লাল বসন্তের গান
আমাদের পিতাকে যেদিন হত্যা করা হয়েছিল পেরেক বিঁধে, গাছে ঝুলিয়ে
তখন জেরুজালেমের রাস্তায় রোদন করেছিল যে সকল নারী, আমরা সাতভাই
সেই দলে ছিলাম। শুধু বোন, আমাদের একটি মাত্র বোন হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল।
লোকেরা বলেছে, তার চিৎকার শোনা গিয়েছিল মাঠের ওপারে আর
চিরে গিয়েছিল আকাশ, দুইফালি। সাক্ষ্য আছেন ধর্মপুস্তক।
হত্যাকারীরা যখন ফিরে এসেছিল নগরে রক্তচক্ষু নিয়ে
আমরা সাতভাই পালিয়ে বেঁচেছিলাম।
তারপর হায়! আমাদের পিতার হত্যাকাণ্ডটি গসপেল হয়ে গিয়েছিল।
আমরা সে গসপেলটি আমাদের নারীদের শুনিয়েছিলাম
রোদনভরাজ্যোৎস্নারাতেআর তারা গর্ভবতী হয়েছিল।
আমাদের নারীরা বলেছিল, ‘রোদন করো না দীন স্বামী,
তোমাদের সন্তানেরা ফুটবে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে লাল লাল ফুল হয়ে লাল বসন্তের দিনে।’
দ্যাখ আমাদের নারীরা আমাদের সত্য বলেছিল।
ঘর
একটুখানি ঘরের জন্যই তো
আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়
ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়।
দিগন্ত বিস্তারী আকাশও আমাকে এতটা
খোলা স্থান দিতে পারে না, যা পারে ছাদের নিচের এতটুকু।
আমি দশ ফুট বাই দশ ফুট ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত।
বৃক্ষকে সকলে প্রশংসা করে ছায়ার জন্যই তো?
অথচ কতই তুচ্ছ সে তোমার আঁচলের কাছে
আমি তোমার একটুখানি আঁচলের ছায়ার জন্য
কত না দ্রুত ঘরে ফিরি ফেনা, রক্তমাখা পায়।
শান্তা।
নগর দুয়ারে গৌতম
নগর দুয়ারে কারা হাসে কাচঝরা
তারা কি জরা, মৃত্যুকে দেখেনি?
দূর থেকে ধেয়ে এসে অগ্নিনদী
এ জনপদ মুছে দেবে
কালোজ্বরে কাঁপিয়ে মেদিনী
সকল মন্দির ভেঙ্গে দেবে
আর মৃত্যু মৌমাছির মত
শুকনো কালো ডানায় উড়ে এসে
নিয়ে যাবে ছায়াপ্রাণ
নগর দুয়ারে কারা হাসে কাচঝরা
তারা কি মৃত্যুকে দেখেনি?
যযাতিও ফের ফিরে পেয়েছিলেন পুত্রের যৌবন
অবশেষে জরা তাকেও নিল
আজও মহাভারতের শুকনো পাতায় পাতায়
জেগে আছে তার হাহাকার।
নগর দুয়ারে কারা হাসে কাচঝরা?
জ্ঞান নদী পারাপার
গুরু পার হবেন জ্ঞান নদী।
আমরা এসেছি আজ নদী তীরে
দেখে ঢেউ থরহরি, উপরন্তু শীত।
আমরা তীরে বসে গুনছি ঢেউ আর
ভাবছি জলের মধ্যেই আছেন মৎস্য কন্যাগণ
আমাদের পাঠে মোটেই মন নেই।
কী করে পার হবো জ্ঞান নদী
গুরুই হাবুডুবু।
আমরা শর্টকার্ট পারের কথা ভাবছি।
ওই যে দূরে রাখাল বালক, তাকে ডাকো
সে বনিয়েছে ভেলা কলাগাছের
তাই চড়ে ওপারে যাবো, জ্ঞাননদী পার হয়ে।
আমরা এসেছি জ্ঞান নদী পার হয়ে
দ্যাখ, জল কাদা কিছুই গায়ে লাগেনি।
পথ্য, তরুণ কবিদের
ক্ষুধার্ত করে তোলো, হাংরি রাখো নিজেরে
যেন এই বনে, পাশের লোকালয়ে কোনো রক্তমাংস নাই।
সেই স্বাদ মনে করে জেগে ওঠো
নরমাংস ভক্ষণের।
যেন বহুদিন তুমি খুব অনাহারেনিপতিত
দুঃখিত মাংসাশী ঘাস পাতা খেয়ে করছো যাপন
লজ্জা আর ক্রোধের জীবন।
নিজেরে আগ্রাসি করে তোলো, শিকারে। ক্ষুদ্ধ করে তোলো
গেঁথে চলো সেই সকল হরিণের ছায়া, পথরেখা যে দিকে গেছে
আর নখ লুকিয়ে খুব নরম পায়ে হেঁটে চলো গহন বনপথে।
নিজেরে তৃপ্ত করো না। কিছুতেই। না কিছুতেই
তবেই না ধরা দেবেন তোমার পাতায় দেবী, অমরতার।
উনুনের পাশে শীত
উনুনের পাশে বসে আছি, জবুথবু
নাচিছে প্রেতিনী, ডাকিনী, যোগিনী, বহাভূতগণ গগণবিদারি
তবু শীত নাহি যায় আজ এই রাতে।
এই উনুনের সাথে যোগ আছে হাবিয়া দোজখের
যতসব মাতৃগামী, সমকামি, অনাচারি, ব্যভিচারিগণের শিৎকার ভেসে আসিতেছে
দপদপ পুড়ার ফলে সাতগুণ আগুনের।
যুক্তিতর্কও শোনা যাচ্ছে জ্ঞানফল, সক্রেটিসের, আবু লাহাবের।
এইসব যুক্তিতর্ক, শিৎকার আর আগুনে বহে যাচ্ছে শীত, আজ এই রাতে।
শিকারি
মাথায় পালক নিয়ে এই অসময়ে বেরুনো কী ঠিক হবে?
চারিদিকে আগুন নদী, পথঘাট অগ্নিবাতাস।
যারা গিয়েছিল অন্ধ পাখি হাতে কোড়া শিকারে
ফিরেনি। রক্তের ঘ্রাণ বাতাসে
চাপ চাপ ছড়িয়ে আছে।
পিতা প্রপিতামহ খেয়েছে বনের বাঘ
আমি সামান্য ভগ্নস্বাস্থ্য বালক, দু’হাতে কী আর আগলাবো
রক্তমাখা দাঁত, নখর, বাঘডাক।
নাকেমুখে বনের কাঁটা, পাতা লেগে আছে
কাঠুরিয়া শক্ত কুড়ালে কেটেছে বৃক্ষকোমর
অরণ্য হাত পা ছড়িয়ে বনের গায়ে পড়েছে
আমার শুধুই অরণ্যবাস,না কাঠুরিয়া, না শিকারি।
নারী এবং হরিণমাংস খেয়েছে যারা, জিহ্বা পাতালব্যাপী
নারীর গর্ভে জন্ম মাগো, পিতা ছিলেন হরিণ শিকারি
ব্যাধের সংসারে জন্ম বধু বংশসুতোবুনে
আমার হাতেই দিয়েছে তুলে তীরধনু পাখির পালক
এই অসময়ে করাল বনে কার কাছে আত্মা রাখি?
পাখিরাত
মধ্যরাতে চুপিচুপি তার চুলে সুর তুলে দেখি
উড়ে এসেছে হাজার পাখি
খাঁচায় ধরা দেয়া পাখি আর ঘাসেদের সেই ঘনরাত।
এমনি তাকে লোহার সিন্দুকে ভরে দিয়েছিলেন অবিশ্বাসী পিতা
দুটো শস্যদানা নারকেলের খোলে
দেহের উত্তাপে ক্ষুণ্ন মিটিয়েছি।
শিয়রে মোমবাতি জ্বলে
আমরা জ্বলি দেহের আগুনে
আগুন আগুন খেলা অর্ধরাত।
তারপর মধ্যরাতে দিঘির মতো সে চুপচাপ।
আমি সংগোপনে যেন পাখি প্রিয়
বাঁশি প্রিয় মাঠের রাখাল
হাওয়া এনেছে বয়ে কি যে হাহাকার
মায়ের স্মৃতি মনে রেখে
তার চুলে সেই চক্ষু করেছি গোপন
অমনি খুব মৃদু পায়ে সুর এলো
চুলের ভেতর কণ্ঠে তুলে নিল গান
উড়ে এলো হাজার পাখি, আহা উড়ে যাওয়া পাখি।
গুহাবাস
বৃষ্টির ফোঁটা চুলে নিয়ে গুহায় ফিরেছি। দুঃখতাপ উড়ছে কু-লী পাকিয়ে। সলতেটা আরেকবার উস্কে দিতে চাই। জ্বলছে চর্বি গলে গলে অন্ধকার; আলোর পিঠে কাঁপা কাঁপা। শোনাও বন্ধু মন্ত্র হরিণধরা, সুরা আল বাকারা মেঘের কাপড় আমার দু’চোখে। অন্ধতা নিয়ে কার কাছে যাবো, কে ফেরাবে নপুংসতার অহং শব্দব্রহ্ম, শব্দ সাজাই কাঠের কারুকা, পালং ছুতার মিস্ত্রি।
কি কবিতা লিখে গেলেন গুরু? ঘুম ভেঙে যায়। অতৃপ্ত বাসনায় ভিজে উঠা রাতের পোশাক ফেলে হামাগুড়ি দেবো, ডাকলো দেখ রাপসোদাই। তিনবার। ঘুম থেকে গীত ভাল, হাঁটু ভেঙে জমিনে গড়াই।
এই বুঝি হাতের তালুতে লেখা ছিল, তাম্রলিপি।উলুখাগড়ার দেহ নিয়ে উড়ে উড়ে যাওয়া-মন্ত্রে বেঁধেছি দেহ আচমন শেষে শরীর পাতন।
বৃষ্টির ভেতর উস্কানি থাকে পদাবলির। ভক্তিমার্গ, রাধাগীত। এই শব্দে সঙ্গম সাজাই।
শিষ্যবচন
ট্যাবু দিয়েছেন গুরু, প্রসাদভাগ না দিয়ে কেমনে খাই। ভিক্ষা মাগি দ্বারে দ্বারে, দুগ্ধবাটি উল্টো করে দাও। রমণীরা বেঁধেছে স্তন কাঁচুলিতে, গুরু তোমার ভাগ কোথা পাবো?
এতোদিন লতাপাতা, আকন্দকষ, গাভীদুগ্ধফেনা খেয়ে বেঁচেছি। আজ গভীর পরিখায়। চক্ষু দু’টি কই? নাম ধরে ডাকো গুরু, নামধরে ডাকো, তোমার রাস্তা যেনো দেখিতে পাই।
কী হবে গো আমার, কে তরাবে পার, লকলকে অগ্নিমালার মাথায় ঝুলবে সুতো এই নাকি পথ, মহিষ পিঠে ফিরবেন মাতা, পুত্র তার আঁচলে কি উপায়ে পাব বলো ঠাই?
গিয়েছিলে চিল্লায় অনুপস্থিতির সকল দায়ভার আমায় দিয়ে। পত্নি তোমার এইকালে রজঃশ্বলা হলো। করিনি ভোগ, রীপু স্বমেহনে ভুলেছি।
এইবেলা শুধু নাম ধরে ডাকো গুরু, অন্ধ আজ পড়ে আছি গভীর পরিখায়।
কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল মৌলভীবাজার জেলায়। পড়ালেখা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ও পাঠ গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুকতাই থাম্মাথিরাত ওপেন ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড ও কুইন্স ইউনিভার্সিটি, কানাডা থেকে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘কাঠ চেরাইয়ের শব্দ’ [১৯৯৬], ‘দুঃখ ছেপে দিচ্ছে প্রেস’ [২০০৩], ‘ডিঠানগুচ্ছ উঠানজুড়ে’ [২০১০], ‘ঘোর ও শূন্য জলধিপুরাণ’ [২০১৭], ‘প্রাচীন পুঁথির পৃষ্ঠা হতে’ [২০২০] উল্লেখযোগ্য। তাঁর রয়েছে শিক্ষা বিষয়ক উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু। কাজ করেছেন জাতিসংঘ শিশু তহবিলের শিক্ষাপরামর্শক হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডুকেশনের অধ্যাপক।