সারা পিঠ ভরে গেছে ঘামাচিতে। হাটখোলার এক চা স্টলে চায়ের গ্লাসে ফুরুক ফুরুক করে চুমুক দিচ্ছে আর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে পিঠের ঘামাচি চুলকাচ্ছে জয়নাল প্রাং। চত্তির মাসের গরমে পিঠ ভরে উঠেছে ঘামাচিতে। সুলতানের চায়ের দোকানে খুব একটা বসে না জয়নাল প্রাং, কারণ সুলতানের বকবকানি মোটেই পছন্দ করে না সে। সুলতান একবার শুরু করলে আর বন্ধ হয় না। সুলতানের ঐ ভাঙা ট্যানডেস্টার একবার চালু হলে আর বন্ধ হবার নাম নেই। চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।
—ঐ সুলত্যান, আরেক কাপ চা দে।
—চাচা, সাথে একটা নুনতা বিশকুট দিই। চা খাওয়ার আগে বিশকুট খ্যালে ভালো লাগলোনি।
—তোক কোছি একটা চা দে, তুই চা দিবু। তোক কি হামি বিশকুট দিবার কোছি। তুই সত্যিই বেশি কতা কোস। মানুষ তো এম্নিতেই কয় না, সুলত্যান একটা বাচাল।
—আঁ, কে হামাক বাচাল কোলো কন চাচা। শালাক হামি একনি গোয়াত লাত্তি বসামু। হামার দোকানোত চা খাওয়াই হামি বন্দ কোর্যা দিমু। কন জয়লান চাচা, কন আপনে।
—আরে শালা, তুই এতো পেচাল পারিস নাতো। মেজাজটা এম্নিতেই খারাপ, তার উপর তোর এই পেচাল। তুই চা দিবু নাকি সেডা ক। না দিলে উটনু কিন্তুক…
—আরে চাচা, আপনেক কি কোছি চা দিমু না। আপনে যে কোলেন হামি বোলে বাচাল। আপনেই কন হামি কি কাজ ছাড়া কুনো কতা কোই। আপনেই কন চাচা।
—বুচ্চি, বুচ্চি, তুই চা দেতো। মেজাজটা খুব খারাপ।
—চাচা, কী হইছে? কুনো সমুস্যা। সমুস্যা হলে হামাক কন।
—না না কুনো সমুস্যা না। তুই চা দে। নদীত গাও ধুবার যামো। গায়োত ঘামাচি হয়্যা চুলক্যাতে চুলক্যাতে অবস্তা খারাপ।
—চাচা, এইডা কুনো সমুস্যা হলো, বাড়িত যায়্যা চাচির কাছ থিকা ভালো কর্যা চুলক্যা লিবেন। তারপর পিটেত টিব্বত ঘামাচি পাউডার লেপ্ট্যা দিবেন। দেকপেন, দুইদিনেতি ঘামাচি ভালো হয়্যা গেছে।
—মহা মুশকিলে পড়া গেল। ধুর তোর বালের চা-ই খামো না। এতো পেচাল পারব্যার পারে রে বাবা। মাতা খায়্যা ফেল্যা দিল। হামার ঘামাচি হামি যা করি করি, তোর কি, তোক হামি কোছি চা দে, তুই চা দিবু। তোক এতো পেচাল পারব্যার কছে কে?
—হছে হছে চাচা, ভুল হয়্যা গেছে। ল্যান ল্যান চা খান। রাগ করেন না।
জয়নাল প্রাং চা খেয়ে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ঘাড়ের পরে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিল। ভাবল নদীতে গোসলটা সেরে তবে বাড়িতে যাবে। কিন্তু তড়িৎ সিদ্ধান্ত পাল্টে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করল। পাড়ঘাটি থেকে আব্বা আব্বা ডাকে পেছন ফিরল জয়নাল। পেছন ফিরে তার পিলে চমকে যায় বড়ো ছেলে বজলুর রহমানকে দেখে। ছেলে তো এই সময় বাড়ি আসে না। ছেলের তাহলে কোনো সমস্যা হলো নাতো!
পাড়ঘাটি থেকে আব্বা আব্বা ডাকে পেছন ফিরল জয়নাল। পেছন ফিরে তার পিলে চমকে যায় বড়ো ছেলে বজলুর রহমানকে দেখে। ছেলে তো এই সময় বাড়ি আসে না। ছেলের তাহলে কোনো সমস্যা হলো নাতো!
—আব্বা, আসসালামু আলাইকুম। আব্বার শরীর ভালো তো। আম্মা কেমন আছে?
ছেলের এত্তসব প্রশ্নের ভিড়ে জয়নাল প্রাং-এর মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, সেটা হলো, ছেলে এই অসময়ে বাড়ি ফিরল কেন। মনের মধ্যে রাজ্যের সব প্রশ্নবোধক তার বোধ-বুদ্ধির মাথায় হাতুড়ি পেটাতে শুরু করল। ভাবছিল ছেলের চাকরি-বাকরি সব গেছে নাকি। বেকার হয়ে বাড়ি ফিরে এলো নাতো। ছেলে আবার ডাকে—
—আব্বা, ও আব্বা, কী হলো। আপনি চুপ হয়ে গ্যালেন ক্যানো।
—হ হ বাবা, তা তুমি এই অসুমায় বাড়ি আসলা যে বড়ো। তুমি এমুন সুমায় বাড়ি আসো না। তুমার কি কুনো সমুস্যা হইছে।
—না না আব্বা, তেমন কোনো সমস্যা না। এই এম্নি বাড়ি আসতে মন চাইল, তাই চইলা আসলাম। আব্বা আপনি কি আমার আসাতে খুশি হন নাই?
—নারে বাপ না, খুশি হমু না ক্যান? অবশ্যই খুশি হইছি। কিন্তু বাপ, দিন-জমানা খারাপ। মতলেবের টং ঘরে টিবিত তো দেখি, করোনার কারণে অনেক লোকের চ্যাকরি ছাটাই হছে। চলব্যার পারিচ্চে না, বাড়ি ভাড়া দিব্যার পারিচ্চে না। বউ-ছোল লিয়া খাবার পাচ্চে না। ঐ তো সেদিনই তো, লুকমান কবিরাজ হামাক পেপার পড়্যা শুনালো ঢাকাত বোলে মেলা স্কুলের মাস্টার আনাজ-তরকারি বেচিচ্চে, কেউ আবার রিকশা চালাচ্চে। তাও ভালো ভিকক্যা করার কতা একুনো শুনা যায়নি। আচ্চা বাবা বজলু, তুমার তো আবার এরকম কিছু হয়নিতো বাপ?
—না না, আব্বা, আপনে এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদের দোয়ায় আমি ভালোই আছি।
—তা বাবা, তুমি যেই স্কুলে চাকরি করতা, ঐ স্কুলও তো বন্দ নাকি?
—হ্যাঁ আব্বা, বাংলাদেশের সব স্কুলই তো বন্ধ।
—তা, তুমাকেরেক কি বেতন টেতন দেয় তো বাপ?
—না আব্বা, আমি তো একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে চাকরি করি। বেতন দিবে কীভাবে? স্কুল বন্ধ, ছাত্রদের বেতন দেওয়াও বন্ধ। আমি যে টিউশনি করতাম, এখন তাই-ই করি আব্বা। টিউশনির টাকায় চলে যাচ্ছে আল্লা যেভাবে চালায়। এইসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
—চিন্তা কি আর সাধে করি রে বাপ। আগে বাপ হও তারপর বুঝবা। বাপের চিন্তা কীভাবে হয়।
আষাঢ় মাস। ভাসান মেঘে বৃষ্টি দুরদাম শুরু হয়ে যায়। সহসাই আকাশ কালো করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। হাওয়া উঠেছে। মনে হচ্ছে চারদিক উথাল-পাতাল করে দেবে। জয়নাল প্রাং ও তার বড়ো ছেলে বজলুর রহমান কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। জয়নাল প্রাং কানে গুঁজে রাখা টপটেন সিগারেটটা জ্বালিয়ে নিল। বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। আষাঢ় মাসের এই দমকা বাতাসে জয়নাল প্রাং-এর হাতে ধরে থাকা সিগারেটের আগুন ক্রমশ ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। জয়নাল প্রাং ছেলের কথায় খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল ছেলের কামাই-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। জয়নাল প্রাং সিগারেটে ফুক ফুক করে টান দিতে থাকে। সিগারেটের টানে ফুঁসে ওঠা ধোঁয়া তার মগজের কোরিডোর দিয়ে বেরুতে থাকে। এই ধোঁয়া ক্রমশ ছুটতে থাকে মলতেজার মোল্লার টালিখাতায়, তিনটা এনজিওর কিস্তির বইয়ের দিকে, ছুটতে থাকে বড়ো মেয়ে জয়তুননেছার শ্বশুরবাড়ির গোয়াল ঘরের দিকে, জামাইয়ের গঞ্জের দোকানের মালামাল ক্রয়-খরচার দিকে, স্ত্রীর চোখের অপারেশনের খরচ বাবদ ডাক্তারের চেম্বারের দিকে…
জয়নাল প্রাং বাড়িতে না ঢুকে পুস্করনিতে যায় গোসল দিতে। বজলুর রহমান বাড়িতে ঢুকে আম্মা বলে ডাক দিতেই রান্না ঘর থেকে মা শুকেদা বেগম বেরিয়ে আসেন। ছেলের ডাক শুনে দ্রুত আসতে গিয়ে বারান্দার খুঁটির সাথে ধাক্কা খান। ছেলে বজলুর রহমান দৌড়ে গিয়ে মাকে ধরে ফেলে।
—বাবা বজলু তুই কখুন আসলু বাপ। তোর শরীর ভালো আছে তো বাপ? কেমুন শুক্যা গেছেরে হামার বাপের মুক। ভালো কর্যা মুনে হয় খাওয়া-দাওয়া করিসনি বাপ লয়।
—আম্মা সব-ই ঠিক আছে। কিন্তু তুমি চোখের ওষুধ ঠিকমতো খাও না না? চোখের ড্রপটা যে ডাক্তার প্রতিদিন দিনে তিনবার করে দিতে বলেছে, তা কি তুমি দেও না?
—দিই তো রে বাপ। আর চোক। এই চোক দিয়া আল্লা মেলা দেকাচে। আর কী দেকমু। চোকের সামনে খালি অভাব আর অভাব। ঐ ঘরেত যায়্যা দেক তোর বোন জয়তুন। ডিমানের টাকা একনো দেওয়া হয়নি তাই জামাই বাড়িত থ্যাক্যা ব্যড় কর্যা দিছে।
—বাড়ি থেকে বের করে দিলেই হলো। ঐ শালাক দাঁড়াও আমি পুলিশে দেব। ঐ জয়তুন… জয়তুন…
জয়তুননেছা ঘর থেকে বের হয়ে আসে। কপালের এক কোণায় পট্টিবাঁধা। মনে হয় স্বামী মারধোর করেছে। জয়তুননেছা দেখতে মাশাল্লা খুব সুন্দর। তবে গরিবের আবার সুন্দর। আজকাল সুন্দর হলো টাকা। টাকা থাকলে থুকথুকে কালো বরও সুন্দরী শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। জয়তুন রূপে-গুণে এক নম্বর। কিন্তু যৌতুকের থুক্কু, জয়তুনের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যৌতুকের ব্যাপারে ঘোর বিরোধী। যৌতুক তারা নিতে নারাজ। তবে তাদের একটাই কথা তারা ছেলেকে কষ্ট করে মানুষ করেছে, গঞ্জে দোকান করে দিয়েছে, ধান-পাট করার জন্য বিঘা দুয়েক জমিও দিয়েছে। কথা হচ্ছিল খালি দোকান থাকলে তো আর বেচা-বিক্রি হবে না, আর বেচা-বিক্রি না হলে বউকে খাওয়াবে কী। আবার জমি আছে কিন্তু হালচাষ করার জন্য গরু দরকার। বাড়ির বউ গরুর দুধ খেতে হবে, তার পুষ্টির দরকার। মেয়ে-জামাই যদি খুশিতে না থাকে তাহলে আপনাদের ঐসব সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন বলেন বিয়াই সাব। কথাগুলো জয়তুনের শ্বশুরের। বিয়ের সময় জয়নাল প্রাংকে এভাবেই বোঝাচ্ছিল জয়তুনের শ্বশুর।
কথা হচ্ছিল খালি দোকান থাকলে তো আর বেচা-বিক্রি হবে না, আর বেচা-বিক্রি না হলে বউকে খাওয়াবে কী। আবার জমি আছে কিন্তু হালচাষ করার জন্য গরু দরকার। বাড়ির বউ গরুর দুধ খেতে হবে, তার পুষ্টির দরকার। মেয়ে-জামাই যদি খুশিতে না থাকে তাহলে আপনাদের ঐসব সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন বলেন বিয়াই সাব। কথাগুলো জয়তুনের শ্বশুরের।
জয়নাল প্রাং-এর জয়তুনের বর হিসেবে ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়। দাবি-দাওয়া তেমন না তাই রাজিও হয়ে গেল। বড়ো ছেলে বজলুর রহমানের সাথে আলাপ করে দিনক্ষণ সব ঠিক করল। যথাসময়ে বিয়েও হয়ে গেল। জয়নাল প্রাং এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিল, মেয়ের বিয়ে দিল। ভরসা বড়ো ছেলে বজলু। বজলু বলেছে, ধীরে ধীরে এনজিওর কিস্তির টাকা সে শোধ করে দেবে। মেয়ের বিয়ের খরচটা কোনোরকমে ঋণের টাকা দিয়ে হলো। আর একজোড়া হালের গরু আর জামায়ের গঞ্জের দোকানের জন্য আশি হাজার টাকা বাকি রাখা হলো। কথা হলো বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে সব দিয়ে দেয়া হবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে করোনা এসে হাজির হলো। ধীরে ধীরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ওপর এই অদৃশ্য শত্রু ক্রমশ ছোবল বসাতে থাকল। জমি-জমা তেমন নেই। যেটুকু আছে তা দিয়ে দুইবেলা বাড়ির মানুষের ভাত হয় না। বছরের তিন মাস কোনোরকমে চলে তারপর কিনে খেতে হয়। কাজেই বর্গাচাষ করেই দিন চলে। পরিবারে সাত সাত জন খানেওয়ালা। এই সামান্য আয়ে কীভাবে চলে। সমস্যা অতটা হতো না। বড়ো মেয়ে জয়তুনের বিয়ে হয়ে গেছে, বড়ো ছেলে বজলু তার বউ আর ছোটো একটা মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। মেজ ছেলে ফজলু বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি ঘরজামাই হয়েছে। ছোটো ছেলে শুপলু, ঘাটে মানুষ পারাপার করে। নদীতে ব্রিজের কাজ শুরু হয়েছে কবে যে এই কাজও ছেলেটার বন্ধ হয়ে যায়। ছোটো মেয়ে ময়ফুল শারীরিক প্রতিবন্ধী, চলতে ফিরতে পারে না। অনেক চিকিৎসা করানো হয়েছে, ডাক্তার-কবিরাজ করে করে ক্ষান্ত দিয়েছে। এভাবেই যে কটা দিন বাঁচে। এই মেয়ের তো আর বিয়েশাদি হবে না।
রাতের খাওয়া সেরে বজলুর রহমান বাইরের ঘরের পাশে মাচানে শুয়ে থেকে সিগারেট জ্বালায়। সিগারেটে টান দিতে দিতে মনের ভেতর রাজ্যের সব চিন্তা ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে। বউ রওশনারার ফোন। আসার পর থেকে ফোনে এই এসে পৌঁছেছি এতটুকুই কথা হয়েছে। তারপরেই ব্যালান্স শেষ। ইমার্জেন্সি ব্যালান্স নিয়ে বউকে ফোন দেয়।
—হ্যালো?
—কী ব্যাপার যাওয়ার পর থেকে তোমার কোনো খবর নাই। ফোনটা কেটে গেল তো ফোনটা ব্যাক করারও প্রয়োজন মনে করলা না। কীসের স্বামী তুমি হ্যাঁ। বিয়ে করলেই স্বামী হয়। মেয়েটার খোঁজ নিয়েছ একবারও। বাপের বাড়ি গেলে আমাদের ভুলে যাও না?
—এই তোমার বকবকানি বন্ধ করবে এখন? ফোন কেটে গেছে, ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। আর ফোন কেটে গেল তো তুমি ফোন করলা না ক্যান?
—আমার ফোনে টাকা থাকলে তো ফোন করব। কয় হাজার টাকা ফোনে তুলে দাও। বাড়িতে আম্মা-আব্বার সাথে কথা বলব তারও মুরদ নেই। আব্বা-আম্মার কাছে নিজেকে এতো ছোটো মনে হয়। মান-সম্মান আমার আর রাখলা না।
—ক্যান তোমাকে পরশুই তো ফোনে টাকা তুলে দিলাম।
—পরশুই তো ফোনে টাকা তুলে দিলাম। দিয়েছ তো বিশ টাকা। ঐ বিশ টাকা দিয়ে কয় মিনিট কথা বলা যায়। এখন মোবাইল ফোনের খরচ কত বাড়ছে তা কি তুমি জানো না। ক্যান তোমার আব্বা যখন ফোন করে তখন তো তুমি ফোন কেটে দিয়ে ফোন কর। ঘণ্টার পর ঘণ্টার পর কথা কও, তখন কত টাকা যায় সেইটা কি তোমার মাথায় থাকে না। আমার আব্বা-আম্মা ফোন দিলে খপ কইরা ফোন ধরো, আমার মান-সম্মান নাই। আমার প্রেস্টিজ একদম পাংচার কইরা দিছ তুমি।
—আরে এই রাতের বেলা এসব তুমি কি শুরু করলা। আরে বোঝো না আব্বার অবস্থা। আমাদের সংসারের অবস্থা। তুমি না এই বাড়ির বড়ো বউ।
—রাখো তোমার বড়ো বউ। আমার বিয়ের সময় কী দিছিল তোমার বাপ-মা। মনে হইছে কোনো এক ফকিরের বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি শুধু তোমাকে, একজন শিক্ষিত ছেলে, এমএ পাস, তাই দেখে বিয়ে করেছি। আমার আব্বা-আম্মা তো কিছুতেই তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে না। আমার জোরেই এই বিয়ে। আর তুমি আজকে আমারে কথা শোনাও।
—আরে বাবা, আমি আবার কী কথা শোনালাম। এখন আমার কী অবস্থা যাচ্ছে তুমি বুঝতে পারছ না। শোনো না, তুমি রাতে খাইছ। আমাদের রাজকুমারী কোথায়, ঘুমাইছে নাকি।
—হইছে তোমার আল্লাদ। রাজকুমারী! বাপ বেচে তরকারি, হের মাইয়া আবার রাজকুমারী।
—আরে এভাবে বলো না। আর এত জোরে বলছো ক্যানো। মেয়েটা শুনে ফেলবে না। আর এখানেও তো কেউ জানে না। আমি এখন ঐ কাজ করি। আস্তে বলো।
—আরে আস্তে আবার কি? আস্তে আবার কি? তোমাকে কি কেউ তরকারি বেচতে দেখে না। সেদিনই তো আম্মা ফোন করে বলল, আমাদের পাশের বাসার ঐ কেরানিগঞ্জের ভাবি তোমাকে তরকারি বেচতে দেখেছে। বাসায় গিয়ে আম্মাকে বলে আর কি হাসে? বলে কিনা— ‘আপনাদের জামাই শেষমেষ তরকারি বেচতে শুরু করেছে।’ লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। আমি আর আম্মার বাসায় যেতে পারব! গেলেই তো আমাকে ধরবে। আর রাজ্যের জেরা করবে।
—আরে বাদ দাও তো। মানুষ সমালোচনা করবেই। কই প্রায় দেড় বছর থেকে স্কুল বন্ধ, করোনার ভয়ে টিউশনি বন্ধ করে দিয়েছে অভিভাবকরা। বাসা ভাড়া নিয়ে প্রাইভেট পড়াতাম, সেটাতেও বাধা। আজ সাংবাদিক আসে, কাল পুলিশ, পরশু মেজিস্ট্রেট। তারা সরকারের গোলাম। সরকার যা বলবে তারা তাই করবে। অভিভাবকদের পড়াতে বাধা নেই, কিন্তু সরকারের বাধা। অথচ এই পনেরো মাসে আমাদের কী অবস্থা। তারা তো কেউ খোঁজ নেয়নি। লেখাপড়া করে এখন মনে হচ্ছে পাপ করেছি। লেখাপড়া না করে যদি অন্য কিছু করতাম তাহলে এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর দেখতে হতো না। শিক্ষকতা পেশায় না এসে যদি গার্মেন্টেসে কাজ করতাম তাও ভালো ছিল। কারখানার শ্রমিক হলেও ভালো ছিল। এসব তো আর বন্ধ নেই। কিছুদিন পর পর লকডাউন, তখন সব বন্ধ করে দিতে হয়। এভাবে কি আর অভিভাবকরা তার ছেলে-মেয়েদের পড়াবে। আর চোর-পুলিশ খেলে কি আর পড়ানো যায়। ধরা পড়লে জরিমানা, ঘর সিলগালা সঙ্গে পত্রিকার পাতায় ফ্রিতে খবর ছাপা হবে—‘একদল লোভী শিক্ষক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছে।’ আমাদের সমাজ শিক্ষক মানেই ময়লা পাঞ্জাবি, ডাট ভাঙা ছাতা, সেন্ডেলে কয়েকশটা তালি লাগানো অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে আর অন্যের সন্তানদের মানুষ করবে। মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের পেট নেই। পরিবার নেই। সন্তান নেই। কথায় তো আছে মাস্টারের সন্তানরা মানুষ হয় না। কারণ মাস্টাররা অন্যের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তানদের দিকে খেয়ালই রাখার সময় পায় না। তা যাই হোক। এই করোনাকালে শিক্ষকরা যে মানবেতর জীবন যাপন করছে সেদিকে কারও তো খেয়াল নেই। শিক্ষকরা সবজি বেচলেই, আর রিকশা চালালেই বা কি। শিক্ষকরা পথে পথে ভিক্ষা করুক, তাহলে এই সমাজ, জাতি তখন মুখ ফুটে বলবে— আহারে, বেচারা শিক্ষক, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এখন ভিক্ষা করছে, তাও নিজের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়নি। ও রওশনারা… রওশনারা… কী ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
—না ঘুমাইনি।
—তা এতক্ষণ যে চুপচাপ ছিলে। আমি একা একা বকবক করে গেলাম। কৈ একটা কথাও তো বললে না। তুমি আমার ওপর রাগ করছ।
—(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমার আবার রাগ। তোমার ওপর কী আর রাগ করব। আমিও তো একটা মানুষ। তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করে আব্বা-আম্মার সাথেও সেই অর্থে সুসম্পর্ক নেই। তোমার এই অবস্থা আব্বাকে যে কিছু বলব, তারও জো নেই। বলতে গেলে তুমি তো প্রেস্টিজের দোহাই দিতে বসে যাবে।
—এটা কি সম্ভব রওশনারা। শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নেয়া এটা কি কোনো সুস্থ মানুষের কাজ। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। আমি তো বসে নেই। ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি। তুমি বলো, আমি আর কয় দিকে যাই। এদিকে আব্বা-আম্মা, ছোটো ভাই, বোন আবার ওদিকে তোমরা। আমি একা আর কয়দিকে যাই। তবুও তো ভালোই চলছিল। কিন্তু এই করোনার পর থেকেই তো সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
তুমি একটু ধৈর্য ধরো। আমি তো বসে নেই। ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি। তুমি বলো, আমি আর কয় দিকে যাই। এদিকে আব্বা-আম্মা, ছোটো ভাই, বোন আবার ওদিকে তোমরা। আমি একা আর কয়দিকে যাই। তবুও তো ভালোই চলছিল। কিন্তু এই করোনার পর থেকেই তো সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
—মেলা রাত হইছে এখন তুমি ঘুমাও। সারাদিন জার্নি কইরা গেছো। রেস্ট নাও। বাড়ির সবাই ভালো তো। আম্মার চোখের কী খবর? ময়ফুল কি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জয়তুনের বাড়ির খবর কী? অর জামাই ভালো আছে? খবর-টবর নিছো নাকি গ্রামে গিয়ে তাসের আড্ডায় বসে পড়েছিলে।
—সেই দিন কি আর আছে রওশনারা। মাথার ওপর রাজ্যের দেনা, সংসার চালাতে চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। আর আমি আছি তাস খেলা নিয়ে, তুমি যে কওনা। বাড়ির সবাই আছে ভালো। তবে আম্মার চোখের অবস্থা বেশি একটা ভালো না। চোখটা মনে এবার নষ্টই হয়ে যায়। চোখের অপারেশনটা এবার আর না করালে হবেই না। কিন্তু কীভাবে? আর এদিকে জয়তুন বাড়িতে এসে উপস্থিত, স্বামী মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, হালের গরু না হলেও যৌতুকের আশি হাজার টাকা দিতে হবে। বলো এসব শুনে আমার উপর দিয়ে কী যাচ্ছে।
—ক্যান আব্বাকে বলো তার মেজ ছেলে ফজলুকে বলুক। ফজলু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় ঠিকই নিজের জমির ভাগটা নিয়ে বিক্রি করে দিয়ে গেল। বাড়ির কোনো দায়িত্বই তাকে পালন করতে হবে না? জমির বেলায় বাপের বেটা আর দায়িত্বের বেলায় ঠনঠনাঠন। আচ্ছা বাদ দাও ওসব। তুমি কি কালকে আসছো, নাকি কালকেও থাকবা।
—কালকে মনে হয় যাওয়া হবে না। ভাবছি জয়তুনের শ্বশুর বাড়িতে যাব একবার। জামাইয়ের সাথে কথাটথা বলে দেখি একবার। বুঝিয়ে বলি এই মহামারির সময় সবারই তো খারাপ অবস্থা। এই বিপদটা কাটুক, তারপর তোমার সব টাকা পরিশোধ করে দেব।
—দেখ তোমার কথা শোনে কি না। আর তোমার বোনও বজ্জাত আছে। দেখ এই সব মিথ্যা। বাপের বাড়ি থেকে টাকাটা জলদি হাতাবার জন্য স্বামীর সাথে ফন্দি করে এসেছে। আগে তোমার বোনের সাথে কথা বলে দেখ তোমার বোন রাজি হয় কি না।
—না না, জয়তুন ওরকম মেয়েই না। ও কি তাহলে নিজেই নিজের মাথা ফাটিয়ে বাপের বাড়িতে এসেছে!
—আরে বাবলির বাপ তুমি সেই বোকা, বোকাই রয়ে গেলে। তুমি টিভিও দেখ না, পত্রিকাও পড় না। টিভিতে খবরে দেখনি, করোনার ভয়ে মাকে জঙ্গলের ভেতর ফেলে চলে গেছে, বাবাকে চরের মধ্যে রেখে পালিয়ে গেছে, বাবাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছে, পানি পানি চিৎকার করলেও পানি দেয়নি, অবশেষে পিপাসায় কাতরাতে কাতরাতে বাবা মরে গেছে… এই মহামারির সময় এরকম কত ঘটনা ঘটলো আর তোমার বোনের টাকা আদায়ের জন্য সামান্য মাথা ফাটাতে পারবে না। তুমি তোমার বোনকে চেননি, ও শুধু ওর নিজের স্বার্থ বোঝে। ও তো ভেবেই রেখেছে, টাকা ওর ভাই দেবে, মাস্টার বজলুর রহমান। ওর ভাইয়ের তো লাখ লাখ টাকা। জানে যে বাপ দিতে পারবে না, বাপের বেচার মতো জমিও নেই, সব জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে, এখন যা আছে তা দিয়ে সংসার চালানোই যায় না তার উপর যৌতুকের আশি হাজার টাকা।
—আমি কোথায় থেকে দেব?
—সেটাই বোঝাও তোমার আদরের বোনকে। আর শোনো তোমার বোনের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি কালকেই চলে আসো। এই বিপদের সময় দোকান দুই দিন বন্ধ রাখা কি ঠিক হবে? এসে দেখছো হয়তো তোমার দোকান করার জায়গায় অন্য কেউ দোকান বসিয়ে দিয়েছে। ফুটপাতে দোকানের জন্য ঐ জায়গা নিতেও তো কতজনকে ধরাধরি করতে হলো, টাকাও গেল দুইহাজার। দিন পঞ্চাশ টাকা চাঁদাও দিতে হয় আবুল মাস্তানকে। কোনোভাবেই কালকে মিস করবে না। চলে আসবা।
—আচ্ছা দেখি, কী করা যায়। আব্বাকে তো বলি নাই। কাল সকাল হোক, আব্বার সাথে কথা বলি তারপর তোমাকে জানাবোনি।
—ঠিক আছে এখন ঘুমাও। রাত অনেক হয়ে গেল। কয়টা বাজে দেখ তো?
—রাত দুইটা ত্রিশ মিনিট।
—ওরেব্বাবা, মেলা রাত হয়ে গেছে। ঘুমাও তুমি। আর শোনো সকাল বেলা আমার ফোনে টাকা দিও, তাছাড়া তোমাকে কল দিতে পারব না। ইমার্জেন্সি ব্যালান্স শেষ, আর রিকোয়েস্ট কল দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ঢোকেও না।
—ওকে। গুড নাইট।
—গুড নাইট। একবার আদরও করলা না। তুমি সত্যিই বুড়া হয়ে গেছ। একদম বেরসিক।
—আগে বাড়ি আসি তখন অনেক অনেক আদর করব। এভাবে মোবাইলে আর আদর করতে ভালো লাগে না।
—আগে তো ঠিকই আদর করতা। মোবাইলে চুমু দিতে দিতে আমাকে অস্থির করে দিতা। এখন তোমার কী যে হইছে। তুমি আর আগের মতো নাই। কেমন জানি চেঞ্জ হয়ে গেছ।
—কী যে বলো রওশনারা, অভাব যখন চারপাশ ঘিরে ফেলে তখন কি আর মুখ দিয়ে আদর-ভালোবাসার কথা বের হয় সোনা। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতেই যেখানে হিমসিম খেতে হচ্ছে তখন কীভাবে আর রোমান্টিকতা বেঁচে থাকে এই হৃদয়ের হাড়জিরজিরে কুঠুরিতে।
অভাব যখন চারপাশ ঘিরে ফেলে তখন কি আর মুখ দিয়ে আদর-ভালোবাসার কথা বের হয় সোনা। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতেই যেখানে হিমসিম খেতে হচ্ছে তখন কীভাবে আর রোমান্টিকতা বেঁচে থাকে এই হৃদয়ের হাড়জিরজিরে কুঠুরিতে।
—(হাই তুলতে তুলতে) হয়েছে হয়েছে, হয়েছে বাবা হয়েছে, তোমার কাছ থেকে আর আদর নিতে হবে না। তুমি এখন ঘুমাও। আমার ঘুম পেয়েছে। মিছে মিছি ঘুমটা কামাই করলাম। ঠিক আছে।
—ওকে। বাই।
ফোনের বাটনটা কেটে দিয়ে বজলুর রহমান আবার একটা সিগারেট ধরাল। মেজাজটা তো এম্নিতেই খারাপ, তারপর বউয়ের প্যাচালে আরও খারাপ হয়ে গেল। ঘুমের তেস মারা গেল। মনে মনে একশেষ বিরক্তি ভর করল। ভাবতে লাগল, এইসব ওকে বলাই ঠিক হয়নি। যে আছে তার চিন্তায়। বাপ-মা আদর যত্নে বড়ো করেছে, যে ভাইবোনদের সাথে একসাথে আদর-ভালোবাসায় বড়ো হয়েছি, আজ তাদেরকে অবিশ্বাস করতে হবে। বউয়ের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এতদিনের স্নেহ-ভালাবাসা কি মিথ্যে। রওশনার কথাও যে সব মিথ্যে তাও নয়। ওর বা কী দোষ দেই। ওওতো মা, একজনের স্ত্রী, ওরও তো সংসার। এসব ভাবতে ভাবতে সিগারেটে জোরে জোরে টান লাগায় বজলুর রহমান। পেটের মধ্যে রাতের আলুভর্তা আর ডাল কেমন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। চাঁদনী রাত। চারদিক ঝলমল করছে জোছনার আলোয়। বদনা হাতে জমির আইলের দিকে দ্রতই হাঁটা দেয় বজলুর রহমান। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চাঁদের জোছনা আর সিগারেটের ধোঁয়া যেন একাকার হয়ে গেছে। করোটি ভরা রাজ্যের চিন্তা আর দাঁত কেলিয়ে থাকা ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকার এগিয়ে যাচ্ছে বজলুর রহমানের পিছে পিছে।
জন্ম ৩ মার্চ, ১৯৮১, রংপুর। পৈত্রিক নিবাস নওগাঁয়। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে পুণ্ড্রনগরী বগুড়ায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়ায় কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘প্রফুল্লচাকী’ (জীবনীগ্রন্থ/ ফেব্রুয়ারি ২০০৯), ‘অক্ষরস্রোতে যারা ভেসে যায়’ (কাব্যগ্রন্থ/২০১২), ‘সক্রেটিস’ (জীবনীগ্রন্থ/ ডিসেম্বর ২০১৫), ‘বায়সের পালা’ (গল্পগ্রন্থ)/ যন্ত্রস্থ। সম্পাদনা : ‘বিবর’, ‘আলোবাদ্য’, ‘শব্দ’, ‘খোলাদশক’ (যৌথ), ও ‘বাতিঘর’ (যৌথ)।