বদরুজ্জামান আলমগীর— নির্জনদাকে নিয়ে আজ কিছু লিখতে গিয়ে এক গল্প মনে পড়ল। একবার খুব বড়ো একজন লেখক সম্বন্ধে লিখতে বলা হলো এক পাঠককে। পাঠক কিছু লিখবে কী?
সে তো ভীষণ মুগ্ধ লেখকের সব সৃষ্টি নিয়ে। শুধু বলল, আকাশের তারা নিয়ে আমি কী লিখব— আমার কিছু কথায় তারার আলো কমবে না বাড়বে?
বেশির ভাগ সময়ই নির্জনদার লেখা আমি পড়ি চোখের জলে। বুকের ভিতর ব্যথা নিয়ে। পড়তে পড়তে আমার আগের জন্মে দেখা হাওরের উপরে ভেসে থাকা আশচর্য পূর্ণিমার চাঁদের কথা মনে হয়, শাপলা ফুলের কথা মনে হয়, ছোটো ছোটো ডিংগি নৌকার কথা মনে হয়, মনে হয় দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের কথা, উঠোনের উপর উপোড় করে রাখা রুপালি আকাশের মতো অসংখ্য, নানা রকম মাছের কথা, বাজিতপুরের কথা, পুড্ডা গ্রামের কথা, নিকলির কথা, আমার দাদুবাড়ি ‘মাষ্টারবাড়ি’র কথা… নির্জনদার জন্মও এই নিবিড় মাটির ভিতর, সোঁদামাটি আর হিজলের গন্ধের মমতায়।
আমার অবস্থাও একদম ঠিক সেরকম। বেশির ভাগ সময়ই নির্জনদার লেখা আমি পড়ি চোখের জলে। বুকের ভিতর ব্যথা নিয়ে। পড়তে পড়তে আমার আগের জন্মে দেখা হাওরের উপরে ভেসে থাকা আশচর্য পূর্ণিমার চাঁদের কথা মনে হয়, শাপলা ফুলের কথা মনে হয়, ছোটো ছোটো ডিংগি নৌকার কথা মনে হয়, মনে হয় দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের কথা, উঠোনের উপর উপোড় করে রাখা রুপালি আকাশের মতো অসংখ্য, নানা রকম মাছের কথা, বাজিতপুরের কথা, পুড্ডা গ্রামের কথা, নিকলির কথা, আমার দাদুবাড়ি ‘মাষ্টারবাড়ি’র কথা… নির্জনদার জন্মও এই নিবিড় মাটির ভিতর, সোঁদামাটি আর হিজলের গন্ধের মমতায়।
বাংলাদেশের হাওরের উপরে পূর্ণিমার চাঁদের কমলা রং যে দেখেনি, তার এ জীবনে চাঁদ দেখা বাকি থেকে গেছে! ঠিক তেমনই যারা আমার নির্জনদার লেখা পড়েনি, পড়েনি তাঁর লেখা কবিতার বই—‘দূরত্বের সুফিয়ানা’; ছিন্নগদ্যের আত্মজৈবনিক—‘সঙ্গে প্রাণের খেলা’, আখ্যাননাট্য—‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’, অথবা, ‘আবের পাঙখা লৈয়া’, ‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর’-এর কবিতাগুচ্ছ, কিংবা কাব্যগ্রন্থ— ‘নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো’, প্যারাবল— ‘হৃদপেয়ারার সুবাস’, এমনকি তাঁর অনূদিত মরমি কবিতার বই—‘ঢেউগুলো যমজ বোন’– তাদের এখনও পড়া বাকি আছে সাম্প্রতিক কালের ঐশ্বর্যময় বাংলা সাহিত্য।
আমার দাদুবাড়ির দেশের লোক নির্জনদা, হাওর এলাকার মানুষ, ভাটি গাঙ্গের নাইয়া। ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে জন্ম তাঁর ১৯৬৪ সালের ২১ অক্টোবর।
২৩ বছর ধরে আছেন দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। এ কারণেও হয়তো আমি নির্জনদার সাথে একটু বেশি আত্মীয়তা বোধ করি। আত্মীয়তাবোধ করি নির্জনদার বড়োভাই অমিত প্রতিভাধর কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাই এর জন্যও।
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথেই আমার আগে পরিচয়— তাঁর ‘কথা’ পত্রিকার জন্য লেখা চেয়েছিলেন। আমার করা অনুবাদ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্প ‘পৃথিবী’ ছেপেছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই তাঁর পত্রিকায়। জাহাঙ্গীর ভাই ছিলেন আমার শশীদাদুর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। সেইসব কবেকার কথা! ভীষণ মেধাবী জাহাঙ্গীর ভাই অকালে চলে গেলেন।
তারপর কীভাবে কীভাবে যেন আশ্চর্যজনকভাবে পরিচয় নির্জনদার সাথে। আর সেই পরিচয়ের পর থেকে মনে হয়, যে পথে আমি হেঁটে চলেছি, নির্জনদা বুঝি সে পথেরই সাথি। প্রায় দুই যুগ আগে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিজের দেশের মাটি ছেড়ে আমরা বসতি গেড়েছি সুদূর আমেরিকায়। গ্রাম বাংলার ভাঁটফুলকে তুলে ক্রিস্ট্রালের গ্লাসে জল দিয়ে রেখে দিলে তা কতদিন আর বেঁচে থাকে? খুব বেশিদিন নয়।
কিন্তু নির্জনদার কবিসত্ত্বাকে এক বিদেশি সংস্কৃতি গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেনি। বরং আমি তো বলব তাঁর কবিসত্ত্বা অজানা মাটিতেও শিকড় ছড়িয়ে হাওড় এলাকার চাঁদই খুঁজে নিতে পারছে। হয়তো তাঁর স্বর কিছুটা বদলেছে, সেটা স্বাভাবিক।
কিন্তু নির্জনদার কবিসত্ত্বাকে এক বিদেশি সংস্কৃতি গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেনি। বরং আমি তো বলব তাঁর কবিসত্ত্বা অজানা মাটিতেও শিকড় ছড়িয়ে হাওড় এলাকার চাঁদই খুঁজে নিতে পারছে। হয়তো তাঁর স্বর কিছুটা বদলেছে, সেটা স্বাভাবিক। পান্তাভাতে কাঁচা মরিচ ডলে খাওয়ার মতো আটপৌরে ভাব উপচিয়ে তাঁর কবিতা আজ জায়গা করে নিচ্ছে বিশ্বের আসরে।
কবির জীবনের মূল সুর আসে তাঁর চারপাশের পৃথিবী থেকে। নির্জনদাও সেখানে ব্যতিক্রম নন। তাঁর লেখায় ঈদ, পূজা, জারিগানের পাশাপাশি ফুটে ওঠে তাই থ্যাংকসগিভিং, নিউ ইয়ার, খ্রিস্টমাস, হানুকা, গ্রীসের নামজাদা পরিবার, জেকুলিন কেনেডি ওনাসিস, জ্যাক হারডেস্টি, ফিলাডেলফিয়ার নোয়াম চমস্কি, মুমিয়া আবু জামাল, বাখলাভা, চেরিফুল…
নির্জনদার সব লেখার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়— ‘হৃদপেয়ারার সুবাস’ বইয়ের ‘জন ওনাসিস’ গল্পটি। পথে হেঁটে যেতে যেতে কিংবা যখন কখনো হঠাৎ চুপ করে বসে আছি, আমার মাথার ভিতর, কানের ভিতর থেকে থেকেই প্রতিধ্বনিত হয়, নুফরি, নুফরি!
গল্পটি এতই আশ্বর্য সুন্দর; এতই মানবিক; ‘জন্মদাগের মতো অমোচনীয়’ এমনই এক আনন্দ-বেদনার গাঁথা যে শুধু দু-একটা লাইন নয়, পুরো লেখাটিই তাই এখানে না তুলে দিয়ে পারছি না।
আমার নির্জনদার কলমের মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক!
জন ওনাসিস
জন ওনাসিস আমার লাগোয়া প্রতিবেশী— গ্রীসের নামজাদা পরিবারের মানুষ। জে এফ কেনেডির স্ত্রী জেকুলিন কেনেডি ওনাসিস— তাঁর বংশের বধূ, এর জন্য জনের মধ্যে একটা তোলা কাপড়ের মতো শ্লাঘা ছিল বৈকি! শেষের দিকে জন ওনাসিস অন্ধ হয়ে গিয়েছিল; একজন অন্ধ গ্রীক; আমি বলি: জন, তুমি তো কবি হোমার— আমাদের জমানায় এসে পড়েছ। জন বলত— হয়তো, আমি হোমার, কিন্তু আমার হয়ে লেখ যে তুমি! আমি বলতাম— তথাস্তু।
জন একা একা আর বাইরে যেতে পারত না, তার স্ত্রী বেটি ওনাসিস ড্রাইভ করে নিয়ে যেত। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে অন্ধ জন মিসেস বেটিকে বলতে থাকে রাস্তার কোন লেইনে তার থাকা নিরাপদ, কতোদূর গিয়ে কোথায় তাকে এক্সিট নিতে হবে। দোকানপাটে বেটিকে সে-ই হাতে বেড় দিয়ে রাখে! এর নাম কী— ভরসা, অধিকার, উদ্বেগ, না জন্মদাগের মতো অমোচনীয় এক লাবণ্য শীলা?
ঘরে ফিরেই জন আমার সংসার মাঝি নার্গিসকে ডাকে— নুফরি, নুফরি, বারান্দায় আসো গল্প করি, আমি বেটির বানানো বাখলাভা নিয়ে আসি। জন নার্গিস বলতে পারত না, বলত— নুফরি। নুফরি নাকি গ্রীসের একটি ফুলের নাম।
বসন্তে আমার ফুল ও পরাগের পোলেনে প্রচণ্ড এলার্জি— অসম্ভব হাঁচি হয়, আর চোখ জ্বালাপোড়া করে। আমি ঘরে জোরে হাঁচি দিলে জন ওনাসিস দেওয়ালের ওপার থেকে চেঁচিয়ে বলে— গড ব্লেস ইউ, গড ব্লেস ইউ। আমরা ঝমঝম করে হাসি, এটা ছিল আমাদের দুই প্রতিবেশী পরিবারের বসন্তকালীন খেলা।
জন চেঁচিয়ে বলত— নুফরি, ডোন্ট গিভ আলমগীর এনি এলার্জি পিল, আই ডোন্ট সি এনিথিং, বাট আই লাইক দিস সাউন্ড।
এই নিদারুণ নিস্তরঙ্গ বসন্ত পোলেনের কালে আমার প্রতিদিন জন ওনাসিসের কথা মনে পড়ে। ভালো যে, এই অনাত্মীয় বসন্তে জন আর বেঁচে নেই। আমি হাঁচি দিলে জন নিশ্চয়ই বলত— আমি ভয় পাই, নুফরি, টেইক হিম টু দ্য হসপিটাল! এই দৃশ্যটি কোনোভাবেই ভাবতে পারি না।
আমি অকূল হয়ে সম্মিলিত একাকিত্বে জানালার পাশে বসে থাকি; সমস্ত যোগ্যতা খুইয়ে ফেলার পরেও অন্ধ জন ওনাসিসের ব্যাকুলতায় অবিরাম চেরি ফুলের দিকে নিথর অক্ষম অভিবাদন পৌঁছে দিতে মনের অজান্তেই বলি— ও চেরি ব্লোসোম, ওগো দখিন হাওয়া— আমাকে গ্রহণ করো, ক্ষমা দিয়ে দাও না আমার জীবন ধুয়ে!
কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক করেছেন। এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বই: আমার ঘরোয়া গল্প; হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা; রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা; মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক; রেশমগুটি; জলরঙ; দমবন্ধ।