শুক্রবার, নভেম্বর ২২

শ্রী নির্বাচিত অসীম কুমার দাসের দশটি কবিতা

0

অথচ ক্রন্দন থেকে যাবে


তোমার পৃথিবী আর
আমাকে ছোঁবে না কোনোদিন—
অথচ বন্ধন থেকে যাবে,
অবলুপ্ত সূর্যের সোনায়
ঊষার ক্রন্দন থেকে যাবে।

যেমন ঝঞ্ঝার পরে ঢেউ।
ক্রমশ ঢেউয়ের বুকে নামে,
দিনান্তে যুদ্ধের শেষে ঘোড়া
নিহত যোদ্ধার পাশে থামে,
তোমার চোখের জলরেখা
এলায়িত কবরীর খামে।

সেতুর অনেক নিচে টেম্স
যদিও প্রচণ্ড শান্ত
বরফের আদিম চুম্বনে,
অথচ অন্তরে তার
অন্ধ জলকল্লোলের ধ্বনি,
সেইভাবে নক্ষত্র-নিহত রক্তে
উদ্বেলিত উন্মত্ত সিম্ফনি।

আর কোনো লুব্ধ রাত্রি
বিপর্যস্ত আঙুলের ফাঁকে
তোমাকে ছোঁবে না—
রজনীগন্ধার গন্ধ
অন্তরীক্ষে ছড়াবে বেদনা।

সুদূর নির্জন ফ্ল্যাটে
তোমার অশান্ত ঘুমে
রুদন্ত স্বপ্নের সীমানায়
ফুল হয়ে ঝরে যাবে
রাশি রাশি অন্ধকার
……………আলোর চেতনা;
তখন হারানো রাত্রি
বিলম্বিত আলেয়ার মতো সেই
………………শ্যাম্পেন-সময়,
কোনো পরিচিত মুখের আদল,
ক্রমাগত চূর্ণ হবে
সূর্য-ডোবা পাহাড়ের ফাঁকে—
অথচ বন্ধন
আর অবলুপ্ত দিগন্তরেখায়
ঊষার ক্রন্দন থেকে যাবে।


গ্লানিও নেবে না তাকে যেন


হয়তো বিকার ছিলো সপ্তলোক,
যোনির ক্লেদের মাঝে তাই
আগুনে ক্ষুধার অবসান।

লুপ্তজ্যোতি আকাশের ভগচিহ্নে
জ্যোতিষ্কের বমি
দুঃস্বপ্নের ঝুলন্ত যৌনতা,
লণ্ঠনের আলো চাটে লালা, অন্ধকার।

গ্লানিও নেবে না তাকে যেন—
জীবাত্মা হাঁপায় গুমোটে লজ্জায়,
মুমূর্ষ অশ্বের মতো
ফেনা-ওঠা দাঁতে এসে সূর্য ডোবে যার।

নিহত স্বপ্নের ভস্ম
দেবতার চোখে এসে নামে
জ্যোতিষ্কলোকের পাখা থামে।

পাললিক আলোহীনতায়
সে তখন চোখ মেলে চাবে,
ভৌত লবণের প্রেত জিহ্বে
………দৃষ্টিহীনতায়।

মহীসোপানের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
আবার আবার সিঁড়ি পাবে,
পাহাড়ের তলদেশে মহারাত্রি
চেতনা খুবলাবে।

তবু সমুদ্র ছোঁবে না তাকে
সূর্য এসে আতঙ্কে পালাবে,
………..এই পাপ
মানুষের রক্তে এসে
একাকী দাঁড়াবে, স্ট্যাচু
উদ্ভ্রান্ত, প্রাচীন।


আদিম রাতের কথা বলি


শোনো
আমি এক আদিম রাতের কথা বলি,
মোমের আলোয় রাঙা ঘর,
সেইখানে
এভারেস্ট ছুঁয়েছিলো
দুজনের দুরন্ত বাসনা,
অস্বচ্ছ ভোরের মতো কুয়াশায়
নরম ঘাসের মতো কথা
………………তখনো অচেনা।

তারপর অগণন রাত্রি চলে গেছে
অসংখ্য দিনের মোহনায়,
আবার এসেছে রাত্রি
সূর্যডোবা দিনের খেয়ায়।
মোমবাতি
নিভে গেছে কবে
বিলম্বিত সোনাটার মতো
ক্রমাগত পুড়ে পুড়ে পুড়ে
একদিন ছুঁয়েছে আঁধার।


কাল রাতে


কাল রাতে
অন্য কোনো মানুষের
হাত ধরে
এসেছিলে
স্বপ্নের ধাতব
আঙিনায়,
রক্তবর্ণা
এখন প্রত্যুষ
রক্ত ছিড়ে
যায়।


ঊর্ধ্বগামী ধোঁয়ার কুণ্ডলী


চলো
জ্বলন্ত বনের দিকে ফিরে যাই
মহাজাগতিক হুতাশনে
লেলিহান জ্যামিতির টানে,
যেখানে বৃক্ষের শিরা উপশিরা
ক্রমাগত ছাই,
আকাশের অনশ্বর পাটাতনে
উড়ন্ত অঞ্জলি
ঊর্ধ্বগামী ধোঁয়ার কুণ্ডলী
তোমার আমার ভালোবাসা,
নক্ষত্র-চুম্বিত স্বপ্নে
লক্ষ্যহীন আশা বা দুরাশা,
দাবানলে
অর্জুনের খাণ্ডবদাহনে যার
সমাপ্তি ঘোষিত ছিলো
নিয়তির অনিবার্যতায়,
সূর্যভাঙা আত্মার ভাষায়
আমাদের চূড়ান্ত চুম্বনে
রক্ত-লুপ্ত ধ্বনি-লুপ্ত
প্রলয়ের জন্মান্ধ শিখায়
আমাদের আলো-বাসা
আমাদের ভালোবাসা নাই,
জ্বলে
অনন্ত রোমের সীমানায়।


একদিন ভুলে যাবো সব


একদিন ভুলে যাবো
আগ্নেয় ক্ষরণ
পাহাড়ের নিচে নীল চাঁদ,
প্রাগিতিহাসের মতো কবেকার
ঝলে ওঠা
আলোকিত ফ্ল্যাটের বিষাদ।

উত্তাল শোণিতে স্মৃতি
আমাদের অসংখ্য বিবাদ
আমাদের অজস্র নিভৃতি,
লাভার উৎক্ষিপ্ত প্রান্তে
বিস্ফোরিত চুম্বনের দাগ
বিস্ফোরিত চোখের বিস্ময়
আকাশের অন্ধ জনপদে
প্রেতায়িত গান হয়েছিলো যার
সমস্ত হৃদয়।

ঠিকানা রাখেনি স্নায়ু
ঠিকানা রাখেনি হিমালয়।
মহারাত্রি খুঁড়ে খুঁড়ে ছায়া
দুলেছিলো, ভুলেছিলো
সব পথ যেখানে আলেয়া,
লবণাক্ত সময়ের মায়া।

বিপন্ন সূর্যের নিচে
উদ্ভ্রান্ত মানুষ চেয়েছিলো
বিলুপ্ত মুখের মোহনায়—
একদিন ভুলে যাবো সব
আগুনের শেষ সীমানায়।


প্রাতিস্বিক নেতিতে বিলীন


আমি আজ মধ্যরাতে
গ্যালাক্সির উপান্ত্য সীমায়
পৃথিবীর
শেষ কবিতাটি লিখে যাবো।

জানি না জানি না আমি
অমরত্ব পাবো কি না পাবো?

দীপ্তির আকাশ আজ ভুয়া
হোমারের গান নীল ধোঁয়া,
রবীন্দ্রনাথের প্রাণ
অর্থহীন গানের আলেয়া।

অনন্ত সময় আর শূন্যতার
নিরালম্ব পটভূমিকায়
ঝলে-ওঠা বিদ্যুতের মায়া
সিন্ধু নয়, সূর্য নয়,
বিন্দুর
বিলীয়মান ছায়া।

কোটি কোটি গ্যালাক্সির মৃত্যু হলে,
অন্ধকারে ঢাকা অন্ধকার
ঈশ্বরের মতো নিরাকার।

অতএব অমরত্ব নেই
নশ্বরতা আছে
শব্দের, আলোর, আকাশের।

সব আলো অবশেষে
আলোহীনতায় এসে মেলে,
কোটি কোটি সূর্য গিলে ফেলে,
মেলে না মেলে না তারা কোনোদিন
শব্দ আর আলো।

শেষ সূর্য রক্ত ঢেলে দিলে
দানবের শোণিতে বিলীন
স্তব্ধতাই যেখানে নিয়তি,
সেইখানে থেমে যায়
মহাবিশ্বজগতের গতি
অর্থহীন, অন্তহীন প্রাণের কিমিতি,
যেখানে ঈশ্বর উদাসীন
অথবা গহন স্বপ্নে
প্রাতিস্বিক নেতিতে বিলীন।


লোকান্তরিত শূন্যের মাঝে বাসা

বিষ্ণু বিশ্বাস-এর জন্য


কে যেন কোথায় হারিয়ে ফেলেছে ডানা
জটায়ুর মতো পড়ে আছে নীল খাদে
উড়ে যেতে চায় উড়াল হারায় কাঁদে
খঞ্জ বাতাসে নিশ্বাস নিতে মানা ।

চারিদিকে ক্ষয় ক্ষত বিক্ষত শিলা
বিচূর্ণীভূত স্বপ্নের ঘোলা দাঁতে
যেন কান্নার কৃষ্ণাদ্বাদশী রাতে
একা জেগে আছে অন্ধকারের টিলা ।

হারানো দিনের সূর্যেরা যেন মায়া
স্তব্ধ হয়েছে শিলাপুঞ্জের খাঁজে
গোঙানি তাদের রক্তের ভাঁজে ভাঁজে
ব্যাপ্ত করেছে অমাবস্যার ছায়া।

নিম্নে অধীর অসংখ্য শ্যামলিমা
জ্বলে নাকো আর কলস্বনার ধারা
যেন কালাহারি মরুবালুকায় হারা
লুপ্তি গিলেছে সন্ধ্যার অরুণিমা।

কিছুই দেখে না অন্ধকারের চাঁদে
কলধ্বনির মরীচিকা বাজে দূরে
যেন রসাতল-নিংড়ানো বোবা সুরে
লুণ্ঠিত শত দেবকন্যারা কাঁদে।

যেন চেয়ে আছে শিল্পীর কঙ্কাল
গুহাচিত্রের আলো-আঁধারিয়া গানে
বুঝে নিতে চেয়ে নশ্বরতার মানে।
নরপতি যার নিরবধি মহাকাল।

সান্ত্রি হয়েছে সীমাহীনতার কালি
শিলীভূত মেঘ, তমসাবৃত খালি
লোকান্তরিত শূন্যের যাওয়া-আসা
লোকান্তরিত শূন্যের মাঝে বাসা।


ঝঞা ও পুনরুত্থান – এক

শামসুল কবীর-এর জন্য


আদিতমা পৃথিবীর রক্তরসে
………..সমুদ্রশিরায়
………..তখনো প্রত্যুষ,
তখনো দেখেনি সূর্য প্রসার্পিনা
তখনো কাঁদেনি ডিমিটার।

অনচ্ছ প্রাচীন সেই প্রহেলিকা-চূর্ণ তমসায়
প্রোটোমানবেরা হেঁটে যায়—
ঊর্ধ্বে উত্তোলিত, শান্ত
পাথরের অগুন্তি বর্শায়
নক্ষত্রের আলো নৃত্য গলিত রূপার।

সেইসব আদিমানবের
নীলাভ পিঙ্গল চোখে
ক্ৰমজাগরিত দূর স্বপ্নের আবেগ
যার সম্পূর্ণ উদ্ভাস
তখনো প্রতীক্ষারত পৃথিবীর
…………….অনাগত গানে,
যেন এক মানব-দানব-হারা বেলাভূমি
চেয়ে আছে সমুদ্রের আঁধার প্লাজমায়,
কবে উঠে আসে প্রাণ, স্বতশ্চল।
……………..তারার বিস্ময়।

সেই লগ্নে ভবিষ্যৎ দিনের মিছিল
বেজে ওঠে সূর্য-ডাকা গানে,
‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’

আদিমানবের পথে রুদ্র চাদ
আলো ফেলে অরণ্যের বাঁকে,
লতা আর গুল্মের গহনে
কখনো সে পথ দিশাহারা,
আবার হরিণ-লুপ্ত তমসার সীমান্তরেখায়
ঝলে ওঠে পথ, নদীরেখা।

কোনো এক অদ্ভুত সময়
অতিকায় বৃক্ষের পাহারা
শেষ হয়ে আসে,
প্রসারিত তখন প্রান্তর—
জ্যোৎস্নার নীলাভ রক্তে ধূলি আর বিস্তীর্ণতা।

সেই ধূলির ওপরে তারা হেঁটে যায়
ধূলি-ধূসরিত সেই রাত্রির ওপারে
যেখানে ঘুমের শেষ দিগন্তসীমায়
সূর্যদেব লুটোপুটি খায়।

হঠাৎ বাতাস জাগে
ধেয়ে-আসা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘে,
উচ্চকিত ঘুমন্ত বিদ্যুৎ
ছিন্ন-ভিন্ন করে স্বর্গ নৃসিংহ থাবায়,
যেন এক পশুর নখরাঘাতে বিদীর্ণ সকাল।

আদি মানুষেরা থামে—
আদিমানবীরা আর্ত,
প্লাবনের মতো কেঁদে ওঠে,

সেই আর্তনাদ যেন জলস্তম্ভ প্রার্থনার,
উঠে যায় ঊর্ধ্বাকাশে
কোনো এক অসম্ভুত ঈশ্বরের দিকে—
যেখানে আণব ঝঞ্ঝা—
কোটি কোটি অশ্বের কুয়াশালীন,
অ-মানব মহাশক্তি নাচে
আন্দোলিত হাতে যার বজ্রের হাতুড়ি।

কখন ফুরিয়ে যায় অচেনা তাণ্ডব,
ভিজে ওঠে প্রান্তরের বিস্তীর্ণতা
বৃষ্টির আঘাতে।

ফিরে আসে নীল চাঁদ, কিছুটা পাণ্ডুর;
তারা চলে— দুর্জয় হৃদয়,
যেন এক ঋক্‌ছন্দ বেজে ওঠে তাদের চলায়
ইতিহাস থেকে ইতিহাসে।

প্রান্তর ফুরিয়ে আসে—
অন্য কোনো অরণ্য-আভাস
স্তিমিত আলোর ছায়া
নীল নয় অথচ নীলিমা।

অসম্ভত বেদনার মতো গাছ
জেগে ওঠে
ছায়ামূর্তি যেন রাত্রি-চেরা,
সারিবদ্ধ দিগঙ্গন-ভাঙ্গা যুদ্ধ
……….আলোর প্রেক্ষিতে
পার হয়ে যায় তারা,
ক্ৰমজাগরিত স্বপ্নে
ক্লোরোফিল-বিস্ফোরিত পথ;
ছায়ার ওপারে কাঁপে ছায়া।

ক্রমশ ফুরিয়ে যায়
বৃক্ষের স্তব্ধতা,
তখন নদীর শব্দে সচকিত
মনে হলো অরণ্যের শেষ,
সেখানে মিছিল থামে।

জেগে ওঠে ছোটো ছোটো ঘর,
সমিদ্ধ অরণি-সৃষ্ট মাংসের ধোঁয়ায়
শিশুর অমল দাঁতে কলোচ্ছ্বাস।

মেয়েদের এলায়িত চুল।
……………..ঝলে ওঠে গলে ওঠে
……………..সূর্যের আলতায়,
নদীর সীমায় শান্ত পুরুষেরা
…………….যখন উদাস।

অকস্মাৎ ঘোরশব্দে কেঁপে ওঠে অরণ্যের সীমা—
অচেনা বীভৎস চোখে
ধেয়ে আসে অর্ধ-মানবেরা,
মনে হলো অন্ধ আবর্তনে ক্লান্ত
কোনো এক জ্যোতিষ্কের শিঙে
…………….বিদ্ধ হিমালয়
হঠাৎ সংঘর্ষে লিপ্ত
পৃথিবীর চূড়ান্ত সীমায়।

তারপর আঁধার সবুজ ঘাসে
অবচ্ছিন্ন হাত, মুণ্ড,
কেলাসিত রক্তের চাঙড়।

সন্ধ্যা নামে
প্রনষ্ট আলোর শীর্ষে
মরীচিকা-প্রতারিত কাল,
যারা বেঁচেছিলো— ফিরে আসে ঘরে।

অন্ধকার-অবলুপ্ত অরণ্যচূড়ায়
খদ্যোত-খচিত চাঁদ জাগে,
মেয়েদের ফুলে-ওঠা কান্নার জোয়ার
ঘুমের ভাটার টানে
ক্রমশ বিলীন।

তবু রক্ত-ঝঞা-রাত্রির গহনে
উদ্ভাসিত চোখ তার সুষুপ্তিবিহীন,
প্রোটোমানবের কোন কবি
আকাশের তারা গোনে
তারা হতে চায়—
অমৃত-খোঁজার শেষে
নেমে আসে নদীর সীমায়,
যেখানে লাশের নিচে লাশ—
বহুদূরে ধ্বংসের দামামা।

অকস্মাৎ দূরাগত গভীর নিনাদ
স্নায়ুপুঞ্জে আনে ঝড়,
অমৃত ছোঁবার প্রণোদনা।

ধ্বংসক্ষেত্র পিছে রেখে
সে তখন শব্দের পেছনে ধাবমান—
বৃক্ষ আর আঁধারের
মাইল মাইল রাজ্য,
নৈরাজ্য পেরিয়ে ছুটে যায়।

তার ধাবমান উদ্ভ্রান্ত আত্মায়
একে একে সূর্য ডোবে
একে একে নক্ষত্র ঘনায়,
তারা-নিভে-যাওয়া রাত্রি
শত শত সূর্য ফিরে পায়—
যেন তার উন্মত্ত চলার ছন্দ
মানুষের লক্ষ বছরের ইতিহাস।

কখনো সে থেমে যায় রোমাঞ্চিত।
মনে হয় অদ্ভুত, নিকটবর্তী,
যেন সেই পুঞ্জ পুঞ্জ ধ্বনির দামামা
উন্মোচিত হবে ক্ষিপ্র
……………নদীর বাঁকেই;
কখনো বা স্মৃতি আর শ্রুতির সীমায়
ক্রমশ অস্পষ্টতর ক্রমশ সুদূর।

তারপর একদিন
যুগান্তকালীন আলোহীনতায়
যখন সে লুপ্ত ছিলো,
জ্যোতিষ্কলোকের উদাসীনতায়
যখন সে বিপর্যস্ত ছিলো,
তখন অভ্রান্ত শব্দ শোনা গেল—
তখন মাহেন্দ্রলগ্নে
কুয়াশার অন্তরালে অসূর্য পাহাড় জাগে।
গুটি গুটি পায়ে আসে ভোর।

সেখানে অরণ্য শেষ—
পাহাড়ের রুদ্র পায়ে
ভেঙে-পড়া জলস্রোত
অজস্র তুষার-শুভ্র দানবীর
ঝড়ে-ওড়া চুলের উল্লাস।

শিলার আসনে স্তব্ধ
প্রোটোমানবের সেই কবি
তখন নিমগ্ন শোনে
চূর্ণ জলরাশি থেকে উৎপাটিত
…………..আদিম সোনাটা,
বোধের অনেক দূরে বেজে ওঠে বীঠোফেন
বোধির অনেক নিচে জেগে ওঠে
……………………..মৃত্যুর এষণা।

জলপ্রপাতের সেই
ফসফরাস বিচূর্ণ ঊষায়,
ইরম্মদ-ঝলসিত মুহূর্তের
…………..শৈলান্তরীপে কাঁপে
…………..অনাগত ভবিষ্যৎ;
চেয়ে দেখে— ঝঞ্ঝায় উত্থানে
আর উত্থানে ঝঞ্ঝায়—
ক্লান্তিহীন ইতিহাস
খুঁজে পায় চূড়ান্ত বিন্যাস।

প্রমিথিউসের রক্তে
সূর্যের আবির-গোলা জল
তখন মন্থিত, ক্ষিপ্ত, অসহায়;
ইতিহাস-প্রসারিত চেতনায়
লোহিতাক্ষ এ্যান্টিগোনি
ট্র্যাজেডীর দিনান্ত সিম্ফনি।

তারও পরে বোধের ওপারে
সমাধিবিলীন সেই দেবতার জটার আঁধার শূন্যে
পরতম নেতির আভাস;
তার প্রোটোমানবিক স্বপ্নে, জাগরণে,
…………সে তখন স্নায়ুর গহনে, শোনে—
অগ্নিমুখ বিহঙ্গের পক্ষবিধুনন।


ধর্ষিতার গান, ২০০১

সুস্মিতা চক্রবর্তী-র জন্য


কেঁদে উঠি যদি যন্ত্রণায়
অন্ধকারে ঢেকে দিও লোনা জল,
রক্তে যদি ভেসে যায়
শরীরের সমস্ত সরণী
ঢেলে দিও এ্যান্টার্কটিকা শাদা,
শোণিতের সূর্যবিন্দু শান্ত হবে
বরফের কঠিন চুম্বনে।

যদি অঙ্গ ছিন্ন হয়
পুঁতে দিও মাটির তলায়
মাতা বসুমতী দিবে ঠাই,
বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে যদি
হাতের কঙ্কণ, এই কণ্ঠহার
ছুঁড়ে ফেলো অগ্নিকুণ্ডে স্বর্ণমায়া
…………….তুচ্ছ আভরণ।

কণ্ঠ যদি আর্তি পায় অনুনয়ে
শব্দ যদি ভেঙে যায় ভয়ে, আরো গাঢ়তর ভয়ে,
রুদ্ধ কোরো প্রার্থনার লেশ
সুনিশ্চিত কোরো সেই মেয়েলী আবেশ যেন
আক্রান্ত করে না কারো সিংহবীর্য
………………..আর বীররস।

ধুলায় লুণ্ঠিত যদি কালো বেণী
কেটে দিও সর্প বলে
জড়াবে না বারবার আঙুলে তোমার,
যদিবা অশ্লীল ভাবো সিঁথির সিঁদুর
গলিত সীসার জল ঢেলে দিও
…………রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার।

শেষ দুর্বলতা হয়ে
যদি কোনো মাতৃমূর্তি
ভেসে ওঠে অসতর্ক স্মরণে তোমার
বিদ্যুতের ক্ষিপ্রতায় উৎপাটিত কোরো তার স্মৃতি।

আর যদি মৃত্যু হয়—
ছুঁড়ে দিও নদীর আত্মায়,
যেন এক অধ্বনিন পুনরুত্থানের পরে
উঠে আসি এলোচুলে, খড়গহস্তা
অনন্ত বাংলার প্রতিটি নদীর রক্তজলস্রোত ছিন্ন করে
রণচণ্ডী হয়ে বারবার।


ছবিঋণ : ব্যানারে ব্যবহৃত কবি অসীম কুমার দাসের ছবিটি মারিয়া সালামের ফেসবুক থেকে নেওয়া। তাঁকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।