একটা কাছিম পোষার শখ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তিরিশ বছর। উঠতে-বসতে এমনকি শুয়ে থাকলেও সেই শখ ধীরপায়ে তাড়া করছে। যেন একটা কাছিম পুষতে পারলেই আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। কাছিমের খোড়লের মধ্যে আমি জমিয়ে রাখতে পারতাম আমার স্মৃতিরাশিকে। যা একটু একটু করে মহাগর্ভে হারিয়ে গেছে। আমার সকল কথামুখের উৎসে একটা কাছিম গলা বাড়িয়ে যাতায়াত করে। কোনো কাহিনির ডালপালা মেলবার কোনো মুরোদ নেই আমার। পলেস্তরা খসা রেলস্টেশনে কছিমকে দেখেই আমি কাছিম চিনতে শুরু করি। এ যেন সাপ-লুডু খেলার সময় দুজনের বাকোয়াজির মতো শোনাবে আপনাদের কাছে। সাপের মুখে পড়লেই লেজে চলে আসার মতো একটা অবস্থার অবতারণা মাত্র। স্টেশনে শাঁ শাঁ করে বিরতিহীন একটা ট্রেন চলে যেতেই তাকে আবিস্কার করি। যজ্ঞডুমুর গাছ ধরে এক লোক ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। ঝাঁকাচ্ছে… নড়াচ্ছে… উপরে তাকাচ্ছে… নিচে তাকাচ্ছে… বিরামহীন একনাগাড়ে সেই গাছ ঝাঁকিয়েই চলেছে লোকটি। ঝাঁকুনির সময় ওর হাতের পেশি এমনভাবে ফুলে উঠছে যেন এই সুঠাম শরীর পুরো পৃথিবীকে কাঁধে নিয়ে মঙ্গলে ফেলে আসতে সময় লাগবে সাড়ে চার মিনিট। আমি একমনে সেই দৃশ্য চোখে ধারণের মুহূর্তে পাশের ডোবা থেকে একটা কাছিম উঠে আসতে দেখি। লোক ও কাছিম এখন আমার দেখার বস্তু। লোকটি ডুমুরগাছের তল থেকে সরছে না। ভয়ানক কোনো চিন্তার ঘূর্ণি তাকে গ্রাস করেছে। উসকো-খুসকো লোকটি কি কোনো গুপ্তচর? আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
সাপের মুখে পড়লেই লেজে চলে আসার মতো একটা অবস্থার অবতারণা মাত্র। স্টেশনে শাঁ শাঁ করে বিরতিহীন একটা ট্রেন চলে যেতেই তাকে আবিস্কার করি। যজ্ঞডুমুর গাছ ধরে এক লোক ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। ঝাঁকাচ্ছে… নড়াচ্ছে… উপরে তাকাচ্ছে… নিচে তাকাচ্ছে… বিরামহীন একনাগাড়ে সেই গাছ ঝাঁকিয়েই চলেছে লোকটি।
আমার যেহেতু কাছিম পোষার শখ তাই তাকে ধরার একটা মওকায় আছি। কিন্তু কোনোক্রমেই লোকটি গাছের তল ছাড়ছে না। ভারি মুশকিল ব্যাপার। আমার আর তর সইছে না। ‘এই ভাই, আপনি পাগল নাকি এভাবে গাছ ঝাঁকিয়ে যাচ্ছেন?’ একটু ধমকের সুরে লোকটির কাছে যেতে যেতে বললাম। লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি তার রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। বহু বছর ঘুম না হলে চোখের কোটর যেভাবে শুকিয়ে যায় তেমনই গর্তে ঢোকা চোখজোড়া যেন আমার দিকে আগুনকুণ্ডলী ছুড়ে মারছে। মাথা নিচু করে লোকটিকে মিনমিনে গলায় বললাম, ‘ভাই, গাছটা কি উপড়ে ফেলবেন?’ সে কোনো রা না করে ডুমুরগাছের পাতার দিকে তাকিয়ে রইল।
কাছিমটি ডুমুরতলায় এসেছে। একটু গলা বের করছে আবার ঢোকাচ্ছে। বের করছে… আবার ঢোকাচ্ছে… আয় কাছিম কাছে আয়। আয় আয়। লোকটির পায়ের ফাঁক গলে আয়। এসো ভাই সাধনার ধন। এসো এসো। তোমার খোলসের নিচে আমার স্মৃতিরাশি জমিয়ে রাখতে চাই। তোমার গলা দিয়ে আমি মেঘের জল শুষে নিতে চাই। আয় আয়। ওরে কাছিম, আয় ধীরে ধীরে আয়। লোকটিকে ফাঁকি দিয়ে বুনো ঝোপের ভেতর দিয়ে আয়। কাছিম আসছে। আমার ভেতরে উত্তেজনার ঝিলিক মারছে। আয় বাবা। আয় আয়। এসো হে পরানসখা হেঁটে হেঁটে এসো… কাছিম আসছে… লালপিঁপড়ার সারি লোকটির পা বরাবর যাচ্ছে। কাছিম আসছে… লোকটি ডুমুরগাছ ঝাঁকিয়েই চলেছে। লোকটির পায়ের ফাঁক দিয়ে কাছিম আসছে… আমি একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষার জপমালা গাথছি। আমার স্মৃতিরাশি সেই কাছিমের খোলসের মধ্যে চালান করার প্রক্রিয়ায় আছি। শত শত বছর এই বিচিত্র স্মৃতি একটা কাছিম বয়ে বেড়াবে। আহা আনন্দ! বাতাস ভেদ করে, পাহাড় ডিঙিয়ে আনন্দের পুলকে শরীর চনমন করে উঠছে। কাছিম আসছে… আরেকটু এলেই সে আমার অধীনে হবে। আয় বাবা। একটু জোরে পা চালা সোনা। আয় আয়…
চিলের মতো একপলকে ছোঁ মেরে কাছিমটি ধরে ফেলল লোকটি। ধরেই রেলপথে হাঁটা শুরু করল। আমি চিৎকার করলাম, ‘আরে ভাই, কাছিম ধরলেন ক্যান? দিয়ে যান ভাই, দিয়ে যান।’ লোকটি নির্বিকার হেঁটে যেতে যেতে খ্যাক করে বলল, ‘আমার নাম কছিম, পুরা দুনিয়াডা একটা কাছিম’। কাছিমের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে পরের বার বলল, ‘গলা নামা, বাড়ি যা’। আমি যজ্ঞডুমুর গাছটার নিচে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাছটির দিকে তাকিয়ে সব শক্তি দিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিতে ইচ্ছে করল।
২
এই রাইত খুব ভয়ানক। কার হাত যেন গলা টিপে ধরে। কছিম, এই গভীর রাইতে কই গেলা ভাই? আমি ভয়ে নীল হয়ে যাই। তুমি কি কবরখানার শিউলিগাছটার কাছে গেছ? কছিম, কছিম! এই শালা কছিম পাগলা?
‘কি হইছে এত চিল্লাস ক্যান?’
আমার ভয় করে ভাই।
‘ক্যান ডরাস, কি হইছে?’
একটা হাত আমার গলা টিপে ধরতে চায়। সে আমারে ওই শিউলিগাছটার নিচে পুঁতে ফেলতে চায়।
‘ও বুঝছি, ওইডা আমলার হাত। তোর কর্মচারির হাত।’
আমার কর্মচারি গলা টিপবে ক্যান!
‘ও এখন মালিক বনে গেছে। তুই কোন ছাগলের ছাও?’
তাইলে আমি কি শেষ হইয়া যাব এই রাইতের কাফনে?
‘ধুর, দুর্নীতির হাত ও নাক দুইডাই ছোট। সেইগুলারে খুব বড় দেখা যায়। তুই কি শিউলির গন্ধ পাস?’
হু।
‘তাইলে ঘুমা। মনে রাখিস, যারা শিউলির গন্ধ পায় তাদের গলা অবধি হাত আসে, কেউ তাকে মারতে পারে না।’
কি কও?
‘একজন মরলে হাজারো ফিনিক্সে শিউলির গন্ধ ছড়িয়ে থাকে।’
৩
রেলপথের পাশেই বিশাল এক কড়ইগাছের তলে আধবয়সী নারী ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি করে রোজ। একমনে তার ভুট্টা পোড়ানোর কারিশমা দেখে আমি অবাক হই। ছোট্ট থালার ওপর কয়লার আগুনে হাতপাখার বাতাসে ভুট্টা পোড়ান তিনি। ভুট্টা পোড়ানো সময় এতই ধ্যানমগ্ন হন যেন ভুট্টার দানা নয় নিজেকেই সেই নারী পুড়িয়ে এসেছে এতকাল। তার কপালের ভাঁজ ও চাহনি হয়তো সেই কথাই বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। যখন ভুট্টার একেকটি দানা পট পট করে পোড়ে তখন তার কপালের রেখাগুলো ফুটে ওঠে আগুনের মতো। গাছ ও পথের নিশানা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আগুনের ফুলকি আমার বুকের ওপর যেন ফোসকা ফেলে দেয়। রেলপথ পার হবার সময় এ দৃশ্য আমার অভিজ্ঞতায় থাকে। সেই নারীর ফেলে আসা আধশ বসন্ত যেন ভুট্টার খই হয়ে ফোটে। একটা ভুট্টা কিনে জিজ্ঞেস করি:
ছোট্ট থালার ওপর কয়লার আগুনে হাতপাখার বাতাসে ভুট্টা পোড়ান তিনি। ভুট্টা পোড়ানো সময় এতই ধ্যানমগ্ন হন যেন ভুট্টার দানা নয় নিজেকেই সেই নারী পুড়িয়ে এসেছে এতকাল। তার কপালের ভাঁজ ও চাহনি হয়তো সেই কথাই বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। যখন ভুট্টার একেকটি দানা পট পট করে পোড়ে তখন তার কপালের রেখাগুলো ফুটে ওঠে আগুনের মতো।
কি নাম আপনার?
‘করিমন।’
ছেলেমেয়ে কেউ নেই?
‘না।’
এভাবে ভুট্টা পোড়াতে কষ্ট হয় না?
‘কষ্ট হয়। করার কিছু নাই, আমি তো প্রতিদিন আমার রক্ত পোড়াই।’
করিমনের চোখ ছলছলে দেখে প্রসঙ্গ পালটে ফেলি। একথা সেকথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে বলতে করিমনের মুখে কথাস্রোত এসেও ফিরে যাচ্ছে বারবার। দ্বিধাদ্বন্দ্বের সাঁকোটা যেন দুলছে ভীষণ। তিরিশ বছর আগে হাজরাপুকুর এলাকার কাছিম ব্যবসায়ী বুডডার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। বছর খানেক ছিল সুখের সংসার। কাছিম পাচারের কাঁচা পয়সায় স্বামীর আরাম আয়েশ ছিল দেখার মতো। করিমনের ঘরে চৌবাচ্চা ভরতি কাছিম। উঠোনে-বারান্দায় চলাচল করতো তারা। প্রতিটি কাছিম যেন সোনার মোহর। সুখের দিন। ‘হয়তো কারো কারো কপালে সুখ সয় না’ বলল করিমন। একদিন রাতে কাছিম নিয়ে ঢাকায় গেল বুডডা। যাবার সময় করিমনকে বলে গিয়েছিল ‘এইটাই শেষ টিপ, আর এ কাজ করবো না। দুদিন পরে ফিরবো।’ ভুট্টা পোড়াতে পোড়াতেই করিমন বলল, ‘আর ফেরেনি। তিরিশ বছর ধরে সেই মানুষের অপেক্ষা আমাকে তিলতিল করে শেষ করে দিয়েছে।’ আমার মন বিষাদে ভরে উঠল। একটা মানুষের তিরিশ বছরের জমানো স্মৃতি খুঁড়ে ফের তাকে দুখী করে দিলাম। কিন্তু আমিও তো তিরিশ বছর ধরে একটা শখ পুষে আসছি মনের ভেতর। আধশ বছরের নারীর মনে বুডডার কাছিমগুলো হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ। শখ-দুঃখ মাখামাখি জীবনের এই চোরাস্রোত আমাকে নাড়িয়ে দিল ভীষণ।
৪
ক্যামেরায় অন্ধকার ধরা কছিমের নেশা। জলা-জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার শিকার করতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। ক্যামেরায় অন্ধকার ধরে না। কোথাও একটা জোনাকি আলো ছড়িয়ে যায়। ঘন অন্ধকারের মধ্যে ক্ষুদ্র আলো।
কছিম?
‘হু।’
পারলে?
‘নাহ।’
কেন?
‘ওই আলোটা বোধে এসে ধাক্কা মারে।’
মারুক, তুমি অন্ধকার শিকার করো।
‘পারবো না। ওই আলোটুকু মাথা বিগড়িয়ে দেয়।’
এত বৃহৎ অন্ধকারে ওটা তো নস্যি। ফের ধরো। কছিম, বাদ দাও শিকারের জারিজুরি।
‘ক্যান?’
ফেসবুকে অনেক ঘটনা, তাকে ধরি।
‘হুদাই, ওগুলো হুদাই।’
কি বলো?
‘কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম একে একে শিশ্ন এসে কসাইখানায় জড়ো হচ্ছে। এক কসাই সমানে কুচি কুচি করে কাটছে শিশ্ন… কেটেই যাচ্ছে… রক্ত জমে কালো হয়ে যাচ্ছে কসাইখানার নালা। আমি ক্যামেরা চালিয়ে অন্ধকার ধরছি।’
পারলে?
‘না।’
কেন?
‘সেখানেও এক জোনাকি এসে আলো ফেলে গেছে।’
ওই আলোটা কি, জানো?
‘জানি।’
কি?
‘ওটাই আমাদের ভরসার জায়গা…’
৫
কছিম আদতেই পাগল। তার যে কাছিম পোষার শখ ছিল—তা আমার জানা ছিল না।
কবিতা ও গল্প লেখেন। লেখালেখির ঝাউবাংলোয় মগ্ন থাকাই তার আরাধ্য। জন্ম ও বেড়েওঠা পদ্মাপারের রাজশাহীতে। জীবন-নির্বাহের জন্য কাজ করেন গণমাধ্যমে। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৫ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে ‘ডুমুরের আয়ু’ গ্রন্থের জন্য বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রকাশিত গল্পের বই ‘সান্ধ্য মাংসের দোকান’।