যা কিছু জলের রেখা
রাণা রায়চৌধুরী
সমুদ্র দূরে সরে যায়।
সমুদ্র কাছে আসে। ঢেউ। সাদা ফেনা।
বাবলি তিন দিন হলো তার এই বন্ধু ও আত্মীয় সমুদ্রের কাছে এসেছে। উঠেছে সমুদ্রের কাছেরই এক হোটেলে।
সমুদ্র এই দূরে যাচ্ছে, কাছে আসছে— এর মধ্যে দিয়ে সে প্রশান্তকে খোঁজে।
প্রশান্ত। টাইটেল নেই। ফলে জাতপাত নেই।
কিন্তু প্রশান্তর ‘আছে’ অনেক। ছিল অনেক।
প্রশান্ত মৃত। নিখোঁজ নয়। সে আছে। হয়তো এই সমুদ্রের দূরে যাওয়া, কাছে আসার মধ্যেই আছে।
প্রশান্ত খুব ভালো গান গাইত। বাবলি গাইতে পারে না। বাবলি শুনতে ভালোবাসে। সবাই তো গাইতে পারে না, শুনতেও সবাই পারে না। বাবলির কিন্তু গান শোনার কান ও ইচ্ছে প্রায় উপাসকের ধ্যানের সমান।
প্রশান্ত গাইত, বাবলি চোখ বুজে শুনতে শুনতে প্রশান্তর থেকে দূরে কোথাও দূরে দূরে থেকে কাছে কোথাও কাছে কাছে চলে আসত।
বাবলির মতো শ্রোতা পেয়ে প্রশান্ত তার গানকে এবং গায়কীকে একেবারে চূড়ান্ত চূড়ায় নিয়ে যেত। বাবলি প্রশান্তর গানের ওপর হরিণ শিশুর মতো গড়াগড়ি খেত। প্রশান্তর গানের আদর খেত, গানের সুরে সে অল্প অল্প করে দাঁড়াতেও পারত। গানের কাঁধে ভর দিয়ে সে অল্প অল্প করে হাঁটতেও পারত ইদানিং। প্রশান্তর গানের ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে মনে কতদূর যে চলে যেত, যে ‘কতদূরে’ সে কোনোদিন যায়নি, সেই অব্দি যেতে পারত বাবলি।
বিছানায় বসে, কখনো বাগানের ধারে হুইল চেয়ারে, প্রশান্তর গান— প্রশান্তর কথা, প্রশান্তর আবৃত্তি, প্রশান্তর কন্ঠস্বরে তার মনে হত, সে দাঁড়াতে পারবে, হাঁটতে পারবে।
সে যেতে পারবে নিজে নিজে অনেকটা। অনেকটা না হোক অন্তত ঐ জামগাছ অব্দি। একটা ফড়িং জামগাছের সবুজ পাতায় বসে তাকে আর প্রশান্তকে দেখতো রোজ। ফড়িংটাও বাবলি’র সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্তর গান কথা শুনত। ফড়িংটা একবার বাবলির হাতে একবার প্রশান্তর কাঁধে এসে বসে— আবার উড়ে যায় জামের সবুজ পাতার আড়ালে।
সমুদ্র কাউকে নেয় না। সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়। প্রশান্তকেও দিয়েছিল। কিন্তু প্রাণহীন গানহীন কথাহীন প্রশান্তর দেহ সমুদ্র ফিরিয়ে দিয়েছিল গভীর রাতে। সেদিন ছিল চাঁদনী রাত।
সমুদ্র কাউকে নেয় না। সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়। প্রশান্তকেও দিয়েছিল। কিন্তু প্রাণহীন গানহীন কথাহীন প্রশান্তর দেহ সমুদ্র ফিরিয়ে দিয়েছিল গভীর রাতে। সেদিন ছিল চাঁদনী রাত। সারারাত জোৎস্নায় ভিজেছিল প্রশান্তর দেহ।
বাবলির বিশ্বাস প্রশান্তর দেহ সমুদ্র ফিরিয়ে দিলেও, তার গান, তার কথা বলার আন্তরিক ভঙ্গি, তার দয়ালু মনকে সমুদ্র নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। সমুদ্রের গভীরে, সমুদ্রের হৃদয়ে প্রশান্তর গান বাজছে।
বাবলি তাই মাঝেমধ্যেই আসে সমুদ্রের কাছে প্রশান্তকে কাছে পেতে, প্রশান্তকে শুনতে, আদিগন্ত এই সমুদ্র যেন প্রশান্তময়। সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে, পুরনো অনেক কথা মনে পড়ে তার।
বাবলি সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে আসা প্রশান্তর গান শুনছিল। অনুভব করছিল। সে আনমনা। অন্তু বলল, ‘পিসি এবার চলো!’ অন্তু বাবলির দাদার ছেলে। বাবলি একা চলতে পারে না। নির্ভর চাই। তার আসল নির্ভর ঐ সমুদ্রের ভিতর। অগত্যা অন্তু।
অন্তু পিসিকে আজকের মতো সমুদ্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে— সমুদ্রের অতল থেকে— প্রশান্তর গান সামুদ্রিক বাতাসে ভেসে আসছে।
০২.
যদি ছেড়ে যাওয়া না থাকত, যদি চলে যাওয়া, যদি চিরতরে যাওয়া না থাকত, যদি ছেড়ে থাকার কষ্ট না থাকত, তাহলে?
এই যে আমার ভাইটা চলে গেল সংক্রমণে—গেল—আর আসবে না, কত কথা ওকে নিয়ে বলে চলেছি, যাকে নিজের মনে হচ্ছে তাকেই বলছি, ওর ছোটোবেলার কথা, ওর শেষ ফোন… যখন শোনার কেউ নেই, শুনতে আর চাইছে না, তখন একা নিজের মনে মৃত ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি, ওর অতীত ভাবছি।
আজ মনে হলো, যদি মৃত্যু না থাকত, যদি ছেড়ে যাওয়া না থাকত, কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে যেত না, চলে যেত না— তাহলে?
হঠাৎ আজ মনে হলো, যদি মৃত্যু না থাকত, যদি ছেড়ে যাওয়া না থাকত, কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে যেত না, চলে যেত না— তাহলে?
বিরহ শোক নেই। দুঃখ নেই। কাউকে মিস করা নেই। কারোর কথা মনে পড়া নেই। তাহলে?
আমরা সবাই আছি। কোনো বিয়োগব্যথা নেই আর। এমন একটা দারুণ সিস্টেম ধরা যাক কেন্দ্রীয় সরকার চালু করেছেন সম্প্রতি। যে, কেউ যাবে না। শুধু আসবে। শুধু যোগ যোগ আর যোগ হবে। তাহলে?
তাহলে মনখারাপ, কান্না শোক—কাউকে মনে পড়া—মাকে মনে পড়া এসব তো থাকবে না আর। কারণ মা তো আছে। মরে যায়নি। মরে যাবেও না কোনোদিন।
ভরদুপুরে মার কথা মনে পড়লে, এক ব্যথা-মিশ্রিত আনন্দ হয়, তখন দূরে কোথাও কোনো ‘দুপুরপাখি’ ডাকছে হয়তো
তাহলে? ভরদুপুরে মার কথা মনে পড়লে, এক ব্যথা-মিশ্রিত আনন্দ হয়, তখন দূরে কোথাও কোনো ‘দুপুরপাখি’ ডাকছে হয়তো, বুকটা আরও হু হু করে উঠল, হঠাৎ কাছে কেউ গাইছে, তারপরেই আনন্দ সংবাদ এলো— পল্টুর ছেলের বিয়ে। ব্যস দুঃখের মাদুর গুটিয়ে আমরা চা বানাতে যাই, পিছনে চলে যাওয়া মানুষটির শোক মৃদু তবু বাজে কোথাও। ঐ শোক-দুঃখের বাজনাটাই আমাদের আগামীর উৎসাহ। আমাদের গানের নতুন সুর। আমাদের মেয়ের বিবাহ প্রস্তাব।
কিন্তু কেউ আর চলে যাচ্ছে না। সবাই আছে। আছে।
থাকবেও সবাই। তবু কিছু একটা থাকবে না।
বাজবে না আর। আমাদের ছোটোবেলার রেডিওটা যেমন। এখন আর নেই। নেই মানে নেই।
০৩.
আমার বা আমাদের পরিচিত কেউ মারা গেলে আমি মনে মনে ভাবতাম— যে চলে গেল, তার আলমারি ভর্তি জামা কাপড়গুলো এখন কে পরবে? প্যান্ট টি-শার্ট পাঞ্জাবি এগুলো কে পরবে? যে ব্যক্তি পরতেন তাঁর সঙ্গে ঐ জামাকাপড়ের একটা নৈকট্য একটা আত্মীয়তা তো নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছিল। না হলে বারান্দা থেকে ভরদুপুরে পছন্দের নীল শার্টটা চুরি হয়ে গেলে তিনি এতো রাগলেন কেন? হতাশায় দুমড়ে গেলেন কেন? নিশ্চয়ই নীল শার্টের সঙ্গে তাঁর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল!
আমার বা আমাদের পরিচিত কেউ মারা গেলে আমি মনে মনে ভাবতাম— যে চলে গেল, তার আলমারি ভর্তি জামা কাপড়গুলো এখন কে পরবে? প্যান্ট টি-শার্ট পাঞ্জাবি এগুলো কে পরবে? যে ব্যক্তি পরতেন তাঁর সঙ্গে ঐ জামাকাপড়ের একটা নৈকট্য একটা আত্মীয়তা তো নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু মানুষটা তো চলে গেল। তার পোশাকগুলো তো শোকে আলমারির ভিতর মুষড়ে আছে। ঐ যে গত ভাই ফোঁটায় ছোড়দির দেওয়া জিন্সটা ওপরের তাকে আরও গভীর ব্যথায় নীল হয়ে শুয়ে আছে জানলাহীন। আলমারির জানলা নেই বলে ওদের কান্নাটা কেউ খেয়াল করে না।
কিছু দিন বাদে— বাড়ির লোকের শোক কাটলে— চলে যাওয়া মানুষটির জামাকাপড়গুলোও ধীরে ধীরে বিদায় হয়।
একে তাকে ডেকে ডেকে দিয়ে দেওয়া হয়, উদ্দেশ্য আলমারি খালি করা। তিন জোড়া চটি সেও কাউকে ডেকে দিয়ে দেওয়া হলো।
ধীরে ধীরে তিনি নেই, নেই।
তাঁর পছন্দের লাল জামাটি এখন পঞ্চায়েতের দেবুর গায়ে, তাঁর প্রিয় কলমটি এখন পল্টুর কাছে, পল্টু পার্টির চাঁদা কাটে ঐ কলমে।
এদিকের জল ওদিকে গড়ায়।
দিনগুলো কারোর কারোর কাছে খুব খালি খালি লাগে। কাউকে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা দেখলে মনে হয়—ভ্রম হয়— আরে অজয়দা না? মানুষটা ফিরে তাকালে খেয়াল হয়, সে নেই, তিনি নেই।
কিন্তু তিনি আছেন; ঐ অচেনা পাঞ্জাবি পায়জামার মধ্যেই তিনি আছেন। দুপুরের নির্জনতা হয়ে তিনি আছেন, বিকেলের নীল আকাশ হয়ে তিনি আছেন।
তাঁর পোশাকগুলোও আছে এখানে ওখানে জীবিত হয়ে।
০৪.
একটু একটু করে বেঁচে থাকছি।
কাল সৌরভের মৃত্যুটা আমাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। আমার সঙ্গে আলাপ ছিল না, দূর থেকে একবার দুবার দেখেছি।
তরুণ কবিকে দূর থেকেই দেখা উচিত। তথাপি খুব মনখারাপ ও ভয় লাগছিল। আমি ভয় কাটানোর জন্য শৌভিক-কে (আলিপুর দুয়ার, কবি-অনুবাদক) আমার বন্ধু— ওকে ফোন করি।
শৌভিক বলল— পোস্ট কোভিড আরও সাঙ্ঘাতিক। মুরগি খাও পাঁঠা খাও ডিম খাও।
আমি শৌভিককে বললাম, খুব দুর্বল আমি। সৌরভের মৃত্যতে আমার ভয় করছে। আমি তো মাংস খাই না। আচ্ছা তুই যখন বলেছিস, পাঁঠা খাসি ডিম খাব। শুভেন্দুতে নাকি আরও প্রোটিন! ওকে চিবিয়ে খাব? শৌভিকের হাসি পদাতিক এক্সপ্রেসের নন-এসিতে, আস্তেধীরে, খুব নেভা নেভা হয়ে আমার কাছে এলো।
কোভিডের পর পোল্ট্রি-মুরগির মতো ঝিমিয়ে আছি। এক একটা মৃত্যু সংবাদ আমাকে আরও ঝিমিয়ে দিচ্ছে। যে লোকটা পোল্ট্রি-মুরগি বিক্রি করছে—কাটছে, আমি তার ঝুড়িতেই আছি লাইনে।
সে একবার ডাকল আমাকে কাটবে বলে। বলল খরিদ্দার ওয়েট করছে। আমি বললাম, দাঁড়াও আরেকটু ঝিমিয়ে নিই। তার মাঝেই কনিষ্ক-র একটি ছোটোগল্প পড়লাম, ‘নয়ন তোমারে!’ গল্পটা পড়ে একটু প্রেম জাগল। একটু অল্প যৌনতা জেগে আবার মৌন হয়ে গেল।
এই মে মাসে আমার জন্ম। এই মে মাসের একত্রিশের পর আমার চাকরি শেষ। এই ‘শেষ’টাও আমি মানতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে। দিনমজুরের মতো কিছু না কিছু কাজ সবসময় আমার করতে ভালো লাগত। আর সে কাজ আমাকে কেউ করতে দেবে না।
সিনিয়র সিটিজেন শব্দে যে করুণা দয়া তা গ্রহণ করতে আমি পারব না। আমার যে সামান্য ইগো, অহংকার, এক ইঞ্চি মতো কনফিডেন্স তার সবটাই এখন পোস্ট কোভিড, পোস্ট প্রাইমারি মাস্টারি চাকরির—যে মৃত্যুর কাছাকাছি দুর্বলতা— সেটা কিভাবে ওভারকাম করব জানতে শৌভিককে ফোন করেছিলাম
সিনিয়র সিটিজেন শব্দে যে করুণা দয়া তা গ্রহণ করতে আমি পারব না। আমার যে সামান্য ইগো, অহংকার, এক ইঞ্চি মতো কনফিডেন্স তার সবটাই এখন পোস্ট কোভিড, পোস্ট প্রাইমারি মাস্টারি চাকরির—যে মৃত্যুর কাছাকাছি দুর্বলতা— সেটা কিভাবে ওভারকাম করব জানতে শৌভিককে ফোন করেছিলাম, শৌভিক আমাকে পাঁঠা খেতে বলল। আর বলল মান্টো পড়তে, আর বলল নর্থবেঙ্গল যেতে । ও আমাকে জঙ্গলে মাতাবে, অরণ্যে মাতাবে।
হাসপাতাল থেকে রিলিজের সময় ডাক্তার বলল— ভালো ব্যাটিং করেছেন, রান মোটে দুই। কিন্তু পুরো সময়টা ক্রিজে ছিলেন। ডাক্তার খুব রসিক, ও ইয়াং। আমার ইয়াং-দের খুব ভালো লাগে। তাই আমি দূর থেকে ইয়াং পোয়েট সৌরভ চন্দ্র মুখার্জিকে দেখতাম। এখন সে, সৌরভ নেই। আমার ইয়াং চাকরিও নেই। এখন আমি কার দিকে তাকাব?
ঝিমোতে ঝিমোতে তবু মনে হয় ঐ দূরে ডুয়ার্স ঐ দূরে শ্যাম চাচাকে মান্টোর চিঠি ঐ দূরে পোঁদপাকা তরুণ কবির সবজান্তা সবুজ ভঙ্গি, এইসব নতুন রোদের মতো বেশ উষ্ণতা দিচ্ছে।
ঝিমোতে ঝিমোতে তবু মনে হয় ঐ দূরে ডুয়ার্স ঐ দূরে শ্যাম চাচাকে মান্টোর চিঠি ঐ দূরে পোঁদপাকা তরুণ কবির সবজান্তা সবুজ ভঙ্গি, এইসব নতুন রোদের মতো বেশ উষ্ণতা দিচ্ছে।
হে ঠাকুর সবার ভালো করো।
হে নদী, হে ছোটো মুদিখানার দোকান, হে গাছের ছায়া, হে স্নেহমাখা পথ, সবার ভালো করো…
০৫.
কাউকে খারাপ কথা বললে, কটু কথা বললে, পরে খুব কষ্ট হয়। মনে হয় আমার ঐ কটু বাক্য বক তার শাদা ডানায় বয়ে নিয়ে চলেছে দূরের কোনো সুন্দর ও বাংলাবাক্যঘেরা জলাশয়ে গঞ্জে গ্রামে।
আজ শোকাহত মনে অনেকক্ষণ একটা ছবি দেখছিলাম অনেক বক তাতে ডানা মেলে এক রোগমুক্ত শোকমুক্ত দূরের কাছের দেশে উড়ে যাচ্ছে।
আসলে বকের সাদা পালক অনেক গল্পকার অনেক উপন্যাসকার-এর বাক্যভঙ্গিমা অনেক কবির লিখনভঙ্গিমা অনেক শিল্পীর তুলির টান বক তার সাদা পালকে বয়ে নিয়ে যায়—টেনে নিয়ে যায়—যায়, তার কারণ বকগণ নিজেরাও এক একজন শিল্পী, পাখিশিল্পীর যেহেতু পত্রিকা বা পুস্তক বা চিত্রশালা নেই তাই সে বা বকপক্ষীগণ মানুষের শিল্পের সঙ্গে নিজের শিল্পডানাকে গেঁথে দেয় আকাশপথে জলপথে শোকহীন গানের বাতাস পথে— আর সেই সঙ্গেই আমার শোকাতুর মনকেও সে নিয়ে যায় দূরে আমাকে আমার থেকে মুক্ত করবে বলে।
শ্মশান বা বার্নিংঘাটে তখন যে কিশোর পিতার শেষকৃত্য সম্পাদন করছিল ভয়ে দুঃখে ব্যথায় সে হঠাৎ আকাশে মাথা তুলে দেখে একঝাঁক বক একঝাঁক শাদা পাখি তার আগামীর সব ভার সব ক্লেশ নিয়ে চলেছে যেন সংগীতনির্ভার এক চির বাতাসের আশ্রয়ে।
শ্মশান বা বার্নিংঘাটে তখন যে কিশোর পিতার শেষকৃত্য সম্পাদন করছিল ভয়ে দুঃখে ব্যথায় সে হঠাৎ আকাশে মাথা তুলে দেখে একঝাঁক বক একঝাঁক শাদা পাখি তার আগামীর সব ভার সব ক্লেশ নিয়ে চলেছে যেন সংগীতনির্ভার এক চির বাতাসের আশ্রয়ে।
পাখি তুমি কোথা যাও আমাদের ছায়ার ওপর দিয়ে?
গান তুমি কোথা যাও আমাদের শোকাহত ছায়ার ওপর দিয়ে?
০৬.
কেবলই মনে হচ্ছে, গায়ের ওপর একটা সাপ উঠে আসছে। বিষধরই হবে। ফণা সমেত, রাজপথ সমেত। কোমরে মাদুলি। উঠে আসছে, উঠে এলো।
আমার ভিতরে রেডিও বাজছিল। বিনাকা গীতমালা, দুই ব্যাটারি, সেটি থেমে গেল, সেটির ভল্যুম গেল বেড়ে।
সাপ, সাপিনী তাহার ওষ্ঠ আমার ঠোঁট ছুঁয়ে আছে, আমার ফার্নিচার ছুঁয়ে আছে, আমার দোকান-পাট রাস্তা পথ গলি আমার গ্রহ-নক্ষত্র আমার পুকুর ছুঁয়ে আছে। এ চ্যানেল থেকে ও চ্যানেলে ঘুরছে, ফণা পেঁচিয়ে ধরেছে আমায়।
পথিককে জিজ্ঞেস করি, বটতলা কতদূর? ফণার সাইড ব্যাগে আছে পুরাতন রেডিওটি, দুই ব্যাটারি। সঙ্গে পুরোনো টিফিন কৌটোয় আরও পুরনো দিনের বিষ, বিষও দুই ব্যাটারির, তবে তার ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর, পথ-ঘাট রাস্তা গলি দোকান-পাটের ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর…
এইভাবে অনেক দূর এসেছি আমরা, পথিককে জিজ্ঞেস করি, বটতলা কতদূর? ফণার সাইড ব্যাগে আছে পুরাতন রেডিওটি, দুই ব্যাটারি। সঙ্গে পুরোনো টিফিন কৌটোয় আরও পুরনো দিনের বিষ, বিষও দুই ব্যাটারির, তবে তার ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর, পথ-ঘাট রাস্তা গলি দোকান-পাটের ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর…
জন্ম ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের স্নাতক রাণা পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সম্প্রতি অবসরে। তিনি লেখক এবং মূলত লেখকই। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোটি। কবিতা, গদ্য ও গল্পের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন একটি উপন্যাসও। তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ মধ্যে গদ্যবই : ‘রং ও দাগের কাটাকুটি’, ‘পাগলদের বাড়ি’, ‘রাণার কথা’। উপন্যাস : ‘কিতকিত খেলা’। গল্প : ‘দ্রাবিড়ের ভাঙা উইকেট’। কবিতা : ‘একটি অল্পবয়সী ঘুম’, ‘শরীরে সন্দীপন নেই’, ‘লাল পিঁপড়ের বাসা’, ‘বুনো গাধার ডাক’, ‘বাংলা ভাষার মাদুর’, ‘অগাস্ট মাসের রাস্তা’, ‘রোদ ওঠার খাতা’, ‘আমাদের প্যাথোজ একাদশ’, ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ ও ‘কবিতা সংগ্রহ’।