শুক্রবার, নভেম্বর ২২

‘মিস করি’ সিন্ট্যাক্সের বাইরে, তোমাকে : রুম্মানা জান্নাত

0

০১.
যা হচ্ছে তাই কি বলব তোমাকে
পুরাটা বৈশাখ কেটে গেল
বৃষ্টি হলো না।

তুমি দেখতে চেয়েছ পানের বরজ
খয়েরি রোদের ছায়া
আরও দূরে বাঁশবনী, ঢালু অন্ধকার

তোমার ঘুমের পাশে জেগে আছি। বারান্দায় সকাল হয়ে গেছে।

সারাটা দিন কৃতকর্মের মতো বসে থাকব৷ বাইরে মড়কের বাতাস, টিকিট কেটে আমাদের কোথাও আর যাওয়া হবে না, পাখি! কাটাপাড়, দেওয়ানতলা ব্রিজ থেকে দেখা হবে না, নানির কবরে কদম গাছ আরেকটু বৃদ্ধ হলো কি না!

আরও যদি শোনা যায়, বন্ধ মিলের গেটে ঈদের জোসনা এসে লাগে। শ্রমিকের তাল মিলিয়ে হাঁটার মতো রাত হয়, প্রতিটা সকাল!

পুরানা ক্যালেন্ডার নামিয়ে রাখা ছাড়া দিন বদলের কোন চিহ্ন আমাদের হলো না—

 

০২.
প্রতিদিন মনে হয়, কত কি লেখার কথা—

সেইসব সকাল, বৃষ্টির পরেই যা কেবল উজ্জ্বল দেখাতো
শুধু ঘুম ভেঙে যায়, প্রাচীন এক স্থাপত্যের নিচে আমাদের দেখা হওয়া শ্যামল হয়ে আছে।

মনে পড়ে? কতদিন ভুল করেছি৷ দারুণ উপমা। রাস্তার দু’পাশে সাজানো বাগান, টিপ টিপ ফুল, তাতে বৃষ্টির ফোঁটা আর পুবের বাতাস—আমার আগ্রহ ছিলো শুধু নূরজাহান রোড থেকে তাজমহল বরাবর, আরও কোনো গভীর সাম্রাজ্যের দিকে—এমন থর থর মেঘে রিক্সার হুড কেঁপে যাচ্ছে, আর আমার প্রিয় ভ্রমণগুলোতে শুধু রাস্তা হারানোর ভয়!

ও মোহাম্মাদপুর, বিহারি মিছিলে আটকা পড়া বিকাল—
তোমাকে ভালোবেসে, আমি মৃত্যুর প্রতি তাড়াহুড়া বন্ধ করেছি—

 

০৩.
কিছুই তো করা হলো না। অনেকদিন। শান্তি আর নিঃসঙ্গতা একসাথে পাওয়া যায় কি না ভেবে আরেকটু অলসতার দিকে মনযোগী হলাম! প্রতিদিন রাত বাড়ল, ঘুমের অধিক নিরাপত্তা চেয়ে দরজা বন্ধ করলাম একইভাবে। এই ফাঁকেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। কখনো অতিথি পাখির শীত দেখা হয়নি। যেখানেই যাই, মনে হয় ফ্যাসিস্ট এক ঝলসানো আলো চেয়ে আছে৷ তবু ইচ্ছা করে বাড়ি যাব৷ এক ব্যপ্তি চরাচর পার হয়ে বাউলার হাট। তারও পরে হয়তো স্মৃতি আপার বাড়ি৷ সেখানে যাব একদিন। ধানপাঁকা মাঠে দুইটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকব। কানের লতিতে শিরশির করবে বাতাস। সেখানে কি যাব একদিন? দেখতে চাইলে চাল ধোয়া পানিতেও কত রহম গড়ায়া যায়। শাদা ভাতে বোটানো লাউয়ের পাতা—সন্ধ্যার উঠানে ভাঁপ উঠতেছে! অনেকদিন পর আবার আমাকে কেউ বলবে, রাত হলে ঘুমাতে হয়। এমন তারার আকাশ, মনে হবে মৃত্যুর দিকে মুখ করে শোয়ার কৌশল আমি ভুলে যাব হঠাৎ!

এইসব মামুলি দিনের মধ্যে তোমাকে নিয়ে যাব। বলব, আমি এমন একজনকে জানি যে কখনো সমুদ্র দেখেনি, অথচ চিরুনীর দাঁত থেকে কী নিবিড়ভাবে ঢেউ আর গর্জনগুলোকে আলাদা করতে পারে!

অনেক বিষ্ময় পার হয়ে একটা সরল নদীর কাছে যাব হয়তো৷ শান্ত, স্রোতহীন৷ ঝিরিঝিরি সাঁতার আর মানুষের পারাপার আছে কিছু। ধোঁয়া ওঠা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকার অলসতা থাকবে প্রচুর—একদিন সেইদিকে মুখ করে শোবো৷

 

০৪.
যখন তোমার আশেপাশে বসি, একটা ভ্রমণের মতো লাগে। মনে হয় তিন রঙের টিউলিপ কাছেই ফুটে আছে আর তুরাগের শ্যামলা ঢেউ টোকা দিচ্ছে আমাদের নীরবতায়—কেউ একজন সংকেত দিচ্ছে, সন্ধ্যা ছাপিয়ে সেইটুকু আলো চেয়ে আছে।

কখনো হঠাৎ মনে পড়ে, অন্ধকারেও আমি কাঁটাযুক্ত গাছগুলোকে না মাড়িয়ে চলতে শিখেছি, তার ছোট্ট ফুল, গোলাপি রেণু উড়ছে। চোখ বন্ধ করে বহুবার দেখেছি চাঁদের সভা, শিমুল গাছ থেকে অন্ধ বাঁদুর উড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে, ফুলার রোড—তোমাকে না ছুঁয়েও ঝরে গেছে চন্দ্রমল্লিকা রাত!

একটা ফ্যাসিস্ট ক্যালেন্ডার এবং তার বন্ধ তারিখগুলো আমি পাড়ি দিচ্ছি। পামুক যে ‘হুজুন’ এর কথা বলে আমাদের শহরেও সেই একই বাতাস, বিষাদগ্রস্থ সব মানুষ আর মৃত্যু গুণে রাখা৷ গলিতে ফকিরের সুর করা ঠাট্টা, তিনটা শিশু মা’য়ের ছায়ায় পা ফেলে হাঁটছে৷ আর আমি তুমি সরকারি চাকরীবিহীন, পুলিশের তাড়া খেয়ে পাশাপাশি হাঁপাই—

যখন তোমার কাছাকাছি থাকি, নদী আর সন্ধ্যা ছাড়াই একটা ভ্রমণ লেগে থাকে!

 

০৫.
আমি যেখানে যেতে চাই, যে জায়গাগুলোতে যাব বলে আরেকটু স্বচ্ছলতার কথা ভাবি—প্রায়ই স্বপ্নে প্রকৃতপক্ষেই যা স্বপ্ন, আমাকে সেসব জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। যা আমার কল্পনার চেয়ে সুন্দর, দেখার থেকেও আলোকিত৷ যেমন গতকাল একটা গ্রামে ছিলাম, এমন একটা ঘরে যেমন হয়তো আর কোথাও অবশিষ্ট নাই৷ চারপাশে এমন নরম সবুজ সব গাছ যাদের নাম আমি জানি অথচ মনে পড়ছে না এমন বিভ্রান্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছি। অনেক পাখি ডাকছে, এত মৃদু কিন্তু উজ্জ্বল সেই ডাক যে ভয় হয়, স্বপ্নের মধ্যেই আমার পলকা ঘুম ভেঙে যাবে৷

আমার স্বপ্নগুলো একেকটা রাত এমন বিভোর স্বচ্ছ সফর করিয়ে আনে, আমার কেবল সারাটাদিন মখমল হয়ে থাকে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি। জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে, গাইবান্ধায়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।