আগামী ২১ ডিসেম্বর কবি জফির সেতু ৫০-এ পদার্পণ করবেন। কবিকে আমাদের শুভেচ্ছা। তিনি নিরন্তর কর্মমুখর এবং সৃজনশীল থাকুন— এ-ই প্রত্যাশা। —সম্পাদক
বনের ভিতর আমার ঘর
একঝাঁক সুয়াপাখি উড়ে আসল নলখাগড়ার বনে
এই স্তব্ধ দুপুর ভরে উঠল আমার শঙ্কা ও বিষাদে
কারণ আমি চাষা; বনের ধারেই আমার বীজতলা
সুয়াপাখি যখন এলো উড়ে আমি তো দূরের মাঠে
বনের ভিতর আমার ঘর; লতাপাতা দিয়ে রাঁধছে বউ
যখন একঝাঁক সুয়াপাখি আসল নলখাগড়ার বনে!
জিয়াফতে
কলাপাতায় খাচ্ছি আমনধানের ভাত
বসেছি মাটিতে জানুপেতে
এই যে দাওয়ায় লোকের সারি জিয়াফতে
ব্যস্ত সকলে খেতে গোশত ও আলু
আমারও জিহ্বায় গড়িয়ে পড়ছে জল্লু
তুমি শুধু হাঁটছ উঠানে চুল খুলে!
আঙুলে গরুর চর্বি আর হলুদের দাগ; খাচ্ছি মিঠুরি
একটা কুকুর শুঁকছে তোমার জামার খুঁট!
জারুল
আমাকে জ্যৈষ্ঠেই ডেকেছিল একটি জারুল, আয়!
আমাকে তুলেছিল গাছে; শাখায় পাতায় ও শিখরে
একটি জারুল শুয়েছিল মাঠে; গড়িয়ে গড়িয়ে ঘাসে
মূর্ছাও খেয়েছিল পুবাল বাতাসে যখন নওলি যৌবন!
খেতের আলে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি জারুলও
কতটা লাজুক হতে পারে এমনকি যখন সে একা
আমাকে জ্যৈষ্ঠেই বিদায় জানিয়েছিল একটি জারুল
ছুড়ে ফেলেছিল শূন্যে ও মাটিতে; বলেছিল, বিদায়!
হাওয়ার শব্দ
তোমাকে কখনও ভাবি জংলি একটা পোকা
কোথা থেকে উড়ে এসে বসেছ আমার চুলে
বসেছ হাতের পিঠে ঘাড়ের ওপর!
একটা তীব্র গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে
তারপর কোথায়-যে উড়ে গেলে!
এখন কান পেতে শুনি কেবল হাওয়ার শব্দ
আর তার ভিতরে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা!
গজারমাছ
যে-রাতে সরষেখেতে উঠে এলো গজারমাছ
কী আশ্চর্য জোছনা গড়িয়ে পড়েছিল আকাশে
মাঘের হাড়কাঁপুনি শীতে জঙ্গলমাড়িয়ে
সেই যে এলো মাছ সরষের ফুল খাবে বলে
আমরাও নীরব শিকারি ট্যাটা হাতে সজাগ দৃষ্টিতে
কাটিয়ে দিলাম প্রহরের পর প্রহর ঠান্ডা ও হিমে
সেই সে রাতে শিশিরে স্নাত আমরা সকলে কাঁপছি
ট্যাটায় গেঁথে বড়ো গজারমাছ আমরা কতই-না খুশি
কিন্তু তুমি পুরুষ-মাছটি দেখে এভাবে কাঁদছিলে কেন?
ঢোঁড়াসাপ
এই ঢোঁড়াসাপ আমার সঙ্গী
মাছের সঙ্গে সেও জালে ধরা পড়েছে!
এই যে নির্বাক ঢোঁড়া এখন আর তেড়ে আসে না
শুধু ঝিমায় আর নেতিয়ে পড়ে কাদায়।
এই ঢোঁড়াসাপ আমার সঙ্গী
করচগাছের নিচে সেও প্রণয়কাতর ছিল!
পুরোনো ভিটায়
ভিটার ওপর গাছগুলি কুষ্ঠরোগীর মতো কাঁপছে
এই গাছগুলি রুয়েছিল দাদি বড়োপানিরও আগে
যখন ডাকাতেরা পুড়িয়ে গেল ঘর
দাদা-দাদিও জোড়া-অঙ্গার; আমরাও ভিটেহারা!
আবার এসেছি ফিরে পুরোনো ভিটায়
জোড়া গাছগুলি কেবল কুষ্ঠরোগীর মতো দাঁড়িয়ে!
এই বৃষ্টিতেই
এই বৃষ্টিতে একটি চড়ুইছানা আমাকে ডাকল
আমি দেখলাম মা মনসা মুখ টিপে হাসছে!
পাখিরা আমাকে এভাবে ডাকে—ডেকে নিয়ে যায়
বলে, আমরা মনসার কোলে-কাঁখে থাকি
মনসা আমাদের মা— বনে-বাদাড়, খালে ও বিলে!
আজ বৃষ্টিতে যখন চড়ুইছানাটি উড়ে এলো ঘরে
আমি তার চঞ্চু দেখলাম; করুণচোখ ও পালক
সারা শরীরে মা মনসার গন্ধ আর গর্ভের উষ্ণতা!
আমার হাতেই মনসা-মায়ের সন্তান কাঁপছে
পক্ষীর ডাক আমি উপেক্ষা করতে পারি না!
গঙ্গা-যমুনা
শবরী বালিকাকে চেয়েছিলাম, পাইনি
এখন আমি উন্মত্ত শবর।
যো চোর সো সাধু—আমি চোর যেমন সাধুও বটে
আমার গলে এখন হাড়ের মালা।
আমাকে জিজ্ঞেস করো না আজ সে কোথায়?
সারাজীবন আমি শুধু গঙ্গা-যমুনাই করেছি!
শবরী বালিকাকে চেয়েছিলাম, পাইনি।
নমঃশূদ্র
আমি নমঃশূদ্রের ছেলে আমি শিবু কৈবর্ত
আমার পরনে নেংটি গলায় পুতির মালা
আমার উদোম শরীরে থুতু ছিটিয়ে দাও!
খালের পাড়ে ঘর আমার চাঙারিতে শুই
আমি নমঃশূদ্র সন্তান; কবজিতে গাছের জড়ি
আমার বাবা গেছে জালে মা শামুক কুড়ায়
আর বোনকে নিয়ে গেছে সুবীর মহাজন
আমি নমঃশূদ্র, নেংটি পরে তোমার পায়ের নিচে
আমার ঘন চুলে, চোখে-মুখে আবার থুতু দাও!
জন্ম সিলেটে, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। তিনি একাধারে কবি, আখ্যান-লেখক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তাঁর এ-যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশ। ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘কবিতাসংগ্রহ’ প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্য ‘তিনভাগ রক্ত’ (২০২০), আখ্যান ‘একটা জাদুর হাড়’ (২০২০), ভ্রমণ-আখ্যান ‘না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা’ (২০২১), ও গবেষণা ‘বঙ্গবন্ধু ও নয়াচীন’ (২০২১)। সম্পাদনা করেন ছোটোকাগজ ‘সুরমস’ ও গোষ্ঠীপত্রিকা ‘কথাপরম্পরা’।