তোমার নিজের যে কথাটি তুমি জানো না,
সেই কথাটি বলতে কবি তোমার কাছে এসেছে,
‘হোমার-সাগরে হিমালয়’ সুজন দেবনাথের লেখা সদ্য প্রকাশিত একটি বাংলা কবিতার বই। কবিতাগুলি তিনি গ্রীসে থাকাকালীন লেখা শুরু করেন এবং শেষ করেন ভুটানে। বইয়ের কভার পেজ দেখে গ্রিসের বিখ্যাত সান্তোরিনির কথা মনে পড়ে যাবে। সেখানকার নীল জল, খোলা আকাশ, পাহাড় মানুষকে দিনের-পর-দিন আকর্ষণ করে এসেছে। আমাদের লেখকও তাদের মধ্যে একজন। লেখক তার কবিতায় উল্লেখ করেছেন যে তিনি গ্রিসের সাগরগুলির নাম দিয়েছেন ‘হোমার-সাগর’।
সেই প্রথম যেদিন অডিসিয়াস পড়েছি,
গ্রিসের সাগরগুলোর নাম কেটে, আমি হোমার-সাগর রেখেছি।
কখনো কখনো অনুভবের বৈচিত্র্যতা এবং প্রকাশভঙ্গির সরলতা কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। সুজন দেবনাথের অনেক কবিতাই তার উদাহরণ। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বচ্ছতা। সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠককে স্পর্শ করার মতো। তিনি তার এই কবিতার বইয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। প্লেটো, হোমার, সক্রেটিস, ফ্রয়েড, গ্রীক মিথলজি, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে এই কবিতাগুলি রচিত।
তিনি প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কথাও বলেছেন এই বইয়ে। তিনি তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে কবিদের এক নতুন পরিচয় দিয়েছেন আর দিয়েছেন এক নতুন ঠিকানা।
তোমার মনে ঘর বেঁধেছে, কবি নিজের ঘর হারিয়ে ফেলেছে,
চির যাযাবর হয়ে গেছে।
প্লেটো তার রাষ্ট্র থেকে কবিদের বাদ দিতে পারেন কিন্তু তিনি একটি সহজ কথা বোঝেননি যে কবিরা মানুষের মনে থাকে। কবি সুজন দেবনাথ এর কথায় প্লেটো না জানতেই কবিদের একটা অনেক বড়ো উপকার করে দিয়েছেন, তিনি মানুষের মনে কবিদের একটি ঘর করে দিয়েছেন।
প্লেটো না বুঝেই, কিরম এট্টা ফাটাফাটি কাজ করে ফেলেছে।
মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে মানুষের কাছে সাহিত্যের মর্যাদা ততটাই কমে যাচ্ছে। সাহিত্যমাত্রই মানুষের খিদের জ্বালা মেটাতে সক্ষম নয়।
কিছু রবীন্দ্রনাথ আধখানা নজরুল আর দুটি সুকুমার রায়ের দাম
দু’কিলো চাল, আধকিলো ডাল আর এক হালি ডিমের চেয়ে কম।
তাছাড়াও তিনি বর্তমান সমাজকেও তুলে ধরতে ভোলেননি। আধুনিক সমাজে মানুষের যে ভয়ংকর রূপ ফুটে উঠেছে তিনি সেটার উল্লেখ করেছেন তার কবিতার মধ্যে। পাশাপাশি বাড়তে থাকা বেকারত্ব জীবনের কথা বলেছেন। বর্তমান সমাজে বেকারত্ব এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তার সামনে ভালোবাসাও মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান সমাজ,প্রেম, জীবনের টানাপোড়েন, ছোটোবেলার স্মৃতি সবকিছুর সমাহারে এই বইটি হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত।
তুমি অন্যের বউ হয়ে ভালই হয়েছে। আমার এই ছোট চাকরি,
ছোট ঘর – জানালা তো আরো ছোট। তোমার খুব কষ্ট হতো।
এই বইয়ের মধ্যে আপনি যেমন গ্রীসকে পাবেন তেমনি হিমালয়কেও পাবেন। একইসাথে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে বাংলাদেশ মাটি, আপনার দৈনন্দিন জীবনের কথা। পৃথিবী একটি খুব অসহিষ্ণু জায়গায় পরিণত হচ্ছে, মানুষ একে অপরের থেকে দূরে এবং আরও দূরে চলে যাচ্ছে। এবং, এইরকম একটি কবিতার বই বিশ্বকে একত্রিত করতে, আহত হৃদয়কে নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই বইয়ের সমস্ত কবিতা আপনার আবেগকে মন্থন করে এবং আপনার নিজের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতাগুলিকে পুনরায় জীবিত করে তোলে। তার কবিতার শব্দগুলো মানুষের হৃদয়কে এমনভাবে ভেদ করে যা সহজে ভোলার নয়। এই ধরনের সাহিত্যই মানবতাকে একত্রিত করে, যা বিক্ষিপ্ত সমাজে একতা এনে দেয়। কবিতার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো সুবিধা হলো একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। অবাধ্য শৈশবকে যেমন অনুভব করা যায় তেমনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়। আর ঠিক এভাবেই কবি নিজের গান গেয়ে অন্যকে করে প্রভাবিত। আর ঠিক এই রকম একটি কবিতার বই পারে পাঠকের মন একরাশ মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিতে, হয়তোবা ক্ষণিকের জন্যে কিংবা আজীবনের জন্যে।
জন্ম ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলায়, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে। স্কুল ও স্নাতক স্তরের পড়াশোনা পুরুলিয়া জেলা থেকে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে। বর্তমানে বি.এড-এ অধ্যায়নরতা। ‘উদাত্ত’ নামক নাটক দলের সক্রিয় সদস্য। আবৃত্তি, নাটক, শ্রুতিনাটক, উপস্থাপনা, গান, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদির সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত।