রবিবার, নভেম্বর ২৪

অসীম কুমার দাসের কবিতার নন্দন : মাসুদুল হক

0

অসীম কুমার দাসের কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায় সেগুলো যত্ননির্মিত। তাঁর এমন নির্মাণের কারুকৃতির পেছনে সুপ্রচুর কবিতাচিন্তার বিবর্তন, শ্রমশীলতার প্রচ্ছায়া বর্তমান, উপরন্তু চসার-হোমার-এলিয়ট প্রভৃতি কবিদের কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতার নির্যাস লক্ষণীয়। অবশ্য তার ‘ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাতে কবিতা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন :

‘কবিতা নামক শিল্পমাধ্যমের এই রকম স্বয়ম্ভু ও অদ্বিতীয় ‘Mode of existence’ এর জন্য একটি বিষয় দায়ী বলে আমার মনে হয়। সেটা হলো এই যে, কবিতা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দ্রজালময় ধ্বনির উপরে এবং সেই ধ্বনি বিশেষভাবে অর্থময়। এক বিচারে যদিও সব ধরনের ধ্বনিপুঞ্জরই কোনো না কোনো অর্থ থাকে—যেমন সংগীতে ব্যবহৃত ধ্বনির থাকে অন্তর্লীন দ্যোতনা। তবে সংগীতের ধ্বনি আক্ষরিকভাবে কোনো বিশেষ ভাব ও ধারণার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে না বরং তা এক পরিব্যাপ্ত ভাবনার বিশ্ব নির্মাণে সবচেয়ে পারঙ্গম। কবিতাও এ-ধরনের অর্থময়তার পরিব্যাপ্তি ঘটাতে সক্ষম সন্দেহ নাই। কিন্তু কবিতার অর্থময়তার এই আততি যেভাবে ঘটে, তা একটু অন্য প্রকারের। যেমন, কবিতার ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দেরই একটি আভিধানিক অর্থ থাকে। কিন্তু কবির ‘স্বপ্ন-কল্পনা’ (Imagination) আপাতবিচ্ছিন্ন শব্দাবলীর ভেতর থেকে একটি বিশাল ও অপ্রত্যাশিত রকমের নতুন অর্থকে সূর্যালোকের অজস্রতায় প্রতিস্থাপন করে। অর্থাৎ একটি অন্ধকার শব্দের সাথে অন্য একটি অন্ধকার শব্দের সংঘর্ষের ফলে জ্বলে ওঠে অর্থময়তার আলো এবং সেই আলোর স্পর্শে সঞ্জীবিত হয় পার্শ্ববর্তী আরো একটি অনালোকিত শব্দ। তার পরে শুরু হয় খাণ্ডবদাহন। অর্থাৎ শেষ বিচারে কবিতা হচ্ছে শূন্য। দেশের মহাজন শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে-থাকা এক মর্মর পিরামিড যা ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর লোকে।’

উপর্যুক্ত মন্তব্য থেকে অসীম কুমার দাসের কবিতা বিষয়ক নন্দনচিন্তাকেই আমরা অনুধাবন করতে পারি । অর্থাৎ তিনি কবিতায় বৌদ্ধিক বিশ্লেষণের চাইতে আবেগের গুরুত্বকেই দিতে চান বেশি। এখানে তার কবিতার নন্দনতাত্তিক পরিচয় স্পষ্ট হয়। তার কবিতা থেকে উদাহরণ দেওয়া যাক :

‘তোমার পৃথিবী আর
আমাকে ছোঁবে না কোনোদিন—
অথচ বন্ধন থেকে যাবে,
অবলুপ্ত সূর্যের সোনায়
উষার ক্রন্দন থেকে যাবে। ’

(অথচ ক্রন্দন থেকে যাবে)

অসীম কুমার দাসের কবিতায় প্রেমচেতনা থাকে, কিন্তু সে প্রেমচতনা কেবল মিলনের নয়, প্রেমিক-ব্যক্তিত্বের প্রতি স্বতোৎসারিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশই তার কবিতায় স্পষ্ট হয়। আর এই ক্ষেত্রে তিনি একজন অনিবার্য রোমান্টিক হিসেবেই চিহ্নিত হন।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক:

সন্ধ্যা নেমে এলো।
তুমি নেই—
অথচ সন্ধ্যার স্মৃতি
তোমার চুলের মতো হাসি
মৃত্যুজয়ী
এলায়িত গান ।
রাত্রি ঘন হলো
তুমি নেই
আমার অশান্ত বিশ্ব
নিঃস্বতায়
এখন হলুদ,
নদীর আকাশ
কালো কথা ।

(তুমি নেই)

অসীম কুমার দাসের প্রেমের কবিতায় পরিচ্ছন্ন একটি মানুষকে খুঁজে পাই। সে মানুষটি প্রেমের প্রতি কখনও তীব্র আসক্তিময়, দেহপ্রমত্ত; কিন্তু সেটুকুই সব না। কখনো স্থান ও কালের বিশাল প্রেক্ষাপটে প্রেমের সীমাতীত প্রতিষ্ঠা, কখনো বিপুল রোমান্টিক আবেগ, কখনো বা প্রাজ্ঞ ও প্রৌঢ় উপলব্ধিতে প্রেমের শান্ত-গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে কবিতায়। এই গুণটিও তাঁর কবিতার নন্দনতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।

অসীম কুমার দাস তাঁর কবিতায় জাগতিক প্রতীকী-শঙ্খলা নিয়ে উপস্থিত এবং প্রাচীন প্রত্ন-সময় ও স্থানের পরিবেশ নির্মাণে পারদর্শী। আর এই পরিবেশ নির্মাণটি সৌন্দর্যের সূচনা করে যা আশির দশকের কবিতায় একটি মৌলিক দিকের প্রতি নির্দেশ দেয়। দৃষ্টান্ত :

আদিতমা পৃথিবীর রক্তরসে
সমুদ্রশিরায়
তখনো প্রত্যুষ,
তখনও দেখেনি সূর্য প্রসার্পিনা
তখনো কাঁদেনি ডিমিটার।

অনচ্ছ প্রাচীন সেই, প্রহেলিকা-চূর্ণ তমসায়
প্রোটোমানবেরা হেঁটে যায়—
ঊর্ধ্ব উত্তোলিত, শান্ত
পাথরের অগুন্তি বর্শায়

নক্ষত্রের আলো নৃত্য গলিত রূপার:

ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রাচীন
বেজে ওঠে সূর্য-ডাকা গানে,
“উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরাণনিবোধত”।

(ঝঞ্ঝা ও পুনরুথান : প্রস্তাবন)

অসীম কুমার দাস ভারতীয় এবং গ্রিক পুরাণনির্ভর এতিহ্য অবগুণ্ঠিত প্রাচীন সময় ও পরিবেশকে আত্মস্থ করে কবিতার ক্ষেত্রে প্রণয়ন করেন নতুন চেতনাকাঠামো। তিনি স্মৃতিকাতর, এক অব্যক্ত মানস-বেদনায় জর্জরিত। প্রাচীন প্রত্ন-সময়ের দিকে তিনি বারবার ঘুরে তাকান। এই স্মৃতিকাতরতাকে অবলম্বন করেই কবি তাঁর কবিতার সৌন্দর্যকে পাঠক হৃদয়ে নিবিড়ভাবে গেঁথে দেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে।

প্রাগৈতিহাসের সেই রাতে
জমাট রক্তের মতো অন্ধকার
নেমে এসেছিলো
জমে উঠেছিলো সেই

ভয়ার্ত চোখের মতো প্রান্তরের পারে
কোটি কোটি মানুষের হাড়
রঙহীন, সীমানাবিহীন।

(আলো আর আঁধারের গান)

অসীম কুমার দাস, সৃজনশীল সময়ে বারবার তাকান সৌন্দর্যচেতনার গোপন আবেগের দিকে। কবিতার আত্মা থেকে সৌন্দর্যকে নিকষিত করে আনতে চান তিনি। তাঁর প্রতিটি কবিতার পেছনে এক ধরনের সহজাত আবেগী অনুপ্রেরণা কাজ করে। এক নস্ট্রালজিক যন্ত্রণা তিনি অনুভব করেন এবং এই যন্ত্রণাকে সৌন্দর্যচেতনা দিয়ে এক বিরল কৌশলে পাঠক-হৃদয়ে পৌঁছে দিতে চান। এখানেই তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক সার্থকতা; তার বিশিষ্টতা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মূলত কবি ও কথাসাহিত্যিক; অনুবাদ ও গবেষণায় রয়েছে সমান আগ্রহ। বাংলা একাডেমির রিসার্স-ফেলো হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে পি-এইচ. ডি সম্পন্ন করেছেন ২০০৪ সালে। বাংলাদেশের সরকারি কলেজে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনায় নিয়োজিত। তার কবিতা তাইওয়ানিজ, চীনা, নেপালি, আজারব‌ইজানিজ, তার্কি, রোমানিয়ান, আরবি, ইতালীয়, অসমীয় ও স্পেনীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় বিশ্বের বিখ্যাত জার্নাল ও ব্লগগুলোতে নিয়মিত কবিতা লিখে যাচ্ছেন। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ইংল্যান্ডের ‘THE POET’ পত্রিকা কর্তৃক ‘International Poet of the Week’-‌এ ভূষিত হয়েছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার (২০১১); চিহ্ন পুরস্কার (২০১৩); দিনাজপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি গুণীজন সম্মাননা (২০১৪); উপমা সাহিত্য পুরস্কার (২০২১) অর্জন করেছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : ‘টেনে যাচ্ছি কালের গুণ’, ‘ধ্বনিময় পালক’, ‘ধাঁধাশীল ছায়া’, ‘জন্মান্ধের স্বপ্ন’, ‘সার্কাসের মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা’, ‘The shadow of illusion’, ‘Blind Man's Dream’. গল্পগ্রন্থ : ‘তামাকবাড়ি’, ‘আবার কাৎলাহার’, ‘ঢুলকিপুরাণ’, ‘নাবিকের জুতো’। প্রবন্ধ : ‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’, ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’, ‘জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য’, ‘বাংলা সাহিত্যে নারী’, ‘বাংলা উপন্যাস অধ্যয়ন’। অনুবাদ : ‘চৌদল ঐকতান’, মূল: টি. এস. এলিয়ট; ‘ধূসর বুধবার’, মূল: টি. এস. এলিয়েট; ‘বালি ও ফেনা’, মূল: কাহলিল জাফরান; ‘হল্লা’, মূল: অ্যালেন গিনসবার্গ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।