‘দাদাভাই ডাকত ঝুমি, দিদিমণি ডাকত আন্না, মামা ডাকত গাব্বু, স্কুলের মেয়েরা ডাকত টেঁপি। সই পাতিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে, সে নাম দিয়েছিল লতা। আমি তার নাম দিয়েছিলাম পাতা’।
কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’ উপন্যাসটি কথক ইয়াকুবের মুখে বর্ণিত হলেও অন্যতম প্রধান চরিত্র রেহানার এমন সব স্মৃতিচারণে ভরপুর। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে বনের আকুল গন্ধমাখা নির্জনতম এক জায়গায় রেহানা নামের এই তরুণীর ঠাঁই হয়। চিঠি মারফত বন্ধু টুনুর এই বোনটির দেখাশোনার দায়িত্ব পায় ইয়াকুব। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা আদিনাথের ভিটেবাড়িতে, যার ইতিহাস শুরুতেই জানা যায়, ওর সঙ্গে রেহানা ওরফে আন্নার ঘরকন্নার দিনগুলি লিপিবদ্ধ হতে থাকে।
এই উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র মুকুল চন্দ্র। সেও ইয়াকুবের বন্ধু। রেহানার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আদিনাথের বাড়িটির সন্ধান সে-ই দেয়। মুকুল মাঝামাঝে ছৈ তোলা নৌকায় চেপে সদাইপাতি দিয়ে যায় ওদের। ওর কথাবার্তায়, কাজেকর্মে চলমান সময়ের অস্থিরতা ফুটে ওঠে।
এই উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র মুকুল চন্দ্র। সেও ইয়াকুবের বন্ধু। রেহানার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আদিনাথের বাড়িটির সন্ধান সে-ই দেয়। মুকুল মাঝামাঝে ছৈ তোলা নৌকায় চেপে সদাইপাতি দিয়ে যায় ওদের। ওর কথাবার্তায়, কাজেকর্মে চলমান সময়ের অস্থিরতা ফুটে ওঠে। মুক্তিরা কিভাবে শায়েস্তা করছে আর্মিদের বন্ধুকে সেসবের খুঁটিনাটি বিবরণ দেয় মুকুল। কোথায় কোন গ্রাম আক্রান্ত হচ্ছে, গেরিলারা কোন ক্যাম্প উড়িয়ে দিয়েছে, কোথায় পাটের গোডাউনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ওরা।
সে সময়কার প্রেক্ষিতে মানুষের দুঃসময়ে একজন বিবেকবান তরুণ হিসেবে যেমন তৎপরতা এবং সাহসিকতা দেখানোর কথা সেসব মুকুলের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
কিন্তু ওরই বন্ধু ইয়াকুবের স্বভাবে বিপরীতমুখী এক নির্লিপ্ততা চোখে পড়ে। মুকুলের ভেতর যে সাহসের চারাগাছ জন্মেছে পাড়াগাঁয়ের কলেজ মাস্টার ইয়াকুবের ওপর সেটার কোনো প্রভাব পড়ে না। ওর ভেতর কোনো রকম উদ্যম নেই। তার চোখে সবই উৎসাহের বাড়াবাড়ি, ফাঁকা ঢ্যাবঢ্যাবে, মিথ্যে ঢাকঢোল পেটানো। এইসব বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধের খবর তাকে আশ্বস্ত করে না। ফলে সে মুকুলকে বলে– ‘চোখ কান একটু খোলা রাখিস মুকুল, আমার ভাল লাগে না।’
মাঝেমাঝে আশংকাগ্রস্থ হলেও ইয়াকুব নিজের মতো দিব্যি মগ্ন থাকতে পারে। মিঠুসারের নির্ঝঞ্ঝাট জীবন তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। ফলে এই দিনগুলি সে আশা নিরাশার আধবোজা চোখে কাটিয়ে দেয়।
রেহানার সাহচর্যের গুণে একেকটা দিন মাধুর্যময় হয়ে ওঠে। কামরাঙা গাছের ঝিরঝিরে ছায়ায় ইট পেতে চুলা বানায় রেহানা ওরফে আন্না। রাঁধতে রাঁধতে ইয়াকুবকে ‘গল্প করো’ বলে নিজেই কথার ঝাঁপি খুলে বসে। একথা থেকে ওকথায় ঘন ঘন প্রসঙ্গ বদলায়। তবে সবই তার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি৷ সেই কবে একই বরের সঙ্গে ঘর করার ছেলেমানুষি স্বপ্ন ছিল ওর আর পাতার, মিষ্টি মৌরি দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে উঠানে বসে এক ধারসে কাঁথা সেলাবার স্বপ্ন, পাতার বদমেজাজি চাচীর অত্যাচার, পুকুরে ডুবে পাতার মৃত্যুর কথা, ওদের বন্ধু বাবুর কথা।
দাদাভাইয়ের মুখে শোনা বকুলবালার গল্প শোনাতে গিয়ে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আন্না। সে ইয়াকুবকে বলে–‘তুমি আমাকে ঝুমি বলে ডেকো না, ঠিক আছে? দাদাভাইয়ের দেয়া নাম তো…’
কচুরিপানায় ভরা পুকুরের ঘাটলায় বসে আন্নার মুখে এইসব আদ্যোপান্ত শুনতে শুনতে কখনো দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ শান্ত হয়ে যায়। কখনো গাঢ় হয়ে সন্ধ্যা নামে।
আন্নার ব্যক্তিত্বে একটা সহজাত সুষমা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমদিন থেকেই সে ইয়াকুবকে তুমি বলে সম্বোধন করে এবং কয়েকদিনের মধ্যে ওকে ছেলেবেলার বন্ধু বাবুর নামে ডাকতে শুরু করে। ইয়াকুবের মুখে কখনো ঘরদোর, সংসারী জীবন বা জাগতিক বিষয়াদির প্রতি অনীহার কথা শুনে, সেসব কথা গল্পচ্ছলে বলা হলেও আন্না ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে, তীব্র তিরস্কারে কিংবা নরম কথায় বাবুকে সে পরম আন্তরিকতায় জড়িয়ে রাখে।
খোলা হাওয়ার মতো সহজ স্বভাবের কারণেই হোক আর নিবিড় বনের মতো আচ্ছন্ন চোখের চাহনির জন্যই হোক, আন্নার প্রতি, ওকে ঘিরে থাকা সবকিছুর প্রতি ইয়াকুব এক ধরণের মুগ্ধতা অনুভব করে।তার ভাষায়–
‘জারুল তমাল আর কদমঘেরা বাঁশবন, রেহানা সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে। মাস্তুলের মত মাথা উঁচু করা কদম, ঘনঘোর আঁধার জড়ানো থমথমে তমালবন, বাঁশঝাড়, গাছে গাছে ঝামরে ওঠা শতেক লতাগুল্মের গা-জড়াজড়ি, এই সবের ভেতর কোথায় কীভাবে তপু আছে রেহানাই জানে। কিন্তু গুমোট, মেঘলা তার মুখ, ছলছলে চোখের অতীন্দ্রিয় স্তব্ধতায় সে আবার একা হয়ে যায়।’
রেহানার প্রতি এই আচ্ছন্নতাটুকু ঔপন্যাসিকের অনুপম গদ্যশৈলীর গুণে পাঠকের সামনে চমৎকার সব দৃশ্যপটের মত বাঙময় হয়ে ওঠে এবং পাঠককে কৌতূহলী করে তোলে। ইয়াকুবের এই মুগ্ধতা বা দুর্বলতা কি কখনো সীমা অতিক্রম করবে? আন্নার মতো সহজ মানুষটির প্রতিক্রিয়া তখন কেমন হতে পারে? আন্নাও কি ওর প্রতি একইভাবে আকর্ষন বোধ করেনি? নাকি সেটুকুও তার হেঁয়ালি স্বভাবের প্রতিচ্ছবি! বইটি পড়তে পড়তে ক্রমশ এই সব প্রশ্ন আসে মনে।
অদ্ভুত মেয়ে আন্নার প্রথমে ঠাঁই হয়েছিল এক কবিরাজ বাড়িতে। সেখানে সে কেন বেশিদিন থাকতে পারেনি তার কারণটা স্পষ্ট না হলেও ওর খামখেয়ালি স্বভাবই যে দায়ী তা সহজেই অনুমেয়। তক্ষকের ডাক শুনে বয়স বলে দেয়া, ইয়াকুবের দৃষ্টিকে টর্চের আলোর মতো টিপটিপে মিনমিনে বলে আখ্যা দেয়া, যে আলো দেখে ‘অন্ধকার খুশিতে হাত তালি দিয়ে ওঠে’, পুকুরে নেমে ডাহুকের মেলা, কচুরির জঙ্গল দেখতে দেখতে গলা ডোবা হিজলের ডালে বসে পেয়ারা খেতে খেতে অনর্গল বকতে পারা আন্না– পুরো উপন্যাসজুড়ে এমন অসংখ্য আচরণ দেখা যায় যার ফলে প্রথম থেকেই এই চরিত্রটিকে অদ্ভুত বলে মনে হয়।
ইয়াকুবের বন্ধু, আন্নার ভাই টুনু মিঠুসারে এলে আন্নার অতীত সম্পর্কে জানা যায় এবং তার এলোমেলো আচরণের কারণটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। টুনু আসার পর ইয়াকুবের দায়িত্বও শেষ হয়। ছড়িয়ে বসা ঘরকন্না ফেলে বিনা আপত্তিতে, এতটুকু দোনামোনা না করে টুনুর সঙ্গে ফিরে যাবে বলে নৌকায় চেপে বসে আন্না।
ইয়াকুবের বন্ধু, আন্নার ভাই টুনু মিঠুসারে এলে আন্নার অতীত সম্পর্কে জানা যায় এবং তার এলোমেলো আচরণের কারণটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। টুনু আসার পর ইয়াকুবের দায়িত্বও শেষ হয়। ছড়িয়ে বসা ঘরকন্না ফেলে বিনা আপত্তিতে, এতটুকু দোনামোনা না করে টুনুর সঙ্গে ফিরে যাবে বলে নৌকায় চেপে বসে আন্না। ইয়াকুবের সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়ায় দিন কাটালেও শেষ মুহূর্তে ওর এই নির্বিকার আচরণ সত্যি বলতে পাঠককে খুব বেশি বিস্মিত করে না। বারান্দায় ওর রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ, পানির কোলঘেঁষে চেনা ঘুমশাক, ঝাঁপিয়ে ওঠা ডুমুর গাছের পাতা ওদের যৌথ জীবনের স্মারক হয়ে থাকে।
কথাশিল্পী মাহমুদুল হক সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবন, নিত্যদিনের নানা রকম টানাপোড়েনকে উপজীব্য করে অসামান্য শিল্পবোধ দিয়ে খুব স্বল্প সময়ে সৃষ্টি করে গেছেন কিছু অনবদ্য সাহিত্যকর্ম। সামাজিক সংকট কিংবা রাজনৈতিক বিষয়গুলো তার লেখার মূল বিষয় হয়ে ওঠেনি। ‘খেলাঘর’ উপন্যাসটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রত্যক্ষ চিত্র দেখা যায়নি। বরং সেই সময় রণক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন, দুজন মানব মানবীর নিভৃত গার্হস্থ্যজীবন ও তাদের সম্পর্কের নানারকম উত্থানপতনকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে। বিষয়বস্তুর এই ভিন্নতার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যান্য উপন্যাস থেকে বইটি ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে।
জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। পেশায় চিকিৎসক। লেখালেখিতে তিনি মনের খোরাক খুঁজে পান। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থসমূহ : কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮), নৈর্ঋতে (২০২০), বিহঙ্গম (২০২১)।