পুরুষ
বহন অযোগ্য এক ভার এই পৈতৃক ‘পুরুষ’ পরিচয়, একে নিয়ে চলে ফিরে খেতে হবে আরো কিছুকাল, এই গ্লানি মনের গভীর থেকে ক্রমশ নিস্তেজ করে দেয়
চারিদিকে রমরমা যৌনহিংস্রতা দেখে কেঁপে উঠি, খ্যাপে উঠি, পুরুষ আমাকে আজ ঘৃণা করি, থুথু দিই
আজ আমি কামনারহিত হয়ে খেলা করি বেণী নিয়ে মেয়েপুতুলের
হয়ে ওঠা বিষয়ে একটি দার্শনিক অনুধ্যান
এক আশ্চর্য হাওয়ার রাতে চাঁদের গুহামুখ থেকে যেভাবে আঠালো বর্জ্যরাশি গড়িয়ে পড়তে লেগেছিল লবণজলের ’পর এবং যে গূঢ় গোপন রাসায়নিক ক্রিয়ায় সমুদ্রকে ঢেকে জন্ম নিয়েছিল শক্ত ও কঠিন ঘন আস্তরণ এবং যে নিয়মে সবুজ এসে গ্রাস করেছিল ক্রমে ঊষর প্রান্তর, আমি সে খায়েশে এক ফোঁটা বর্জ্য ঢেলে বলি, ফুটে ওঠো ক্লেদজ কুসুম, বলি জেগে ওঠো ফল ও বীজের সম্ভাবনা
প্রতিটা হয়ে ওঠাই পদার্থিক, চিৎকৃত মূর্ছনায় সব সৃষ্টিই মোচড় দিয়ে ওঠে জোরে, পৃথিবীর কান্নার শব্দ যেমন সমুদ্র শুনতে পেয়েছিল একদিন, আমি সব নড়চড় তেমনি টের পাই তোমার
হয়ে ওঠো, ঘন সরের মতো সাদা দুধের সংসারে ধীরে জমে ওঠো আধারের গায়, সব কোলাহল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমি জেনে নেব কান পেতে সুরম্য ওলানে
পুরুষের ধর্ম
নারীমানুষের ধর্ম আছে, নারীশরীরের নেই
সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ খুব নারীর শরীর, জাতপাতহীন
জাতপাতে অন্ধ ধর্মঅলারাও ধর্ম খোঁজে না বিশেষ শরীর পূজায়
পুরুষের ধর্ম বড়ো বিচিত্র জিনিস
শৈলগীতি
কাঁধে এসে ভর করো হিম শৈলচূড়া
বুকে যে পাথর আছে আত্মার ফসিল
তারে শক্তি দাও— তোমার অতলে আছে
চোরাহ্রদ— তারে বলো অনন্ত প্রবাহ
দিক— পাতাল সূর্যের থেকে ধরে আনে
যেটুকু আলোক— কোষে কোষে দিক সেঁধে
তারে বলো গান দিক ঠোঁটে হাসি দিক
গতপ্রাণ জেগে হোক পৃথিবী আদিম
পাহাড়ে পাহাড় গাঁথা চির অবিনাশ
বৃক্ষে বৃক্ষ সাঁধা অনন্ত সবুজ বীথি
বাণীময়— মাটির আকুল করা ঘ্রাণে
খুলে যাক দপাদপ বুকের কবাট
বরফের গাঢ় চুল ছুঁয়ে আসা রোদ
মেঘের হেঁয়ালি বোঝে সবচে’ সুবোধ
খতিয়ানবই
নিরাশার ঘটে আগুন জ্বালাব বলে প্রস্তুত হয়েছি এমন প্রতিজ্ঞা
প্রতিজ্ঞা ভেসে যাচ্ছে পরিপার্শ্বের অসহযোগে এমন জমানা
জমানা পুঁজির দাস তার হাতে মার খেয়ে মরছে এমন স্মৃতি
স্মৃতি থেকে সব শব্দ উধাও হয়ে গেছে ত্রাসে এমন মুহূর্ত
মুহূর্ত ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো মিশে গেছে নয়ানজুলিতে এমন বিস্ময়
বিস্ময়াঘাতে পাতাল মাথা তুলে বসেছে আকাশে এমন দুর্যোগ
দুর্যোগ মানে নিজের সাথেই ঝগড়া ও বনিবনা এমন বোঝাপড়া
বোঝাপড়াগুলো মননিরপেক্ষ ও শরীরঘেঁষা সুর এমন কল্পনা
কল্পনার লেজ ধরে টেনে নামাচ্ছি মাটিতে বাস্তব এমন কৌশল
কৌশল মেরে মেরে জোড়া জোড়া পুরছি খাঁচায় এমন বাহাদুরি
বাহাদুরি মানে বেঁচে আছি তবু সন্নিপাতের রোগী এমন পরিণতি
পরিণতির ঘায়ে কাত হয়ে গেছে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা এমন নিরাশা
একাগাছ
শালজঙ্গলের কোনো জেরক্স হয় না
পোড়োবাড়ির কোনো সারাই হয় না
আমাকে আধলে রেখে উড়ে গেলে তুমি
পোড়োবাড়ির ধারণা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বাতাসে বাতাসে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে
মাঠের ভিতরে থাকা একাগাছ যত দেখি
শূন্যতার তত বেশি পড়ে যাই প্রেমে
গোড়ার জল কী দারুণ আগলে রাখে
থমথমে কালো ছায়া
একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে
ধুধুপথে হাঁটা দেব শূন্য অভিলাষে
তুমি জেনে রেখো
সাঁতার
সাঁতার শেখো নি বলে ভর্ৎসনা কখনো করি নি
জানি নদীই দেখে নি এক জীবনে— এমন
ভূরিভূরি লোক আছে
এই নদীমাতৃক দেশেও
স্বপ্নে তোমাকে যেদিন সাঁতার শেখাচ্ছিলাম
বিছানায় বয়ে গেছে জলের প্রবাহ— নদী
ধরে ধরে ব্রেস্ট স্ট্রোক ব্যাক স্ট্রোক
সযতনে দিয়েছি শিখিয়ে
তোমার হাত পা নাড়ানো চাড়ানো দেখে
ঘন ঘন শ্বাসাঘাত শুনে
মনে হয়েছিল তুমি
এ যাত্রা সাঁতার শিখে গেছে
দিব্যি
চিত্রকর
স্তন হাতে এগিয়ে আসছে নারী চিত্রকর
রংতুলিযোগে তাকে শুভ সম্ভাষণ
দীর্ঘ প্রজননঋতু পার করে এসে দূরের বন্দরে
আজ তাকে বলব ভাবছি নৌকা বাওয়ার কথা
রতিজাহাজের পণ্য খালাসের দৃশ্য দেখে দেখে
নিজের ভেতরে জমা পণ্যপ্রায়
বিরল বাসনা খালাসের একটা ইচ্ছা
জেগেছিল মনে পড়ে
আজ আমরা চুমুর একটা ছবি এঁকে নিয়ে
ভেসে যাব আমাদের যৌথ বাসনার জলে
রতিবিছানায়
অল্প অল্প করে এগিয়ে যাচ্ছি তোমার রতিবিছানার দিকে
পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা আকাশ যেমন হাতছানি দিয়ে ডাকে
তার সম্পূর্ণ নিবেশের দিকে
তেমনি তোমার অল্প আগুন আমাকে টেনে নিতে চাইছে গভীর বিবরে
এর মধ্যে ক্লিশে বসন্ত বাতাস এসে নাড়িয়ে দিয়েছে
আমার সুরভিত ধ্যানজ্ঞান
ধ্যানজ্ঞান ও ধ্যানের জ্ঞান যে দুই ভিন্ন জিনিস
তা মনের ভেতরে চশমা ছাড়া না তাকালে
কখনো জানাই হতো না
তুমি আলতায় রাখো পা
আমি মুছে দেব কামনার সাদা টিস্যু দিয়ে
ধূলি ওড়ানোর ভঙ্গি
ভঙ্গিটাই মূল, বুঝে গেছি
কথা সব একই প্রায়
পার্থক্য শুধু হাড়ের সাথে অস্থির
পানির সাথে জলের
প্রত্যেকের মনে একটা করে সম্রাটের আসন থাকে
উঁচু ও নকশি করা
ওই গৌরব নিয়ে তারা হেঁটে হেঁটে চারপাশে ধূলি ওড়ায়
সাদা পথিকেরা নোজ মাস্ক পরে পথে বেরোয়
ধূলি ওড়ানোর ভঙ্গিটাই আসল
ধূলি সব একই
ক্লিশে
জন্ম ৩ জানুয়ারি ১৯৬৯-এ, ময়মনসিংহে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। একটি অধিকারভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণা— নানা মাধ্যমে নিরলস কাজ করে চলেছেন এই কবি। লেখালেখির ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনকে। কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা ও অনুবাদ মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। ২০১১-এ পেয়েছেন লোক সাহিত্য পুরস্কার।