ফরোগ ফারখজাদ ইরানের অন্যতম বিখ্যাত কবি যিনি ১৯৬৭ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যান। তাকে বলা হয় ইরানের সিল্ভিয়া প্ল্যাথ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যীয় সাহিত্যে ফরোগের অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তার বিদ্রোহী এবং নিয়ম ভাঙা স্বভাব এবং সাহসী উচ্চারণ যা সেইসময় কবিদের, বিশেষত নারী কবিদের কবিতায় অকল্পনীয় ছিল। তার কবিতায় শাসকশ্রেণি এবং ইরানের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে সরাসরি কটাক্ষ করে বক্তব্য যেমন পাওয়া যায় তেমনি প্রেমের কবিতায় যৌনতাও বেশ সাবলীল ও সাহসীভাবে এসেছে যা ফরোগকে তার সময়ের অন্য কবিদের চাইতে আলাদা করে তুলেছে। মূল ফার্সি ভাষা থেকে আমেরিকান-ইরানি অনুবাদক শোলেহ ওলপে প্রথম অনুবাদক যিনি ফরোগের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, যা কাব্যগ্রন্থ হিসেবে পরে আরকানসাস ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে দুটো কবিতা অনুবাদ করা হয়েছে।
পুনর্জন্ম
আমার আস্ত আত্মাটা একটা ক্লেদাক্ত স্তব
নিজের মধ্যেই সে আওড়ে যাচ্ছে তোমাকে
অনন্তকাল ধরে ফুটে ওঠা এবং ফেটে পড়া ভোরে তোমাকে বয়ে নিয়ে চলেছে
আহ, তোমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, এই স্তবে!
এই স্তবে,
তোমাকে জুড়ে দিলাম বৃক্ষ, পানি আর আগুনের সাথে
সম্ভবত জীবন
এক দীর্ঘ রাস্তা যার পাশ দিয়ে
ঝুড়ি নিয়ে এক নারী প্রতিদিন যায়
সম্ভবত জীবন
একটা দড়ি যা দিয়ে মানুষ নিজেকে ঝোলাতে পারে
গাছের ডালে
সম্ভবত জীবন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা এক শিশু
সম্ভবত জীবন হলো তুমুল প্রেমে ডুবে যাওয়া দুটো সঙ্গমের মাঝে
মাতাল নেশা ছড়িয়ে জ্বলে উঠা সিগারেটের আগুন
বা কোনও পথিকের দ্বিধান্বিত পথ
যে কিনা অন্য কোন পথিককে টুপি খুলে
শুকনো হাসি দিয়ে বলছে,
শুভ সকাল
হতে পারে জীবন সেই অবরুদ্ধ মুহূর্ত
যখন আমার দৃষ্টি নিজে থেকেই ভস্ম করে দেয়
তোমার চোখের মণিদের
এবং এর মধ্যে কেমন যেন মনে হয়
আমি মিলে যাব চাঁদের অনুভবে
আর অন্ধকারের বরণে
নিঃসঙ্গতার সমান একটা ঘরে
আমার হৃদয়
এক প্রেমের সমান
নিজ-সুখের সহজ অজুহাতগুলি তাকিয়ে দেখে
দেখে ফুলদানীতে রাখা তীর্যক মায়াময় ফুলগুলি
দেখে আমাদের ফুলশয্যায় রোপন করা সেই ছোট্ট চারাগাছটাকে
দেখে ক্যানারি পাখিদের কলতান
যারা এক জানলা সমান সুরে গেয়ে যায় গান।
আহ
এ আমার জন্য অনেককিছু
এটা আমার জন্য অনেএএএএক কিছু
আমার আছে অনেক বড়
একটা আকাশ, যা কিনা পড়ে যাওয়া এক পর্দা আমার থেকে আড়াল করে রেখেছে
আমার এমন অনেককিছু একটা পরিত্যক্ত সিঁড়ি বেয়ে নামছে
আর জুড়ে দিচ্ছে কিছু একটাকে আমার স্মৃতিকাতরতা আর ক্ষয়ে যাওয়ার সাথে
আমার অনেককিছু মানে হলো নিরানন্দ হেঁটে চলা স্মৃতির বাগানে
এবং তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য মরে যাই দুঃখে যে আমাকে বলে :
‘আমি ভালোবাসি
তোমার হাত’
আমাদের ফুলশয্যায় ফুল ফোটাব
বীজ বুনব, আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি
আর চড়ুই ডিম পাড়বে
আমার কালিভরা আঙ্গুলের ফাঁকে
একজোড়া লাল চেরির কানের দুল ঝোলাব
গোল করে কানের লতিতে
নখের উপরে ডালিয়ার পাপড়ি লাগাব
একটা গলি আছে
যেখানে ছেলেরা তাদের সেই উড়াধুড়া চুল, সরু গ্রীবা এবং ক্ষুধার্ত পায়ে
একসময় আমার প্রেমে মত্ত ছিল
তবুও এখনো মনে পড়ে ছোট্ট মেয়েটির নিষ্পাপ হাসি
যে কিনা এক রাতে ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেল
একটা গলি আছে যেখানে আমার হৃদয়
শৈশবের সমস্ত জায়গা থেকে চুরি করে রেখেছে
সময়ের রেখা ধরে দীর্ঘ আয়তনে যে যাত্রা
এবং বিশাল সেই আয়তনে সময়ের বন্ধ্যা রেখায়
ভিজে আছে
আরও বড় আকারের এক সচেতন চিত্র
ফিরে আসছে আয়নার ভোজসভা থেকে
এভাবে
কেউ মারা যায়
এবং কেউ থেকে যায়
কোনও জেলে মুক্তা সংগ্রহ করবে না
খাদে প্রবাহিত সেই স্রোত থেকে
আমি এক দুঃখ ভারাক্রান্ত মৎস্যকন্যাকে চিনি
সমুদ্রে যার বাস
মৃদু, আলতো করে তার হৃদয়ে
এক কাঠের বাঁশি বাজছে
এক বিষণ্ণ মৎস্যকন্যা
প্রতি রাতে যে মরে যায় চুম্বনে চুম্বনে
পাপ
এমন এক পাপ করেছি, যে পাপ শুধু আনন্দে ভরপুর
আলিঙ্গন, উষ্ণতা এবং জ্বলেপুড়ে জড়িয়ে যাওয়ায় মোড়ানো
আমি পাপ করেছি
এক উজ্জ্বল প্রাণবন্ত, উথালপাথাল, হিংস্র দুবাহুতে।
সেই ম্লান ও শান্ত নির্জন স্থানে
আমি দেখেছি তার চোখে ভেসে উঠা রহস্য
আমার বুকের মধ্যে ভীষণ শিহরিত আমার সমস্ত হৃদয়
কামনায় জ্বলছে তার চোখের দৃষ্টিতে
সেই ম্লান ও শান্ত নির্জন স্থানে
ভিতরে ভিতরে টুকরো টুকরো হয়ে তাঁর পাশে বসে থাকি
তার ঠোঁট আমার ঠোঁটে ঝরায় কামনার তৃষ্ণা
আর অমনি আমি ভুলে যাই হৃদয়ের যত দুঃখ বেদনা
তাঁর কানে ফিসফিস করে বলি ভালবাসার এইসব কথা:
‘আমি তোমাকে চাই, আমার প্রাণসখা
আমি তোমাকে চাই, আমাকে জীবন দেয়া আলিঙ্গন
আমি তোমাকে চাই, উন্মাতাল প্রেমিকের মতো’
তার চোখে দেখি কামনা বাসনা
রেড ওয়াইন ঝলকে পড়ে কাপে
আমার শরীর তার সমস্ত শরীরে ঘুরে বেড়ায়
খাটো বিছানার কোমলতায়।
আমি পাপ করেছি, যে পাপ সমস্তটাই আনন্দে ভরা
একটা ক্লান্ত ও ন্যাতানো শরীরের পাশে শুয়ে এখন
কী যে করেছি আমি জানি না, হে খোদা
সেই ম্লান ও শান্ত নির্জন স্থানে।
মূলত কবি। পাশাপাশি অনুবাদ করেন। একটা ইংরেজি ওয়েবজিন ‘প্রাচ্য রিভিউ’র কবিতা বিষয়ক সম্পাদক। জন্ম ২১ এপ্রিল ১৯৮৭, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। প্রথম কবিতার বই নিঃসঙ্গম।