ক্রাকভ : হাজার বছরের শহর
শাকুর মজিদ
ভিসতুলা নদীর তীরে এক জায়গায় এসে আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সামনেই নদীর তীরে বেশ উচুঁ একটা পাহাড়ের ওপর এক পুরনো রাজপ্রাসাদ। তার নিচে, আমরা যেখানে এসে নেমেছি, সেখানে এক খোলা জায়গায় কতগুলো ফর্মের ভাস্কর্য। বেশির ভাগই খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী। বুঝতে বাকি থাকে না এই শহরের মাহাত্ম্য। এই ক্রাকভ (Krakow) পোল্যান্ডের সব চেয়ে প্রাচীন শহর। এবং শহরটি তার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখনও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের প্রায় সব নগর-জনপদ ধ্বংস হয়ে গেলেও এই ক্রাকভ নগরীটি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়। আর সেই সাথে প্রায় প্রস্তর যুগে গড়ে ওঠা এই নগরটিও টিকিয়ে রাখে তার আদি রূপ।
এই ক্রাকভ (Krakow) পোল্যান্ডের সব চেয়ে প্রাচীন শহর। এবং শহরটি তার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখনও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের প্রায় সব নগর-জনপদ ধ্বংস হয়ে গেলেও এই ক্রাকভ নগরীটি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়। আর সেই সাথে প্রায় প্রস্তর যুগে গড়ে ওঠা এই নগরটিও টিকিয়ে রাখে তার আদি রূপ।
আমাদের পঞ্চপর্যটকের ৭টি ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝ বিকেলের হালকা তেজী আলোয় ভাস্কর্যগুলোও আলো ছায়ায় খেলতে শুরু করে। মিনিট দশেকের ফটোশুটের পর আমরা এগুতে থাকি রাজপ্রাসাদের দিকে।
এর মধ্যেই ওমর ভাইয়ের ফোন। তাঁর শহর থেকে এই ক্রাকভের দূরত্ব এক ঘন্টার মতো। তাঁর পরামর্শ— এখন কোনো কিছুতে না ঢুকে বরং নিচে কতগুলো ছোটো ছোটো গাড়ি আছে, সে গুলোর একটাতে উঠে এক ঘন্টা শহরটা দেখে ফেলো। এরপর এখানেই এসে থামবে গাড়ি, তিনি এসে যোগও দেবেন আমাদের সাথে। বিকেলে আর কী কী করা হবে, সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রনেই থাকবে।
আমাদের হাতে সময় প্রায় একঘন্টা এবং এই একঘন্টা সময়ের জন্য আমরা আমাদের দেশের ‘মেক্সি’ স্টাইলের একটা গাড়িতে উঠে পড়ি। এই গাড়ি আদতেই আমাদের ‘টেম্পো’র মতো, শুধু চাকাগুলো আলাদা, প্রাইভেট কারের চাকা, সামনে একটি, পেছনে দুইটি। তার তিন পাশ খোলা। ছাদের সাথে চমৎকার স্পীকার। কিছুক্ষণ পর পর আমাদের ড্রাইভার শুধু কতগুলো সংখ্যা চিহ্নিত বোতামের ওপর চাপ দেবেন, আর অনর্গল ইংরেজি বক্তৃতা শুরু হয়ে যাবে। যেন এক অশরীরী ট্যুর গাইড আমাদের সাথে আছেন, আমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তিনি সামনে তাকাতে বললে আমরা সামনে তাকাই, ডানে বললে ডানে। এবং ডানে তাকিয়েই দেখি, যে বস্তুটির বর্ণনা তিনি শোনাচ্ছেন, সেই বস্তুটিই আমাদের সামনে হাজির।
আমরা চুপচাপ বসে থাকি। সবগুলো ক্যামেরা আমাদের সচল, সবগুলো কান আমাদের ম্যাক্সি-ক্যাবের ছাদের স্পিকারের দিকে। সহজ, সুন্দর বর্ণনায় আমরা প্রাণীত হই।
ক্রাকস থেকে ক্রাকভ
ধারণা করা হয় ভাভেল পাহাড়ের জন্মের পরে পরে প্রস্তর যুগে এখানে মানুষের বসবাস শুরু।
পৌরাণিক শাসক ক্রাকস ড্রাগনের দখল থেকে একটি গুহা উদ্ধার করেন। এবং সেই গুহাটিকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে এখানে একটি নগরী গড়ে ওঠে। সেই পৌরাণিক শাসক ক্রাকসের নামানুসারে নগরটির নাম হয়ে যায় ক্রাকভ। ক্রাকভ নগরের লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় ৯৬৬ সালে একজন বোহেমিয়ান ডিউকের লেখা থেকে। তিনি ক্রাকভ নগরীকে সমৃদ্ধশালী নগর হিসেবে আবিষ্কার করেন। সেই থেকেই ক্রাকভের ইতিহাস ঐতিহ্যের শুরু।
১০৩৮ সাল থেকে পোলিশ সরকার ক্রাকভকে রাজধানী ঘোষণা করে পোল্যান্ড শাসন করা শুরু করেন।
এই সময় থেকেই ক্রাকভে ইটের ইমরাত নির্মাণ হতে থাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ইউরোপের মধ্যে ক্রাকভ একটি সম্পদশালী নগরীতে পরিণত হয়। যদিও ১৪৯৫ সালে রাজধানী ওয়ারশোতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে এর জৌলুস কিছুটা কমে এসেছে তবুও এখনও পর্যন্ত এটি পোল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।
ক্রাকভ নগরীর প্রতিটি ইট-কাঠ, অলি-গলি-ইমারত এখন ইতিহাস। ক্রাকভ নগরীর সকল বিশেষণকে ছাড়িয়ে এই নগরী এখন হয়ে উঠেছে পর্যটন নগরী। প্রতিটি অলিগলিতে পর্যটকদের গিজগিজানি। পর্যটকদের আতিথেয়তার জন্যও এই নগরী প্রস্তুত।
ক্রাকভ নগরীর প্রতিটি ইট-কাঠ, অলি-গলি-ইমারত এখন ইতিহাস। ক্রাকভ নগরীর সকল বিশেষণকে ছাড়িয়ে এই নগরী এখন হয়ে উঠেছে পর্যটন নগরী। প্রতিটি অলিগলিতে পর্যটকদের গিজগিজানি। পর্যটকদের আতিথেয়তার জন্যও এই নগরী প্রস্তুত। আমাদের গাড়িটি ছুটে চলে ক্রাকভের পুরাতন শহরের অলিগলি ধরে।
এক সময় ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখে। আমাদের জানায়, গাড়িতে ৫ মিনিট নীরবে বসে বসে আমাদের পুরাতন শহরটি দেখুন।
বেশ প্রাণচঞ্চল এই এলাকা। আমাদের চকবাজারের এক অভিজাত সংস্করণ। রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত, লোকজনের গিজগিজানি, ফুটপাতে সস্তা খাবার দোকানের সমাহার। আর তার চারপাশে অতি পুরাতন ইটের তৈরি বেশ কিছু দালান।
ত্রয়োদশ শতক থেকে যখন ক্রাকভ নগরীতে ইটের ইমরাত গড়ে উঠতে থাকে সে সময় এই মার্কেট স্কয়ারটি গড়ে ওঠে। নগরের সব ব্যবসা বাণিজ্য এই খোলা চত্বরেই হতো। প্রায় দুই কিলোমিটার প্রশস্ত একটি রাস্তা ছিল এটি। নগরের অন্যান্য সব রাস্তা এসে মিলিত হতো এই স্থানে। আর এখানেই বসতো নগরীর বাজার। তখন ধীরে ধীরে তার চারপাশে ইটের স্থাপনা গড়ে উঠতে থাকে।
১২৪১ সালে মোঙ্গলীয়রা যখন এই নগরী মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় তখন এই মার্কেট স্কয়ারের আশেপাশে সমস্ত স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। ১২৫৭ সালে যখন ক্রাকভ পুণরায় জেগে উঠতে শুরু করে সে সময়ে আশেপাশের এই সব স্থাপনাসমূহও গড়ে উঠতে শুরু করে।
১২৫৭ সালের নকশায় এখানে যে ভবনগুলো গড়ে উঠেছিল এখনও সে ভবনগুলো কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যযুগীয় নগর চত্বরগুলোর মধ্যে এই মার্কেট স্কয়ারটিই ইউরোপের সর্ববৃহৎ নাগরিক উদ্যান। প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই খোলা চত্বরটি এখনও ক্রাকভবাসীর প্রধান মিলন কেন্দ্র।
মার্কেট স্কয়ারের এই ক্লথ হাউজটি কোনো পর্যটকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। এটি পৃথিবীর পুরাতন শপিং সেন্টারগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৩০০ সালে যখন এটি তৈরি করা হয় তখন এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো কাপড়ের মার্কেট। গোথিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই ইমারতটি দৈর্ঘ্যে ১০৮ মিটার এবং প্রস্থে ৮০ মিটার।
মার্কেট স্কয়ারের খোলা চত্বরের মাখখানে একটি মূর্তি। এটি এ্যাডাম মিসকিয়েভিচের মূর্তি। এ্যাডাম মিস্কিয়েভিচ [MISKIEWICZ] ছিলেন উনিশ শতকে পোল্যান্ডের বিখ্যাত রোমান্টিক কবি। এ কবির শততম জন্ম বার্ষিকীতে, ১৬ জুন ১৮৮৯ সালে মূর্তিটি উন্মুক্ত করা হয়। মূর্তিটির পাদদেশে আরো চারটি মূর্তি।
সেই আদিরূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খোলা চত্বরটির মাঝখানে। সেন্ট এডালবার্ট গির্জা। রোমান স্থাপত্য নকশার এই গির্জাটি প্রায় একহাজার বছরের পুরনো। প্রথমে এখানে একটি ছোট্ট পাথরের গির্জা ছিল। যেহেতু এই চত্বরটি ছিল ব্যবসায়ীদের মিলন কেন্দ্র, সেকারণে ছোট্ট গির্জাটিতে লোক সংকুলান না হওয়ার কারণে আয়তাকার আরেকটি পাথর খণ্ডের ওপরে গির্জাটির নতুন অবয়ব দেওয়া হয়। সে সময় বারোক স্থাপত্যরীতির গম্বুজটি গির্জার ওপরে বসে যায়। হাজার বছরের পুরনো এই গির্জাটিতে এখন আর প্রার্থনা হয় না। এখন এটি এই মার্কেট স্কয়ারের জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই মার্কেট স্কয়ারের আরেকটি স্থাপনা কোনো পর্যটকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। লম্বা চিকন একটি টাওয়ার। এটি ওল্ড টাউন হল টাওয়ার। প্রায় ৮শ বছর আগে ২শ ফুটের বেশি উচ্চতার এই টাওয়ারটি বানানো হয়েছিল। পাথর আর ইট দিয়ে তৈরি এই টাওয়ারটির গায়ে ঘড়ি বসানো হয় ১৫২৪ সালে। নির্মাণের ১৫০ বছরের মধ্যে আগুনে টাওয়াটির বেশ কিছু ক্ষতি হলেও ১৮২০ সালে টাওয়ারটি ধসে পড়ে। তখন নতুন করে আবার টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়। টাওয়ারটির চূড়ায় উঠতে হলে মাড়াতে হয় ১০০ ধাপ সিঁড়ি। এর প্রবেশ পথের পাশেই দুটি সাদা পাথরের সিংহ মূর্তি। এই সিংহ মূর্তি দুটোকে এখানে পাহারায় বসানো হয়েছে এই সেদিন ১৯৬০ সালে।
এই ফাঁকে আমরা কিছুক্ষণের জন্যে গাড়ি থেকে নেমে যাই। যেহেতু বার বার এখানে আসা যাবে না, সেহেতু যতোটা দ্রুত এ-সময়ের স্মৃতিটাকে অমর করে রাখা যায়, তার জন্যই আমরা মূলত ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ব্যস্ত আমাদের ক্যামেরাগুলোও। গ্রীষ্মের শুরুতে এ চত্বরটি পর্যটকদের আনাগোনাতে মুখরিত। সেই সাথে খোলা খাবারের দোকানগুলোও সাজিয়ে বসেছে তাদের পসরা। প্রতিটি বিখ্যাত ভবনের সামনেই খোলা রেস্টুরেন্টগুলো ছাতা সাজিয়ে বসেছে। ছাতার নিচের চেয়ারগুলোও খালি নেই। দেখেই বোঝা যায় এখানকার পর্যটকেরা বেশ ভোজন রসিকও।
আমরা চলে আসি আরেকটা গির্জার সামনে। এটি সেন্ট মেরিস ব্যাসেলিকা।
এই সেন্ট গির্জার উঁচু টাওয়ারটি থেকে প্রতি ঘন্টায় একটি সংকেত ভেসে আসে। এই সংকেতের নাম হেজনাল মেরিয়াকি। হেজনাল মেরিয়াকি অদ্ভুত ধরনের এক শব্দ করতে পারতেন। যখন ক্রাকভ শহর মুঘল আক্রমনের শিকার হয় তখন হেজনাল মেরিয়াকি এই গির্জার টাওয়ারে উঠে ওই অদ্ভুত ধরনের শব্দটি করতেন। ফলে সৈন্যরা তৈরি হয়ে যেত এবং সাধারণ জনগণ সাবধান হয়ে যেত। সে যাত্রায় মুঘল আক্রমনের হাত থেকে ক্রাকভ রক্ষা পেয়েছিল। সে কারণে আজও প্রতি ঘন্টায় সেন্ট মেরী গির্জার টাওয়ার থেকে হেজনাল মেরিয়াকির সেই অদ্ভুত শব্দটি ভেসে আসে।
সেন্ট মেরী গির্জাটি পোলিশ ক্যাথেড্রাল রীতির গির্জার একটি দৃষ্টান্ত। পরবর্তীতে এই গির্জার অনুকরণে অনেক গির্জা তৈরি হয়েছে পোল্যান্ড এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
সেন্ট মেরী গির্জাটি পোলিশ ক্যাথেড্রাল রীতির গির্জার একটি দৃষ্টান্ত। পরবর্তীতে এই গির্জার অনুকরণে অনেক গির্জা তৈরি হয়েছে পোল্যান্ড এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
আমাদের বয়ে বেড়ানো গাড়িটা বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না এই খোলা চত্বরে। আমরা চলতে শুরু করি প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো রাস্তা ধরে। এর দুপাশে যে ভবনগুলো তার প্রায় সবই সে সময়ের তৈরি। কিন্তু পরবর্তীকালে সেগুলো সংস্কার করা।
মার্কেট স্কয়ার থেকে অল্প একটু সামনে যেতেই আরেকটি খোলামেলা জায়গা। মাছ আর মাংসের বাজার। প্রায় এক হাজার বছর আগে এই জায়গায় যখন হাট বসতো তখন এটাই ছিল তাদের মেছো বাজার। এখন একে মেছো বাজার বলা যায় না কোনোভাবেই।
এই মেছো বাজার পার হয়ে আমরা ছুটতে থাকি অপ্রশস্ত ছোটো অলিগলি ধরে। দুপাশে পুরাতন সব ভবন।
একটু সামনে যেতেই একটি বড়োসড় ইমারত। এটি আলেক্সান্ডার ফ্রেডরিক থিয়েটার। এই থিয়েটারে পোল্যান্ডের বিখ্যাত সব অপেরার প্রিমিয়ার হয়েছে। আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটির সামনে আলেক্সান্ডার ফ্রেডরিকের একটি মূর্তি। স্যাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা থাকলেও ফ্রেডরিক ছিলেন মূলত নাট্যকার। মানব জীবনকে কমেডির ছাঁচে ফেলে সমাজের অনেক অসঙ্গতিকে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। আর এই দেখিয়ে দেওয়ার জন্য পোলিশ ভাষাকে তার স্টাইলে ব্যবহার করেছেন। সে কারণেই পোলিশদের কাছে ফ্রেডরিক হয়ে আছেন স্মরণীয়। তার নিদর্শন এই থিয়েটার হলের সামনের এই ব্রঞ্জের মূর্তি।
এই ক্রাকভ নগরী বিভিন্ন সময়ে মোকাবেলা করেছে বহিঃশত্রুর আক্রমন। সে আক্রমন প্রতিহত করার জন্যও সে সময়ে রাজন্যবর্গ নিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থার একটি এই বারবিকান। ত্রয়োদশ শতক থেকে ক্রাকভ নগরীকে রক্ষার জন্য এ সিটি ওয়াল নির্মাণ কাজ শরু হয়। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই শহর রক্ষাকারী দেয়াল ১০ মিটার উচু আর আড়াই মিটার পুরু। দুই কিলোমিটার লম্বা এই শহর রক্ষাকারী প্রচীরের মধ্যে ৩৯টি ওয়াচ টাওয়ার এবং ৮টি গেট আছে। এই গেটগুলোকেই বলে বারবিকান। উনবিংশ শতকের শুরুর কয়েক দশকের মধ্যে বারবিকানগুলোর অনেক ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সামনে দাঁড়ানো এই ব্রামা বারবিকানটি এখনও অক্ষত।
আগের দিনের রাজসিকরা তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নিজের রাজধানীর অংশটুকু দেয়াল দিয়ে আটকে রাখতেন। ইউরোপের অন্য শহরে এমন নজির খুব না দেখলেও এই পোল্যান্ডের নতুন ও পুরাতন দুই রাজধানীতেই এমন রক্ষাপ্রাচীর দেখা হয়ে গেল। যেমন দেখেছি ইস্তাম্বুলে, চীনে আর মিশরেও। মধ্যযুগীয় মিলিটারি ইঞ্জিয়ারিং এই নিদর্শনগুলো মূলত আরবীয়দের কাছ থেকে ধার করা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইউরোপীয় সংস্করণ।
গোথিক স্থাপত্যরীতিতে বৃত্তাকার ব্রামা বারবিকানটি ১৪৯৮ সালে নির্মাণ করা হয়। ইটের তৈরি এই বারবিকানটির ভিতরের কোর্ট ইয়ার্ডের ব্যাস ২৪ মিটার। বারবিকানটির ওপরের সাতটি বৃত্তাকার ছোটো ছোটো টাওয়ার। ব্রামা বারবিকান থেকে শহর রক্ষাকারী দেয়ালটি চলে গেছে সেন্ট ফ্লোরিয়ান্স গেট পর্যন্ত।
গোথিক স্থাপত্যরীতিতে বৃত্তাকার ব্রামা বারবিকানটি ১৪৯৮ সালে নির্মাণ করা হয়। ইটের তৈরি এই বারবিকানটির ভিতরের কোর্ট ইয়ার্ডের ব্যাস ২৪ মিটার। বারবিকানটির ওপরের সাতটি বৃত্তাকার ছোটো ছোটো টাওয়ার। ব্রামা বারবিকান থেকে শহর রক্ষাকারী দেয়ালটি চলে গেছে সেন্ট ফ্লোরিয়ান্স গেট পর্যন্ত। আর এই বারবিকান থেকে ফ্লোরিয়ান্স গেট পর্যন্ত দেয়ালটিকে ছাদ দিয়ে ঢেকে একটি সুড়ঙ্গ পথও তৈরি করা হয়েছে।
আমরা ছুটতে থাকি সেন্ট ফ্লোরিয়ান্স গেটের দিকে। এখানে এসে শহর রক্ষাকারী দেয়ালের দেখা মিলল। এটি এখন ছবি ব্যবসায়ীদের দখলে। শহর রক্ষাকরী দেয়ালের শরীর জুড়ে টানিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছবি। পর্যটকেরা চাইলেই খুব স্বল্পমূল্যে এখান থেকে ছবি কিনে নিতে পারেন ক্রাকভের স্যুভেনির হিসেবে।
পুরাতন একটি সরু গলিতে এসে আমাদের গাড়িটি থেমে যায়। গাড়িতে স্বয়ংক্রিয় বকবকানি যন্ত্রটি বেজে ওঠে। আমাদের শোনানো হয় এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এটি ইউরোপের পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। এই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে জোর্তিবিজ্ঞানের জনক নিকোলাস কোপারনিকাস পড়াশোনা করেছিলেন। নেমে পড়ি গাড়ি থেকে।
ক্রাকভ একাডেমি নামের বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স যখন ৩৬ বছর তখন ১৪০০ সালে পোল্যান্ডের রাজা ভাদিস্লাভ [WZADISZAW] দ্বিতীয় ইয়াগেল এই একাডেমিটি কিনে নেন তার প্রয়াত স্ত্রী রানি জাডভিগার নামে। পরবর্তীতে এর নাম হয় কলেজিয়াম মিয়াস বা ‘গ্রেট কলেজ’ (বাংলায় কী একে মহাবিদ্যালয় বলবো?)। গোথিক স্থাপত্যরীতিতে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয় চতুর্দশ শতকে। ইমারতটির ভিতরের দিকে একটি বড়ো খোলা পরিসর। মধ্যযুগের এই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৯০ সালে তরুন থেকে ছাত্র হয়ে আসেন নিকোলাস কোপারনিকাস।
কোপারনিকাসের সেইসব গল্প শুনেছি আমরা তার জন্মস্থান তরুনে বসে। যদিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৪-৫ বছর সময় পার করেছিলেন, কিন্তু প্রথাগত বিদ্যা এখান থেকে খুব কমই অর্জন করেছিলেন। বরং এই ক্রাকভের এক দার্শনিক তার চিন্তা চেতনা বদলে দিয়েছিলেন। সে অনেক কাহিনি, আমরা এসব তরুনের গল্পে বলেছি। তরুন শুধু নয়, এই ক্রাকভ বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন বিখ্যাত হয়ে আছে তাদের সেই অমনোযোগী ছাত্র নিকোলাস কোপারনিকাসের জন্য।
আমাদের গাড়িটি ছুটতে থাকে। এখনো দেখা হয়ে ওঠেনি অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। একহাজার বছর ধরে যে শহর বেড়ে উঠেছিল এক বিকেলে তাকে দেখে শেষ করা কি সম্ভব? আমরা আমাদের গাইডকে তাড়া দিতে থাকি। কারণ আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্রাকভ রাজপ্রাসাদের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। ৯৬৬ সাল থেকে ১৪৯৫ সাল পর্যন্ত যে প্রাসাদটিতে বসে পোল্যান্ডের রাজারা দেশ শাসন করেছেন সে প্রাসাদটি দেখার জন্য আমরা অস্থির হয়ে উঠি। আমাদের গাড়িটি ছুটে চলে প্রাসাদের দিকে।
ভিসতুলা ক্রুজ
পঞ্চপর্যটকরে নিয়ে বয়ে বেড়োনো ম্যাক্সি গাড়িটি অবশেষে ক্রাকভ রাজ প্রাসাদের নিচে, যেখানে আমাদের উঠিয়েছিল, সেখানেই নামিয়ে দিল। যথারীতি কালো জ্যাকেট পরা যে ভদ্রলোকটি প্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, সেই ওমর ফারুক ভাইও আমাদের দেখে বেশ তৃপ্ত। জানতে চাইলেন, ট্যুর কেমন হলো। বলি— ভেরি ইফেকটিভ ট্যুর। আপনি যে গাইড দিয়েছেন, তার সব কথা রেকর্ড করে ফেলেছি। ট্রাভেল ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্ট লিখতে আমার আর সমস্যা হবে না। এবার বলেন, কী দেখাবেন। আমরা কি ক্যাসেলে যাব?
ওমর ভাই ঘড়ির দিকে তাকান। বলেন, ক্যাসেল বন্ধ হতে আরো দু-ঘন্টা আছে। তার চেয়ে চলো ভিসতুলা ক্রুজ মেরে আসি।
যেই কথা, সেই কাজ। তড়িঘড়ি করে একটা বজরা ঠিক করা হলো। এই বজরা সেই বজরা নয়, ক্রুজ বোট।
এই ক্রুজ বোটটি ভিসতুলা নদী দিয়ে বয়ে চলে। যেতে যেতে আমদের আকর্ষণ করে, বিশেষ করে এর নদীর পারটুকু। পায়ে হাঁটা মানুষের পথ, সাইকেল চলার পথ আর গায়ে গায়ে লেপ্টালেপ্টি করে ঘাসের ওপর বসে অফুরান সময় কাটানোর মতো সবুজ পরিসর, তার সবটুকুই আছে নদীর তীরে।
বজরার মূল অংশটি একটা রেস্টুরেন্ট, সেখানেই বসার জায়গা। কিছুক্ষণ বজরার ভেতরে বসে সবাই দেখি উশখুস শুরু করে দিয়েছেন। ওখানে কেউ বসবে না, এক চিলতে পাটাতনে আমাদের ৫ পর্যটককে নিয়ে এই ক্রুজ বোটটি ভিসতুলা নদী দিয়ে বয়ে চলে। যেতে যেতে আমদের আকর্ষণ করে, বিশেষ করে এর নদীর পারটুকু। পায়ে হাঁটা মানুষের পথ, সাইকেল চলার পথ আর গায়ে গায়ে লেপ্টালেপ্টি করে ঘাসের ওপর বসে অফুরান সময় কাটানোর মতো সবুজ পরিসর, তার সবটুকুই আছে নদীর তীরে। প্রতিটি কার্যকরণের জন্য বিশেষায়িত যে জায়গাটুকু রেখে দেওয়া আছে বা শত শত বছর আগে থেকেই যা বানিয়ে রাখা হয়েছিল, তার এমন স্বার্থক প্রয়োগ দেখে আমরা মুগ্ধ। আমাদের নিয়ে বয়ে যায় ইঞ্জিনের বজরা, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এক ঐতিহাসিক শহর।
নদীর এদিক থেকে এই ভাভেল প্রাসাদটি বেশ ভালো করে দেখা যায়। প্রায় এক হাজার বছর আগে, ৯৬৫ সালে উইস্লান বংশের রাজা মিস্কো এখানে তার প্রাসাদটি বানান। তিনিই ছিলেন সম্মিলিত পোল্যান্ডের প্রথম রাজা। সেই থেকে শুরু। ১৫৯৫ সালে ওয়ারশোতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনটা সাম্রাজ্যের পোলিশ রাজারা এই প্রাসাদ থেকে পোল্যান্ড শাসন করেছেন।
এখানে মোট তিনটি প্রাসাদ। এই প্রাসাদ তিনটি এক সময়ে গড়ে উঠেনি। এক এক রাজার আমালে এক একটি প্রাসাদ গড়ে উঠেছে।
ভাভেল প্রাসাদ
একঘন্টার জন্য পয়সা দেওয়া নৌকাটিকে ২০ মিনিটের মাথায় ফিরিয়ে আনা হয় ঘাটে। ভাভেল প্রাসাদ দেখার জন্য আমাদের সময়ের প্রয়োজন। আমরা নেমে যাই ঘাটে এবং ঘাট থেকে কয়েক কদম পায়ে হাঁটার পর পৌঁছে যাই হাজার বছরের পুরনো সেই ভাভেল প্রাসাদে। এ পর্যন্ত পৃথিবীর যতগুলো প্রাচীন প্রাসাদ আমার দেখা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই পাহাড়ের ওপরে বানানো। পাহাড় আর নদীর একত্রবন্ধন খুব কমই আছে। যেমন এই ভাভেল।
প্রাচীনকালের সব দেশের রাজারা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। যে ধর্মেরই রাজা ছিলেন তিনি তার রাজপ্রাসাদের পাশেই একটা বড়ো ধর্মীয় উপাসনালয় বানাবেন, এটাই রীতি। এই ভাভেল প্রাসাদেও তাই। প্রথমেই আমাদের ঢুকতে হবে ভাভেল ক্যাথেড্রালে। এর পর জিগমুন্ড চ্যাপেল ও মোরগের পা টাওয়ার।
প্রাসাদের সামনেই বৃত্তাকার একটি ভবনের ছাদে ঘোড়ায় চড়ে আছে এক মূর্তি। ইনি আঁদ্রে তাদেওস বোনাভেঞ্চুরা কোসুস্কো। ১৭৪৬ সালে জন্মগ্রহণকারী এই বীর সেনাপতি বিভিন্ন সময়ে পোল্যান্ড দখল করে নেওয়া রাশিয়া, প্রুশিয়া, লিথুনিয়া অন্যান্য বেলারুশীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত রেখেছেন। শেষ যখন দেশ রাশিয়ার দাসত্ব স্বীকার করে তখন তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু তিনি দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। পোল্যান্ড দখল করার পর রাশান জার তাদেওস কে বন্দি করে নির্বাসনে পাঠান। তাদেওস ১৮১৭ সালে সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু পোল্যান্ডের রাজসিকরা তাঁর স্মৃতি ভোলেনি। রাজধানী স্থানান্তরের পরে এই রাজদরবার যখন পর্যটকের কৌতূহলের কারণ, তখন সবচেয়ে দর্শণযোগ্য জায়গায় তার ভাস্কর্যটি বানিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রাসদটিতে ঢোকার জন্য অনেকগুলো গেট তবে প্রতিটি গেটই সাধারণের প্রবেশের জন্য নয়। একটি প্রবেশ পথ বড়ো লোহার দরোজা দিয়ে আটকানো। এটি ভাভেল ক্যাথেড্রালের প্রবেশ পথ। ক্রাকভ শহরের বিশপ এখানেই বসেন।
রাজপ্রাসাদের মূল ভবনে ঢোকার মূল প্রবেশপথটি একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে খিলান আকৃতির। সামনে খোলামেলা চত্বর। এখান থেকে প্রাসাদের ওপরের দিকে তাকালে সেই ঘন্টা ঘরটি চোখে পড়ে। এটি জিগমুন্ড ঘন্টা, বানানো হয় ১৫২০ সালে। এই ঘন্টাটি এতো বড়ো যে এটি বাজাতে বারোজন শক্তিশালী মানুষের প্রয়োজন হতো। একবার একজন ঘন্টাবদক তাল সামলাতে না পেরে ঘন্টার রশির টানে জানালা দিয়ে বাইরে পড়ে মৃত্যুবরণও করেছিলেন।
এই রাজপ্রাসাদের মোট তিন ক্যাথেড্রালের মধ্যে ১৮টি চ্যাপেল রয়েছে। এই আঠারোটি চ্যাপেলও এক একজন রাজা বা রানির নামে। এর প্রথম ক্যাথেড্রালটি বানানো হয় ১০০০ সালে। তখন পুরো ক্যাথেড্রালটি বানানো হয় কাঠ দিয়ে। কাঠের তৈরি সে রাজপ্রাসাদ এখন আর চোখে পড়ে না। ১৩০৫ সালে এক রাজপ্রাসাদটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেলে ইটের তৈরি এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে রাজপ্রাসটিতে আরও যত সংযোজন হয়েছে সবই ইট আর কংক্রিটের স্থাপনা।
পুরো রাজপ্রাসাদটি রক্ষাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কিছুদূর পর পর ওয়াচ টাওয়ার এবং বারবিকান। এই প্রাসাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিঃশক্রর আক্রমনের শিকার হয়েছিল বলে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করার জন্যই বিশাল আয়তনের এই সব বারবিকান।
পুরো রাজপ্রাসাদটি রক্ষাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কিছুদূর পর পর ওয়াচ টাওয়ার এবং বারবিকান। এই প্রাসাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিঃশক্রর আক্রমনের শিকার হয়েছিল বলে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করার জন্যই বিশাল আয়তনের এই সব বারবিকান। এই সব বারবিকানে একসাথে দুই থেকে আড়াই শ সৈন্য অবস্থান করতে পারত।
হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া এই রাজপ্রাসাদসমূহ দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন।
প্রাসাদটিতে ঢোকার পথটি তেমন রাজকীয় নয়। খুবই সাদামাটা।
ভিতরে ঢুকেই একটি বড়োসড় খোলা চত্বর। এই খোলা চত্বরের চারিদিকে প্রাসাদ ভবন। পুরো প্রাসাদটির স্থাপত্য নকশা একরকম নয়। এক একটি ভবনের বৈশিষ্ট্য এক এক রকম। রোমানেস্ক, গথিক, রেনেসাঁ, বারোক এবং আধুনিক সব ধরনের স্থাপত্য নকশার ভবন আছে এই রাজপ্রাসাদটিতে।
এই রাজপ্রাসাদটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের শাসকবর্গ দখল করে তাদের ইচ্ছামত ব্যবহার করেছেন। এবং অনেককিছু ধ্বংসও করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই প্রাসাদটি ছিল অক্ষত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যখন পুরো পোল্যান্ড দখল করে নেয়। তখন ক্রাকভ শহর একজন জার্মান গভর্নরের অধীনে চলে যায়। তখন রাজপ্রাসাদটি ছিল গর্ভনরের অফিস। আর এখান থেকেই একের পর এক যেতে থাকে ক্রাকভের ইহুদি নিধনের এক একটি কুট কৌশল।
গভর্নরের নির্দেশে প্রথমে ইহুদি নাম নিবন্ধন করে তাদের নতুন আবাসস্থল দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একটি জায়গায় জড়ো করা হয়। সে সময়ে ক্রাকভের কাজিমিজ ডিস্ট্রিক্টে ছিল ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো কলোনি। ইহুদি কলোনির পাশে একটি এলাকা গড়ে তুলে তার নাম দেওয়া হয় ‘ঘিটো’। সে সময়ে ইহুদিদের নতুন আবাসস্থল দেওয়ার নাম করে এখানে প্রায় ৬৫ হাজার ইহুদিকে একত্রিত করা হয়। যাদেরকে পরবর্তীতে আসভিচ ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হয়। এসব কাহিনি আমরা আসভিচে শুনে এসেছি।
এই প্রাসাদ ভবনের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আছে। অন্য অনেক জায়গায় পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া না হলেও আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারটিতে পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হয়। আমরা হাঁটতে থাকি সে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারের দিকে।
ক্রাকভ শহরের উপকন্ঠে একটি পর্বতমালা আছে, ভাভেল পবর্তমালা। সে পর্বতমালার একটি গুহা এখানে বানিয়ে রাখা হয়েছে। টানেলের শেষ মাথায় সেই গুহা। কিন্তু আমাদের গুহায় পৌঁছানো হয় না। আমরা বেরিয়ে আসি টানেল থেকে।
টানেল থেকে বেরিয়েই একটি খোলা চত্বরে একটি ড্রাগন। কিছুক্ষণ পর পর তার মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। হাজার বছরের একটি রূপকথা প্রচলিত আছে এই ড্রাগন সম্পর্কে।
সেসময় ভাভেল পাহাড়ের গুহায় এক ড্রাগন বাস করত। তিন মাথাওয়ালা সেই ড্রাগনের মুখ দিয়ে আগুন বের হতো। সে গ্রামে হানা দিয়ে মানুষ, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগী খেয়ে ফেলত। কিন্তু এতেও সে ক্ষ্যান্ত হতো না। তার একটি দাবি ছিল, প্রতি মাসে একজন কুমারী মেয়ে চাই তার। একসময় দেখা গেল রাজার ছোটো মেয়ে ছাড়া রাজ্যে আর কোনো কুমারী মেয়ে নেই। সে সময় রাজা ঘোষণা করলেন, যে এই ড্রাগনকে মারতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজত্বসহ রাজকুমারীর সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন।
অনেক দেশ থেকে রাজকুমাররা এলো, কিন্তু সবাই ড্রাগনের খাবারে পরিনত হলো। শেষে এক রাখাল বালক এগিয়ে এলো। সে বলল, এই ড্রাগনকে সে মারতে পারবে। এদিকে সময় মাত্র একদিন। রাজা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করো।
রাখাল বালকটি ছিল এক মুচির ছেলে। তাদের অনেক ভেড়া ছিল। সে একটি ভেড়াকে হত্যা করে ভেড়ার পেটের ভিতরে বিষ দিয়ে ড্রাগনের গুহার মুখে রেখে দিল। ড্রাগনটি গুহা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে জীবিত ভেড়াগুলো দৌড়ে পালাল কিন্তু মৃত ভেড়াটিকে দেখে ড্রাগন মনে করল ঘুমন্ত ভেড়া। ড্রাগন ভেড়াটিকে এক লহমায় খেয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে বিষের ক্রিয়া শুরু হলো। ড্রাগন ছটফট করতে লাগল। সে ভিসতুলা নদীর পাড়ে গিয়ে এক চুমুকেই নদীর সব পানি খেয়ে ফেলল, তবুও তার পেটের জ্বালাপোড়া থামে না। শেষে সে যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে পাহাড়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল এবং সেখানেই তার মৃত্যু হলো। এদিকে রাজকুমারীর প্রাণ বেঁচে গেল। রাজা খুশি হয়ে রাখাল ছেলের সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দিয়ে তাকে অর্ধেক রাজত্বও দিয়ে দিল।
এই রূপকথা এখনও পোলিশদের মুখে মুখে ফেরে। সে কারণেই সেই ড্রাগনের অবিকল একটি ড্রাগন এই রাজপ্রাসাদ চত্বরে বানিয়ে রাখা হয়েছে।
দিনের আলো শেষ হয়ে আসছে।
ক্রাকভের বাঙালি রেস্টুরেন্ট
সন্ধ্যার আলো জ্বলছে ক্রাকভের সড়কে। ইউরোপিয়ানরা এ সময় ডিনারে বসে। আজ আমাদের লেট লাঞ্চ হবে এই বিকেল ৭টায়। ওমর ভাই বলেন, একটা ছেলে এখানে নতুন একটা বাংলাদেশি (ভারতীয়) রেস্টুরেন্ট খুলেছে। চলো দেখে আসি।
আমরা চলে আসি আমিনুর রহমানের রেস্টুরেন্টে। ক্রাকভ শহরে বাঙালিদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা নিয়ে কুড়ি বছর পর ইতিহাস লেখা হলে, এ নামটি থাকবে সবার আগে। তার নাম আমিনুর রহমান। ঢাকার ছেলে।
বেজমেন্টসহ ৪০০ বর্গমিটারের দুটো ফ্লোর নিয়ে নতুন যে রেস্টুরেন্টটি তিনি খুলেছেন, এটা তাঁর জন্য বেশ ঝক্কির বিষয়ও। যদিও তাঁর ধারণা পোলিশরা ভারতীয় খাবারে আকৃষ্ট হবেই, কিন্তু এর আগে এই শহরে ভারতীয় খাবার দোকানের কোনো আয়োজন কেউ করেনি।
এ পর্যন্ত তার ১১ জন কর্মী আছেন। ২ জন মাত্র বাংলাদেশি, বাদবাকি সবাই পোলিশ। তিনি নিজেও ওয়েটারি করেন, সঙ্গে আছেন আরও ৩ জন, কয়েকজন সেল্স রিপ্রেজেনটেটিভও আছেন তার। এরা লিফলেট বিক্রি করে ক্রাকভ পর্যটন স্থানগুলোতে। ভারতীয় খাবার অন্বেষী বিদেশী পর্যটকেরা তার প্রথম টার্গেট।
এ পর্যন্ত তার ১১ জন কর্মী আছেন। ২ জন মাত্র বাংলাদেশি, বাদবাকি সবাই পোলিশ। তিনি নিজেও ওয়েটারি করেন, সঙ্গে আছেন আরও ৩ জন, কয়েকজন সেল্স রিপ্রেজেনটেটিভও আছেন তার। এরা লিফলেট বিক্রি করে ক্রাকভ পর্যটন স্থানগুলোতে।
আমরা খেতে বসেই অর্ডার দিয়ে দেই। আমাদের জন্য আলাদা মসলায় রান্নার আয়োজন হচ্ছে। আমিনুর রহমান নিজেই তদারকি করছেন। আমাদেরকে না জানিয়েই তিনি মেন্যু ঠিক করে ফেলেছেন। মুখে বলছেন, আপনাদের পছন্দ হবে।
আমাদের পাশের টেবিলে কয়েকজন পোলিশ এসেছেন। তাঁরা এই রেস্টুরেন্ট পেয়ে খুব খুশি। ভারতীয় খাবারের সাথে তাদের আগে পরিচিত ছিল। দিল্লীতে কাজ করেছিলেন এই দম্পতি। বলেন, ভারতীয় খাবারে ঝাল বেশি থাকে, এটাই মজা। আমাদের দেশের লোকজন মসলা দিয়ে ঝাল করে রাঁধতে পারে না, তোমরা পারো। আমি যেখানেই যাই ভারতীয় খাবার পেলে আর কিছু মুখে তুলি না। বাহ!
আমাদের খাবার আসে। গরম ভাত, আলু দিয়ে পাতলা ঝোলের গরুর মাংশ, ডাল, সবজি আর মাছ ভাজা।
সারা দিনের ঘোরাঘুরির পর আমরা সবাই ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। এ খাবারটুকুকে অমৃত বলে মনে হলো।
খাবার শেষ। বিল দেবার পালা। আমরা অপর একজন ওয়েটারকে ডাকি বিল নিয়ে আসার জন্য। ওয়েটার জানান, বস নিষেধ করেছেন, বিল হবে না। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি দই নিয়ে আসছি, আমার নিজের বানানো দই।
ধারাবাহিকটির অন্য পর্বগুলো পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৩
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৪
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৫
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৬
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৭
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৮
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৯
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-১০
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।