বুধবার, নভেম্বর ২০

আয়না ভেঙে গেলে : কৃষ্ণ জলেশ্বর

0

আয়না ভেঙে গেলে কী হয়? কিছুই হয় না। আয়না ভেঙে গেলে ভাঙা আয়নার প্রতিটি টুকরা আয়না হয়ে ওঠে। আবু হানিফ এ পর্যন্ত তিনটা আয়না ভেঙে ফেলেছে। বড়ো আয়না। আবু হানিফ হচ্ছে আবু হানিফ। আবু হানিফ মোহাম্মদপুরে দ্য লেডিস চয়েস দর্জি দোকানে জামা-কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে। তার বেতন মাসে সাড়ে নয় হাজার টাকা।

 

০২.
সাড়ে নয় হাজার টাকায় আপনি ঢাকার মতো একটি শহরে ত্রিশ বা একত্রিশটি দিন কীভাবে কাটাবেন? না আপনার আর কোনো অপশন নেই। সকালে ১০টা থেকে রাত ১১টা অবধি দ্য লেডিস চয়েস দর্জি দোকানে এসে একের পর এক কামিজ-সালোয়ার সেলাই করতে হবে। জায়গা মতো লাগাতে হবে চেইন ও বোতাম। কখনও সেলাই শেষে তৈরিকৃত কাপড়টিকে ঠিক-ঠাক ইস্ত্রিও করে দিতে হতে পারে। আবার কেউ কেউ বানানো কাপড় ফেরত নিয়ে আসবে, বলবে, ‘ধ্যাত! কী বানাইছেন? গলাই ঢোকে না। আরও বড়ো হবে।’ আবার কেউ কেউ বলবে, ‘ওই মিয়া কী সেলাই করছেন এইটা? পলকা সেলাই, টান লেগেই সবটা খুলে এলো!’ ইত্যাদি। ফলত আপনাকে সেইসব করে ফেলা কাজ পুনরায় করে শেষ করতে হবে। এবং মাস শেষে সাড়ে নয় হাজার টাকা নিয়ে এ পৃথিবীতে একটি মাস বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করতে হবে। বলুন আপনি কীভাবে বাঁচবেন?

সকালে ১০টা থেকে রাত ১১টা অবধি দ্য লেডিস চয়েস দর্জি দোকানে এসে একের পর এক কামিজ-সালোয়ার সেলাই করতে হবে। জায়গা মতো লাগাতে হবে চেইন ও বোতাম। কখনও সেলাই শেষে তৈরিকৃত কাপড়টিকে ঠিক-ঠাক ইস্ত্রিও করে দিতে হতে পারে। আবার কেউ কেউ বানানো কাপড় ফেরত নিয়ে আসবে, বলবে, ‘ধ্যাত! কী বানাইছেন? গলাই ঢোকে না। আরও বড়ো হবে।’ আবার কেউ কেউ বলবে, ‘ওই মিয়া কী সেলাই করছেন এইটা? পলকা সেলাই, টান লেগেই সবটা খুলে এলো!’ ইত্যাদি।

আবু হানিফ বেঁচে আছে। সাড়ে নয় হাজার টাকায় দিব্যি তার মাস কেটে যাচ্ছে। সে শুধু একা নয়। সাড়ে নয় হাজার টাকায় তারা তিনজন দুটি পরিবারে বেঁচে থাকছে। মানে আবু হানিফের বয়স বাইশ-তেইশ হলেও সে বিবাহিত। তার স্ত্রী গুলনাহারকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস। আর গ্রামের বাড়িতে তার মা একা থাকেন। মাকে প্রতিমাসে দুইটি হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়। বাকি থাকে সাড়ে সাত হাজার। এই সাড়ে সাত হাজার টাকা আবু হানিফ ও গুলনাহার জীবনের প্রয়োজনে খরচ করতে পারছে। এবং এ ছাড়া তাদের আর কীই বা করার আছে!

 

০৩.
গুলনাহার খুব সুন্দর। বয়স সতেরো কি আঠারো। বয়সটাই মূলত সুন্দর। তারপর আবার গুলনাহার ফর্সা। তার দীঘল কালো চুল। এবং যা হলে পুরুষরা নারীদের সুন্দর বলে মনে করে, শরীরের সুষম জ্যামিতিক বিন্যাস। না উঁচু, না খাটো। আর তাই গুলনাহার সুন্দর। এবং সুন্দর বলেই গুলনাহার কোথাও নিরাপদ নয়। তাই গুলনাহার বাসায় থাকে। আবু হানিফের জন্য ভাত রান্না করে, ডাল রান্না করে। কোনো কোনোদিন ডিম ভাজে কিংবা মুরগির সালুন রাঁধে। মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকায় জীবনের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে ফেলার তাগিদ যেহেতু তাদের, তারা থাকে ট্যানারিপাড়ার ছয়তলা একটা বাসার ছাদের বস্তিতে। ছাদের উপর বাঁশের চাটাই ও উপরে টিন দিয়ে তৈরি বিশ পরিবারের ঘর। সেখানেই একটি ঘরে গুলনাহার ও আবু হানিফের সংসার। সংসার মানে পৃথিবীতে আড়াল টানা ঘর। আর ঘরের ভেতর জীবন জীবন খেলা।

 

০৪.
আগেই বলেছি গুলনাহার সুন্দর। সুন্দর গুলনাহারের আয়নার কষ্ট। একটা ছোটো আয়না অবশ্য গুলনাহারের আছে। শাদা প্লাস্টিকের বর্ডার দেওয়া আয়নার পেছনে লালকসাই সিনেমার ফটো। সেই আয়নায় শুধু মুখ দেখা যায়। সম্পূর্ণটা না দেখলে কি আর মন ভরে! বড়ো আয়না আছে রুস্নার ঘরে। তাদের পাশের ঘরই রুস্নার।

গুলনাহার একটু সাজলেই দৌড়ে ছুটে যায় রুস্নার ঘরে। বলে, যাই আয়নায় দেখে আসি। তারপর মিনিট দশেক পরে ফিরে আসে। আর আবু হানিফকে বলে, একটা আয়না আনতে পারো না তুমি! আবু হানিফ তখন বিব্রত হয়। কিছুটা লজ্জিতও।

রুস্না কাজ করে আলকাতরা কারখানায়। রুস্নার স্বামী কামরান। এক চোখ কানা। কালো চশমা পরে সারাদিন ঘরের সামনে বসে থাকে। যাই হোক, গুলনাহার একটু সাজলেই দৌড়ে ছুটে যায় রুস্নার ঘরে। বলে, যাই আয়নায় দেখে আসি। তারপর মিনিট দশেক পরে ফিরে আসে। আর আবু হানিফকে বলে, একটা আয়না আনতে পারো না তুমি! আবু হানিফ তখন বিব্রত হয়। কিছুটা লজ্জিতও। তিন তিনবার আয়না কিনে ঘর পর্যন্ত আনতে পারেনি সে। পথেই ভেঙে রেখে এসেছে।

 

০৫.
মানুষ কেন সুন্দর হতে চায়? নিজেকে মানুষ কতক্ষণ দেখে? আয়না ছাড়া নিজেকে তো পূর্ণরূপে দেখা যায় না। আর আয়নার দিকে মানুষ কতক্ষণই বা তাকিয়ে থাকে! তবে অন্যের জন্যই মানুষের সুন্দর হয়ে উঠতে চাওয়া! অন্যে দেখে বলুক, বাহ! খুব সুন্দর তো! আবু হানিফ গুলনাহারের প্রেমে পড়ার পর সুন্দর হয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু তার খুব একটা আয়নার প্রয়োজন ছিল না। আয়নার প্রয়োজনটা বেশি গুলনাহারের। গুলনাহার সাজতে ভালোবাসে। কোথাও বেড়াতে যাওয়া ছাড়াই সে তোলা একটা শাড়ি পড়বে, চোখে কাজল মাখবে, ঠোঁটে লাগাবে ঠোঁটপালিশ। তারপর আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবে।

আবু হানিফ গুলনাহারের প্রেমে পড়ার পর সুন্দর হয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু তার খুব একটা আয়নার প্রয়োজন ছিল না। আয়নার প্রয়োজনটা বেশি গুলনাহারের। গুলনাহার সাজতে ভালোবাসে। কোথাও বেড়াতে যাওয়া ছাড়াই সে তোলা একটা শাড়ি পড়বে, চোখে কাজল মাখবে, ঠোঁটে লাগাবে ঠোঁটপালিশ। তারপর আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবে।

সে সেজেগুছে যখন রুস্নার ঘরে ছুটে যায় আয়না দেখার জন্য, আবু হানিফের মনে হয়, এক চোখ কানা কামরান বুঝি সানগ্লাস পরা আর চোখ দিয়ে গুলনাহারকে দেখে দেখে তুলে নিচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতর আর পানখাওয়া ক্ষয় হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে মিচকে শয়তানের মতো হাসছে। ফলত একটা বড়ো আয়না কেনা জরুরি হয়ে ওঠে আবু হানিফের। সোহরাবের আয়না ঘর থেকে আধেক বাকিতে রেখে বারোশটাকার একটা আয়না কিনে নিয়ে ফিরছিল সে একদিন রিকশায় করে। কিন্তু সোহরাবের দোকান থেকে রিকশা চলতে শুরু করতেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল সে আয়না। এতো মন খারাপ হয় আবু হানিফের!

 

০৬.
সোহরাব বলে, ‘আয়না ভেঙে পড়া ভালো কথা নয়, আবু হানিফ!’ সোহরাব শুধু আয়নাই বিক্রি করে। সবসময় ধবধবে শাদালুঙি আর শাদা ফতুয়া পরে। এমন কি পায়ের সেন্ডেলগুলোও শাদা। শাদা তার দীঘলচুল খোঁপাবাঁধা। শাদা দাড়িগোঁফ। দেখে সুফি মনে হয় সোহরাবকে। আশেপাশের দোকানের লোকজন তাকে সাধু বলে চেনে।

কামিজে ফুটিয়ে তোলে নারীদের স্তনের আকার, হিপের ভাঁজ। এরপর আর কোনো একদিন যখন সে আবার সোহরাবের কাছে যায়। তখন সোহরাব হয়তো তাকে বলে, ‘আয়না হইতাছে আচানক জিনিস! আয়না মানুষকে গিলে খায়। মানুষ সেইটা বোঝে না।

দ্য লেডিস চয়েস থেকে দু-তিন দোকান পরেই সোহরাবের আয়নাঘর। হানিফ মাঝেমধ্যেই দুপুরের খাবারের পর মিনিট দশেকের যে অবসর, সেই সময় সোহরাবের কাছে যায়। সোহরাব এমনিতে খুব একটা কথা টথা বলে না। নিশ্চুপে আয়নার কাচ কাটে আর ফ্রেম বাঁধে। আবু হানিফ হয়তো কখনো সখনো চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় তার পাশে। তারপর হয়তো জানতে চায়, ‘সাধু, আপনি শুধু আয়না কেন বেচেন?’ কিংবা ‘আয়না ভেঙে গিলে কী হয়, সাধু? আপনি যে বললেন আয়না ভেঙে পড়া ভালো না!’ এইসব প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকে সোহরাব। মিনিট দশেক পরে হানিফ হয়তো ফিরে যায় তার কাজে। কামিজে ফুটিয়ে তোলে নারীদের স্তনের আকার, হিপের ভাঁজ। এরপর আর কোনো একদিন যখন সে আবার সোহরাবের কাছে যায়। তখন সোহরাব হয়তো তাকে বলে, ‘আয়না হইতাছে আচানক জিনিস! আয়না মানুষকে গিলে খায়। মানুষ সেইটা বোঝে না। অল্প অল্প করে আয়না মানুষটাকে রেখে দেয়।’ এই শুনে মন খারাপ হয় আবু হানিফের। সে ভাবে, তবে কি কামরানের আয়নায় অল্প অল্প করে রয়ে যাচ্ছে গুলনাহার?

 

০৭.
আবু হানিফ দ্বিতীয়বার যখন আয়না নিয়ে বাড়ি ফিরছিল তখন খুব সতর্ক ছিল সে, যেন কোনোভাবেই ভেঙে না পড়ে সে আয়না। সেবার রিকশায় নয়, ভ্যানে বসে শক্ত করে ধরে রেখেছিল আয়নাটিকে। কিন্তু মাঝপথে যেতে না যেতেই একটা স্পিড ব্রেকারে এসে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে আয়নাটা। আবু হানিফের মনে হয়, সোহরাবের আয়নার কোয়ালিটিই খারাপ। না হলে এতো অল্প ঝাঁকুনিতেই কেন ভেঙে পড়বে! পরদিন সে সোহরাবের দোকানে যায়। সোহরাবকে কিছু বলার আগেই, একটা আয়নার ফ্রেম ঠিক করতে করতে সোহরাব বলে, ‘আবু হানিফ আয়না বড়ো আচানক জিনিস, বুঝছো! কার আয়না কতক্ষণ টিকবে সেটা বলাটা কঠিন। মন খারাপ কইরো না। আর আয়না বাকিতে কিনতে হয় না। তোমাকে আর বাকিতে আয়না দেব না। বাকির আয়না টেকে না।’ ভেতরে ভীষণ রাগ পুষে কিছুই না বলে ফিরে আসে আবু হানিফ। মনে মনে ভাবে, বালের সাধু! বাজে মাল দিয়ে এখন ভাব নিচ্ছে, বাকির আয়না টিকে না!

 

০৮.
প্রতিরাত ছটফটে খারাপ মন নিয়ে ঘরে ফেরে আবু হানিফ। ফিরে দেখে গুলনাহারের চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল ঠোঁটপালিশ। শরীর থেকে আসে সুগন্ধ। ভাতখাওয়া শেষে গুলনাহারের সুবাসের পাশে সে মনখারপ নিয়ে শোয়। সে ভাবে, নিশ্চয়ই সেজেগুজে গুলনাহার কামরানের আয়নায় দেখতে গিয়েছিল, আর আয়নাটাতে খানিকটা রয়ে গেছে গুলনাহার। সে আলো জ্বেলে গুলনাহারকে দেখে। দেখে কিছুটা ম্লান হয়ে গেল কি না সে! গুলনাহারের ভাঁজ খেলানো শরীর তাকে পুলকিত করে। সে মুগ্ধ হয়। আবু হানিফের মুগ্ধ চোখে চোখ রেখে গুলনাহার ফিসফিস করে বলে, ‘আমার খুব সম্পূর্ণ আমাকে দেখার শখ, আমাদের একটা আয়না হলে সব কাপড় খুলে একবার আমি আমাকে দেখতে চাই।’

 

০৯.
‘যাবে না যাবে না’ ভেবেও আবু হানিফ সোহরাবের আয়নাঘরে গিয়ে হাজির হয়। সোহরাবের তখন কোনো কাজ ছিল না। দোকানে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। চুপচাপ গিয়ে আবু হানিফ সোহরাবের পাশে বসে। তারপর জানতে চায়, ‘আয়না কি সত্যি মানুষকে রেখে দেয়?’ সোহরাব চোখ বন্ধ রেখেই মিটমিট হাসে কোনো কথা বলে না। মিনিট পাঁচেক বসে থাকে আবু হানিফ।

জামা সেলাই করতে করতে সে অনুভব করতে থাকে মিসেস শিরিন, জান্নাত, আফরোজা, দীপালি চক্রবর্তীসহ সকল নারীর শরীরের ভাঁজ। কোথায় গিয়ে ফুরিয়েছে কোন নদী! কোথায় কোন গিরিখাত উন্মুক্ত হয়েছে, সব যেন সে অনুভব করতে থাকে। কাপড়ে সেই ভাঁজ সেই গিরিখাত সে নিপুনভাবে সেলাই করতে থাকে।

তারপর কাজে ফিরে যায়। কামিজ-সালোয়ার বানাতে আসা নারীদের সে চোখ দিয়ে পরখ করে। ওরাও কি গুলনাহারের মতো নিজেকে দেখতে চায়! নিশ্চয়ই ওদের আয়না আছে। আর আয়নার সামনে ওরা নগ্ন দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের দেখে। এইসব ভাবে আবু হানিফ। তারপর জামা সেলাই করতে করতে সে অনুভব করতে থাকে মিসেস শিরিন, জান্নাত, আফরোজা, দীপালি চক্রবর্তীসহ সকল নারীর শরীরের ভাঁজ। কোথায় গিয়ে ফুরিয়েছে কোন নদী! কোথায় কোন গিরিখাত উন্মুক্ত হয়েছে, সব যেন সে অনুভব করতে থাকে। কাপড়ে সেই ভাঁজ সেই গিরিখাত সে নিপুনভাবে সেলাই করতে থাকে। আর তার মনে হয়, গুলনাহার নিজেকে কামরানের আয়নায় দেখে আসার পর কামরান কি সে আয়নায় হাত বুলায়! তার অন্তর পুড়ে যেতে থাকে কামরানের আয়নার ঈর্ষায়।

 

১০.
তৃতীয়বার আবু হানিফ আর সোহরাবের দোকান থেকে আয়না কেনে না। বাসার কাছেই ট্যানারিপাড়ার এক দোকান থেকে সাড়ে আটশো টাকা নগদে ঝকঝকে একটা আয়না সে কিনে ফেলে। এবং খুব সাবধানে আয়না নিয়ে ঘরের দিকে ফিরতে থাকে। কিন্তু কে জানে কীভাবে ছয়তলার সিঁড়ির তিনতলাতে গিয়ে পা ফসকে আয়নাসমেত সে পড়ে যায়। স্বভাবতই আয়নাটা ঝনঝন করে ভেঙে যায়। এবং ভাঙা আয়নায় আবু হানিফের হাত কেটে যায়। আবু হানিফ চিন্তিত হয়। বারবার কেন তার আয়না ভেঙে যাবে! ভাঙা আয়নার কাচগুলো ফেলে দিয়ে ঘরে এসে দেখে গুলনাহার পায়ে আলতা দিচ্ছে। তার এক পায়ে পায়েল। আবু হানিফকে দেখে গুলনাহার বলে, ‘দেখো রুস্নাপু কী করছে! আমার জন্য পায়েল আর আলতা কিনে আনছে। সেদিন বলছিলাম, পায়ে আলতা দিতে আমার ভালো লাগে। এই শুনে রুস্নাপু আলতা কিনে নিয়ে আসছে। সাথে পায়েলও।’ তারপর চোখ যায় আবু হানিফের কাটা হাতের দিকে। তখনও রক্ত পড়ছিল। আৎকে উঠে গুলনাহার, ‘কী হইছে! হাত কাটছে ক্যামনে!’ আবু হানিফের কেটে যাওয়া হাতের শুশ্রুষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে গুলনাহার। তারপর পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়ে আবু হানিফ বেড়াল হয়ে মাথা রাখে গুলনাহারের কোলে। আর গুলনাহার তার আলতারাঙা পা ভাঁজ করে বসে থাকে বিছানায়। আবু হানিফের মাথা কোলে নিয়ে পা নাচায় সে। আর তার পায়ের পায়েলে ঝুনঝুন শব্দ ওঠে। আবু হানিফ দেখে গুলনাহারের খোঁপা থেকে দুএকটা অবাধ্য চুল ফ্যানের বাতাসে উড়তে থাকে। গুলনাহারকে সুন্দর আর সুন্দর মনে হয় তার। রুস্নার ঘর থেকে কামরানের বিশ্রি হাসির শব্দ আসে।

 

১১.
সকালে কাজে যাওয়ার সময় কামরানকে ঘরের সামনে বসে থাকতে দেখে কে জানে কেন পিত্তি জ্বলে যায় আবু হানিফের। মিটমিট করে যেন হাসে কামরান। বড়ো বিশ্রি লাগে। আবু হানিফের ইচ্ছে করে লাথি দিয়ে তাকে ছতলার ছাদ থেকে ফেলে দিতে। দাঁতে দাঁত কামড়ে সে কাজে চলে যায়। সেলাই করে করে জুড়ে দেয় কাপড়ের সাথে কাপড়। মেশিনের সুঁই দৌড়াতে দৌড়াতে কেমন বন্ধন তৈরি করে দেয় একের সাথে অপরের! কেমন অবয়ব ফুটে ওঠে কাপড়ে! আবু হানিফ ভাঁজ তুলতে তুলতে ভাবে, এই যে সে কাপড়ে কাপড়ে স্পর্শ বুনে দিচ্ছে। সেইসব স্পর্শ কি ধুয়ে দিলেই চলে যাচ্ছে!

সকালে কাজে যাওয়ার সময় কামরানকে ঘরের সামনে বসে থাকতে দেখে কে জানে কেন পিত্তি জ্বলে যায় আবু হানিফের। মিটমিট করে যেন হাসে কামরান। বড়ো বিশ্রি লাগে। আবু হানিফের ইচ্ছে করে লাথি দিয়ে তাকে ছতলার ছাদ থেকে ফেলে দিতে।

দুপুরের খাবারের পর সে সোহরাবের কাছে যায়। সোহরাব তখন বেশ বড়ো একটা আয়না বাঁধছিল। আবু হানিফকে দেখে হাসে সাধু। বলে, আবু হানিফ! মানুষের অনুভূতির বাইরেও পৃথিবী থাকে। দেখার অন্তরালে থাকে অনেক দৃশ্য। যা অনুভূতিতে থাকে, তার উপস্থিতি তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নাকি আছে? যার উপস্থিতি আছে, তা একেবারে মুছে যায় কী করে? ছায়া আমরা দেখতে পাই, দেখি আয়নার পারদে প্রতিবিম্ব, সবটাই কি মুছে যায়? মানুষ কি সময়ে সময়ে পৃথিবীতে একটু একটু করে মিশে যেতে যেতে ফুরিয়ে যায় না?’ সোহরাবের এইসব কথা কঠিন ঠেকে আবু হানিফের কাছে। সে বলে ‘যাই’। সোহরাব বলে সন্ধ্যায় আইসো একবার আবু হানিফ। তোমার মাস্টারের সাথে কথা বলছি সন্ধ্যায় তোমাকে ছুটি দিয়ে দেবে।

 

১২.
কাটিং মাস্টার সত্যি সত্যি আবু হানিফকে ছুটি দিয়ে দেয়। বলে যে, ‘সাধুর সাথে দেখা করে বাড়ি চলে যা আজ। কালকে সকাল সকাল চলে আসিস।’

সোহরাব দুপুরের বাঁধতে থাকা বড়ো আয়নাটা একটা ভ্যানে তুলে দিয়ে আবু হানিফকে বলে, ‘আবু হানিফ, আয়না কখনও সত্যি দেখায় না। মানুষকে প্রকৃত সত্য দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। সব সময় আয়নাকে বিশ্বাস করিস না।

সোহরাব দুপুরের বাঁধতে থাকা বড়ো আয়নাটা একটা ভ্যানে তুলে দিয়ে আবু হানিফকে বলে, ‘আবু হানিফ, আয়না কখনও সত্যি দেখায় না। মানুষকে প্রকৃত সত্য দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। সব সময় আয়নাকে বিশ্বাস করিস না। আর আয়না ভেঙে গেলে ভাঙা আয়নায় কখনও তাকাস না। একটা মিথ্যা সহ্য করা যায়, অনেকগুলো মিথ্যা অনেকেই সহ্য করতে পারে না।’ সাধুর খালি বিভ্রান্তির কথাবার্তা— ভাবে আবু হানিফ। নতুন আয়না উপহার পেয়ে খুব সাবধানে সে ঘরে ফেরে। ঘর পর্যন্ত নিয়ে আসতে এবার আয়না আর ভেঙে পড়ে না। ঘরে এসে দেখে ঘরে গুলনাহার নেই। বোধহয় রাঁধতে গেছে। পাঁচঘরের একটা রান্নার জায়গা। আবু হানিফ আয়নাটা ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে দেয়। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখে। হঠাৎ ঝুনঝুন শব্দ আসে রুস্নার ঘর থেকে। পায়েলের আওয়াজ। গুলনাহারের পায়েল! সে ঘরের দরজা থেকে বের হয়ে দেখে ঘরের সামনে কামরানের চেয়ারটা খালি পড়ে আছে। তাদের ঘরের দরজা ভেজানো। কে জানে কেন হাত-পা কাঁপতে থাকে আবু হানিফের। সে কান পাতে ঘরের বেড়ায়। ঝুন ঝুন পায়েলের শব্দ। পৃথিবী ভীষণ কাঁপতে থাকে আবু হানিফের। সে দেখে ঘরের বেড়া থেকে আয়নাটা খুলে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায়। সে দৌড়ে গিয়ে ভাঙা আয়নার কাচের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়নার খণ্ডাংশগুলো আয়না হয়ে আছে, আর সেগুলোতে বিশ্রি দাঁত বের করে হাসছে অসংখ্য কানা কামরান।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাংলাদেশে। প্রকাশিত গল্পের বই 'আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।