আধুনিক পোড় খাওয়া জীবনের ড্রয়িংরুমে ছোটোগল্পের শারীরিক কাঠামোর অনেক বদল ঘটেছে। ছোটোগল্প যেন দিনে দিনে হয়ে উঠছে মানুষের ভেতর বাড়ির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনাবলির তীর্যক অনুভূতির প্রকাশ। আস্ত একটি মানুষ কাচের টুকরার মতো চুরমার হয়ে ভেঙে ফিরে আসছে এক নতুন মানুষের আদল নিয়ে। সেই মানুষ আধুনিক চিন্তা চেতনার অমূল্য সম্পদ। বাইনরি দৃষ্টির ফ্রেমে সেই মানুষকে বন্দি করে দাঁড় করানো হচ্ছে এক মহাসত্যের কাঠগোড়ায়। স্বপ্ন-বাস্তবতা, জীবন নাটকের মহড়া, ঐতিহ্যের নিপুন স্মৃতিচারণ, প্রাণী ও মনুষ্য জীবন এসবই যেন এক একটা খেল্ মাত্র। আলোচ্য গল্প ‘স্বপ্নচোর’ গল্পটি পড়তে গিয়ে এমন এক অনুভূতির জন্ম নিয়েছে আমার ভেতর। দৈর্ঘের দিক দিয়ে এটি বড়োগল্পই বলা চলে। ‘স্বপ্নচোর’ শিরোনামটি উচ্চারিত হবার পরপরই কেমন যেন একটা বিস্ময় জাগে! স্বপ্নকে চুরি! আমরা যেন এক ধাঁধার ভেতরে ঢুকে পড়ি। গল্পটি পড়তে শুরু করার আগে পাঠকদের বলবো, পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’ বইটি পড়ে নিতে। তাতে স্বপ্নের টার্মসগুলো বুঝতে একটু সহজ হবে। তো, চলুন ‘স্বপ্নচোর’ গল্পের টানেলে প্রবেশ করি। শুরুতে গল্পকার রংতুলি দিয়ে একটি ক্যানভাস এঁকে সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে আহবান করছেন। একটি প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি। সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর রয়েছে আকাশ, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত মাঠ। লেখকের ভাষায়, ‘যেন পৃথিবীর চেয়েও বিশাল’ সেই মাঠ। ঘাস, কচি গমক্ষেত। মাথা উঁচু করা জিরাফ। একদল হাতি শুঁড় উঁচিয়ে চিৎকার করছে। ঘন জঙ্গল। ডাল গুলোতে বানর লাফাচ্ছে। পাখি ডাকছে। এসমস্ত একজন চিত্রশিল্পীর মতো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন গল্পকার হুমায়ূন কবির।
শুরুতে গল্পকার রংতুলি দিয়ে একটি ক্যানভাস এঁকে সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে আহবান করছেন। একটি প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি। সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর রয়েছে আকাশ, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত মাঠ। লেখকের ভাষায়, ‘যেন পৃথিবীর চেয়েও বিশাল’ সেই মাঠ। ঘাস, কচি গমক্ষেত। মাথা উঁচু করা জিরাফ। একদল হাতি শুঁড় উঁচিয়ে চিৎকার করছে। ঘন জঙ্গল। ডাল গুলোতে বানর লাফাচ্ছে। পাখি ডাকছে। এসমস্ত একজন চিত্রশিল্পীর মতো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন গল্পকার হুমায়ূন কবির।
শুরুর এই বর্ণনা থেকে যেকেউ অনুমান করে নিতে পারে এটা বোধহয় আফ্রিকার কোনো জঙ্গল। এরপর গল্পে রোমান্টিক দৃশ্যায়নে প্রবেশ ঘটে একটি নারী ও পুরুষ চরিত্রের। শুরুতেই আমরা জানতে পারি পুরুষ চরিত্রটির নাম মাইকেল। আর নারী চরিত্র নোরা। পরস্পর জড়িয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। এই দৃশ্যের পরপরই গল্পকার মাইকেলের মাধ্যমে আমাদেরকে নিয়ে যান প্রথম স্বপ্নের জগতে। মাইকেল চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখে শৈশবের। সঙ্গে তার বাবা। আমরাও যেন স্বপ্রণোদিত হয়ে সেই স্বপ্নে অংশগ্রহণ করি। কারণ এটি একটি কমন সহজ স্বপ্ন। এরপর ভয়ংকর এক সংবাদের ধাক্কার আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। গল্পকার জানান, ‘বাবার স্বর্ণকেশী গার্লফ্রেন্ড ভেরোনিকা..’ বাঙালি হৃদয়ে সংস্কারের বাইরের চিন্তাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় আমাদের মস্তিষ্ক। কিন্তু পরক্ষণে মস্তিষ্ক বুঝে যায় এটা কোনো আটপৌরে বাঙালি জীবনের সহজ সরল গল্প নয়। জটিল এক ঘোরলাগা গল্প শোনাতে লেখক এবার নিয়ে আসেন ‘লুসিড ড্রিম’ নামে এক কোর্সের বিষয়। হার্ভাডে সেই কোর্সের ছাত্র গল্পের প্রধান চরিত্র মাইকেল। সেই গবেষণায় অংশগ্রহণকালে গল্পকার পরিচয় করিয়ে দেন আরেকটা নারী চরিত্র মার্গারেট এর সঙ্গে। সে মাইকেলের সহপাঠি। ‘লুসিড ড্রিম’ হলো বাস্তব আর অতিবাস্তবের বিষয় নিয়ে কাজ। বেশ জটিল সেই কাজ। এরপর মার্গারেটের সঙ্গে তার সখ্য। সেইসবই কথাশিল্পী স্বপ্নের মাধ্যমে বর্ণনা করে গেছেন। ক্লাসরুম। গবেষণার বিষয়াদি সবকিছুই। মার্গারেটকে নিয়ে এক রহস্যময় খেলা খেলতেই তার উপস্থিতি। মাইকেল নোরার আদলে মার্গারেটকে দেখতে চাই। মনে করার চেষ্টা করে শেষ কবে দেখেছে। কল্পনা করে রিটায়ারমেন্ট পার্টিতে মার্গারেটের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল শেষবার। হুইল চেয়ারে করে মার্গারেট এসেছিল। চেহারাটা ঠাহর করলে মনে হয় আগের মতোই। শুধু গলায় সামান্য ভাজ। এরপর মাইকেল সোজাসুজি মার্গারেটের বর্তমান অবস্থা ভাবতে গিয়ে মনে মনে ভাবে, গল্পকারের বর্ণনায়, ‘মার্গারেট কি এখন নার্সিং হোমে? বোস্টনের সেই ছায়াঘেরা নার্সিং হোম, যেখানে অসংখ্যবার একসঙ্গে গিয়েছে দুজন, বৃদ্ধদের ঘুমের ডাটা সংগ্রহ করার জন্য?’
এরপর বাস্তবে ফিরে এসে মাইকেল নোরাকে দেখে। এভাবে স্বপ্ন-বাস্তব করতে করতে একসময় স্বপ্ন ও বাস্তবের পার্থক্যটা কমে আসতে থাকে তার কাছে। বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয় মাইকেলের। এখন সে স্বপ্নকে নিয়ে বাঁচতে চাই। ভয় পায়। মনে তার ধারণা জন্মে স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে ফিরলে তার প্রিয় মানুষেরাও হারিয়ে যাবে। স্বপ্নকে নিয়ে সে নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। গল্পের বয়ানে, ‘স্বপ্ন যদি বাস্তব হয়ে দেখা দেয় তবে কি আর স্বপ্ন থাকল সেটা? স্বপ্ন মানেই তো এক ধরনের রোমান্টিকতা। আর বাস্তব জীবন থেকে চলে যাওয়া মানেই তো মৃত্যু। মৃতদের স্বপ্ন নেই। মরতে চায় না সে। মাইকেলের মনে হয়, মানুষ মাত্রই স্বপ্নভুক। স্বপ্নের জন্যই বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্নহীন জীবন মানেই একধরনের মৃত জীবন যাপন।’
এমন এক দার্শনিক বয়ান শেষে কুশলী গল্পকার পাঠককে রিলাক্স দেবার জন্য সরাসরি কিছুক্ষণ চলে যান সহজ জীবনের রুটিনে। গল্পের এই পর্যায়ে এসে তিনি ডেইজি নামের আরেকটা চরিত্রের আগমন ঘটান। মাইকেলকে দেখাশোনার দায়িত্ব এই মেয়ের। তার ডিউটি ১২ ঘন্টা। গৃহস্থলির কাজ থেকে শুরু করে মাইকেলের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর। মাইকেল চরিত্রটা একটু রিজার্ভ হলেও ডেইজিকে মেনে নেয় সে। অবশ্য প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হতো তার। ডেইজি আসাতে মাইকেলের শারীরিক ও মানসিক চাপটা একটু কমেছে। সারাদিন তার সঙ্গে থাকে ডেইজি। সন্ধ্যার পর সে বাড়ি ফেরে। ডেইজির ব্যবস্থা মাইকেলের কর্মস্থল থেকে করা হয়েছে। গল্পে ডেইজির প্রবেশের পর গল্পকার মাইকেলের পেশার পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি জানান মাইকেল কাজ শুরু করেছিলেন নাসার সাইকোলজিস্ট হিসেবে। এবং এর কয়েক বছর পর মাইকেলকে ছাটাই করা হয়। এরপর ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জিতে সে চাকরি পায়। মূলত সেখান থেকেই ডেইজিকে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে মাইকেল রাজি না হলেও নার্সিং হোমে যেতে হবে এই ভয়ে ডেইজিকে মেনে নিয়েছে সে। অনেক বাকবিতন্ডা হয় ডেইজির সঙ্গে। কিন্তু ধীরে ধীরে মাইকেল সব মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কারণ তার সামনে আর কোনো অপশন নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাকে নার্সিং হোমে যেতে হবে এরকম এক পরোয়ানা মাথার উপর ঝুলে আছে সবসময়। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। তাকে পুরো নিয়ন্ত্রণ করছে ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। মাইকেলের যখন এসব কিছুতেই অসহ্য লাগছিল। ঠিক তখন বর্তমান পৃথিবীর পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কৌশলী কথাসাহিত্যিক নারী চরিত্র ডেইজির মুখে বসিয়ে দিলেন অন্য ভাষা। ‘আমাদের কোম্পানিতে এখন ছাঁটাই চলছে। তোমার অ্যাপয়েন্টটা পাওয়ায় আমার চাকরি থাকল। নইলে আমাকে ছাঁটাই করে দিচ্ছে। দয়া করে আমাকে সাহায্য করো। চাকরিটা হারাতে চাই না।’
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে গোটা পৃথিবীর অবস্থাটা ঠিক এমন। সমসাময়িক এই বিষয়ের প্রভাব চাকরির ক্ষেত্রে ব্যাপকভারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গল্পকারের এহেন পর্যবেক্ষণ গল্পটাকে আরো বিশ্বাসী ও বাস্তবধর্মী করে তুলেছে। চলুন আমরা আবারো গল্পে প্রবেশ করি। ডেইজির এমন কাকুতিমিনতির কাছে হার মানে মাইকেল। আর কোনো আপত্তি করে না। গল্পের এই পর্যায়ে এসে আবারো শুরুর দিকে টার্ন নেয়। গল্পকার এবার সরাসরি আফ্রিকার প্রকৃতির বর্ণনা টেনে সেদিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন আমাদেরকে। স্বপ্ন ও বাস্তবের কল্পনায় ডুবে মারতেই যেন সদা প্রস্তুত তিনি। নোরা আর মাইকেলের সম্পর্কটা বয়সের মানদণ্ডে অসম। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নোরা। বাবা-মায়ের ছাড়াছড়ির পর বাবার কাছে মানুষ হয় সে। বাবা ছিলেন অ্যালকোহলিক। অল্প বয়সে নোরা ফ্যাক্টরিতে কাজ নেয়। বাবার ইচ্ছে সে একজন জেন্টেল ম্যানকে বিবাহ করুক। বাবা তার জীবনদশায় মেয়ের এই জেন্টেল ম্যানের সঙ্গে দেখে যেতে পারেননি। ফ্যাক্টরির কাজ ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় জনপ্রিয় ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট ‘ওয়াফল হাউস’ এ কাজ নেয় নোরা। মূলত এখানেই সেই বাবার কাঙ্ক্ষিত জেন্টেল ম্যানের সঙ্গে দেখা ও প্রণয় হয় নোরার। প্রায় বাপের বয়সী সেই জেন্টেল ম্যান আর কেউ নয়, আলোচ্য গল্পের প্রধান চরিত্র মাইকেল। নোরাকে প্রথম ডেটে যাবার প্রস্তাব দিলে বেশ অবাক হয়েছিল সে। রাজি হয়নি নোরা। কিন্তু নোরার দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করে নোরাকে রাজি করে ফেলে সে। বলা ভালো, কথার ফাঁদে ফেলে রাজি করিয়ে নেয়।
গল্পকার এখানে বিয়ের সংজ্ঞাটা অন্যরকমভাবে তুলে ধরেন। দার্শনিক সেই বক্তব্য খানিকটা তুলে ধরছি। ‘বিয়ে মানেই শুধু একসাথে শোয়া নয়, নোরা। এর জন্য বিয়ের প্রয়োজন নেই। বিয়ে মানে দুটো জীবনের এক হয়ে যাওয়া। নিরবচ্ছিন্নভাবে একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে থাকা। একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণ করা, উপভোগ করা— শুধু শরীর নয়, মন ও মননে, মেধা ও দর্শনে।
গল্পকার এখানে বিয়ের সংজ্ঞাটা অন্যরকমভাবে তুলে ধরেন। দার্শনিক সেই বক্তব্য খানিকটা তুলে ধরছি। ‘বিয়ে মানেই শুধু একসাথে শোয়া নয়, নোরা। এর জন্য বিয়ের প্রয়োজন নেই। বিয়ে মানে দুটো জীবনের এক হয়ে যাওয়া। নিরবচ্ছিন্নভাবে একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে থাকা। একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণ করা, উপভোগ করা— শুধু শরীর নয়, মন ও মননে, মেধা ও দর্শনে। এর নামই সংসার। আর শুধু রিটায়ার করার পরেই সংসারী হওয়া সম্ভব। কারণ একজন প্রকৃত কর্মী তার কাজকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার পক্ষে প্রকৃত সংসারী হওয়া অসম্ভব।’
নিজেকে পাত্র হিসাবে প্রমাণ করতে আর কিছু বলা লাগে না মাইকেলের। এমন এক জীবনের লোভও হয় নোরার। সে ভাবে আট ঘন্টার ঘানি তাকে টানতে হবে না যদি মাইকেলের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা হয়। এমন জীবন তো শুধু স্বপ্নেই দেখেছে সে। কল্পনার পালা শেষ; গল্পকার আবারো আমাদেরকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনেন। মাইকেল ভাবে, স্বপ্নকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তার অবচেতন মন নোরার চরিত্রকে বাস্তবে রূপ দিতে চায়। এমনই এক কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে সবসময় খেলে মাইকেলের মন। স্বপ্নের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ডেইজিকে বলে সে। সময়ের গতিকে বাড়াতে কমাতে চায় মাইকেল। এ এক অদ্ভুত খেলা। ধীরে ধীরে আমরাও কখন যেন সেই খেলার অংশ হয়ে যায়। মানে গল্পকার কৌশলে আমাদেরকে ফেলে দেন পুরো গল্পের সেই রহস্যময় খাদে। আগ্রহ বাড়তে থাকে এরপর কী জানি কী হয়। কল্পনার শরীর বাস্তব হয়ে ফ্রিজ খোলে, আইসক্রিম খায়। ডেইজিকে দেখে বলে, ‘তোমাকে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ নোরার মতো মনে হয়। কেন বলো তো?’ প্রশ্নের ভেতর বিস্ময়! বিস্ময়ের সেই খাদে পড়ে আমরাও হাসফাস করি। জানতে পারি গতরাতে মাইকেল নোরাকে আবারো স্বপ্নে দেখেছে। স্বপ্নে নোরা হানা দিয়েছে। ডেইজি মাইকেলকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে যায়। হতাশ হয়। ডেইজিকে সরি বলে আবারো সবকিছু হালকা করতে চায় মাইকেল। নিজে নিজে বলে ডেইজিকে, ‘প্লিজ চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হবে না, দেখো।’
‘তোমাকে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ নোরার মতো মনে হয়। কেন বলো তো?’ প্রশ্নের ভেতর বিস্ময়! বিস্ময়ের সেই খাদে পড়ে আমরাও হাসফাস করি। জানতে পারি গতরাতে মাইকেল নোরাকে আবারো স্বপ্নে দেখেছে।
এমন এক নিস্তব্ধতার কানে বাড়ি মেরে লেখক আমাদেরকে সজাগ হতে বলেন। সাহায্য নেন দূর ট্রেনের ভেঁপুর। ব্যাস, সেটা বাজিয়ে নীরবতা ভাঙান। আমাদেরকে নতুন করে গল্পের নতুন টানেলে প্রবেশের দাওয়াত দেন। স্বপ্ন বিষয়ের চমৎকার এক পৌরাণিক কাহিনীর গল্প শোনান তিনি। কঠিন এক থিউরিকে খুব সহজ সরলভাবে ব্যাখ্যা করেন। স্বপ্নের মতো এমন এক জটিল বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খুব কমই কাজ হয়েছে। হয়তো গল্পকার নিজে চিকিৎসক বলে বিষয়টি আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। স্বপ্নের উপর থিউরির ক্লাস নেন রীতিমতন। প্রাচীন পৃথিবীর লোকেরা স্বপ্ন নিয়ে কী ভাবত সেই বিষয়ের একটি ধারণা পাই গল্পের এই মধ্যখানে প্রবেশ করে। আমাদের পরিচয় ঘটে ‘ড্রিম কেচার’ এর সঙ্গে। মার্গারেটও সেই ক্লাসে উপস্থিত। এক ঘোরলাগা রহস্যঘেরা জগতের সন্ধান দেন গল্পকার হুমায়ূন কবির। আমরা যেন সবাই সেই ড্রিম কেচারের জগতের রহস্যময় বাসিন্দা। পর্দায় ভাসে একটি ছবি, বৃত্তাকার চাকতির সাথে লাগানো কিছু পালক ও পাথর, বৃত্তের ভেতরে সুতার জাল। উপরে লেখা ‘ড্রিম কেচার’। ভেতরে এক অদ্ভুত থ্রিল অনুভূত হয়। একজন প্রফেসর যার নাম ইশিকাতা। তিনি তার আকর্ষণীয় কন্ঠে সবকিছু বর্ণনা করে যান। এরপর দেখা পাই, মাকড়সার জাল, জীবনের চক্রের ব্যাখ্যা। গল্পকার এখন যেন এক অভিজ্ঞ শিক্ষক। আমাদেরকে গল্পের ছলে ছলে সবকিছু শিখিয়ে ও জানিয়ে দেন। পরাবাস্তব একটা জগতে আমাদেরকে নিয়ে গল্পকার বলে চলেন এক স্বপ্নচোরের গল্প। এই দৃশ্যে আমরা মার্গারেটকে মাইকেলের ঘাড়ে হেলান দেওয়া অবস্থায় দেখতে পাই। সে যেন এক স্বপ্নময় দৃশ্য। সেই অসংখ্য স্বপ্নের ঘোর কাটাতে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামান গল্পকার। ফ্রেমে নিয়ে আসেন হেমন্তের শীত। সেই সঙ্গে উৎসব। থ্যাঙ্কস গিভিং, ক্রিসমাস ইত্যাদিতে বরাবরই টাকা পাঠায় মাইকেল। রেড ইন্ডিয়ানদের স্থানীয় চেরোকি ট্রাইবের বাচ্চাদের স্কুল থেকে এলো এক চিঠি। সঙ্গে ড্রিম কেচার। আবারো গল্পে স্বপ্ন ঢুকে পড়ে হুড়মুড় করে। চিঠিটা পেয়ে মাইকেলের রাগ হয়। ডেইজি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। মাইকেলকে অসুস্থ বলাতে রেগে ওঠে। বলে, ‘আমি অসুস্থ? বুড়ো হওয়াকে অসুস্থ বলছো তুমি, ডেইজি? তুমি কি বুড়ি হবে না?’ তথাকথিত সংলাপের ধারের কাছে না গিয়ে তিনি এক অন্য দার্শনিক সংলাপ গুঁজে দেন মাইকেলের মুখে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে টাকা নেবার বিষয়টিও গল্পকারের কলম থেকে রেহায় পায় না। চার্চের প্রার্থনার বিষয় এলে সেটিও ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় মাইকেল। একধরনের অবিশ্বাসের সুর শুনতে পাই তার কণ্ঠে। ডেইজির প্রার্থনার বিষয়ে সে প্রশ্ন তোলে। জানতে চাই, ‘প্রার্থনায় কোনো কাজই হয় না। হলে তোমারটাতেই কাজে দিত। রোববারের সকাল-সন্ধ্যাটা তো চার্চেই কাটাও। আমার জন্য প্রার্থনা করো নাকি করো না?’
এইক্ষেত্রে মাইকেলের চরিত্রটা সংশয়বাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যদিও সে ডেইজিকে আগে বলেছিল সে ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়। তবু বিশ্বাসী ডেইজির এখন ধারণা হয় মাইকেল বোধহয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তাই তার মনটা ভরে ওঠে। মাইকেলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘চার্চে আজ আমাদের প্রেয়ার লিস্টে তোমার নাম দিয়েছি, মাইকেল।
এইক্ষেত্রে মাইকেলের চরিত্রটা সংশয়বাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যদিও সে ডেইজিকে আগে বলেছিল সে ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়। তবু বিশ্বাসী ডেইজির এখন ধারণা হয় মাইকেল বোধহয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তাই তার মনটা ভরে ওঠে। মাইকেলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘চার্চে আজ আমাদের প্রেয়ার লিস্টে তোমার নাম দিয়েছি, মাইকেল। বড়ো জমায়েত ছিল। চিন্তা করো না, ঈশ্বর সহায় হবেন।’ এরপর তর্কটা আরো জমে ওঠে। পাঠকদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি সেই তর্কে। সরাসরি গল্পের বয়ান—
—এই কাজটা আর করো না, প্লিজ! আমার কোনো প্রার্থনার প্রয়োজন নেই।
—প্রার্থনায় কাজ হয়, মাইকেল।
—না, প্রকৃত কিছু হয় না। সামান্য কিছু হলে সেটা সাইকোথেরাপির কারণে হয়। প্রার্থনা মানে মেডিটেশন। আর মেডিটেশন এক ধরনের থেরাপি।
—যেভাবেই হোক, কাজ হলেই তো হলো।
—হ্যাঁ, সেটা হবে যদি আমি নিজে মেডিটেট করি। তোমাদের প্রার্থনায় আমার কাজ হবে না।
—বা রে, প্রার্থনায় আমরা তো ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হই। ঈশ্বরই সকল মঙ্গলের মালিক।
—ডেইজি, তুমি তো জানোই, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে আর এসব আবোল-তাবোল বলো না।
তর্কটা আরও চলতে পারতো। চিরায়ত এই তর্ক। কিন্তু কৌশলী গল্পকার এখানে থামিয়ে দিলেন তার আশ্চর্য পরিমিতবোধের অনুশাসনে। মাইকেলের কথা শুনে ডেইজি কষ্ট পায়। কিন্তু সহজে দমবার পাত্র সে নয়। মাইকেলের মঙ্গল কামনায় সে সদা ব্যতিব্যস্ত। রোববারের প্রার্থনা শেষে রেভারেন্ড উইলকারসনের সঙ্গে মাইকেলের বিষয় নিয়ে আলাপ করে। রেভারেন্ড তাকে আশ্বাসের বাণী শোনান। তিনি বলেন, ‘ ঈশ্বর না মানা মানুষও ঈশ্বরের সন্তান। তাই সকল মানুষকে ভালোবাসতে হবে শর্তহীনভাবে। এটাই ঈশ্বরের নির্দেশ। তোমার কাজ হচ্ছে এদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করে যাওয়া। ঈশ্বর সর্বমঙ্গলের মালিক।’
এইক্ষেত্রে গল্পকার ব্যালেন্সিং করে তর্কটাকে নিউটাল পজিশনে রাখলেন। এটা লেখকের অন্যতম লক্ষণীয় শক্তি। এরপর কথাশিল্পী একের পর এক আমাদেরকে জানান যে, ডেইজি আসলে মাইকেলকে ভালোবাসে। কিন্তু মাইকেল জানে না কিছুই। ওদিকে মাইকেলের কাল্পনিক চরিত্র নোরা বাস্তবকে শাসন করতে থাকে। কাল্পনিক এই টানটান উত্তেজনা পাঠককে আঠার মতো চরিত্রের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে। ভালোবাসা-ভালোলাগা নিয়ে দার্শনিক আলোচনা চলে কিছুক্ষণ। সেই আলোচনাটা পাঠক সরাসরি পড়লে বেশি উপকৃত হবেন। ভালোবাসা ছেড়ে লেখক আবারো স্বপ্নের বিষয়ে ঢুকতে আহবান করেন। নিয়ে আসেন সেই ‘ড্রিম কেচার’। বেডরুমের পর লিভিংরুমেও একটা ড্রিম কেচার ঝুলিয়ে রাখতে বায়না ধরে উক্ত গল্পের প্রধান চরিত্র মাইকেল। তার এমন পাগলামো দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় ডেইজি। অবসেশনে ডুবে থাকা মাইকেলকে বারবার ঠেকানোর চেষ্টা করে সে। যুক্তিতর্ক বাড়ে। কিন্তু কোনোভাবেই মাইকেলকে থামানো যায় না। মাইকেলের কাছে এখন বাস্তবটাকে স্বপ্ন আর স্বপ্নকে বাস্তব মনে হয়। নার্স-ডাক্তার-সাইকোলজিস্ট সবাই মিলে স্বপ্নকে তাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু মাইকেল সেই স্বপ্নকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। ওষুধ খায় না সময়মতো। এক পর্যায়ে মূল ওষুধটা ইনজেকশনের মাধ্যমে দেহে পুশ করা হয় প্রত্যেক সপ্তাহে। মাইকেলকে নিয়ে বোর্ড বসানো হয়। আলোচনা চলে দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু সমস্যা বাধে অন্যখানে। মাইকেল নিজে সাইকোলজিস্ট হওয়াতে সবকিছু সে জানে। যার ফলে রোগের অনুসঙ্গকে সে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে সহজেই। জটিল আকার নেয়। কষ্টকর হয়ে যায় রিয়েলটা ধরতে। তবুও কেউ আশা ছাড়ে না। লেগে থাকে ডেইজি। গল্পের এই পর্যায়ে এসে গল্পকার গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেন। আমরাও যেন এক অনিশ্চিত পরিসমাপ্তির ঘোরে আটকে যায়। ধাধার মতো লাগে। ওদিকে মাইকেলের হেলুসিনেশন বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও যেন হেলুসিনেশন বাড়ে। কারণ ইতোমধ্যে আমরা গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি মাইকেলের জীবনের সঙ্গে। এক্ষেত্রে বলা ভালো, দক্ষ গল্পকার তার আশ্চর্য লেখনীর বলে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য করেন। চেতন অবচেতন মনে আমরাও যেন কখন অংশ হয়ে উঠি ধীরে ধীরে। এক পরাবাস্তব জগত সৃষ্টি হয়। আধুনিক টার্মে যাকে আমরা বলি জাদুবাস্তবতা। এখানে গল্পকার হুমায়ূন কবির দেখিয়েছেন কীভাবে বাস্তব হয়ে যাচ্ছে কল্পনা আর কল্পনা হচ্ছে বাস্তব। এ এক অদ্ভুত খেল। মাইকেলকে ফাইনালি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা হয়। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি, এরপর কী হয় এমন এক বাসনা নিয়ে। কিন্তু গল্পকার সমাপ্তি টানেন আমাদেরকে দীর্ঘ অপেক্ষায় রেখে। যেন এই অপেক্ষা অনন্তকালের। দীর্ঘশ্বাস হয়ে বুকে বেঁধে যায় সেই অপেক্ষা। শুধু কানে বাজতে থাকে গল্পের শেষ লাইনের আগের লাইন। ‘Life is moment in space, when the dream is gone…’
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। প্রাচীন জেলা শহর যশোর। সীমান্তবর্তী থানা শার্শা। চারদিক বিল বাওড় ও সোনামুখীর রহস্যে ঘেরা বদ্বীপের মতো গ্রাম স্বরূপদহ। এখানেই জলের সঙ্গে জলকেলি খেলতে খেলতে বেড়া ওঠা। একাডেমিক পড়াশুনা যথাক্রমে : স্বরূপদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শার্শা পাইলট হাইস্কুল (বর্তমানে মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়), যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এবং সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স। নাটকের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে থিয়েটার স্কুল থেকে এক বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। ২১তম ব্যাচের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ভেতরে শিল্পের নতুন অস্থিরতায় অভিনয় ছেড়ে সার্বক্ষণিক মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। বাংলা একাডেমিতে সরকারি অনুদানে তরুণ লেখক প্রকল্পে বৃত্তি নিয়ে কাটান অর্ধবর্ষ। বর্তমানে অধ্যক্ষ ও পরিচালক নলেজ ট্রি অ্যাকাডেমি। ‘জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’ এর ইংরেজি বিভাগের লেকচারার। প্রকাশিত বই : আদিপাপ (ছোটোগল্প সংকলন, ২০১৪), অনুবাদ : জাদুর আংটি (শিশুতোষ উপন্যাস, ২০১৪), অদ্ভুত সাহায্যকারী (বেলারুশের শিশুতোষ গল্প সংকলন-১, ২০১৫)