সংবাদপত্রটির নাম ‘সুসংবাদ’। বলা বাহুল্য সেখানে দুঃসংবাদ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সমস্ত সংবাদই প্রকাশ করার দায় বর্তায়। তাই পেট্রোলের দাম বাড়ার খবরে সেখানে লেখা হয়, ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের নতুন দাওয়াই’। দেশে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খবরের শিরোনামে লেখা হয়, ‘যুবসমাজকে স্বাধীন ব্যবসায় উৎসাহিত করার জন্য সরকারের নতুন উদ্যোগ’। হাসপাতালে একসঙ্গে ষাটজন নবজাতকের মৃত্যুর পর সেখানে প্রকাশিত হয়, ‘পুলিশের প্রশংসনীয় তৎপরতায় তিনদিনের মধ্যে গাফিলতির অভিযোগে গ্রেফতার ডাক্তার খান’। ধর্ষণে আক্রান্তের মৃত্যু হলে লেখা হয়, ‘জীবনযন্ত্রণা হতে মুক্তি পেলেন নির্ভয়া’, আর ধর্ষিতা প্রাণে বাঁচলে লেখা হয়, ‘শহরে প্রতিবাদের নতুন মুখ সুজেট জর্ডন’। সরকারি সম্পত্তির লাগাতার বেসরকারিকরণের পর পত্রিকার প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো কালো হরফে লেখা থাকে, ‘বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে’।
ধর্ষণে আক্রান্তের মৃত্যু হলে লেখা হয়, ‘জীবনযন্ত্রণা হতে মুক্তি পেলেন নির্ভয়া’, আর ধর্ষিতা প্রাণে বাঁচলে লেখা হয়, ‘শহরে প্রতিবাদের নতুন মুখ সুজেট জর্ডন’।
হলুদ যেহেতু আনন্দের রং, ‘সুসংবাদ’ এর সম্পাদক, কর্মীদের হলদে রঙের জামা পরে আসার নির্দেশ দেন অহরহ। হলুদ উর্দি পরে জনা চারশো সংবাদ ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক কর্মী ‘সুসংবাদ’-এর দপ্তরে দৈনিক আসা যাওয়া করে থাকেন। ‘সুসংবাদ’ এর একটি দূরদর্শন চ্যানেলও রয়েছে, সেখানেও সংবাদপাঠকেরা হলদে পোশাক পরে খবর পড়েন। প্রসঙ্গত, ‘সুসংবাদ’ চ্যানেলটির লোগো থেকে শুরু করে সমস্তকিছুই হলদে। ‘সুসংবাদ’ আগাগোড়া হলুদ। এবং এটাই ‘সুসংবাদ’ এর কর্তৃপক্ষ চেয়ে এসেছেন। আর হলুদ যেহেতু আনন্দঘন রং, তাই ‘সুসংবাদ’-এ কর্মরত সমস্ত মানুষ সবসময় আনন্দিত। দেশের আর্থিক উন্নতি গত চল্লিশ বছরে সর্বনিম্ন হলে ‘সুসংবাদ’ এর রবিবারের ক্রোড়পত্রে যখন নিবন্ধ প্রকাশিত হয়,- ‘গান্ধীজির জীবনাদর্শ : সরল জীবন উচ্চ চিন্তন’, তখনও তাঁদের আনন্দে ভাঁটা পড়ে না। তাঁরা সকালে হাসিমুখে কাজে যান। রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলেই তাদের ঘুম আসে। ছুটির দিনে দুপুরবেলা তাঁরা পুকুরে মাছ ধরতে বসেন ছিমছাম ছিপ নিয়ে। বিকেলের দিকে তাঁদেরকে ছাদে পায়রা ওড়াতে দেখা যায়।
সুসংবাদ পত্রিকার দূরদর্শন চ্যানেলে মাঝেমধ্যে সান্ধ্যকালীন বিতর্কসভা আয়োজিত হয়। মুখ্য সঞ্চালক যিনি, বহুল ব্যবহারে তাঁর ঠোঁটদুটি বেশ্যার যোনির মতো খলবল করে। মহোদয়ের চক্ষুদ্বয় সবসময় অর্ধ নিমীলিত থাকে। তাঁর চশমার আড়ালে, চোখের নিচে যে আইব্যাগ, দুর্জনের ধারণা, সে দুটি পর্যন্ত কালোধনে পরিপূর্ণ। মুখ খুলতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই তিনি সর্বদা তাঁর মুখ খোলাই রাখেন। খোলা মুখে দিনের পর দিন থাকার ফলে মহোদয়ের মুখ হতে দুর্গন্ধ বেরিয়ে জন্মজন্মান্তরিত হয়। এই বিষয়টি সর্বজনবিদিত। আগে কোনো আলোচনাসভায় এই কারণে কেউ মহোদয়ের আশেপাশে বসতে চাইতেন না। অতিমারীর সময়, মাস্ক ব্যবহার করার সুযোগ মেলাতে এই সমস্যা কিঞ্চিৎ কমে। মহোদয় সবসময় কলম হাতে উদ্যত থাকেন, মহোদয়ের হাতে কলমটি— তরবারি, ছোরা, ভোজালি, কুকরি, এমনকি বর্শার চেয়েও মহান দেখায়। কথা বলার সময় সেই কলম তাঁর হাতে জ্যান্ত হয়ে নাচানাচি করে। মহোদয় কী এক অদ্ভুত কারণে যেন, একনাগাড়ে ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে কথা বলে যেতে পারেন না। তাই দর্শক বন্ধুরা তাঁকে অনবরত চোখ পিটপিট করতে দেখে। মহোদয়ের অসংখ্য অনুরাগী সন্ধ্যে সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত সুসংবাদ চ্যানেলে বিতর্কসভায় মহোদয়ের বক্তব্য শোনে। তর্করত মহোদয়কে দেখে পুরুষ দর্শকের লিঙ্গ উত্থিত হয়, নারী দর্শকের যোনিফুল খোলে। সভায় অতিথি বক্তা যে থাকেন না তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ সময়ে শুধু মহোদয়কেই বক্তব্য রাখতে দেখা যায়, কারণ দেশে নীলছবির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া এবং কর্মসংকোচ হওয়ার পর থেকে জাতি আরও বেশি করে এটাই চায়, বলে মনে করেন সুসংবাদ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। তাই কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে গেলেও মহোদয় চোখ পিটপিট করে উত্তেজনার তুঙ্গে গলা তুলে, টেবিল চাপড়িয়ে, থুতু ছিটিয়ে বলেই চলেন, বলেই চলেন, আর সেই বক্তব্য শুনে জাতির শীর্ষসুখ হয়।
এমনই এক সন্ধ্যায়, বিতর্কসভা গরম সিঙারার মতো উপভোগ্য হয়ে উঠেছে যখন, সুসংবাদ পত্রিকার কার্যালয়ের শৌচাগারের ঘুলঘুলি দিয়ে একটা বেনেবউ ফড়ফড় করে ঢুকে পড়ল ভিতরে। কীভাবে যেন সবার চোখের আড়ালে এই ঘর ওই ঘর উড়ে উড়ে সে লাইভ স্টুডিওতে এসে উপস্থিত হলো এবং বিতর্ক শুনতে থাকল।
এমনই এক সন্ধ্যায়, বিতর্কসভা গরম সিঙারার মতো উপভোগ্য হয়ে উঠেছে যখন, সুসংবাদ পত্রিকার কার্যালয়ের শৌচাগারের ঘুলঘুলি দিয়ে একটা বেনেবউ ফড়ফড় করে ঢুকে পড়ল ভিতরে। কীভাবে যেন সবার চোখের আড়ালে এই ঘর ওই ঘর উড়ে উড়ে সে লাইভ স্টুডিওতে এসে উপস্থিত হলো এবং বিতর্ক শুনতে থাকল। বিজ্ঞাপনী বিরতির ঠিক আগে উত্তেজনার শীর্ষে পৌঁছে যে মুহূর্তে মহোদয় টেবিল চাপড়ে বললেন, ‘দা কান্ট্রি ওয়ান্টস টু নো!’
বেনেবউটি উঁচু এক লাইটের মাথায় বসে সুর করে বলে উঠল, ‘এ কেওড়া!’
সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সব কটি চোখ আতংকিত হলো, স্টুডিওতে উপস্থিত তিনখানি ক্যামেরা ত্রস্ত হয়ে বিজ্ঞাপনী বিরতিতে চলে গেল।
মহোদয় চমকে উঠলেন, ‘কে? কে বলল একথা?’
পাখিটি উঁচু আলোর উপর হতেই ফের বলল, ‘এ কেওড়া!’
আলোর দিকে তাকাতে চোখ ঝলসে গেল মহোদয়ের, পিটপিটে চোখদুটো সরু করে অনেকক্ষণ ধরে দেখে অবশেষে একটা হলুদ রঙের পাখিকে তিনি শনাক্ত করতে পারলেন।
উপস্থিত অতিথি বক্তাদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল, ‘পাখি, পাখি!’
‘একটা হলুদ রঙের পাখি!’
স্টুডিওতে এই প্রথম নিজেদের কন্ঠস্বর শোনা যেতে সবাই আরও অবাক হয়ে দেখলেন যে মহোদয়ের মুখ হাঁ হয়ে আছে। এই প্রথম তাঁর কোনো কথা নেই!
পৃথিবীটা যেন থমকে গেল। চীনের প্রাচীর গেল ভেঙে। তাজ মহলের চুড়ায় একপাল বাঁদর উঠে লাফালাফি করতে লাগল, আর সেই দৃশ্য দেখে অনেকের ’৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের কথা মনে পড়ে গেল। খোদ স্টুডিওতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উবে গিয়ে ক্যামেরা, আলো, কম্পিউটার, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি তারসমেত শূন্যে ভেসে উঠল। পরিচালক, প্রযোজক, স্টুডিওর সমস্ত কর্মীরা বাতাসে ভাসতে থাকলেন। চায়ের কাপ থেকে চায়ের বুদবুদ উঠে ভেসে চলে গেল। জলের বোতল, পেনের খাপ, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব সব অভিভূত ভাসতে থাকল স্টুডিওর বাতাসে।
পাখি আবার সুর করে ডেকে উঠল, ‘এ কেওড়া!’
সেই সুরে সম্বিৎ ফিরতে মহোদয় ব্যস্ত হয়ে উপস্থিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই, কেউ পাখিটাকে শিগগির ধরো!’
মহোদয় যে ভয়টি করছিলেন, এরপর ঠিক তাই হলো। বেনেবউটি হেলেদুলে মহোদয়ের টেবিলে উড়ে এসে জুড়ে বসে বলল, ‘আমার কিছু প্রশ্ন আছে।’
মহোদয় যারপরনাই বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘পাখির আবার প্রশ্ন!’
পাখি বলে, ‘আমি বেশি সময় নেবো না,’
মহোদয় তখনো হতবাক হয়ে থাকেন, এবং তাঁর খোলা মুখ থেকে স্টুডিওর বাতাসে দুর্গন্ধ বেরতে আরম্ভ করে।
পাখিটি বলে, ‘আমি সত্যিই বেশি সময় নেবো না,’
সান্ধ্যকালীন বিতর্ক অনুষ্ঠানের পরিচালক এই পর্যায়ে মহোদয়ের টেবিলের কাছে এসে জানতে চাইলেন, বিজ্ঞাপনী বিরতি আর কতক্ষণ টানা দরকার। এই প্রশ্নে মহোদয় আমোদ পেলেন, ভাবলেন জনসমক্ষে পাখিটাকে একটু রগড়ে দেওয়াই যায়, তাই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত করার নির্দেশ দিলেন।
হলুদ স্টুডিও লাইভ হলো, একশো কুড়ি কোটির দেশের ‘একুশ লাখ’ দর্শক দূরদর্শনের পর্দায় মহোদয় ও বেনেবউটিকে এক টেবিলে দেখামাত্র রোমাঞ্চিত হয়ে নড়েচড়ে বসলেন।
মহোদয়ের ঠোঁট দুটি ইল মাছের মতো খলবল করে উঠে বলল, ‘আজ একজন বিশেষ অতিথি আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমার পাশে বসে আছেন একজন বেনেবউ,’ মহোদয় হাত দিয়ে পাখিটিকে নির্দেশ করেন, ক্যামেরা জুম করে হলুদ পাখিকে দেখায়, ‘তিনি একটু আগেই জানিয়েছেন, তাঁর কিছু প্রশ্ন আছে এবং তিনি বেশি সময় নেবেন না। তো, দেখা যাক কী কী প্রশ্ন,’
ম : নমস্কার, আজকের বিতর্কসভায় আপনাকে স্বাগতম, আপনি আপনার প্রশ্ন শুরু করতে পারেন—
পা : চারদিকে সবকিছু এত হলুদ কেন?
মহোদয় হেসে ওঠেন, তারপর বলেন, ‘আমরা হলুদ রঙে বিশ্বাসী, কারণ এই রং আনন্দের রং, এই রং মানুষকে আনন্দিত করে। ভিতরের সব দুঃখ কষ্টকে ছাপিয়ে ওঠে সেই আনন্দ। এই আনন্দের মধ্যে আমরা খাই, ঘুমাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াই, দাড়ি কামাই। আমরা হলুদ রঙের পোশাক পরি। বলা যায়, আমাদের জীবনের সবকিছুই হলুদ। হলুদের মধ্যে আমাদের দর্শকবন্ধুরা, আমাদের কর্মীরা আনন্দে থাকেন। হলুদ রং আমাদের মন থেকে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, দুঃখ কষ্টের যে মূল—অবিশ্বাস এবং ভয়— সব শুষে নেয়। কোথাও কোনো সন্দেহ থাকে না। আমি নিজেও সবসময় নিজের ভিতরে অনাবিল এই আনন্দ বোধ করি।
পা : সবসময়?
ম : সবসময়।
পা : নাগরিকত্ব আইনের বিরূদ্ধে উত্তরদেশে যখন কনকনে ঠান্ডায় মহিলারা ধর্নায় বসলেন তখনও?
ম : তখনও।
পা : দক্ষিণদেশের কৃষকেরা যখন অন্য মৃত কৃষকের হাড়, করোটি নিয়ে মিছিল করল তখনও?
ম : হ্যাঁ… তখনও।
পা : অক্সিজেনের অভাবে পূর্বদেশে কাতারে কাতারে করোনা আক্রান্ত মানুষ যখন হাহাকার করছে তখন?
ম (অল্প হেসে) : আলবাত তখনও!
পা : পশ্চিমদেশ থেকে আসা ষাট হাজার ট্র্যাকটর যখন রাজধানী ঘেরাও করল, তখনও?
মহোদয় ঢোক গিলে মুখে হাসি টেনে এনে বললেন, ‘নিঃসন্দেহে! নিঃসন্দেহে!’
পা : মানুষের গুয়ের রংও কিন্তু হলুদ,
পাখি এবার ফাঁদে পড়বে ভেবে নিয়ে মহোদয় সহসা উত্তেজিত হয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি তো বেশ বিপজ্জনক! কী বলতে চান! একুশকোটি দর্শকের প্রিয় হলুদ রঙের এমন অপমান আপনি করতে পারেন না। আমাদের অটলবিশ্বাসে আপনি আঘাত করতে পারেন না! জাতি জানতে চায় কেন আপনি একথা বললেন! দা কান্ট্রি ওয়ান্টস টু…’
বেনেবউ হঠাৎ টেবিল ছেড়ে ফড় ফড় করে উড়ে উড়ে স্টুডিওর এদিক ওদিক বিষ্ঠা ত্যাগ করতে শুরু করে দিল। বিষ্ঠা বৃষ্টি থেকে নিজেদের মাথা বাঁচাতে পরিচালক মহোদয়কে অনুরোধ করলেন স্বল্প সময়ে পাখিটির প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে ফেলতে। জানালেন ইত্যবসরে, বনদপ্তরকে তলব করা হবে, যাতে প্রশ্নোত্তর শেষ হওয়া মাত্রই তাঁরা বিপজ্জনক বেনেবউটিকে খাঁচা বন্দি করতে পারেন।
পকেট থেকে হলুদ রুমাল বের করে চশমার কাচে লেগে থাকা পাখির বিষ্ঠা মুছে তেলো চুল ঠিক করে শান্ত হয়ে বসলেন মহোদয়।
বেনেবউ আবার টেবিলে ফিরে এলো।
ম : আপনার পরবর্তী প্রশ্নটি কী?
পা : এত কিছুর পরেও আপনাদের রাতে ঘুম হয়?
ম : ঘুম হবে না কেন? বালাইষাট! ‘সুসংবাদ’ই তো আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, যে ‘সুসংবাদ’ পড়ে না, এখন তার চোখে কোনো ঘুম নেই, এখন তার চোখের নিচে কালি।
পা : দেশ বলতে আপনি কী বোঝেন?
ম : দেশ মানে, আমি… আমাদের স্টুডিওয় উপস্থিত কর্মীরা, আমাদের পর্দার ওপারের দর্শকবন্ধুরা, আমাদের সরকার। দেশ বলতে…
পা : গঙ্গাজলে দলে দলে ভেসে আসা করোনা রোগীর মৃতদেহকে বোঝেন?
মহোদয় ঢোক গিলে প্রযোজকের দিকে তাকান। প্রযোজক ইঙ্গিতে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, ‘মৃতদের কোনো দেশ হয় না। আপনি জানেন, কী অবস্থায় আমাদের দেশের সেনারা উঁচু পর্বতমালায় বরফের রাজ্যে শত্রুদের মোকাবেলা করছে? যে বা যারা আমাদের দেশ নিয়ে কোনো কথা বলবে, তাদের কথা আমরা শুনছি না শুনবো না, তাদের কথা দা কান্ট্রি ডাস নট ওয়ান্ট টু নো, জনগণ জানতে চায় না।’
পা : জনগণ বলতে আপনি কী বোঝান?
মহোদয় ক্যামেরার দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘ওই যে, ওপারে বসে আছেন যিনি, যার মনে কোথাও কোনো সন্দেহ নেই এই আনন্দঘন হলুদের প্রতি। যিনি বিশ্বাসী, তিনিই জনগণ।’
পর্দার ওপারের হলুদ আলোয় বসা দর্শকেরা এতে তুমুল হরষিত হয়।
পাখি জিজ্ঞেস করে চলে, ‘আর যাঁরা অবিশ্বাসী? ভিন্নমতের, ভিন্নধর্মের, ভিন্নজাতের— তাঁরা?’
ম : এরকম কেউ আছে নাকি? আমার দেশে অন্তত তেমন কেউ থাকে না, যার মত ভিন্ন, জাত ভিন্ন…
পাখিটি চুপ করে মহোদয়কে দেখল কিছুক্ষণ, তারপর তুরুপের তাসটি ফেলল, ‘আচ্ছা, আপনাকে কেউ কোনোদিন বলেছে, যে আপনি মুখ খুললেই দুর্গন্ধ বেরোয়? যেন ইঁদুর মরে পড়ে আছে ভিতরে কোথাও… অথবা আপনি নিজেই পচে উঠেছেন ভিতরে ভিতরে, আপনার এক্সপায়ারি ডেট পার হয়ে গেছে… কেউ কি কখনো বলেছে একথা আপনাকে?’
মহোদয় চমকে উঠলেন। একথা সত্যিই তাঁকে কেউ কখনো বলেনি।
ঠিক তখন বনদপ্তর থেকে আসা দুজন রেঞ্জার খপাত করে হলুদ পাখিটিকে একটা খাঁচায় বন্দি করে ফেলল। নির্বিরোধে পাখিটি খাঁচার ভিতর থেকে মহোদয়কে দেখতে লাগল।
মহোদয় একহাত মুখের কাছে নিয়ে অবিশ্বাসের সাথে শ্বাস ছেড়ে নিজের মুখের গন্ধ পরখ করলেন। অতীব দুর্গন্ধ ভক ভক করে বেরিয়ে এলো তাঁর মুখ দিয়ে। কিন্তু অদ্ভুত, দুর্গন্ধে তাঁর বমি পেল না। তিনি অবাক হলেন। নিজের নাককে সন্দেহ করলেন তিনি। দুর্গন্ধটা সত্যিই তো, না মনের ভুল?
মহোদয় একহাত মুখের কাছে নিয়ে অবিশ্বাসের সাথে শ্বাস ছেড়ে নিজের মুখের গন্ধ পরখ করলেন। অতীব দুর্গন্ধ ভক ভক করে বেরিয়ে এলো তাঁর মুখ দিয়ে। কিন্তু অদ্ভুত, দুর্গন্ধে তাঁর বমি পেল না। তিনি অবাক হলেন। নিজের নাককে সন্দেহ করলেন তিনি। দুর্গন্ধটা সত্যিই তো, না মনের ভুল? নিজের মনকে সন্দেহ করলেন তিনি।
খাঁচার ভিতর হতে হলুদ বেনেবউ বলল, ‘নিজেকে সন্দেহ করছেন?’
এ কথায় মহোদয়ের পিলে চমকে উঠল। তিনি চিৎকার করে বনদপ্তর কর্মীদের নির্দেশ দিলেন এই বিপজ্জনক পাখিকে এই মুহূর্তে স্টুডিও থেকে বহিস্কার করার।
রেঞ্জাররা খাঁচা নিয়ে বেরিয়ে যেতে গেলে পাখিটি গেয়ে উঠল, ‘এ কেওড়া!’
‘এমন অশ্লীল পাখি আমি জীবনে দেখিনি!’, বলে উঠল ক্যামেরাম্যান ১।
‘এমন সন্দেহজনক পাখিও আমি দেখিনি কখনো,’ বলল দ্বিতীয় ক্যামেরাম্যান।
তৃতীয় ক্যামেরাম্যান পাখির উপর থেকে ক্যামেরা সরিয়ে মহোদয়ের দিকে ফিরল।
মহোদয় তাঁর হলুদ টাই ঠিক করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলা শুরু করলেন, ‘অনেক ধন্যবাদ জানাই আমাদের দেশের বনদপ্তরকে, এত দ্রুত ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য।’ বলেই চুপ করে গন্ধ শুঁকলেন। মৃত ইঁদুরের গন্ধ মুখ হতে বেরিয়ে এসে ভিড় করল তাঁর নাকে। কিন্তু তাঁর কোনো অসুবিধা হলো না।
তিনি আবার বললেন, ‘ধন্যবাদ আমার দর্শকবন্ধুদের, যাঁরা এতক্ষণ ধরে বিপজ্জনক পাখিটিকে, ভয়াবহ পাখিটিকে স্টুডিওয় সন্ত্রাস ছড়াতে দেখলেন।’
পুনরায় মহোদয় চুপ করে দ্রুত গন্ধ শুঁকলেন। এবারও সেই এক পচা গন্ধ। তবে কি তিনি সত্যিই পচে যাচ্ছেন? মহোদয়ের ভয় হলো এবার।
তিনি বললেন, ‘কুমতলবি পাখিটিকে আমরা ধরে ফেলেছি। এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কোনো ভয় নেই।’
যত জোরের সাথে কথাগুলি তিনি বললেন, তত দ্রুত একটা ভয়, একটা সন্দেহ তাঁর গলা টিপে ধরল। মহোদয় প্রতিটা শব্দ বলার পর চুপ করে, ঘ্রাণ নিয়ে, দুর্গন্ধের তীব্রতা পরখ করে তার পরের শব্দটি বলতে লাগলেন।
মহোদয়েকে বারবার থমকে যেতে দেখে প্রযোজক ও পরিচালক পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকালেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, মহোদয়ের মনের মধ্যে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে পাখিটা। উপস্থিত অতিথিবৃন্দের মধ্যেও কীভাবে যেন একথা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
মহোদয় প্রতিটি শব্দ, প্রতিটা যতিচিহ্নের পর হোঁচট খেতে থাকলেন।
পর্দার ওপারে হলুদ আলোয় বসা নারীপুরুষগণ পর্যন্ত টের পেয়ে গেলেন, যে মহোদয় ভয় পাচ্ছেন। মহোদয় সন্দেহ করছেন। মহোদয়ের অবিশ্বাস হচ্ছে।
সুসংবাদ চ্যানেলের আনন্দঘন হলুদ স্টুডিওর কর্মীরা, উপস্থিত অতিথিবক্তাগণ মহোদয়ের দিকে ধীরে ধীরে আঙুল তুলে ধরলেন।
দূরদর্শন পর্দার এপারের হলুদ আলোয় বসা ‘একুশ কোটি’ নরনারীও বুঝল এটাই সময়।
হলুদ আলোর মধ্যে বসে থাকা প্রত্যেকটি মানুষ আঙুল উঁচিয়ে ধরল মহোদয়ের দিকে, আর বলে উঠল— ‘শালা দেশদ্রোহী!’
কোলকাতায় জন্ম। পেশাগত কারণে বাস ব্যাঙ্গালোরে। দশটা-আটটায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। নিশাচর অক্ষরশ্রমিক। প্রকাশিত বই : ঝিঁঝিরা (২০১৫), হাওয়াশহরের উপকথা (২০১৮), দাস্তানগো (২০১৯) এবং রণ বিশ্বাস কারো নাম নয় (২০১৯)।