পারত তা নয়, ইরানি সমাজের সাথে লেখালেখি-লেখকদের ইতিহাস এবং আলোকচিত্রে যে জায়গাটির ছবি আছে তার সাথেও পরিচিয় ছিল– বিষয়টি এমন যা পাশ্চাত্যর কারো কাছে অনুবাদ করা অসম্ভব।
স্কট: আলোকচিত্র থেকে ফিল্ম এবং ভিডিওতে কীভাবে রূপান্তর ঘটালে?
শিরিন: আমি তিরানব্বই সাল থেকে বিপ্লবকে উপজীব্য করে আলোকচিত্রের কাজটি করে আসছিলাম, তবে সাতানব্বইতে এসে আমি যখন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি পুরোপুরি আগ্রহী ছিলাম, ঠিক তখনই রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে একটি দার্শনিক পদ্ধতি ধারনের তাগিদ অনুভব করেছি। আমার চিন্তা-দর্শন-ধারণাগুলি সংশোধন করার বিষয়ে ভাবতে ভাবতেই মনে হলো আমি যে মাধ্যমে কাজ করছি সেখানেও পরিবর্তন আনা জরুরি। তাছাড়া আলোকচিত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়েও হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, অন্তত আমার কাজের ধরনকে মাথায় রাখলেও। আলোকচিত্র শেখার ক্ষেত্রে আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু আমার কাজে একটি নির্দিষ্ট শৈলীর বিকাশ ঘটেছিল, যার ফলশ্রুতিতে ‘উইমেন অফ আল্লাহ’ সিরিজ। আমার এমন একটি মাধ্যম দরকার ছিল যা আমাকে নতুন স্তরের গীতিময়তা এনে দেবে। তাই আমি স্থিরচিত্র থেকে চলন্ত ইমেজে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রয়াস নিই। আমার প্রথম ভিডিওচিত্রটি ইস্তাম্বুলে ধারণকৃত, সহযোগী হিসেবে দু’জন ক্যামেরাম্যান ছিলেন।
স্কট: টার্বুলেন্ট-এর কথা বলছো?
শিরিন: না, শামিয়ানা বা চাদরের তলায় ছায়ার খেলা, যুগপৎভাবে চারটি প্রক্ষেপনকে নিয়ে একটি কাজ, ইস্তাম্বুলে সাতানব্বই সালে করা। এটি এমন একটি ইনস্টলেশন ছিল যেখানে একজন নারী (আমিই) নিজেকে কালো আলখাল্লায় মুড়ে একইসাথে ভিন্ন চারটি স্থানে অবস্থান করে, বিষয়টি একইসাথে ব্যক্তিগত, প্রকাশ্য, পবিত্র এবং প্রাকৃতিক। সেই সময়ে আমি কোনো স্থান বা জায়গাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেই বিষয়ে জানতে উৎসুক ছিলাম, কীভাবে স্থানকে নিয়ন্ত্রন করা হয় বিশেষত লিঙ্গের প্রকৃতি অনুসারে ইসলামী সংস্কৃতিতে স্থানকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত, নিয়ন্ত্রণ ও বিভক্ত করা হয় এসব। যেমন ধরো, কীভাবে প্রথাগত সমাজে ব্যক্তিগত স্থানগুলিকে বা ঘরের ভেতর বা আব্রুঅলা জায়গাগুলো ‘মেয়েলি’ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং পাবলিক স্পেস তথা খোলা চত্বর, বাজারঘাট, পানশালা ইত্যাদিকে বিবেচনা করা হয় ‘পুরুষালি’ হিসেবে। রঙিন এই ভিডিওচিত্রটি আমার করা আগেকার শাদা-কালো আলোকচিত্র ফরম্যাট থেকে আমাকে একটানে সরিয়ে আনল।
স্কট: বেশ শক্তিশালী কাজ বলেই মনে হচ্ছে। আমি তোমার ইনস্টলেশন ‘প্যাসেজ’টা দেখেছি, গগেনহেইমে। দারুণ লেগেছে।
শিরিন: হ্যাঁ, প্যাসেজ। টার্বুলেন্টে যেমন পর্দা ভাগ করে পাশপাশি ভিন্ন দুটি চিত্র আমি দেখাতে চেয়েছি প্যাসেজে সেটা করিনি, এক পর্দাতেই রেখেছি সব।
স্কট: এমনকি ফারসি না জেনেও আমি বুঝতে পারছি, বা মনে করছি যে আমি বুঝতে পারছি, টার্বুলেন্টের কথা বলছি। এটির এমনই আবেদন এবং প্রতিক্রিয়া, এবং খুব সুগ্রন্থিত উদার নারীবাদী প্রয়াস। সিনেমার পুরুষ গায়কটির গাওয়া দুর্দান্ত বটেই এবং তুমি দেখিয়েছো যে সে শ্রোতাদের কাছ থেকে অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছে, যা তার প্রাপ্য, এবং তারপরেই নারী চরিত্রটি তার আশ্চর্য সুর-মুর্চ্ছনা পরিবেশন করে যা দর্শক হিসেবে আমাকে, পর্দার সেই পুরুষ গায়কটিসহ সবাইকে অবাক করে দেয়। ওরা কি প্রকৃতই গায়ক, নিজের গানেই ঠোঁট মিলিয়েছে?
শিরিন: নারী চরিত্রটি যিনি রূপদান করেছেন তিনি প্রকৃতই সংগীতশিল্পী, সুসান দেহিম এবং নিজের গানেই ঠোঁট মিলিয়েছেন। পুরুষ গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শোজা আজারি। শোজা এর আগে কখনও গান করেনি; ও কেবল এই অংশটিতে ঠোঁট মিলিয়েছে। পুরুষ কন্ঠের প্রকৃত শিল্পী হলেন অতি সুপরিচিত ইরানি গায়ক শাহরাম নাজেরী, সম্ভবত বর্তমানে জীবিত ইরানি সংগীতশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যিনি ক্লাসিকাল পার্সিয়ান এবং সুফি সংগীত গেয়ে থাকেন। শাহরাম বেশিরভাগ হাফেজ ও রুমির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইরানি কবিদের কবিতা গেয়েছেন। টার্বুলেন্টেও তিনি রুমির একটি কবিতা গাইছিলেন।
স্কট: আমি প্রায়শই আমার ক্লাসে লরা মালভে এবং পিটার উলেনের রিডলস্ অফ দ্য স্ফিংস (১৯৭৭)-এর উল্লেখ করি। তুমি কি সেই ফিল্মটি বিষয়ে কিছু জানো?
শিরিন: তেমন না!
স্কট: এটা বেশকিছু তত্ত্ব এবং জেণ্ডার বিষয়ক আলোচনা থেকে উঠে আসা। চলচ্চিত্রের পুরুষালি ধরন বা গড়নকে মোকাবেলা করতে গিয়ে, মালভে এবং উলেন তাদের চলচ্চিত্রের গল্পটিকে গোলাকার রূপ দিয়েছেন, নারী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাজুয্য রাখতে গিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি প্যানের সাহায্যে এ-র গল্পটি বর্ণিত করে। আমি অবাক হয়েছি যে তুমি মিলনায়তনেরর স্থানটিকে মূলত পুরূষের মর্দানি হিসাবে দেখিয়েছো এবং নারী চরিত্রটির চারদিকে চক্কর দেওয়ার মধ্যে দিয়ে একধরনের নারীবাদী প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখাতে চেয়েছো।
শিরিন: বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হলো। টার্বুলেন্টের মূল ধারণাগত বিষয়টি ছিল বিপরীতের ধারণা যেমন নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, খালি মিলনায়তন-ভরা মিলনায়তন, ঐতিহ্যবাহী সংগীত বনাম সম্পূর্ণরূপে অস্থায়ী সংগীত, অনুগামী বনাম বিদ্রোহী। তাই আমি ভেবেছিলাম পুরুষ গায়কের বেলায় ক্যামেরা স্থির রাখা যথাযথ হবে এবং নারী গায়কের বেলায় ক্যামেরাটি ঘুরবে, বিশেষত যখন সে তার গানের চূঁড়ায় পৌঁছুবে। চারপাশে ক্যামেরার দ্রুত চলনে তার মানসিক অবস্থা, উন্মাদনা, ক্রোধ ইত্যাদি ধরা পড়বে।
স্কট: একটা বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে যে নারী চরিত্রটির মুখচ্ছবিটি দেখানোর মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়নি। পুরুষ চরিত্রটি যেমন সোজাসুজি আমাদের মুখোমুখি হচ্ছে…
শিরিন: আমি অবশ্য ব্যাপরটা উল্টো করতে চেয়েছিলাম যাতে শেষ পর্যন্ত সে আর লুকিয়ে না থাকে। নিজের অবিশ্বাস্য পরিবেশনার মাধ্যমে নিজেকে দারুনভাবে প্রমাণ করার পরে, সে স্বস্তি নিয়ে, শান্ত হয়ে হাজির হবে শোকাতুর এবং নিদারুণ বেদনার মুখোমুখি হয়ে।
স্কট: কোনো টুকরো ধারণা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই কি তুমি তোমার সহযোগীদের সঙ্গে কাজ শুরু করো? বা তাদেরকে যুক্ত করার আগে তোমার প্রস্তুতি কেমন হয়?
শিরিন: আমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি না বেশ অর্গানিক বলা চলে! টার্বুলেন্ট তৈরির মধ্যে দিয়ে এটি শুরু হয়েছিল, যখন আমাদের কয়েকজন বেশ দুর্ঘটনাক্রমেই এক হয়েছিলাম। আমরা সবাই বিদেশে বসবাসকারী ইরানি ছিলাম, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই আসা আলাদা শৈল্পিক ক্ষেত্র থেকে। উদাহরণস্বরূপ, শোজা আজারি একজন লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা; সংগীতশিল্পী ও সুরকার সুসান দেহিম; অভিনেতা দারিউস খোন্দজি; চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা গাসেম ইব্রাহিমিয়ান; শাহরাম করিমি, সে ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট এবং শিল্প নির্দেশক। তাৎক্ষণিক উত্তেজনার মধ্যে দিয়েই মনে হয়েছিল যে এই দলটির শক্তি এবং এদের সামাজিক এবং শৈল্পিক রূপ উভয়ই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমি মূলত একটি ধারণা প্রকাশ করব এবং সবাইকে সেটি উপস্থাপন করব। আমরা চলচ্চিত্রের ধারণা, অবস্থান, বাজেট, ভিজ্যুয়াল ফর্ম ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব, প্রত্যেকে ধারণাটিতে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবে। এইরকম। অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে, গোটা দলটি আমার নান্দনিকতার বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল এবং তখন তাদের সহযোগিতা আরও চমৎকার রূপ পায়। এই দলে, শোজা আজারি মূল ধারণাটি থেকে শুরু করে পোস্ট প্রোডাকশন কাজের ক্ষেত্রে আমাকে অনেক সহায়তা করেছে। সুসান দেহিম এবং আমি বেশ কয়েকবার একসাথে কাজ করেছি। আমি আমার সহযোগিদের নিয়ে খুব গর্বিত। এই সহযোগীতার প্রচেষ্টা গতিশীল হয় দলে নতুন সদস্যদের যোগদানের সাথে সাথে, এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের ভাবনা-ধারনা পরিবর্তিত হতে থাকে। এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে এই দলের সকল সদস্য স্বতন্ত্রভাবে নিজের কেরিয়ারে খুব সক্রিয় রয়েছেন এবং তাদের সহায়তা করার জন্য আমি সময় প্রস্তুত। যেমন ধরো, সম্প্রতি শোজা আজারির ছবি ‘কে’ (২০০২)-এ আমি অভিনয় করেছি, প্রোডাকশন ডিজাইনে সহায়তা করেছি এবং এ-র সহনির্মাতা হিসেবে যুক্ত থেকেছি।
স্কট: তুমি তো নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছো। এটি কি ন্যারেটিভ ফিচার ধাঁচের কিছু?
শিরিন: হ্যাঁ, একটি বই পড়ছি, ওটা থেকেই স্ক্রিপ্ট দাঁড় করাব। সুপরিচিত ইরানি নারী লেখক শাহরনৌশ পারসিপুরের ‘উইম্যান উইদাউট ম্যান’। পারিসপুর ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তিনি ইরানে প্রায় পাঁচ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। আমি তাঁর খোঁজ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি এবং আমাদের মধ্যে দুর্দান্ত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। ‘উইম্যান উইদাউট ম্যান’ হলো পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন নারীর এক সুন্দর পরাবাস্তববাদী গল্প যাদের সকলেরই পটভূমিতে আছে নিপীড়ন এবং নিগ্রহ, তবে রহস্যজনকভাবে তাদের জীবন এখন ইরানের এক গ্রামাঞ্চলে অতিবাহিত হয়, একটি বড়ো উদ্যানঘেরা বাড়িতে। সেখানে তারা তাদের স্বাধীন সমাজ গঠনের চেষ্টারত: এক ধরণের ইউটোপিয়া, একটি স্বর্গরাজ্য, যেন বহির্বিশ্বের সাথে এর কোনো যোগাযোগই নেই। আর এই আপাত নির্বাসিত নারী সমাজে একমাত্র পুরুষ হচ্ছে সেই বাগানের মালী, একজন দেবতুল্য ব্যক্তির মতো, জ্ঞানী ও করুণাময় পুরুষ যিনি এই মহিলাদের অভিভাবক বনে যান। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই তাদের অনন্য আকাঙ্ক্ষার সাথে জটিল সম্পর্কে যুক্ত। সুতরাং স্পষ্টতই এটি পুরুষদের বিরুদ্ধে বা বিপরীতে নারী অবস্থানের কোনো গল্প নয়। মজার বিষয় হলো শেষ পর্যন্ত কীভাবে এই সমাজটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সেটাই। আমার কাছে এই বইটি, খুবই ঐক্ষিক, দারুণ রাজনৈতিক, দার্শনিক, রহস্যবাদী, সর্বজনীন এবং অবশ্যই খুব নারীবাদী।
স্কট: তুমি বললে যে এই নতুন চলচ্চিত্রটি পুরুষদের বিরুদ্ধচারণমূলক কোনো চলচ্চিত্র নয়। তোমার ‘র্যাপচার’-এর সাথে কি কোনোভাবে মিলছে ব্যাপারটা?
শিরিন: হ্যাঁ এবং না। আমি বিশ্বাস করি যে এটি সত্যিকার অর্থেই পুরুষদের বিরুদ্ধে নারীদের বিপরীত অবস্থানমূলক কিছু নয় বা নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের। বরং এটি প্রকৃতি এবং সংস্কৃতিতে পুরুষ ও নারীর যে বৈসাদৃশ্য তা নিয়ে কাজ করে।
স্কট: র্যাপচারের শুটিং তো মরক্কোয় করেছিলে?
শিরিন: হুম
স্কট: যদি সম্ভব হতো তাহলে কি ইরানেই শুটিং করতে? র্যাপচারের ওই দুর্গটি বেছে নিয়েছিলে কি এই ভেবে যে এর স্থাপত্য আরব বিশ্ব এবং ইরানের লোকদের কাছে পরিচিত মনে হবে? তাছাড়া দুর্গটির ব্যবহার কি কেবলই স্থানিক বিবেচনায় নাকি অন্তর্নহিত কোনো কারণ আছে?
শিরিন: আমার চলচ্চিত্রের বিষয়গুলোর প্রকৃতি বিতর্কিত হওয়ার কারণে শুধু আমি কেন আমার মতো কারও পক্ষে ইরানে সিনেমা করা অসম্ভব বা অত্যন্ত জটিল। তাছাড়া, আমি ইরানে নিরাপদ নই, এবং আমি ঝুঁকি নিতে চাইনি। তবে আমি এরকম অন্যান্য দেশে কাজ করেও ইরানে কাজ করছি মনে করে একধরনের আনন্দ নিতে চাই, আমি যে ধরণের আর্কিটেকচার ব্যবহার করি সে সম্পর্কে আমি খুব সচেতন। যেমন ধরো, আমি সেই দেশের (যে দেশে শ্যুট করছি) ঐতিহ্যবাহী ও প্রতিনিধিত্বশীল স্থাপত্য থেকে দূরে থাকি। র্যাপচারে, আমি এশাউইরা শহরের দুর্গে শুটিং করেছি, কারণ এই জায়গাটি আমার বিষয়ের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল। একটি দুর্গের স্থাপত্য, বিশেষত ইসলামী সংস্কৃতিতে, সাধারণত পুরুষালি বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে, যেমন সেনাদলের যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি পুরুষদের সাথে সম্পর্কিত তাবৎ ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই দুর্গটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল (আমার ধারনা), তবে বেশিরভাগ ইসলামিক শহর ঐতিহ্যগতভাবে প্রাচীর বা পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল– মারাকেশ নগরী এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। এই দুর্গের প্রতি আমার আরেকটি ব্যক্তিগত আকর্ষনের জায়গ অরসন ওয়েলস, ওথেলো (১৯৫১)-এর কয়েকটি দৃশ্য এখানেই ধারণকৃত। প্রাকৃতিক দৃশ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে, আমি সাধারণত সহজ-সরল ল্যান্ডস্কেপ বিবেচনা করি, এমন একটি স্থান যা কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতির পরিচয় বহন করবে না। যেমন ধরো র্যাপচারের নারীটি যে মরুভূমিতে ঘুড়ে বেড়ায় সেই জায়গাটি দেখলে তুমি ঠাহর করতে পারবেনা আসলে ওটা কোন দেশের মরুভূমি।
স্কট: আমার মনে হয় টার্বুলেন্টের চেয়েও সম্যকভাবে, র্যাপচারে পুরুষ-নারী, পয়েন্ট বা কাউন্টারপয়েন্ট তৈরি করে। পুরুষরা যখন যা কিছু উচ্চারণ করছে বা জপ করছে তখন নারীরা তাদের দিকে তাকায় এবং সেই জপমালার শব্দগুলো যেন তাদের হাতে ধরে রাখছে, যেন পুরুষদের বলা কথাগুলো তারা রক্ষা করতে পারে এবং সেখানে এমন মারাত্মক এক অবসান নেমে আসে যখন ওই গ্যালারীতে নাটকীয় ভাবে দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে দেখা যায়, তখন পুরুষেরা নারীদের দিকে হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষন জানায় যেন তার দূর সমুদ্রে নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য বেড়িয়ে পড়ছে, এরকম।
শিরিন: আরে বাহ্! তুমি তো ঠিক ঠিক পড়তে পেরেছো। খুশি হলাম। র্যাপচার পরিচালনা করা আমার কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতেই বটে। আমি অনুভব করেছি যে এই সিনেমার ন্যারেটিভে এবং কোরিওগ্রাফিতে বিভিন্ন জ্যামিতিক আদলের ব্যবহার বিশেষ মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। এ-র সম্পাদনার প্রক্রিয়াটি আমি দারুণ উপভোগ করেছি এবং কীভাবে ইমেজগুলো নান্দনিকভাবে অন্যান্য কিছুর পরিপূরক হিসাবে কাজ করে সেটা ভেবেছি। উদাহরণস্বরূপ, একটি দৃশ্যে পুরুষরা বৃত্তাকার একটি জায়গায় বসে ছিলেন প্রার্থনার প্রস্তুতির নিচ্ছে, ওদিকে নারীরা প্রার্থনার জন্য জড়ো হয়েছে ত্রিভুজাকার স্থানে। এমন আরও উদাহরণ রয়েছে যেখানে আমি আমার গল্পটি বলতে গিয়ে ইমেজের নিখুঁত সৌন্দর্য এবং শক্তির উপর নির্ভর করেছি। র্যাপচারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গোটা চলচ্চিত্রে কখনই কোনো বিশেষ চরিত্রের দিকে ক্যামেরা ফোকাস করা হয়নি।
স্কট: তুমি উল্লেখ করেছ ‘ফেভর’ মূলত এমনভাবে নির্মিত যাতে দুটি চিত্র পাশাপাশি থাকতে পারে। চলচ্চিত্র মাধ্যমের একজন হিসেবে আমার মনে হয় এই চলচ্চিত্রটি বিশেষভাবে আবেদনময়ী; দুটি চিত্র একসাথে এক ফ্রেমে যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে তা লক্ষণীয়।
শিরিন: মূলত, আমার অনুভূতিটি ছিল এরকম যে যেহেতু যৌন সম্বন্ধিয় বিষয় মুসলিম পুরুষ এবং নারী উভয়ের কাছেই নিষিদ্ধ টাইপের কিছু, এবং এখনও তা বিদ্যমান রয়ে গেছে, কিন্তু আমার কাছে তা আর বিরোধী অবস্থানের বা নিষিদ্ধ কিছু তো নয়! গাসেম ইব্রাহিমিয়ানের দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির সাহায্যে আমি অনুভব করেছি যে পুরুষ ও মহিলাদের দুটি দলের মধ্যে যে বিচ্ছেদ এবং প্রলোভন তা খুব সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে।
স্কট: এর চিত্রনাট্য বা কারিগরি দিকগুলো কি শুরু থেকে এভাবেই ভেবেছিলে?
শিরিন: চিত্রগুলি পাশাপাশি রাখার সিদ্ধান্ত একদম শুরুতেই নেওয়া হয়নি। বলা চলে দুর্ঘটনাক্রমে একদিন সম্পাদনার কক্ষে পাশপাশি রাখা কিছু ছবি চোখে পড়ে। সেখান থেকেই ধারণাটি পেয়ে যাই।
স্কট: ফেভরের পুরুষ চরিত্রটি দুই দলে বিভক্ত নারী-পুরুষের সামনে বক্তৃতা দেয়। তোমার কাছে কি সেই ভাষণের অনুবাদ আছে?
শিরিন: হ্যাঁ, আমি ওটার অনুবাদ করেছিলাম পেশাদার অনুবাদক দিয়েই এবং সাবটাইটেলও জুড়ে দিয়েছিলাম। তবে পরে অনেকই, বিশেষত ইংরাজিভাষী বন্ধুরা জানায় যে অনুবাদ করা সাবটাইটেল সিনেমাটিকে খুব আক্ষরিক করে তুলবে। তারচে এটা অপেরার মতোই হওয়া উচিত। তাই শেষে আমি সাবটাইটেলগুলি ফেলে দিই। অবশ্য মাঝেমধ্যে এই সিদ্ধান্তের জন্য আফসোসও করি। সেই আফসোস কমাতে আমি এখন প্রদর্শনীতেগুলো ফেভর প্রদর্শনের সময় বক্তবটি প্রিন্ট করে টাঙিয়ে রাখি।
স্কট: অপেরায়ও এখন কিছু ক্ষেত্রে সাবটাইটেল যোগ করা হচ্ছে।
শিরিন: হ্যাঁ, তা হচ্ছে। তবে আমি মনে করি অপেরার সঙ্গে দর্শকের সম্পর্কটি মৌখিক নয়। এটি চাক্ষুষ করা এবং শোনার।
স্কট: আচ্ছা ফেভরের বক্তা আসলে কি বিষয়ে বলছিলেন তা একটু যদি বলতে।
শিরিন: বক্তা ‘পাপ’ বিষয়ে নৈতিক বক্তব্য দিচ্ছিলেন, যে, পাপ আসলে বিপরীত লিঙ্গের জন্য আকাঙ্ক্ষা ও প্রলোভন থেকে উদ্ভূত হয়। এসময় তিনি কোরআন থেকে ইউসুফ এবং জোলেখার গল্পটি ব্যবহার করেছেন। যা অনেকটা আদম ও হাওয়ার গল্পের অনুরূপ যেখানে ইউসুফকে প্ররোচিত করার জন্য জোলেখাকে দায়ী করা হয়েছে। বক্তা এই গল্পটি পুরুষ এবং নারীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য হিসাবে ব্যবহার করছেন, যার পটভূমিতে এই গল্পটি একটি চিত্রের মাধ্যম উপস্থিত হয়েছে। প্রদর্শনের এই স্টাইলটি আসলে ইরানের থিয়েটারগুলোর একটি বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ধরন যেখানে গল্পকার তার গল্পটি বিশাল ক্যানভাসে আঁকে এবং মঞ্চের ব্যাকড্রপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যাইহোক, বক্তাটিকে– আমি মোল্লা, অভিনেতা, বা রাজনীতিবিদ কোনো কাতারে না ফেলে সন্দেহজনক অবস্থানে ছেড়ে দিয়েছি। যিনি জনসাধারণকে ডেকে ডেকে ব্যভিচার থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সকল অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন প্রবণতা দমন করার জন্য মুসলিম পুরুষ ও নারীকে সতর্ক করেছেন। তিনি একটি শ্লোগান ব্যবহার করেছেন ‘শয়তানকে অভিশাপ দাও!’
স্কট: ইরানে তোমার কাজ কতটা সমাদৃত বা ব্যাপকভাবে দেখা হয়?
শিরিন: সম্প্রতি তেহরানের কনটেম্পোরারির আর্ট মিউজিয়ামে ‘তুবা’-র আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয়েছে, এই একটাই। দৃশ্যতই এটি আমার জন্য অভ্যর্থনার মতো। তবে তুমি তো জানোই, আমার কাজের বিষয়গুলি সহজাতভাবে অসহজ, তাই বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই প্রকাশ্যে প্রদর্শনের জন্য অনুমোদিত নয়।
স্কট: সলিলোকুই নিয়ে আমার দুটি প্রশ্ন রয়েছে। তার একটা এরকম, তুমি নিজেই এ-র মূল চরিত্রে অভিনয় করেছ– সে এমন এক ব্যক্তি যে মনে করে– ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটা সঠিক হবে কি-না আমি জানি না, দুটি ভিন্ন জায়গা থেকেই পৃথক, যদিও কিছুটা ভিন্ন উপায়ে এবং আবার সে ওই দুটি জায়গাকেই সমানভাবে উপভোগ করে তবে সেটাও ভিন্ন উপায়ে।
শিরিন: চমৎকার পর্যবেক্ষণ।
স্কট: লোকেশন দুটো কোথায় ছিল?
শিরিন: একটা লোকেশন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ওখানের বেশ কয়েকটি শট। অন্যটি ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তে পূর্ব তুরস্কের মারদিনে, আব্রাহামের জন্মস্থান উরফা শহরের খুব নিকটবর্তী একটি কুর্দি শহর। মার্দিন একটি ধর্মীয় শহর, অত্যন্ত দরিদ্র এবং অবহেলিত, তবে বেশ সুন্দর। শহরটি মরুভূমির মাঝখানে একটি ছোটো পর্বতের উপরে যেখানকার বেশিরভাগ ঘরবাড়িই কাঁচা, কুঁড়েঘর। আমরা খুব দ্রুত আবিষ্কার করি যে কুর্দি বিদ্রোহী এবং মুসলিম মৌলবাদী উভয়ই সীমান্তে ইরানিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বলেই এই শহরটি বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তুর্কি সরকার সেখানে একটি বিশাল সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, এবং তুমি বুঝতেই পারছ, আমরা শ্যুটিং কারার জন্য এসে পৌঁছানোর পরপরই সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছিলাম। আমরা যখন চিত্রধারণ করছিলাম তখন পুরো সময়টা আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল এবং কড়া পাহারায় রাখা হয়েছিল। সেই প্রথম মতো আমি এতটা উদ্বেগ নিয়ে কাজ করেছি।
স্কট: তুমি কি কেবল একটি কমপ্লেক্সেই পুরো কাজটা শেষ করেছ?
শিরিন: হ্যাঁ, শহরের কিছু অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়া বেশিরভাগটাই ‘ঘাসেমিহ’ নামের এক অত্যাশ্চর্য দালানের মধ্যে চিত্রগ্রহণ করেছি, যা একসময় মূলত কোরান অধ্যয়নের একটি স্কুল ছিল। তবে এই দালানের স্থাপত্য সৌধ সম্পূর্ণ অবহেলিত এবং সেটা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে ততদিনে। শিশুরা প্রায়শই এটি খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করে।
স্কট: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে শ্যুটিংয়ের কথা শুনতে চাই।
শিরিন: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মূল লোকেশন ছিল পাথ ট্রেনগুলির প্রবেশপথ। আমার জন্য দীর্ঘ এস্কেলেটারের দৃশ্য, প্রচুর লোকের উপরে ওঠা-নীচে নামার দৃশ্য প্রয়োজন ছিল কারণ দুটোই ভীতিকর এবং আধুনিক জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অন্যান্য জায়গায়ও যেমন উইন্টার পার্কের মূল প্রবেশপথে চিত্র ধারণ করেছি।
স্কট: আ্যলবানি শহরকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলে?
শিরিন: আমি আমেরিকান কয়েকটি শহর যেমন ডালাস, টেক্সাস এবং কানেক্টিকাটে চষে বেড়িয়ে শেষে আ্যলবানিকে পছন্দ করি। এক্ষেত্রে আমার মূল দেখার বিষয় ছিল যে শহরটি দেখতে যেন একটি সাধারণ আমেরিকান শহরের মতো মনে হয় যাতে চট্ করে কেউ চিনে ফেলতে না পারে। সেদিক দিয়ে আ্যলবানি নিখুঁত কারণ একদা নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজধানী থাকার পরেও এটি খুব বেশি আলোচিত শহর নয়। আ্যলবানির রকফেলার প্লাজা সত্যিই আশ্চর্যজনক স্থাপনা। এখানকার বেশ কয়েকটি ভবন নানা স্মৃতিচিহ্নযুক্ত হলেও কার্যত পরিত্যক্ত। এই ভবনগুলো একই সাথে সুন্দর এবং ভাড়াক্রান্ত। যা তুরস্কের ঘাসেমিহ-র সাথে সাজুয্যপূর্ন। তুমি দেখবে, স্থাপত্যকলা সলিলোকুইয়ের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে কারণ ভবনগুলি প্রতিটি সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে।
স্কট: সলিলোকুইয়ের শুরুতে এক অসাধারণ মুহূর্ত রয়েছে যেখানে দুটি দৃশ্যের বঙ্কিম উপস্থাপন একটি একক সিটিস্কেপ তৈরি করে এবং তারপরে আস্তে আস্তে দুটি চিত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক মুহুর্তের জন্য, অন্তত ডিভিডিতে এই দুটি দৃশ্যই এক জায়গায় বলে মনে হয় যা কিছুমাত্র পরেই দুটি জায়গায় পরিণত হয়।
শিরিন: আমরা খুব সাবধানে এটি বিন্যাস করেছিলাম। দুই জায়গাতেই ভবনের ঠিক একই আকারের ঘর এবং জানালা তৈরি করেছি। আমরা চেয়েছিলাম প্রতিটি ঘর, জানালা বা এমন কাঠামোর মুখোমুখি হবে যা আইকনিক হয়ে উঠবে। আ্যলবানিতে জানালাটি একটি উঁচু ভবনের এবং মারদিনের জানালাটি একটি মিনারের মুখোমুখি হয়েছিল। ক্যামেরাটি একই গতিতে সরে গেলে, জানালায় নারী চরিত্রটি ধরা পড়ে।
স্কট: তুরস্কে শ্যুট করা অংশে ধুলায় লেপ্টে থাকা ছেলেটার সাদা-কালো শটগুলি সিলিলোকুইয়ের ধারাবাহিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়। এই শটগুলি কেন প্রয়োজন পড়ল?
শিরিন: মূলত তুরস্কের অংশে গল্পের মূল ভরটি ‘মৃত্যু’কে ঘিরে, ভবনের চারপাশ থেকে কালো পোশাক পরিহিত একদল নারী-পুরুষ মৃত্যুর ভয়াবহ সংবাদ উচ্চারণ করে চলেছে। এখানে মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল একজন যুবকের, যে প্রধান নারী চরিত্রটির ছেলে। পর্দার ছোটে ছেলেটির ধুলোমাখা অবয়ব সাদা-কালোয় সেই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তির প্রয়াস বলতে পারো। গল্পের এই অংশটি মূলত আমার বোনের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল, এই চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করার এক বছর আগে সে তার তরুণ পুত্রকে হারিয়েছিল।
স্কট: পশ্চিমে দৃশ্যায়িত একটি শটে আমরা দেখি নারী চরিত্রটি আধুনিক ভবনের দিকে থেকে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে একটি চ্যাপেলে আবিষ্কার করে যেখানে আরও অনেক সাদা পোশাকের নারী আগে থেকেই অবস্থান করছে। প্রাচ্যে এরকম দৃশ্যে নারীটি হারিয়ে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে ওঠে। এখানে, নারী চরিত্রটি সম্পূর্ণরূপে দৃশ্যমান তবে তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটি ভিন্নতর।
শিরিন: হ্যাঁ, এরকমটাই দেখাতে চেয়েছিলাম।
স্কট: পার্থক্যও রয়েছে। যেমন পূবের ধর্মীয় স্থানগুলি স্পষ্টতই ধর্মীয় স্থান, আর পশ্চিমে প্রাথমিকভাবে স্থানটি ব্যবসায়ের জায়গা বলে মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই ধর্মীয়।
শিরিন: হ্যাঁ পশ্চিমে আমি আসলেই আধুনিকতার দিকে মনোনিবেশ করছিলাম এবং পুরানো গীর্জা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই কারণেই আমি ম্যানহাটনের সেইন্ট আন্না চার্চ ব্যবহার করেছি কারণ এটি একটি আধুনিক চ্যাপেল।
স্কট: ‘পজেসড্’ এবং ‘পালস্’ দুটি চলচ্চিত্রই আগের ছবিগুলির চেয়ে কিছুটা বেশি সরাসরি বলে মনে হচ্ছে; এদের ধারণা বা বিষয়গুলি বেশিরভাগই প্রচলিত চলচ্চিত্রের মতো মনে হলো।
শিরিন: ঠিক বলেছো। যেমনটি আমি আগেই বলেছি, আমার কাছে এই ফিল্মগুলির প্রতিটিই নীরিক্ষামূলক। বারবার একই স্টাইল পুনরাবৃত্তি করা আমার কাছে একঘেয়ে মনে হচ্ছিল। ‘পজেসড্’ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। প্রথমত, এটাতেই প্রথম একজন পেশাদার অভিনেত্রী (শোহরেহ আঘদাসলু)-এর সাথে কাজ করেছি, তাই তার মানসিকতা তৈরি করতে আমাকে চরিত্র বিকাশে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। এছাড়াও, এই ফিল্মটির সুস্পষ্ট কিছু ধাপ ছিল, যার অর্থ হলো সম্পাদনা প্রক্রিয়ায় আমাদের অতীতের মতো অত নমনীয় হওয়া চলবে না। এই সমস্ত বিষয় আমার জন্য উত্তেজনাপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে, বিশেষত এই যে পরিবর্তন, কোনো একজন অভিনেতাকে ভাস্কর্য বা জড়বস্তুর ন্যায় বিবেচনা না করে সত্যিকারের চরিত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
স্কট: তোমার আগেকার চলচ্চিত্রগুলির সাথে তুলনায় ‘পজেসড্’ অনেক বেশি নাটকীয় এবং কিছুটা প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্রের মতো।
শিরিন: একদম। ব্যক্তিগত এবং বারোয়ারি, উভয় স্থানেই চলচ্চিত্রটির নায়িকার যে উন্মাদনা, মানসিক অবস্থার অন্বেষণ করা এবং তা প্রকাশ করাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। তার মানসিক অবস্থান, সে অনুযায়ী তার আচরণ, এক আবেগ থেকে অন্য প্রকারের আবেগে পরিবর্তিত হতে থাকে…সবই আমার জন্য খুব নাটকীয় এবং সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে।
স্কট: ‘পজেসড্’ আমাকে জঁ গেনেতের ‘উন চান্ত দিআমোর’ (১৯৫২)-এর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। তুমি কি ওটা দেখেছ?
শিরিন: না।
স্কট: এটি কারাগারে দুজন সমকামী পুরুষ বা হয়তো স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কেরই দুজন পুরুষের গল্প। কারাগার কীভাবে দুজন মানুষের একে অপরের প্রতি যৌন ইচ্ছাকে নিয়ে বিবেচনা করে, কীভাবে আকৃষ্ট হয় এটা সেরকম গল্প। মজার ব্যাপার হলো তাদের কাছে কারাগার এমন একটি জায়গায় হয়ে ওঠে যেখানে তারা নিজেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে পারে স্বাধীনভাবে। ‘পজেসড্’ এর সাথে আমি মিল পাই এইভাবে যে এখানে যে সমাজটা চিত্রিত হয়েছে সেখানে পাগলামিই একমাত্র উপায় যেখানে কোনো একজন নারী নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, উন্মাদের বেশে।
শিরিন: আমার ভাবনার কাঠামোটা এরকমই ছিল। এখানে চরিত্রটি উন্মাদ অবস্থায় তার স্বাধীনতা অর্জন করে। এটি অবশ্য ইরানি সংস্কৃতি থেকে বা তাকে উল্লেখ করার মতো একটি বিষয় কারণ ইরানের জনসাধারনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণে বা শৃঙ্খলে থাকাটা অনেকটা বাধ্যতামূলক। এখানে স্বতন্ত্রতার ধারণা সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হয়, কারণ এটি অন্যকে একই অধিকার দাবি তুলতে প্ররোচিত করতে পারে। এই চলচ্চিত্রে নারীটি যখন পাবলিক প্লাজায় প্রবেশ করে এবং প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কেন্দ্র হয়ে ওঠে, ঠিক তখনি প্লাজার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়ে ওঠে এবং উপস্থিত জনসাধারণ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে: যারা তার স্বাধীনতা ও পাগলামীভরা ইচ্ছেমতো আচরণ করার বিষয়টি সমর্থন করে এবং অন্যরা এই প্রকাশে তীব্রভাবে অপমানিত বোধ করতে থাকে, পাশাপাশি তাৎক্ষনিকভাবে উন্মাদিনিকে হটিয়ে দেবার দাবি তোলে।
স্কট: আমরা দেখি যে সে চলে যাওয়ার পরও সমবেত লোকেরা তর্ক করে চলেছে। তার এমনতর স্বাধীনতা বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে।
শিরিন: হুম, এই বচসাকে আমরা বলি ‘ফেতনাহ্’। মানুষের মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরির একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা। র্যাপচার এবং প্যাসেজের চেয়েও এ-র বর্ণনা এবং বার্তার দিকটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা সম্ভবত আরও দ্ব্যর্থক এবং বিমূর্ত। তবে আমি মনে করি এখন পর্যন্ত এটিই আমার সবচেয়ে প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্র যা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি এবং তা দেখে আমি নিজেই খুব খুশি।
স্কট: ‘পালস্’ চলচ্চিত্রে আমরা মেঝেয় বসা নারীটিকে প্রথমে দূর থেকে দেখি; ঠিক কি করছে বুঝে উঠতে পারি না, কিছু একটা ধরে আছে, তারপর আমরা তাকে আরও কাছে দেখতে পাই, মনে হচ্ছে একটি রেডিও ধরে আছে।
শিরিন: হুম। আমরা যত্ন সহকারে ঘরটি এমনভাবে সাজিয়েছিলাম যাতে দেখে মনে হয় এটি একটি শোবার ঘর আবার যেন মনে হয় এটি কারাগারের কামরার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাইরের বিশ্বের সাথে তার একমাত্র যোগযোগ মাধ্যম ওই রেডিওটি। এটি তার পারিপার্শিক পরিবেশ থেকে বাঁচার একটি উপায় যেন। আমরা যখন নারীটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি তখন আমরা শুনতে পাই যে রেডিওতে বাজছে এমন একটি গানের সাথে সে-ও গাইছে। দেখে মনে হয় তার নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে এবং কল্পনাশক্তিতে ভর করে হারিয়ে গেছে। গোটা ফিল্মটি শুরু থেকে শেষ অবধি একটি নিরবচ্ছিন্ন শটে তৈরি করা হয়েছিল।
স্কট: ‘তুবা’ তোমাকে মেক্সিকো অবধি কেন নিয়ে গেল? ‘তুবা’ বলতে আসলে কী বোঝায়?
শিরিন: তুবা মূলত কোরানের একটি পৌরাণিক চরিত্র, একজন নারী যিনি একটি গাছও, পবিত্র গাছ, প্রতিশ্রুতিময় বৃক্ষ। ওয়ান ইলেভেনের পরে, স্বর্গের বাগানের ধারণাটিকে কেন্দ্র করে আমার ভাবনা শুরু হয়। ইসলামী ও ফারসি রীতিতে বাগান বা উদ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, রহস্যময়তা এবং রাজনৈতিক উভয়েরই প্রতীক। অন্যান্য অনেক সংস্কৃতির মতোই, আমাদের ঐতিহ্যেও রহস্যময় ও কাব্যিক উপাদানের নির্যাস নিয়ে একটি বাগান আধ্যাত্মিক স্থান হয়ে ওঠে, স্বর্গে রূপ নেয়। এবং আমাদের রাজনৈতিক ভাষার অভ্যন্তরেও উদ্যান আসলে স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমের জায়গা। সেসময় আমি এই বিষয়টিকে খুব প্রাসঙ্গিক মনে করেছিলাম। মেক্সিকোকে বেছে নিয়েছিলাম কারণ ইরানে এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই সবচেয়ে নিরপেক্ষ দেশে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছি, যার অর্থ ইসলামিক বা পাশ্চাত্য নয়। আমি এর আগে কখনও মেক্সিকো ঘুরে দেখিনি তবে ল্যান্ডস্কেপের বিভিন্নতা এবং অবশ্যই এর দুর্দান্ত সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। তাই আমি বাগান এবং ঠিক যেমন গাছ চাইছি তার খোঁজে ওএক্সাকাতে লোকেশন স্কাউটিংয়ের জন্য যাই। মনমতো গাছ পেয়েও যাই, একটি ডুমুর গাছ যা পবিত্র গাছ হিসেবেই আদৃত। গাছটি এমন এক পাহাড়ের চূড়ায় ছিল যেখানে স্বাভাবিকভাবে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না ফলে আমাদের রাস্তাও তৈরি করতে হয়। স্থানীয়দের সহায়তা নিয়ে আমরা গাছটির চারপাশে প্রাচীর তৈরি করি এবং চিত্রনাট্য অনুযায়ী চরিত্রে রূপদানের জন্য অভিনয় শিল্পী খুঁজতে শুরু করি।
স্কট: ‘তুবা’ এবং ‘র্যাপচারে’ দেখেছি, তুমি যাদের সাথে কাজ করেছ তাদের বেশিরভাগই সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। এদেরকে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল?
শিরিন: সাধারণত আমরা স্থানীয় লোকদেরকে সমন্বয়কারী হিসাবে ভাড়া করি– যেমন কাস্টিং ডিরেক্টর, প্রজেক্ট ম্যানেজার, লাইন ম্যানেজার এবং এরকম আরও কিছু পদে। স্থানীয় লোকদের নিয়োগের ব্যাপারে যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো স্থানীয় লোকজনকে তোমার প্রয়োজন হবেই, পাশপাশি এরা ওই স্থান এবং সম্প্রদায় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং এই ধরনের আয়োজনের হয়তো কিছু পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং আমরা অডিশন রাখি, লোকেরা আসে এবং আমরা নির্বাচন করি। প্রায়শই, এটি আমাদের জন্য খুব হতাশাজনক হয়ে ওঠে কারণ প্রচুর প্রতিযোগিদের সমাবেশ ঘটে। আমরা যতজন নিতে চাই তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চলে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওরা অত্যন্ত দরিদ্র, এবং তাদের কারোরই পেশাদার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নেই, তাই তারা অর্থনৈতিক লাভালাভের কারণেই জড়ো হয়। আমি সবসময় আমার প্রোডাকশনের এই দিকটি সম্পর্কে খানিকটা গর্ব বোধ করি, কারণ কিছুটা হলেও তা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য অর্থনৈতিক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। প্রায় সববারেই দেখা গেছে যে আমরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে একটি দুর্দান্ত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। মরোক্কোর ক্ষেত্রে আমরা সেই লোকদেরকে এখনও সহযোগিতা অব্যাহত রাখি। মেক্সিকোতে আমরা স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে কাজ করতাম, বেশিরভাগই বয়স্ক পুরুষ এবং নারী। যাদের শারীরিক শক্তি অসাধারণ এবং গর্ব করার মতো। ওদের সাথে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা এককথায় চমৎকার।
স্কট: ‘তুবা’ দেখে মনে হয়েছে গাছটির সংস্পর্শে আসা বেশিরভাগ লোকই পুরুষ; কয়েকটি শট রয়েছে যেখানে তুমি নারীদেরও দেখিয়েছ।
শিরিন: না, সংখ্যাটা আসলে সমানুপাতিক; এটা ঠিক যে দৃশ্যায়নে নারীরা পুরুষদের চেয়ে কম উপস্থিত। ওই পাহাড়গুলিতে দৌড়ঝাঁপ বেশ কঠিন, বলাবাহুল্য। তবে লিঙ্গ সম্পর্কিত বা জেণ্ডারসমতার কোনো বিষয় নিয়ে কিছু দেখানোটা আমার ইচ্ছাও ছিল না। ‘তুবা’ এমন একটি চলচ্চিত্র, আমি মনে করি যা পাশ্চাত্য দর্শক বিশেষত আমেরিকান দর্শকরা খুব একটা বুঝতে পারবে না।
স্কট: কেন?
শিরিন: আমার মনে হয় বেশিরভাগ আমেরিকানই সত্যই এ-র ভেতরকার কবিতা এবং প্রতিকীত্বটি টের পান না। আমেরিকান সংস্কৃতিতে ধর্ম এবং কবিতা খুব বড়ো কোনো ভূমিকা রাখে না। এই ফিল্মের ভাষা রূপক, এবং একটি বর্ণনামূলক চলচ্চিত্রের চেয়ে কবিতার দৃশ্যায়ন হিসেবে এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করাটাই আসল।
স্কট: অবশ্যই, খুবই সত্য এবং যথার্থ বললে।
শিরিন: হ্যাঁ, তবে হিজাবের মতো সুস্পষ্ট ইসলামী আইকনোগ্রাফির কারণে আগেকার চলচ্চিত্রগুলো তাদের বোঝাবুঝির জন্য স্পষ্ট কিছু ছিল। ‘তুবা’য় আমি সেই সমস্ত উপাদান বাদ দিয়েছি, সুতরাং এটি বরং সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, যদিও আমার মতে এখনও খুব ইরানি। আমাদের সংস্কৃতিতে বেশিরভাগ ব্যক্তির অবাধে কথা বলার অনুমতি নেই, কেবল রূপক কাব্যিক ভাষার ব্যবহার হলো প্রকাশের একমাত্র উপায়। কবিতা পরিণত হয় রাজনৈতিক বিবৃতিতে এবং জনসাধারণ সেসব পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি পড়তে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
স্কট: ফিল গ্লসের সাথে কীভাবে যুক্ত হলে? তার সাথে কাজ করতে কেমন লেগেছিল? আমি লক্ষ্য করেছি যে এই-ই প্রথম তোমার কোনো চলচ্চিত্রের শুরুর ক্রেডিট লাইন এবং সংগীতায়োজনে ফিল গ্লস এবং তোমার নাম যৌথভাবে রাখা হয়েছে।
শিরিন: (হাসতে হাসতে) সেটা এইজন্য যে ফিল আরও চারজন চলচ্চিত্র নির্মাতা– পিটার গ্রানাওয়ে, গডফ্রে রেজিও, অ্যাটম এগোয়ান এবং মিশাল রোভনার-এর সঙ্গে দশ মিনিট ব্যাপ্তির চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রযোজনা করেছিল এবং এই প্রকল্পটির সংগীতাযোজনও তার করা। তো ওই চারটি সিনেমার টাইটেল ফরম্যাট একই রাখা হয় সঙ্গত কারণেই। ফিলিপ গ্লস এবং তার প্রযোজনা সংস্থার কাছে আমার কাছে সেই একই প্রকল্পের জন্য একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রস্তাব নিয়ে, তো ওসখান থেকেই প্যাসেজ’র শুরু। আমি ভাবনাটা ফিলিপকে জানাই এবং সেটা তার পছন্দ হয়। আমি মরক্কোয় গিয়ে ছবির শুটিং শুরু করি এবং সম্পাদনার কাজেও হাত দিই। প্যাসেজের প্রাথমিক সম্পাদনা হয়ে গেলে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই, ওই রাফকাট দেখে ফিল সংগীতায়োজন শুরু করেন। আমার মনে আছে, সে প্রথমে পিয়ানোতে কয়েকটি নোট বাজিয়ে শোনায়, তারপর একটা প্রি-লিউড; আমার খুবই পছন্দ হয় সেটা। এরপর সে পুরো আয়োজনটি অর্কেস্ট্রায় সাজিয়ে রেকর্ড করে। তার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আসলে গনতান্ত্রিক বাতাবরণে কাজ করার মতোই। সে আমার ধারণা, বোঝাপড়া এবং মতামতের প্রতি খুব সংবেদনশীল এবং অনুগামী ছিল। শুরুতে অবশ্য একটু চিন্তিত ছিলাম, ভেবেছিলাম, ‘লোকটা কেমন না কেমন হবে, তারওপর আবার পশ্চিমা!’ ততদিনে আমার সুসান দেহিমের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে এক বিস্ময়কর সংগীতশিল্পী এবং সুরকার সেটা আগেই বলেছি, নিজে গান বাঁধার পাশাপাশি আদিবাসী এবং ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সুরগুলি সে তাঁর রচনায় ব্যবহার করে থাকে। আর ফিল হচ্ছে মিনিমালিস্টিক সুরকার যে মূলত সুর-সৃষ্টিতে পশ্চিমা শব্দ এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। তবে আমি এই বাধাটিকে স্বাগত জানিয়েছি এবং এ-বিষয়ক ধারণা পরিষ্কার করতে প্রচুর গান শুনেছি। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে চলচ্চিত্রটির সংবেদনশীলতার জায়গাটি ফিল ধরতে পারবে কী-না। আমার বলতেই হয় যে শেষ অবধি তার সংগীতায়োজনে আমি আনন্দিত। এ-প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি। দু হাজার এক সালের মে মাসে বারবারা গ্ল্যাডস্টোন গ্যালারিতে এটি প্রদর্শন করার সময় এই সুরারোপ বিষয়ে বেশ কঠিন এবং মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাই। একদলে এমন অনেকেই ছিলেন যারা এটি পছন্দ করলেন না, এবং বলেলেন, ‘তোমার করা চলচ্চিত্রের মধ্যে এটির সংগীতায়োজেই সবচেয়ে খারাপ; তোমার কেবল সুসান দেহিমের সাথেই কাজ করা উচিত’। বাকি দলটা বলছিলেন, ‘সত্যিই দুর্দান্ত হয়েছে। ’
স্কট: তুমি যখন চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, তার আগে তো তুমি শিল্পী হিসেবে গ্যালারী বা প্রদর্শনশালাভিত্তিক শিল্পী ছিলে এবং সেখান থেকেই তাড়না অনুভব করেছিলে, যা কিছু মাত্রায় অস্বাভাবিকও বটে…আবার ভাগ্যবানও…চলচ্চিত্রের মতো একটি প্রশস্ত জায়গায় প্রবেশের জন্য কারণ…
শিরিন: তুমি বলতে চাইছো ‘দুর্ভাগ্য’?
স্কট: না, আমি ‘সৌভাগ্যবান’ই বলতে চাইছি।
শিরিন: আচ্ছা! তাই?
স্কট: বিগত কয়েক বছরে আমি বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতার সাথে কথা বলেছি, যাদের কমবেশি সবাই বলেছেন যে, ‘আমরা এই চলচ্চিত্রগুলো তৈরিতে যতোটা সময় ব্যয় করেছি এবং আমাদের যতো প্রচেষ্টা ছিল তার তুলনায় একবার প্রদর্শনীর জন্য যে পরিমাণ অর্থানুকুল্য পাই তা নিতান্তই সামান্য। আমাদের সময় এবং চেষ্টা প্রায়শই ব্যর্থ বলে মনে হয়।’
শিরিন: ওহ, তুমি আর্থিক লাভালাভের বিষয়টি বোঝাচ্ছ।
স্কট: হ্যাঁ, গ্যালারির পরিস্থিতি আর্থিকভাবে সক্ষম বলেই মনে হয়, অবশ্য সব নির্মতার জন্য না হলেও অনেকাংশেই।
শিরিন: তা বটে। শিল্পকর্ম হিসাবে আমরা যা তৈরি করি তা বিক্রি করতে পারি। তবে তোমাকে বুঝতে হবে যে আমি একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট হিসাবে চলচ্চিত্রে এসেছি এবং আমার দর্শক সেইসব সাধারণ মানুষ যারা আমার আলোকচিত্র এবং ইনস্টলেশন কাজটা বুঝতে পারেন বা অন্তত চেষ্টা করেন বুঝতে। তারা বুঝতে পেরেছিল কীভাবে আমার কাজ ধীরে ধীরে স্থির আলোকচিত্র থেকে মোশন বা চলন্ত ছবির দিকে বিবর্তিত হয়েছিল এবং আমি যদিও চলচ্চিত্র নির্মাতা তবুও আমার কাজ আসলে ভিজ্যুয়াল আর্টের ভাষা সম্পর্কে। শুরুতে তো আমি মনে করেছিলাম যে আমার এরকম সৃষ্টি চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় ঠাঁই পাবে না কারণ তা প্রচলিত আখ্যান ব্যবহার করে না। কিন্তু এখন আমি মনে করি যে সেই দ্বিধার জায়গাটা উৎরে গেছি। ভিডিও ইনস্টলেশন এবং চলচ্চিত্র, এ দুয়ের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি চলচ্চিত্র নিয়েই।
স্কট: তোমার চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করাটা শিল্প জগতে কেমন প্রতিক্রিয়া তুলেছিল?
শিরিন: দেখো, অনেক সময় তুমি শিল্প জগতের যে সীমানাগুলো আছে তাকে ধুসর বা ঝাপসা হিসেবে দেখতে পাবে। কোথাও একটা প্রতিরোধের মতন। যেমন টার্বুলেন্ট এবং র্যাপচার বেশ ভালোভাবেই আদৃত হয়েছে; বেরিভাগ সমালোচক এবং সাধারণ দর্শক এই ছোটো ভিডিও ইনস্টলেশন ধারনাটি পছন্দ করে, যা বর্ণনায়, আখ্যানে, সঙ্গীতে খুব চাক্ষুষ হয়ে উঠেছে। টার্বুলেন্টে, বর্ণনার উপাদানটি ন্যূনতম ছিল কারণ এটি পুরুষ এবং নারী গায়কের মধ্যে কেবল একটি গানের বিনিময়ের মদ্যে দিয়ে ঘটেছিল। আবার ফেভার এবং সলিলোকুই-এ ন্যারেটিভটি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল। চলচ্চিত্রগুলি যত আখ্যায়িত হয়ে ওঠে, ততই সমালোচকেরা ‘শিল্প সমালোচক’ হয়ে ওঠেন, জানতে চায় যে কাজটি কি শিল্প না-কি শর্ট ফিল্ম, এটি কোনো গ্যালারী, মিউজিয়াম বা কোনো প্রেক্ষাগৃহে দেখানো উচিত কিনা ইত্যাদি। তারপরেই চলে আসে স্বাদ বা রুচি বা পছন্দ যা-ই বলো না কেন, সেই প্রশ্ন। তারা কোন কাজ বা স্টাইলকে পছন্দ করে; কোনটা করেনা, কেন করছে না, কেন এটা করা উচিৎ , কেন উচিৎ না…এইসব। তো আমি এইসব মতামত এবং আপত্তিতে মনোযোগ না দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি স্বভাবতই আমার ধারণা এবং নীরিক্ষার জায়গায় প্রাকৃতিক গতিকেই অনুসরণ করি। আমার কাছে প্রতিটি চলচ্চিত্রই একটি নতুন অনুশীলন এবং সত্যিকারের মাল্টিমিডিয়া শিল্পী হিসাবে আমার ভাষাকে প্রসারিত করার একটি উপায়।
স্কট: তুমি বারবারা গ্ল্যাডস্টনের সাথে কীভাবে যুক্ত হলে? তার সাথে তোমার কাজের পরিসরটা কি রকম মানে আমি বলতে চাইছি কোনো একটা গ্যালারী চলচ্চিত্র প্রয়োজনায় টাকা ঢালবে সেটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
শিরিন: বারবারা এমন এক ব্যবসায়ী যে শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না; বরং তাদের কাছ থেকে যে কাজটি চান সেটি তৈরি হতে বা করতে শিল্পীদের পুরো আস্থা এবং স্বাধীনতা দেয়।
স্কট: তোমরা কি কোনো স্ক্রিপ্ট বা স্টোরিবোর্ড বানিয়ে ফেলেছ?
শিরিন: না, একেবারে কিছুই না। সে যতটা ঝুঁকি নিচ্ছে তা অস্বাভাবিক। আমি মনে করি না সে একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক বা নির্মাতা হওয়ার আশা পোষন করে। আসলে তার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করল তখন সেও এই মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়তে শুরু করে।
স্কট: তোমার একেকটা সিনেমার বাজেট সাধারনত কতো করে হয়?
শিরিন: একেকটার একেকরকম বাজেট। টার্বুলেন্টে খরচ হয়েছে বিশ হাজার ডলার, র্যাপচারে লেগেছে এক লাখ ডলার, ফেভরের বাজেটও এক লাখের একটু বেশি। সলিলোকুইয়ের বাজেট ব্যয়বহুল ছিল কারণ আমাদের দুটি দেশে যেতে হয়েছে, সেটাও দুই লাখ ডলারের মতো। এটাই এখন ইস্তক আমার সবচে বেশি বাজেটের ছবি।
স্কট: ‘প্যাসেজ’ কি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা?
শিরিন: ঠিক তা না, আমার ইউনিটের প্রযোজনা আমি করেছি, ফিল সংগীতায়োজনের ব্যয়ভার নিয়েছে। যখন আমার অংশটি শেষ হলো, তখন তাঁর সংগীত জুড়ে দিয়ে আমার এটাকে পূর্নাঙ্গ শিল্পকর্ম হিসেবে পাই। সে-ও আমার চলচ্চিত্র থেকে কোনো লাভ চায় নি, এবং আমি তাঁর সংগীত থেকে কোনো লাভ চাইনি, সুতরাং চুক্তিটা এরকম ছিল।
স্কট: একটা সিনোমার শুটিং করতে তোমার কত সময় লাগে?
শিরিন: যেহেতু শ্যুটিংয়েই সবচে বেশি আর্থিক ব্যয় হয় তাই আমরা এটিকে খবু কমপ্যাক্ট বা আটোসাঁটো রাখতে চেষ্টা করি, ধরো, একটানা পাঁচদিন শ্যুট করি। সাধারণত আমরা এক সপ্তাহে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করি, এরচেয়ে কম হলে ভালো, বেশি তো নয়ই।
স্কট: তুমি বলছিলে নতুন একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শ্যুটিং শুরু করতে যাচ্ছ। কোথায় এবং কখন সেটি শুরু করবে?
শিরিন: ব্রুকলিনে, ২০০৩ সালের মার্চে শুরু করতে চাই। এই প্রথমবারের মতো চরিত্রদের মুখে কিছু সংলাপ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। এখানে দু’জন প্রধান অভিনেতান পাশপাশি আরও জনা পনের অভিনেতা যুক্ত থাকবে। এবার আমাকে ঠিক প্রথাগত পদ্ধতেত স্ক্রিপ্ট লিখতে হচ্ছে এবং প্রচলিত ন্যারেটিভে গল্পটির বিকাশ ঘটাতে হচ্ছে। (শিরিনের ‘দ্য লাস্ট ওয়ার্ড’-এর নির্মাণ দুই হাজার তিন সালে সম্পন্ন হয়েছিল)
স্কট: এই প্রক্রিয়াকে কি আগামীর নির্মাণের শিখন প্রক্রিয়া হিসাবে দেখছো?
শিরিন: নিশ্চয়ই।
এক দশক ধরে যুক্ত আছেন অনুবাদ চর্চায়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ তিনটি।