চর্যালোক
১
সেই ভোর হতে চাইনি, যে ভোরে নেই সূর্যোদয়
যে স্মৃতিতে আলো নেই, সে স্মৃতি থাকেনা হৃদয়।
২
উজ্জ্বল স্মৃতিরা ঘাই মারে সব তারা নিভে গেলে পর
আমিতো শুকতারা, দিনেও জেগে থাকি, আলোর ভিতর।
৩
হারানো স্মৃতির সাথে দেখা হয় যদি আর
তাকে নিয়ে সন্ধ্যা নদীর ছায়ে, শুধু বসবো একটিবার।
৪
গোধূলি হতে ও রাজি অস্তমিত সূর্য নয়
কিছু স্মৃতি গোধূলির মত, হৃদয়ে উহ্য রয়।
৫
মিলনের বাসনা, মিলনের চেয়ে উত্তম নয় কি ?
লায়লাকে দেখো, দেখো বেহুলার মন–একই কথা কয় কি!
সমুদ্র খালি পায়ে চলে আসে অন্দরে
তাঁতিবউ শাড়ির পাট খুলেছে
অর্ধেক ভিজেছে জলে
দেখেছি কিংবা দেখিনি অসম্ভব কৌতূহলে।
ও পাড়ার তাঁতিরা স্বপ্নবিমুখ
প্রজনন মৌসুমে মুমূর্ষু, আশ্রম খোঁজে;
এ পাড়ার কৃষাণীরা দুঃখের আফিঙ কন্ঠে
ছায়াপর্ব-ছায়ারাত ভালবেসে নিষিদ্ধ সুখের
বৃত্ত ভাঙে, মধ্যবিত্ত মন, জানে না কিছুই
শুধু-শুধু ঈর্ষা আর পলায়ন।
আমি দেখি বিবর্ণ সাদা হাঁস উজান
সাঁতরায়, আর সমুদ্র খালিপায়ে চলে আসে
তাদের অন্দরে, চারদিক নোনাজল—
হাঁসের ঠোঁটে সময়ের ছায়া, অথচ
পায়ে পায়ে আলতারাঙানো—
বিজয়া-বিজয়া।
আমি এক সাগরে ভাসা ক্রীতদাস
এই সমুদ্র মায়ার, এই সমুদ্র ধাঁধার
ক্রীতদাস— ক্রীতদাসী হয়ে এই সমুদ্রে ভাসছে
আমারই মা-ভাই-বোন
অভিবাসী স্বপ্নে বিভোর, সাঁতার না জানা এ-সব স্বজন।
শ্বেতপদ্ম হাতে জন্মেছিলে, মুক্ত-স্বাধীন দেশে, আমার মতন।
গভর্মেন্ট ফেরারী এখানে, বুদ্ধিজীবীরা বাকুড়ার পুতুল সকল
ক্যাফে জ্বলছে, চলছে সংসদ; বারে নাচছে বয়সী বেশ্যা
মুদ্রা জমছে কতিপয়ের হাতে, যারা মানুষ নামে নকল।
স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে নীলজল, সাক্ষী টুনা-ফিস, হার্পুন মাছ
শ্রম লুট হবার আগেই শরীর হারিয়ে
বসে আছে যেন মৃত অক্টোপাস।
চোখ টিপে হাসছে আন্দামান, আচেহ প্রদেশ;
রক্তের ঢেউগুনে দুঃস্বপ্নের স্বদেশ; থ্যাতলানো সময়
রক্তপায়ী দালাল ঘুরছে যেন মৃত দূত করছে প্রণয়।
ও ফুল গ্লাডিওলাস, তুমি কি গ্লাডিয়েটরদের চেনো?
যারা ভাসছে মালয় সাগর আর আন্দামানে
অমিও যেন ভাসছি তাদের সাথে, তারা কি বেঁচে আছে এখনও?
মৃত্যু জাদুকরের মুখের ভিতর লুকানো এক শকুন
ঘুমের ঘোরে পরজন্মের কাফনের পাখি ওড়ে মনে আমার
শোনো প্রণয়িনী পাখি ওগো বুবুন
ওড়ার ঠিকানা জানা নেই যে পাখির ডানার
সেই পাখি আমি; দেখো ওরা ভাসছে অথৈ নোনাজলে
আয়ু রেখা মুছে গেছে যার, স্বপ্নজীবী চোখের গভীরে
সে যে নিহত শিকার।
স্ক্যান্ডাল
কত কত গুজব তোমায় নিয়ে, কত শত স্ক্যান্ডাল
তোমার চাঁদ দুটো নিয়ে অনেক গল্প ছড়ালো
পাড়ায় পাড়ায়, মাঠে চাঁদ কেমন কেমন
জোছনা ছড়ালো একা একা; সবুজ মায়া…
তোমায় নিয়ে পুরাকালে মূর্তি বানানো ছিলো
সে সব মূর্তি দেখে কেউ কেউ বললো,
এ-তো রাধার, গোপন শৃঙ্গারমূর্তি
কেউ বললো অষ্টাদশী নয়, এ তো কিশোরীলো
পহেলা শ্রাবণী, কেউ বললো মা-কুমারেশ্বরী
এসো তোমায় প্রণাম করি, কেউ বললো
ওকে তো চন্দ্রিমা উদ্যানের মূল ফটকে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি…
আরে ওতো আমার সাধিকা
কেউ কেউ বললো, ওতো পদ্মাপাড়ের মেয়ে
জেলেদের ঘরেই বেড়েছে, দেখছো না? নাকছাবি
প্রবাস থেকে কে একজন চিনে ফেলেছে তোমাকে!
সে নাকি দেখেছে লেক অন্টারিয়র পাড়ে একা,
…বিষণ্ন একা।
একজন এসে দাবী করে বসলো, সে তোমার
আপন মানুষ; তোমাকে নিয়ে অনেক কথাই হলো
অনেক ভালোবাসাবাসী হলো; পাহেল গাঁও থেকে
অচেনা এক পাখি এসে জানিয়ে গেল
তুমি কে আমার।
তুমি একটুতে ভেঙে পড়, একটুতে জল
কলঙ্ক গাছের দিকে তাকাতে ভয়
চেয়ে দেখো কলঙ্ক গাছেতে ওই
ঝুলে আছে, বেহেস্তি-ফল।
তোমাকে নিয়ে অনেক কথাইতো হবে
অনেক কথাই হয়, অনেক অনেক কথা…
তাকিয়ে দেখো তোমার এক বুকে মধুমতি
অন্য বুকে জ্বলে সন্ধ্যাতারা।
হীরামন পাখি
শুষ্ক কাঠের মতন ঠোঁটখানা কেন মেলে দিলে
গোপনে, কৃষ্ণনদের দুপাড়ে সবুজের জোয়ার
তখন; ভাইসা যাচ্ছে সময়, ভেসে যাচ্ছে অনন্ত,
টিনএজ সময়ের অন্তরালে শীতলক্ষ্যা জলে
ওদিকে অচ্ছুত বৃষ্টিজল গায়ে মেখে হীরামন
পাখি ওড়ে, কবির অন্তরে; কখনো কখনো ভাবি
রূপকথা নয়, ট্রোজান যুদ্ধে হেলেনের ঠোঁটে
যেন প্রশান্ত মহাসাগর, অশান্ত হয়ে দোলে
এশিয়া মাইনর হয়ে হস্তিনাপুরে দ্রৌপদীর
আঁচলে; ও ঠোঁট তোমার লক্ষ যুগের আধিয়ার।
চোখ খোল মেঘ, দেখোতো চলন্ত ট্রেনের শব্দের
ভেতরে, পূর্ণিমা তিথি হয়ে মনে হীরামন ওড়ে
শেষ বিষে দুলছি তুমি আমি হাস্যকর পুতুল
তবু অচেনা নদীতে নামি, অন্তিম আলোর খোঁজে
যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে-১৭
মৃত নগরের ছবি বেনামী চিঠির খামে ভাইসা আসে অদৃশ্য রাত্রির উড়ন্ত পেখমে, গ্রীষ্ম নামে চন্দ্রবোড়া সাপের ফণায়, ছেলানো নেড়ি কুত্তা কিংবা কাকেদের গণসংবর্ধনা শ্যাষে নেতা নামেন ঘুমের ভাষাবিজ্ঞান হাতে, তন্দ্রা পাহাড়ের উপতলে। জুয়াড়ীর বোর্ডে তাসের মতন আমরা ঘুম সঙ্গীত গাই— হিংস্র পশুর রোমশ বুকে মাথা রাইখা কে কবে ঘুমাইছে, ঘুমায়; নর্তকীর মুদ্রার তালে দেহ নেভে জ্বলে, আসলে কি দেহ আছে, দেহ নাই। চন্দ্রবোড়ার গতর ফুইশা কোন চান ডাকে আমাগোরে, এমন গ্রীষ্মরাতে? আন্দার ঠেলি যত, ভালোবাসা পিছাইয়া যায়, ভালোবাসাও নাই তথাগত। মুর্শিদি মদির রাইত নাই, বাংলার অন্তঃপুরে ধুতরার চাষ। পুঁজ রঙের নাহান ঝরে সব; অন্ধ গলিতে তার ছেঁড়া দোতরার বর্ণহীন সুর এখানে ধূলায় গড়ায় সাধারণ মানুষের শব। অচল আধুলির দামে আমাদের অন্তঃপুরে বৈধব্য-সন্ধ্যা নামে, গুমোট হাওয়া, চিমনির ধোঁয়া-ভরা রাত নীরব পাঁচালি লেখে ইটের ভাটায়।
যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে-২০
আহারে! দোয়েলা; রাত্তির আমার, একলা পরান! কার ভিডায় কান্দো নরমকণ্ঠী পাখি, কার প্রশ্রয়ে ভিজাও মন, কার ঠোঁটে কাঁপে অনুভূতির প্রথম চুম্বন, কোথায় তোর বাউড়িয়া গাঁ, খাডালের ছিট ছিট জোছনা— রৌদ্রে কীরহম তোর চলাফেরা মনে পড়ে, মনে পড়ে না? কৈশোরের বেশ কিছু দিন পর, তোর সাথে বাইন্ধা ছিলাম ঘর, সাক্ষী ছিল হাওর-বাঁওড় আর দেবীঘাটার চর, আরো ছিল ম্যাগলাকাটা আকাশ; হেদিন কুলহারানো হাওয়া; এরপর, কতবার সুশীল পাটিনীর খেওয়া কত্ত কত্ত বার হয়েছি পাড়, তহন ঢেউয়ে ঢেউয়ে জাইগাছি তোর বুকের ভিতর, এহন তুই ক্যামন আছো, কোনহানে তোর বাস, রোদ-পোহানো পাখির নাহান নিভৃতে কি যাস? বেইন্নাবেলা এখনও কি দক্ষিণ দুয়ার খোলো, পারাভাঙা ধানের বীজে মন কি তোর করে এলোমেলো, দুপারকালে ঘুঘুর ডাহে কাঁপে যহন হোগলপাতার ঘর, ভাডারটানে দেখো কি তুই নারাকুডার খর, বাইচা নাওয়ের ভাঙাগুরা পইরা রইছে সব, ও দোয়েলা? তোর মতোই সব একেলা পদ্মাতেও জাইগা গেছে বিশাল বিশাল চর; সব নদীরই এমনই হাল বেপরোয়া দেশ, অদূরকালে পানির অভাব, বিষাক্ত শ্বাস! কী কমু মুই, চাইয়া দেহি নিমের গাছ কাইটা সবাই বাঁচায় পরিবেশ!
যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে-২২
মন ভালো নেই, চারদিকে সাদা অন্ধকার, চোখ খুইলা ঘুমাই। কোথাও গাঢ় অনুভূতি নেই, মাতাল বাতাসের দগদগে স্পর্শে ঠোঁট পুইড়া যায়, ডাহুকী স্বভাবের সেই নারী উইড়া গেছে বাঁকা জমির আঁকা আইল ধইরা দূরের কোন গাঁয়। সেইদিন থেইকা মধ্য দুপুরে বৃষ্টি আসে না; বৃষ্টিপাড়ায় সুখের রৌদ্রকণা আমার চোখে ধরে না গীতিমুখর সেই ডাহুকী শরীর আমার কচুরিপানায় আশ্রয় খুঁজে নাই। লাগাতার বর্ষার দিনেও নির্বোধের নাহান এহনও তার লাইগা ঘর সাজাই। এও জানি এখন সে মৌর্য আমলের চিত্রশোভিত নীলগাই।
হৃদয়লিপি-ঙ
আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে কত পুড়েছি মন
ঘুমের মধ্যে কারা জেব্রারক্ত ঢুকিয়েছে শরীরে
তুমিও জানো না যে, দেশলাই জ্বালিয়েছো কখন;
শুধু ছুটতে ইচ্ছা করে তোর ভূমি থেকে প্রান্তরে।
তোর কফিতে চুমুক, এ বছর বৃষ্টি হবে খুব
তোর মনকে কখনও দুর্গম দুর্গ মনে হয়
আমাদের স্বর্গ এই দেখো সেনেটোরিয়ামে চুপ
দৌড়ে ঢুকতে গিয়ে গলিতে আটকে যায় সময়।
জোছনার পায়ে চুমু খেয়ে তোকে ভাবি একি বিস্ময়
পুরানো বুটজুতার মধ্যে জন্মেছে সাদা ইঁদুর
ভিখিরির মতো রহস্যহীন কেন করি অভিনয়
লুকানো হাসি মাঝে ঈশ্বর হাঁটুমুড়ে চায় প্রণয়
আন্তরিক ভাবে প্রেমিক প্রেমিকাদের বলি শোনো
ঠোঁট ঠোঁটকে বিশ্বাস করে না কখনো কখনো।
নীলডুমুর
পৃথিবী সৃষ্টিরাতে নীলডুমুরের একটি হাতে
তোমার ছবি—অন্য হাতে আমার হৃদয়
দু’হাজার দুই অন্ধ বিকাল শ্মশানঘাটে নষ্ট হলে
ঈর্ষাতুর পতঙ্গেরা সহর্ষে নাচন তুলে, ফসিল ভেবে
ফেলে রাখে পাহাড়ের ওই বরফ চূড়ায়
এতদিনে মেঘলাকাটা ছায়া আমার
দাগ কাটেনি তোমার ভিতর
নদীরা অন্ধ বলে ভাঙনের রূপ দেখে না
শীতের এই শান্তবেলায় গোধূলিমা
আনমনা মন দাগ কাটেনি তোমার হৃদয়
কুড়ানীর গন্ধঘামে ঠুমরি তালের ছন্দ ভুলে
তেঁতুল ছায়ায় বিঁধে রাখি আমার প্রণয়
শামীম রেজা একইসঙ্গে কবি, কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর জন্ম ২৩ ফাল্গুন ১৩৭৭ (১৯৭১ সালের ৮ মার্চ), বরিশালের ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়ার জয়খালি গ্রামে, মামাবাড়িতে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘নিম্নবর্গের মানুষ : বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কবিতা-তুলনামূলক আলোচনা’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট’; বর্তমানে এর পরিচালক তিনি। শামীম রেজার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘পাথরচিত্রে নদীকথা’, ‘নালন্দা, দূর বিশ্বের মেয়ে’, ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’, ‘হূদয়লিপি’, ‘দেশহীন মানুষের দেশ’ ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০৭ সালে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রবর্তিত ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কার লাভ করেছেন।