সোমবার, নভেম্বর ২৫

স্বাধীন বাংলা বেতার : স্মৃতি ভদ্র

0

এই বাড়ি আসার আগে অবধি পুষ্পিতার জানা ছিল না একটি বাড়ির প্রায় সব জিনিসের একটা নিজস্ব গল্প থাকে।

প্রথম প্রথম পুষ্পিতার বেশ ভালোই লাগত। বাড়িটির সিঁড়ি থেকে ঘরের কড়িবর্গা, এমন কোনো বস্তু নেই যার পেছনে লম্বা চওড়া গল্প নেই। আর সেসব গল্প শুনতে শুনতে এ বাড়ির পুরাতন সময় থেকে ঘুরে আসতে বেশ লাগত পুষ্পিতার।

কিন্তু বিপত্তিটা তখন ঘটল যখন সে সব গল্পের বারবার পুনরাবৃত্তি পুষ্পিতার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল।

হয়তো ছাদঘরের নিরিবিলি জায়গাতে ইমেইলের এটাচম্যান্টগুলো ডাউনলোড করতে তাড়াহুড়ো করে পুষ্পিতা সিঁড়ি ভাঙছে, ওমনি ছুটে এলো সিঁড়ির রেলিং-এর গল্প।

পুষ্পিতা, সিঁড়িতে এমন দুম দাম করে উঠতে আছে না কি? জানো তো ষাট বছরের এই সিঁড়িতে কোনো মিস্ত্রির পা পড়েনি সারাই করতে। কেন পড়েনি জানো? এই যে সিঁড়ির রেলিং দেখছো তাঁর কাঠ এসেছিল সাতকানিয়ার হলুদিয়া থেকে…

পুষ্পিতা, সিঁড়িতে এমন দুম দাম করে উঠতে আছে না কি? জানো তো ষাট বছরের এই সিঁড়িতে কোনো মিস্ত্রির পা পড়েনি সারাই করতে। কেন পড়েনি জানো? এই যে সিঁড়ির রেলিং দেখছো তাঁর কাঠ এসেছিল সাতকানিয়ার হলুদিয়া থেকে…

গল্পটির মাঝপথে বাগড়া দিয়ে পুষ্পিতার বলতে ইচ্ছে হয়, ‘বড়োফুপু ছ’মাসে এই সিঁড়ির গল্প এতবার শুনেছি যে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।’

কিন্তু সেসব শব্দ গিলে ফেলে পুষ্পিতা চেহারায় হঠাৎ চিন্তার রেখা ফেলে বলে— ‘বড়োফুপু আমার মোবাইলটা ঘরে ফেলে এসেছি, রিশাদের কল মিসড হয়ে গেলে ও খুব বিরক্ত হয়।’

ছাদঘরে যাবার বদলে পুষ্পিতা তখন লম্বা পা ফেলে নিজের ঘরে চলে আসে।

আজও ঠিক এমনই হলো। ফোনের অজুহাত দেখিয়ে বড়োফুপুর সামনে থেকে পালিয়ে আসতে হলো। এমনিতে হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে কাগজপত্র সব গুছিয়ে অ্যাম্বাসিতে ভিসার জন্য দাঁড়াতে হবে। আর বড়োফুপুর গল্পের পাল্লায় পড়লে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছে দেবেন উনি। আর এরসাথে এক গল্পের লেজ ধরে আরেক গল্প দিয়ে এমনভাবে পুষ্পিতাকে জেঁকে ধরবে যে মাথা থেকে জরুরি সব কাজের লিস্ট হারিয়ে যাবে।

তারচেয়ে এই বরং ভালো, একটু না হয় মিথ্যা বলতে হলো, তবুও সময়ের অপচয় কিছু তো কমানো গেল।

ট্রাউজারের পকেট থেকে থেকে মোবাইলটা বের করে পুষ্পিতা সবার আগে রিংটোন বন্ধ করে দিল। এ সময় কোনো জরুরি ফোন আসবে না। যা আসে ফেসবুকের নোটিফিকেশন কিংবা ম্যাসেঞ্জারের টুংটাং। আর রিশাদের ফোন দেবার প্রশ্নই নেই এখন। রিশাদের দেশে তো এখন মধ্যরাত।

সেদিনও কিন্তু মধ্যরাতই ছিল। প্রকাণ্ড এ বাড়ির হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের কাছে পুষ্পিতাকে রেখে রিশাদ দেশ ছেড়েছিল। যাবার আগে শুধু বলে গিয়েছিল, বড়োফুপুর একটু খেয়াল রেখো।

খুব অবাক হয়েছিল পুষ্পিতা সেদিন, বাবা-মা নয়, রিশাদের সব চিন্তা শুধু ওই বড়োফুপুকে নিয়ে।

ষাটোর্ধ্ব এই মানুষ বড়োফুপু। বাড়ির সবাই সামনাসামনি খুব মান্য করে তাঁকে। তবে আড়ালে গিয়েই মানুষটিকে অগ্রাহ্য করতে এক মুহূর্ত সময় নেয় না। অদ্ভুত এই ঘটনার কারণ উদ্ধার করতে পুষ্পিতার খুব বেশিদিন সময় লাগেনি অবশ্য।

বড়োফুপু মানুষটি আগাগোড়া ব্যতিক্রম। যেমন ধরা যাক তাঁর বয়সের কথা। ষাটোর্ধ্ব মানুষটির শারীরিক গড়ন আর পরিপাটি পরিধানের কারণে তাঁকে দিব্যি পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন বলে চালিয়ে দেওয়া যায় এখনো। আবার মেয়ে মানেই সাধারণত তারা বাবাঅন্তপ্রাণ হয়। কিন্তু বড়োফুপু অন্যরকম। নির্ঝঞ্জাট বড়োফুপুর যত বিরক্তি কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো নিজের বাবার ছবিটিই নিয়ে। বাড়িতে কোনো ব্যত্যয় ঘটলেই বড়োফুপুর সব বিরক্তি গিয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ ওই ছবিটির ওপর— ‘কতবার বলেছি ওই লোকটির কুদৃষ্টির জন্যই এসব হয়, ছবিটা সরাও তো। দেখো না কীভাবে তাকিয়ে আছে!’

এরসাথে যুক্ত হয় চিৎকার চেঁচামিচি।

পুষ্পিতা শুরুতে খুব অবাক হতো, দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকা মানুষটি শুধু এ বাড়ির নয় এই এলাকারও খুব গণ্যমান্য ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, ছবিটাও তো খুব সৌম্যকান্তি। দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে। কিন্তু বড়োফুপুর ক্ষেত্রে তা ব্যত্যয়।

বড়োফুপুর নিজের বাবার প্রতি এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ অবশ্য একে ওকে জিজ্ঞাসা করেও উদ্ধার করতে পারেনি পুষ্পিতা।

তবে বাড়ির মানুষগুলো এই চিৎকারের জন্য শুধু দেয়ালের ছবিটি কিছুদিনের জন্য নামিয়ে ফেলে তা নয়, বড়োফুপুর সামনে সবার বাধ্য থাকার কারণও কিন্তু এই চিৎকার। আর এর কারণ উদ্ধার করতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি পুষ্পিতার।

সত্যি বলতে বড়োফুপুর চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির মানুষগুলোর জুবুথুবু অবস্থা বারবার পুষ্পিতাকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। একজন মেজাজ হারিয়ে ফেলা মানুষ একটু আধটু চিৎকার করতেই পারেন, তাই বলে কী বাড়ির মানুষগুলোকে এভাবে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতে হবে? না কি মানুষটি রেগে গিয়ে যা কিছু অন্যায় আবদার করবেন, তা মেনে নিতে হবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পুষ্পিতা বেশ কয়েকবার রিশাদের মুখাপেক্ষী হয়েছিল। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি। বরং রিশাদের যুক্তিহীন ছাড়াছাড়া কিছু কথায় প্রশ্নগুলোতে সম্পূরক যুক্ত হয়েছে বারবার।

বড়োফুপু তো এমনই, দাদুও ভয় পেতেন বড়োফুপুকে— বড়োফুপুকে নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তরে শেষে এই এক লাইন যুক্ত করে দেয় রিশাদ। আর তাতে পুষ্পিতার মনে বারবার একই প্রশ্ন আসে— একজন মানুষ শুধুমাত্র হুটহাট রেগে যান বলেই কী তাকে সবাই এত ভয় পাবে?

বড়োফুপু তো এমনই, দাদুও ভয় পেতেন বড়োফুপুকে— বড়োফুপুকে নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তরে শেষে এই এক লাইন যুক্ত করে দেয় রিশাদ। আর তাতে পুষ্পিতার মনে বারবার একই প্রশ্ন আসে— একজন মানুষ শুধুমাত্র হুটহাট রেগে যান বলেই কী তাকে সবাই এত ভয় পাবে?

না, ‘হুটহাট রেগে যান’ এই কথাটা বলা মনে হয় ঠিক হলো না।

কই এই ছ’মাসে পুষ্পিতার সাথে কোনো ব্যাপার নিয়ে তো বড়োফুপু রাগ করেননি। এমনকি পুষ্পিতা গল্পের পুনরাবৃত্তি এড়াতে গিয়ে কখনো কখনো তো তাঁকেও এড়িয়ে যায়, তবুও বড়োফুপু রাগ করেন না।

এই তো ক’দিন আগের ঘটনা, এ বাড়ির সীমানায় দাঁড়ানো আকাশনিম গাছটা ইশারায় দেখিয়ে পুষ্পিতা নাম জানতে চেয়েছিল।

ব্যস, বড়োফুপু বলা শুরু করে দিল গাছটির গল্প…

‘সেবার খুব বর্ষা হয়েছিল জানো পুষ্প, একটানা অনেকদিন বৃষ্টিতে আশেপাশের মাঠ-পুকুর পানিতে ভরে গিয়েছিল। এখানে থাকা শ্বেতটগর গাছের গোঁড়ায়ও পানি জমে গেল…’

এটুকু শুনেই পুষ্পিতার উসখুশ শুরু হয়ে যায়। সে শুধু গাছটির নামই জানতে চেয়েছিল— বড়োফুপু তো শুধু গাছ নয়, আদ্যিকালের গল্প ফেঁদে বসল।

আসলে এ বাড়িতে যত দিন যাচ্ছে পুষ্পিতার এসব গল্পের প্রতি আগ্রহ তত কমতে শুরু করেছে। তাছাড়া এই ধরনের ভরা বর্ষার গল্প এরইমধ্যে কয়েকটা শোনা হয়ে গেছে ওর। হোক তা ছাদের তেল-আচারের বয়াম সংক্রান্ত অথবা পুরাতন পেতলের বালতি সংক্রান্ত।

এসব গল্পে সময় অপচয় ছাড়া আর কিছু হয় না।

পুষ্পিতা এজন্যই বর্ষার গল্প থেকে মাঝপথেই নিস্তারের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল।

বড়োফুপু তখনও একমনে গল্প বলে যাচ্ছে— শ্বেতটগর ছাড়া বাড়িটার তখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতি আমার ছিল না জানো। ন্যাড়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা ঘোষণা দিল নিমগাছ লাগানো হবে, তাহলে মেসওয়াকের আর কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তরু ভাইয়ের মুখে আকাশনিম গাছের নাম ততদিনে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে আমার। ইচ্ছে হলো বাড়ির ফটকে আকাশনিম গাছ লাগাবো…

‘আকাশনিম’ গাছটার নাম জানা হয়ে যেতেই পুষ্পিতা বড়োফুপুর গল্পের মাঝে সুর কেটে দিয়ে বলেছিল— ‘আম্মা অনেক আগে ওনার ঘরে আমাকে ডেকেছিল, ভুলে গিয়েছিলাম।’

এটুকু বলেই পুষ্পিতা প্রায় বড়োফুপুর যত্নে গড়া গল্পের আসর ভেঙে দিয়েছিল নির্দ্ধিধায়।

গল্পে বাধা পেয়েও বড়োফুপু একদম নির্লিপ্ত, এমনকি চেহারাতে বিরক্তিটুকুও পর্যন্ত ফুটে ওঠেনি— তা খুব ভালো করে লক্ষ্য করতে ভুল হয়নি সেদিন পুষ্পিতার।

কিন্তু এতসব কাণ্ড-কারখানার মাঝে ‘তরু ভাই’ শব্দ দুটো উচ্চারণের সময় বড়োফুপুর গলা যে একটু কেঁপে উঠেছিল, তা কিন্তু পুষ্পিতার অলক্ষ্যেই থেকে গিয়েছিল।

এজন্যই তো বড়োফুপু মানুষটির খেই পায় না পুষ্পিতা। কখন যে মানুষটি মেজাজ হারাবে তা যেন কারো আগাম অনুমানের সাধ্য নেই।

তবে এ বাড়ির সবাই বলে, বড়োফুপুর রুদ্রমূর্তি পুষ্পিতার এখনো দেখে ওঠার সুযোগ হয়নি।

সবাই যতই বলুক না কেন; এতদিনে পুষ্পিতা বুঝে গেছে বড়োফুপুকে নিয়ে এবাড়ির সবাই একটু বেশিই ভয়ে থাকে, আদতে যার কোনো কারণই নেই।

আর সেটা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে রিশাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর।

রিশাদ ফোন দিলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বড়োফুপুর খোঁজ নেয়— বড়োফুপু কি এখনো হুটহাট রেগে যায়? কিংবা, বড়োফুপু কি দাদুর ছবিটা দেয়ালে আবার ঝুলাতে দিল?

অদ্ভুত কথা তো, ওমন একটু আধটু রাগ করলেই কী তাঁর অন্যায় আবদার প্রাধান্য দিতে হবে? বড়োফুপুকে নিয়ে ওদের এই অকারণ উদ্বেগ সত্যিই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুষ্পিতার জন্য দিন দিন।

তবে এই বিরক্তি খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না পুষ্পিতার। সেখানে জায়গা করে নিল অদ্ভুত এক আতংক। অদ্ভুত এক ঘটনা টেনে আনল এই আতংক।

সেদিন দুপুরে বাড়িটি অন্য দিনগুলোর মতোই স্তব্ধ হয়েছিল। এমনিতেই বিশাল এই বাড়িতে হাতেগোনা চার-পাঁচজন মানুষ। তারা আর কতইবা হৈ হুল্লোড় তুলতে পারে। তবুও সকাল থেকে দুপুর অব্দি দৈনন্দিন কাজের জেরে বাড়িটি যেটুকু জমজমাট থাকে, দুপুরের পর থেকে তা ফুরিয়ে আসে। সারা বাড়ি ঝিমায় সে সময়। দুপুরের খাবারের ঠিক পর পরই বাড়ির সব ব্যবহারিক ঘরগুলোতে খিল পড়ে যায় বেশ লম্বা সময়ের জন্য। এসময় বাড়ির কাজে সাহায্যকারী মানুষগুলোও জিরিয়ে নেয় লম্বা সময়ের জন্য।

এগুলোর সাথে বাড়িটিও জিরোয় মনে হয়।

পুরো বাড়িটা এতই নিস্তব্ধ হয়ে যায় যে, ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধা চড়ুইয়ের ডাকেও চমকে উঠতে হয় হঠাৎ হঠাৎ।

শহরে বড়ো হওয়া পুষ্পিতার এমন মফস্বলী জীবনের সাথে আগে কোনো যোগসূত্রই ছিল না। তাই নিরিবিলি সময়গুলো প্রথম প্রথম বেশ উপভোগ্য মনে হলেও সময় গড়াতেই তা একঘেয়ে মনে হতে শুরু হলো পুষ্পিতার।

এই একঘেয়েমি কাটানোর উপায় কখনও ল্যাপটপে মুভি দেখা, আবার কখনও বিশাল এ বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো। দ্বিতীয় উপায়টি পুষ্পিতার বেশি পছন্দের। তবে এটা করতে হয় খুব সাবধানে। কারণ খুঁট করে একটু আওয়াজেই এ বাড়ির নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায়।

কিন্তু অতি সাবধানেই যে বড়ো অনিষ্ট ঘটে যায়, সেদিনের আগে পুষ্পিতার জানা ছিল না।

সেদিন ঝিমানো বাড়ির উঠোনে আলগোছে নেমে এসেছিল পুষ্পিতা। পায়ে পায়ে এদিক-ওদিক ঘুরছিল উদ্দেশ্যহীন।

দোতলা এ বাড়ির উপর-নিচ মিলে অনেকগুলো ঘর। হাতে গুনলে দশখানা। এজন্যই তো এ বাড়ির নাম দশমহলা। তবে বাড়ির নাম যতই গালভরা হোক না কেন মানুষ তো গুনে ওই চার থেকে পাঁচজন। তবে আগে কিন্তু এমন ছিল না। রিশাদের দাদু মানে সৈয়দ আজমল আলী যতদিন বেঁচে ছিলেন এ বাড়ির ঘরে না কি টান পড়ে যেত।

এ বাড়ির নিজস্ব মানুষ বাদেও আত্মীয়-স্বজন, জায়গীর সব মিলিয়ে এতজন ছিল যে ছাদঘরেও তখন তক্তপোশ পড়ত। আর তা হবেই বা না কেন। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে এ বাড়ির পরিবার তো কম বড়ো ছিল না।

বড়োচাচা, মেজোফুফু আর ছোটোফুফু দেশের বাইরে চলে না গেলে আজও এ বাড়ি আর যাই হোক অন্তত উৎসব পার্বণে গমগম করত। তবে তারা যতই এ বাড়ির প্রতি আগ্রহ হারাক, এ বাড়ি কিন্তু তাদের সব স্মৃতি থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি। এজন্যই তো এদের ঘরগুলোর তালায় এখনো চাবি করে যে কোনো উৎসবের আগে। ধুলো ঝেরে লেপেমুছে এখনো চকচকে করে রাখা হয়, তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায়। আর এই রীতি চালু করেছে বড়োফুপু, ‘কতদিন আসে না ওরা, এবারের ঈদে ঠিক আসবে দেখো।’

অথবা,

‘রাশুর বিছানায় এই চাদরটা পেতে রাখো, গরমের ছুটিতে বিদেশ থেকে দেশে আসে তো সবাই।’

বিছানায় রাজস্থানী চাদরের কোনা টেনে টেনে যতই নিভাঁজ করুক না কেন বড়োফুপু, বাড়ি বিমুখ ভাই বোনদের ফিরিয়ে আনতে পারেন কই তিনি?

পুষ্পিতাকে বলা হয়েছে, বিদেশী সভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষগুলো এই মফস্বলে এসে মানিয়ে নিতে পারে না বলে তারা বাড়ি বিমুখ।

পুষ্পিতা মনে মনে ভাবে রিশাদও কী এরপর একদিন এই মফস্বলী বাড়িতে আসা ভুলে যাবে? আর সে নিজে? সেও তো আর মাস দুয়েকের মধ্যেই এদেশ ছেড়ে যাবে।

প্রশ্নগুলো পুষ্পিতাকে রুবিক’স কিউবের মতো এলোমেলো করে দেয় নিস্তব্ধ সে দুপুর। আর তখনই ওর চোখ পড়ে এ বাড়ির স্টোর রুমের দিকে। সাধারণত বাড়ির অতিরিক্ত জিনিসের জায়গা হবার কথা সে ঘরে। কিন্তু ব্যতিক্রম এই বাড়ি সব কিছুতেই ব্যতিক্রম। তাই তো ফেলে দেবার মতো পুরোনো জিনিসও খুঁজে পাওয়া যায় সে ঘরে।

আর তার কারণ হলো সৈয়দ আজমল আলী যক্ষের ধনের মতো সবকিছু আগলে রাখার অভ্যাস। জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূ্র্ণ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত জিনিস সংগ্রহে রাখার নেশা ছিল তাঁর।

সৈয়দ আজমল আলীর পেশোয়ার ভ্রমণের খাইবার গেটের কাঠের রেপ্লিকা হোক অথবা পঁচাশিতে প্রথম সংবর্ধনায় পাওয়া একটা পেতলের ম্যাপ, সবকিছু কিন্তু একটু খুঁজলেই স্টোর রুমে এখনো পাওয়া যায়। দীর্ঘদিনের পরিচর্যার অভাবে এই ঘরের প্রতিটি বস্তুই জৌলুস হারিয়ে বাতিলের খাতায় নাম তুলেছে অনেক আগেই। তবুও বাড়ির কেউ জিনিসগুলো ফেলে দেয় না, আবার ঝেড়েমুছে যত্নও নেয় না।

অদ্ভুতভাবে ঘরটির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা বাড়ির সকলের। এমনকি বড়োফুপুর ভাণ্ডারেও সে ঘর বা বস্তুগুলো নিয়ে কোনো গল্প নেই। থাকলে নিশ্চয় অন্তত একবার হলেও পুষ্পিতা তা শুনতে পেত।

কোনোকিছু না ভেবেই পুষ্পিতা স্টোর রুমের শেকল নামাল সেদিন। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে দরজা দুটো খুলে যেতেই পুষ্পিতা নিজেকে আবিষ্কার করল ধুলো আর অন্ধকারের স্তুপের মধ্যে। ঘরটিতে আগে কখনো আসেনি পুষ্পিতা।

কোনোকিছু না ভেবেই পুষ্পিতা স্টোর রুমের শেকল নামাল সেদিন। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে দরজা দুটো খুলে যেতেই পুষ্পিতা নিজেকে আবিষ্কার করল ধুলো আর অন্ধকারের স্তুপের মধ্যে। ঘরটিতে আগে কখনো আসেনি পুষ্পিতা। তাই অন্ধকার সামলে সামনে এগোনোর পথের আন্দাজ নেই তার।

বেশ কিছুটা সময় নিল। এরপর দরজা দিয়ে আসা আলোটুকুর ভরসায় খুঁজতে লাগল ঘরের জানালা। না নেই। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটি জানালা পেল না পুষ্পিতা। তবে ততক্ষণে গুমোট অন্ধকারে দরজার ওপাশ থেকে আলো একটু একটু করে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। সেই আলোতেই পুষ্পিতা বুঝতে পেরেছিল সে ঘরটি আসলে অকেজো জিনিসের। হাতল ভাঙা চেয়ার, ঘুণে ধরা কাঠের বাক্স, ছেড়া চটি, পুরাতন বই, রং খোঁয়া পিকদানির মতো মূল্যহীন জিনিসে ঠাঁসা সে ঘর।

শুরুতেই পুষ্পিতা ধুলো সরিয়ে দু-একটি বই হাতে তুলে নিয়েছিল যার সবই উর্দূ ভাষায় লেখা। তবে একটা দুটো ইংরেজি বইও ছিল কিন্তু সেগুলোর পাতা পোকায় কাটা। পুষ্পিতা আগ্রহ হারালো। ততক্ষণে দুপুরের অনেকটা গড়িয়ে গেছে। হাতের ধুলো ঝেরে অকেজো জিনিসের ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল পুষ্পিতা। ঠিক তখনি তার চোখ গিয়ে আটকালো ভাঙা কাঠবাক্সের পেছনটায়। সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্পিতার চোখগুলোয় সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। ফিসফিসিয়ে বলে উঠল ‘ইট’স মেইক মাই ডে।’

এরপরেই অকেজো জিনিসের স্তুপ পেরোলে পুষ্পিতা কাঠবাক্সের পেছনে পৌঁছাবার জন্য। তবে তা কিন্তু খুব নির্বিঘ্নে হলো না। এরমধ্যে কাঠের বাক্সের ভাঙা কোনায় পুষ্পিতার হাত কেটে গেল, কামিজের কোনাটাও ছিঁড়ে গেল। তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই পুষ্পিতার। ওর সব আগ্রহ তখন রূপালী রঙের জিনিসটার প্রতি।

সাধারণত সেই জিনিসগুলো মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। তবে তখন জিনিসটা অবহেলায় ভাঙারির স্তুপের ভেতর পড়ে আছে।

সব বাঁধা এড়িয়ে জিনিসটা হাতে ধরতেই ভাঙা হ্যান্ডেলটা পুষ্পিতাকে বুঝিয়ে দিল অকেজোর দলে সেও নাম লিখিয়েছে। তা বলে কী হবে? প্রাগৈতিহাসিক মূল্য সেটাকে কখনই মূল্যহীন হতে দেবে না। ধুলো ঝেরে একটু পরিষ্কার করতেই পুষ্পিতা বুঝতে পারে রঙটিও ছেড়ে পালিয়েছে জিনিসটির । জৌলুসপূর্ণ দিন তো এদের কবেই ফুরিয়েছে, পুষ্পিতা মনে মনে ভাবে। উল্টেপালটে ভালো করে দেখতে থাকে পুষ্পিতা। হ্যাঁ, হুবহু এমন আরেকটা ও দেখেছিল কলকাতার কোনো এক মিউজিয়ামে, রিশাদের সাথে ঘুরতে গিয়ে। রিশাদ অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিল সেদিন ‘একাত্তর’ লেখা সেলফের সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সব।

রিশাদের সেদিনের সেই আগ্রহটা মনে পড়তেই পুষ্পিতা ঠিক করে ফেলল যাবার সময় এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। রিশাদ কতটা খুশি হবে, তা অনুমান করে উদ্বেলিত হয়ে উঠল পুষ্পিতা।

একঘেয়ে দুপুরে একটু আনন্দ আবিষ্কার করে পুষ্পিতা আহ্লাদিত হয়ে উঠছিল একটু একটু করে, আর অন্যদিকে আধখোলা দরজায় পুষ্পিতার জন্য জমা হচ্ছিলো তীব্র আতংক।

অনেকদিন পর স্টোর রুমের দরজা আধাখোলা দেখে বড়োফুপু খুব অবাক হয়েছিল। কে খুলেছে এ ঘরের তালা এতদিন পর, তা দেখতে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। ধুলো আর ভাঙাচুরা জিনিসের মধ্যে পুষ্পিতার পেছনটা দেখে বড়োফুপু কিন্তু শুরুতে অবাক হয়নি মোটেও। বরং ভেবেছিল অলস সময়গুলো পার করা মেয়েটার জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি রিশাদের কাছে পাঠিয়ে দেবার একটা তাড়াও বোধ করতে শুরু করে তখন। তবে সে ভাবনায় ছেদ পড়ে আচমকা। এরপরে যা ঘটে তাতে বড়োফুপু মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

পুষ্পিতা ঘুরে দাঁড়াতেই ওর হাতের দিকে চোখ স্থির হয়ে যায় বড়োফুপুর। সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাতে থাকা পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে মাড়ে পুষ্পিতার দিকে। কাঁচের গ্লাসটা লক্ষ্যচ্যূত হয়ে ঝনঝন শব্দ তুলে পুষ্পিতার আহ্লাদিত সময় খানখান করে দিল।

পুষ্পিতা ঘুরে দাঁড়াতেই ওর হাতের দিকে চোখ স্থির হয়ে যায় বড়োফুপুর। সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাতে থাকা পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে মাড়ে পুষ্পিতার দিকে। কাঁচের গ্লাসটা লক্ষ্যচ্যূত হয়ে ঝনঝন শব্দ তুলে পুষ্পিতার আহ্লাদিত সময় খানখান করে দিল।

গ্লাসটা পুষ্পিতার গা ছুঁইয়ে গেলে কতটা রক্তারক্তি হতে পারত, তা ভেবে বাড়ির মানুষগুলোর গায়ে এখনো কাঁটা দেয়।

তবে ঘটনার পরপরেই বড়োফুপুকে সেখান থেকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

আর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্পিতাও আগপাছ না বুঝে গিয়ে উঠেছিল নিজের ঘরে । কিন্তু বিনাকারণে বড়োফুপুর অতর্কিত সেই আক্রমণ পুষ্পিতাকে আতঙ্কিত করে তুলতে সময় নিল না মোটেও।

তবে সেদিনের হৈ হট্টগোলের ভেতর থেকে দুটো শব্দ পুষ্পিতা আলাদা করতে পেরেছিল।

তারমধ্যে ‘তরু ভাই’ নামটা একমাত্র আকাশনিম গাছের গল্পে শুনেছিল পুষ্পিতা, এর আগে বা পরে আর কখনই শোনেনি। আর অন্য শব্দটি ‘সন্তান’।

কোন সন্তান, কার সন্তান— বড়োফুপু কার কথা ওমন চিৎকার করে বলছিল, কেনইবা সেদিন বড়োফুপু ওমন হিংস্র হয়ে উঠল, কোনোকিছুরই উত্তর নেই পুষ্পিতার কাছে।

কীভাবে থাকবে উত্তর সে ঘটনার পর বড়োফুপু নিজের ঘর থেকে বেরই হন না। আর পুষ্পিতার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়ে ওর শ্বশুর শাশুড়ি এতই লজ্জিত যে, সে ঘটনা নিয়ে কিছু বলা তো দূরে থাক পারলে পরদিনই পুষ্পিতাকে ওর বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

তবে নিজের দায়িত্বের দোহাই দিয়ে পুষ্পিতা এ বাড়িতেই থেকে গেছে। এর পেছনে যে বড়োফুপুর এই আক্রমণের কারণ জানার শতভাগ ইচ্ছা তা কিন্তু পুষ্পিতা বেশ কষ্ট করেই লুকিয়ে রেখেছে।

আসলে লুকিয়ে না রেখে উপায় নেই। রিশাদকে জিজ্ঞাসা করে লাভ হয়নি। ও যেটুকু জানে তা হলো, বড়োফুপু না কি একটা সময় শুধুই চিৎকার চেঁচামেচি করত; বাড়ির সবাইকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করত। তবে সেসব রিশাদের শুধুই শোনা কথা। কারণ রিশাদের জন্মের পর থেকেই না কি বড়োফুপু অনেকটা ধাতস্থ হতে শুরু করে। তবে এরজন্য অবশ্য রিশাদের মাকে বেশ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সন্তান জ্ঞানে রিশাদকে যতবার বড়োফুপু বুকে জড়িয়ে নিয়েছে, রিশাদের মা ততবার মাতৃস্নেহ উপেক্ষা করে দূরে দূরে থেকেছে।

এজন্যই তো ছোটোবেলায় রিশাদ বড়োফুপুকে অনেকবার মা ভেবে ভুল করত।

কিন্তু রিশাদের এ গল্পে তো গ্লাস ছুঁড়ে মারার কারণ খুঁজে বের করা যায় না।

আর এ বাড়ির অন্যকেউ কিছুই জানে না।

অদ্ভুত যে বাড়ির সবকিছুতে গল্প সে বাড়ির গল্পের ভাড়ারে এমন টান পড়ে গেল? পুষ্পিতার মনটা বেশ দমে গেল এতে।

এরমধ্যে পুষ্পিতার এম্ব্যাসিতে যাওয়ার ডেট চলে এলো। মফস্বলী জীবনের অদ্ভুত সময়গুলোও ফুরিয়ে এলো এরইসাথে। বলে দেওয়া হলো, পুষ্পিতা ভিসা পেলে এ বাড়ির সবাই গিয়ে ওকে বিদায় দিয়ে আসবে।

আসলে খুব সুক্ষ্মভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো আপাতত পুষ্পিতার এ বাড়িতে ফিরে আসার দরকার নেই।

সবকিছু পরিকল্পনামাফিকই হলো। পুষ্পিতার ভিসা পেয়ে যাবার খবরটা এ বাড়িতে আসতেই সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। পুষ্পিতাকে বিদায় জানাতে কে কে যাবে, কবে যাবে, রিশাদের জন্য কী কী পাঠানো হবে তা নিয়ে সবাই এমনকি বড়োফুপুও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।

ও হ্যাঁ, বড়োফুপু কিন্তু এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। রাগ, ক্ষোভ সব ভুলে আবার গল্প বলায় মেতে উঠেছে। তবে মুশকিল হলো, সে গল্প শোনার মানুষের অভাব হয়ে গেছে এ বাড়িতে।

তা বলে কিন্তু বড়োফুপুর গল্প বলা বন্ধ নেই। একে তাকে শেষমেষ কাউকে না পেলে নিজে নিজেই গল্প আওড়াতে থাকে। তবে তা কিন্তু মোটেও অসংলগ্ন নয়, কারণ বড়োফুপু জানে সামনে না থাকলেও আড়াল থেকে এ বাড়ির মানুষগুলো ঠিকই কান খাড়া করে রেখেছে।

আর তা না করে উপায় আছে এ বাড়ির মানুষগুলোর? বড়োফুপু কখন কী বলা শুরু করে তার ঠিক আছে নাকি।

আর ঠিক নেই বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে পুষ্পিতাকে বিদায় জানাতে বড়োফুপুকে সঙ্গে নেওয়া হবে না। এমনকি তাঁকে লুকিয়েই যাবে সবাই।

কিন্তু এই লুকোচুরি খেলায় সবাইকে হার মানিয়ে দিল পুষ্পিতা। দেশ ছাড়ার দিন দুয়েক আগে ভর দুপুরে হুট করে এসে হাজির হলো মফস্বলের এ বাড়িতে। কী এক জরুরি জিনিস না কি ভুল করে রেখে গেছে। এমনকি তা কোথায় রেখে গেছে তাও ভুলে গেছে। তাই নিজেই খুঁজতে এসেছে সেটা।

বাড়ির সবাই অসন্তুষ্ট হলেও মনে মনে হাসে বড়োফুপু। যাক, গল্প শোনার একজন মনযোগী শ্রোতা পাওয়া গেল, হোক তা অল্প সময়ের জন্য।

এজন্য অবশ্য বড়োফুপু খুব বেশি ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিল না, সন্ধ্যা রাতেই হাজির হলো পুষ্পিতার ঘরে। স্বভাবসুলভ শান্ত কন্ঠে বলল, ‘পুষ্প, আমি জানি তুমি কি খুঁজতে এসেছো এ বাড়িতে।’

পুষ্পিতা চমকে উঠল না, অবাক হলো না। শুধু নির্বিকারভাবে বলল, ‘গল্পটা শুরু করো বড়োফুপু।’

গল্প শুরু হলো…

এ গ্রাম কেন আশেপাশের কোনো গ্রামেই তখন রেডিও কী জিনিস সেভাবে জানত না। তবে গ্রামের সবচেয়ে বড়ো বাড়ির আভিজাত্যে আরেকটু রং চড়াতে সুদূর জাপান থেকে হঠাৎ একদিন কিনে আনা হলো ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও।

ব্যস্, গ্রামের সবার মধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেল। এ দেখতে আসে ও দেখতে আসে। সবার একই কথা— অদ্ভুত বাক্স, মানুষের মতো কথা কয়!

যতই বলা হয়—মানুষই কথা বলছে তো, বাক্সটি কথাগুলো আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে শুধু।

সে কথায় উল্টো চোখ বড়ো করে সবার প্রশ্ন— এইটুকুন বাক্সের মধ্যে কীভাবে এতগুলান মানুষ ঢুকল?

গ্রামের অশিক্ষিত মানুষগুলোকে বোঝানোর আশা বাদ দিয়ে তাদের অবাক হওয়াটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগল বিশাল বাড়ির মানুষগুলো।

তবে বাড়ির বড়ো মেয়ে ষোড়শী রাবেয়ের সুখ কিন্তু ছিল অন্য জায়গাতে।

রবিবার দুপুরবেলা রেডিওর নব ঘুরিয়ে আকাশবাণীতে ‘ওয়েসিস মনের মতো গান, মনে রাখার কথা’ ধরতেই বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়াত বিশ বছরের এক যুবক। এক একটি গান যেন রাবেয়া আর সেই যুবককে তাঁদের না বলা কথা একে বলে দিত।

ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওটির তাৎপর্য এতটুকুই ছিল তখন পর্যন্ত রাবেয়ার জীবনে।

কিন্তু দিন হঠাৎ পাল্টে গেল…

এটুকু বলে বড়োফুপু থেমে গেল। ‘এরপর কী হলো?’ পুষ্পিতার প্রশ্ন উপেক্ষা করে বেশ কিছু সময় মাথা নিচু করে বসে রইল বড়োফুপু। যেন গল্পের বাকী অংশ আর জানা নেই তাঁর।

আনকোরা এ গল্প পুরোটা শোনার জন্য অধির হয়ে আছে পুষ্পিতা। ‘বড়োফুপু…’ পুষ্পিতার কথা শেষ হবার আগেই বড়োফুপু গল্পে ফিরলেন—

…একাত্তরের মে মাস আসতে না আসতেই গ্রামের মানুষগুলোর জীবনটা আর অতটা সরল রইল না। শহর থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয়দের মুখে ভয়াবহ সব ঘটনা শুনে আতংক যোগ হলো সেখানে।

মানুষগুলোর আশংকা খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে উঠল। যুদ্ধ শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামের দিকেই আসছে তখন। এসময়ই একদিন বাড়ির পাশের আমবাগানে রাবেয়াকে ডেকে পাঠাল যুবকটি, ‘ওপাড়ে যাচ্ছি ট্রেনিং নিতে।’

রাবেয়ার বুক কেঁপে উঠল। ওপাড় আর ট্রেনিং শব্দ দুটোর আড়ালে অনিশ্চিত ভয়াবহ সময় আঁচ করতে ভুল করল না সে। চোখের জল লুকিয়ে রাবেয়া প্রশ্ন করল, ‘কবে ফিরবে?’

উত্তর জানা ছিল না যুবকের । শুধু কেঁপে ওঠা কন্ঠ নিজের বশে এনে বলল, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার শুনিস, ওখানে আমাদের খবর পাবি।’

সেদিনের পর থেকেই ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওর ভূমিকা বদলে গেল রাবেয়ার জীবনে। সারাদিন অপেক্ষা করা রাতের জন্য। আর রাত এলেই রেডিও নিয়ে বসে পড়া। এরপর নব ঘুরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার খুঁজে বের করা। এই সময়টা ছিল সবচেয়ে উত্তেজনার…

সেদিনের পর থেকেই ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওর ভূমিকা বদলে গেল রাবেয়ার জীবনে। সারাদিন অপেক্ষা করা রাতের জন্য। আর রাত এলেই রেডিও নিয়ে বসে পড়া। এরপর নব ঘুরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার খুঁজে বের করা। এই সময়টা ছিল সবচেয়ে উত্তেজনার…

উজ্জল হয়ে ওঠা বড়োফুপুর মুখটায় পুষ্পিতার নিস্পলক চোখ আটকে যায়। বড়োফুপু খুব দ্রুত বলে চলেছে, মেগাহার্ৎজের লাল কাঁটা তিরতির করে কেঁপে স্টেশনটা ধরে। আর তা ধরলেই মনে হয়, সেই মানুষটার খুব কাছে পৌঁছে গেছে রাবেয়া। একের পর এক অনুষ্ঠান হয়। ‘রণাঙ্গনের সাফল্যকাহিনি’ শুনলেই রাবেয়ার মনে হয় সফল সে দলে নিশ্চয় সে আছে। আনন্দ বা গর্ব কোন অনুভূতি রাবেয়াকে ভাসিয়ে নেয়, তার ফারাক করতে পারে না। তবে সব সময় যে এমন হতো তা নয়।

যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর-এ শত্রুবাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যূর খবরে রাবেয়ার বুক যে কেঁপে উঠত না, তা কিন্তু নয়।

তবে এই আশংকা আচমকা একদিন ফুরিয়ে গেল…

বড়োফুপুর চেহারায় এখন অদ্ভুত একটা স্বস্তিবোধ। গলার স্বরে স্পস্ট উচ্ছ্বাস, ‘খুব গোপনে খবর এলো যুবকটি আসছে। একরাতের জন্য গ্রামে আসছে। বড়ো একটা অপারেশনের আগে নিজের আপন মানুষগুলোকে দেখতে চায় সে।’

সুতরাং, রাবেয়ার সাথেও দেখা হবে তার।

সবাইকে লুকিয়ে রাবেয়ার কাছে খবর এলো।

গ্রামের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির আমবাগানে সন্ধ্যার ঠিক আগে রাবেয়ার সাথে দেখা করবে সেই যুবক।

সবাইকে লুকিয়ে দেখা করতে গেল রাবেয়া। বাড়ি কেন, গ্রামের কোনো কাকপক্ষীও জানতে পারল না এ কথা।

কতদিন পর দেখা হলো দু’জনের। বড়ো চুল, অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় আর শীর্ণ দেহের যুবকটির শুধু উজ্বল চোখদুটোই রাবেয়াকে অদ্ভুত প্রশান্তি দিল।

কতদিনের কথা জমা হয়েছে তাদের!

কিন্তু ওদিকে খুব অদ্ভুতভাবে গ্রামে মুক্তি আসার খবর পৌঁছে গেল শত্রুবাহিনীর কাছে। এতদিনের জমানো কথা ভাগ করে নেবার আগেই শত্রুবাহিনী চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল যুবকটিকে।

‘আর রাবেয়া?’ পুষ্পিতার প্রশ্ন বড়োফুপুকে থামতে দিল না।

ষোড়শী রাবেয়াকেও মুক্তিযোদ্ধার চর বলে রেহাই দেওয়া হলো না।

‘এরপর…’

‘এরপর আর কী!’ বড়োফুপু থেমে গেল।

‘রাবেয়ার কী হলো?’ পুষ্পিতার নিজের মনে বলে ওঠা প্রশ্নের উত্তর এলো— ষোড়শী রাবেয়া সতেরোয় পড়ার আগেই যখন ক্যাম্প থেকে মুক্ত হলো তখন সে চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা।

বড়োফুপু কী একটু কেঁপে উঠলেন এটা বলার সময়? পুষ্পিতা বুঝে উঠতে পারল না। তবে বড়োফুপুর দৃঢ় চোয়াল আরেকটু শক্ত হলো : না, গ্রামের সেই বিশাল বাড়ি অন্তঃসত্ত্বা রাবেয়াকে বিতাড়িত করেনি। বরং যতটা সম্ভব গোপনে রাবেয়াকে রেখে পরিচর্যা করা হয়েছে।

রাবেয়া তখনো স্বাভাবিক। পরিবর্তনের মধ্যে শুধু মুখে কথার যোগান কমে গেছে।

সেই সময়েই কোনো একদিন সেই যুবকের মা রাবেয়ার কাছে এলো। উদ্ভান্ত্র সে মায়ের প্রশ্ন ছিল, ক্যাম্প থিইক্যা আমার বাজান কবে ছাড়া পাইবো রাবেয়া?

সেদিনই প্রথম ডুকরে ডুকরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল রাবেয়া।

তবে সেদিনই কিন্তু শেষ।

এরপর কী যে হলো? রাবেয়ার কান্না একদম থেমে গেল।

বড়োফুপুও গল্পের এই জায়গাতে একটু পর পর থামতে লাগল। যেন ভুলে যাওয়া গল্প মনে করতে হচ্ছে তাঁকে। থেমে থেমে বলে চলেছে বড়োফুপু— সে সময় সুযোগ পেলেই ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও নিয়ে বসে পড়ত রাবেয়া। মেগাহার্ৎযের লাল কাঁটাটা এদিক ওদিক করে খুঁজত স্বাধীন বাংলা বেতার, ওখানেই তো যুবকটির খবর পাওয়া যাবে।

কিন্তু রেডিওর লাল কাঁটাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর ধরতে পারত না স্বাধীন বাংলা বেতার স্টেশন।

কিন্তু রাবেয়া দমে যায় না। দিনরাত সারাক্ষণ ওই রেডিও নিয়েই পড়ে থাকে। নব ঘুড়িয়ে শুধুই খোঁজে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

বাড়ির সবাই বুকে পাথর বেঁধে সব দেখতে থাকে। অপেক্ষা শুধু রাবেয়ার সন্তান প্রসবের ক্ষণ।

হিসেব মতো আষাঢ়ের ভরা বর্ষায় রাবেয়ার সন্তানের কান্নায় সে বাড়ি কেঁপে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তা হলো কই? মৃত বাচ্চা বিশাল বাড়িতে কবরের নিস্তব্ধতা এনে দিল।

বড়োফুপুর কন্ঠেও এখন কবরের নিস্তব্ধতা। তবে তা বেশি সময় স্থায়ী হলো না। ‘তারপর?’ পুষ্পিতার এই শব্দটি চাপা পড়ে গেল বড়োফুপুর শব্দের তলে— এ বাড়ির নিস্তব্ধতা মেনে নিতে পারলেও রাবেয়ার পাথর হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারলেন না রাবেয়ার বাবা। তাই নিজের পাপের ফিরিস্তির বিনিময়ে মেয়েকে শাপমুক্ত করতে চাইলেন।

হ্যাঁ, সেদিন গ্রামে মুক্তি আসার খবরটা তিনিই নিজে ক্যাম্পে গিয়ে জানিয়ে এসেছিলেন।

এটা জানার পরেও রাবেয়া ভাবলেশহীন। কান্নাকাটি নেই, অভিযোগ অনুযোগ নেই, কারোও প্রতি ক্ষোভ নেই, শুধুই নিঃশব্দ চাহনীতে চারপাশ দেখত।

তবে সমস্যা হতো তখনই যখন যুদ্ধের বছরের কোনো কথা বা কোনো জিনিস তাঁর সামনে আসত। কী হতো কে জানে, খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ত তখন। চিৎকার করে বলতে থাকত ক্যাম্পের নির্যাতনের কথা।

তবে সমস্যা হতো তখনই যখন যুদ্ধের বছরের কোনো কথা বা কোনো জিনিস তাঁর সামনে আসত। কী হতো কে জানে, খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ত তখন। চিৎকার করে বলতে থাকত ক্যাম্পের নির্যাতনের কথা।

যা আস্তে আস্তে এতই বিব্রতকর হয়ে উঠল যে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতিকে রাবেয়াদের বাড়ি থেকে নির্বাসন দেওয়া হলো। যথারীতি একই ভাগ্য বরণ করল ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওটি।

তবে রাবেয়ার বড়ো ভাই, মেজ বোন বা ছোটো বোন কিন্তু স্বেচ্ছা নির্বাসন নিল সে বাড়ি থেকে। আর কারণ সেই এক। উত্তেজিত রাবেয়ার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা বিব্রতকর কথাগুলো। হয়তো এদের কারো সন্তানের নাম স্বাধীন বা কারোও শ্বশুরবাড়ির প্রায় সবগুলো পুরুষমানুষই রণাঙ্গনে না গিয়েই মুক্তিযোদ্ধার হালনাগাদ তালিকায় নাম তুলেছেন।

ব্যস্, এগুলো জানামাত্রই রাবেয়ার শুরু হতো বিব্রতকর আচরণ। এই আচরণই একে একে তাদেরকে এ বাড়ি বিমুখ করেছে।

আর এজন্যই মফস্বলী সেই বিশাল বাড়িটা এমন বিরান।

তবে রাবেয়ার স্বাভাবিক হয়ে ওঠার গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ। বিশাল সেই বাড়িতে তখন মানুষ মোটে চারজন। রাবেয়ার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্বা। কোনো এক আষাঢ়ে সদ্যজাত শিশুটির কান্নায় সে বাড়ি কেঁপে উঠতেই রাবেয়া দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল— কাঁদে না সোনা, কাঁদতে হয় না, এই তো মা এখানে।

রাবেয়া সত্যিই সেদিনের পর থেকে বাচ্চাটির মা হয়ে উঠেছিল। সেই মাতৃত্ববোধই রাবেয়াকে আস্তে আস্তে ফিরিয়ে এনেছিল স্বাভাবিক জীবনে।

তবে হুটহাট চিৎকার চেঁচামেচি করা, ক্যাম্পের নির্যাতনের বিব্রতকর কথাগুলো বলে ফেলার অভ্যাসটা কিন্তু থেকেই গেল।

গল্পটা শেষ হয়েছে ভেবে পুষ্পিতা বড়োফুপুর খুব কাছে এসে বসল। বড়োফুপুর হাত দু’টো ধরে বলল, ‘একাত্তর নিয়ে আমার কোনো গল্প জানা ছিল না বড়োফুপু। তুমি আর ওই রেডিওটা আমার কাছে একাত্তর।’

সেদিন দুপুরে স্টোর রুম থেকে পাওয়া ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওটা লাগেজে ধরাতে খুব একটা কসরত করতে হয় না পুষ্পিতাকে।

একাত্তরের গল্পটা লাগেজে পুরে পুষ্পিতা যখন দেশ ছাড়ছে, তখন বড়োফুপু না বলা আরেকটি গল্পের উৎস সৈয়দ আজমল আলীর মিথ্যে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রটা খুঁজে বেড়াচ্ছে মফস্বলী বাড়িটার আনাচকানাচ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরের শাহজাদপুরে। স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে সিরাজগঞ্জ শহরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর তিনি। ছোটোবেলা থেকে সাহিত্য অনুরাগী এই লেখকের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা-২০১৮ তে। পেন্সিল-জাগৃতি প্রতিভা অন্বেষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পগ্রন্থটির নাম ‘অলোকপুরীর ডাক’। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনটি। তিনটিই গল্পগ্রন্থ। বইগুলোর নাম : ‘অলোকপুরীর ডাক’, ‘অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ’ এবং ‘পার্পল জলফড়িং’।
লেখক স্মৃতি ভদ্র বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।