এক
সারা রাত বহু আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি। ভোরে ঘুম ভাঙার পর আবিষ্কার করলাম, আমি গ্রেগর সামসা হয়ে গেছি।
কাফকা আমার প্রিয় লেখক। কিন্তু সামসা প্রিয় ক্যারেকটার না। তাকে থাপড়াইতে মন চাইছিল যখন মেটামরফোসিস পড়ছি প্রথমবার। জীবনে আর যা-ই চাই না কেন, গ্রেগর সামসা হইতে চাই নাই কখনো। সার্ত্রের কোনো ক্যারেকটার হইতে পারলে বেশি খুশি হইতাম। যদিও ওঁনার ফিকশন খুব একটা পছন্দ না আমার। তবে তাঁর দর্শন ভালো লাগে। লোকটা মার মার কাট কথা বলে—যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং।
সত্যি বলতে কি, আমি খুশি হইতাম কামুর দি আউটসাইডার-এর ক্যারেকটার হইতে পারলে। যেকোনো ক্যারেকটার। তার বদলে হইলাম গ্রেগর সামসা। একটা ধ্বজভঙ্গ লোক যাকে পৃথিবী তার যাঁতাকলের মধ্যে ফালায়ে প্রতিদিন পিষতেছে আর সব রস নিংড়ায়ে নিতেছে।
গত দুইদিন কলেজ ছুটি ছিল। প্রচুর মুভি দেখছি গতকাল বিকাল পর্যন্ত। সিরিয়াস কোনো মুভি-টুভি না। নটিংহিল, ফিফটি ফার্স্ট ডেইটস, মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস ওয়েডিং … এই টাইপের হালকা পাতলা রোমান্টিক মুভি। আসলে রিভিশন দিছি। ছবি দেখা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে এখন আর আমার ভালো লাগে না। পুরনো অল্প কয়েকটা ছবিই ঘুরে ফিরে দেখি। যতবার এক্সপেরিমেন্ট করছি, বিপদে পড়ছি।
গত রাতেও সেই রকম একটা ভুল করে ফেলছিলাম। ছোট বোন উর্মি রাত নয়টার দিকে বলল, আপু, ক্যাপারনেয়্যাম ছবিটা দ্যাখো। বাচ্চাটার অ্যাকটিং দেখলে পাগল হয়ে যাবা।
দেখার সময়ই বুঝতেছিলাম যে ভুল হইতেছে। তবু ফাঁদে পা দিলাম। সিক একটা ছবি। জীবনে জটিলতা কম নাই আমার। এইসব ছবি দেখে নতুন করে জটিলতা আমদানি করতে ভালো লাগে না আর। ক্যাপারনেয়্যাম দেখে আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হইলো। মানুষ এইসব ছবি বানায় কেন কে জানে? কোনো ব্রিদিং স্পেস নাই, খালি দুঃখকষ্ট।
দেখলাম। দেখার সময়ই বুঝতেছিলাম যে ভুল হইতেছে। তবু ফাঁদে পা দিলাম। সিক একটা ছবি। জীবনে জটিলতা কম নাই আমার। এইসব ছবি দেখে নতুন করে জটিলতা আমদানি করতে ভালো লাগে না আর। ক্যাপারনেয়্যাম দেখে আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হইলো। মানুষ এইসব ছবি বানায় কেন কে জানে? কোনো ব্রিদিং স্পেস নাই, খালি দুঃখকষ্ট। সাফোকেশনে ভর্তি।
ক্যাপারনেয়্যাম-এর ভুত মাথা থেকে নামল না। সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখলাম ছাড়াছাড়া ভাবে। এরপর কী হইলো তা তো আগেই বলছি। আমি গ্রেগর সামসা হইয়া গেলাম।
সামসা হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, আজ রোববার। কলেজে যাইতে হবে। সকাল নয়টায় অনার্সের একটা ক্লাস নেওয়ার কথা। পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচারের থিংস ফল অ্যাপার্ট-এর ওপর ক্লাস। কোনোভাবেই মিস দেওয়া যাবে না। লেকচারার হিসেবে জবটা এখনো পারমানেন্ট হয় নাই আমার। পারমানেন্ট করতে হইলে অনেক আজাইরা কাজ করতে হবে। তার মধ্যে একটা হইলো, সকাল নয়টার ক্লাসে ঠিকঠাক হাজিরা দেওয়া।
সামসারাই হয় পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার। বাপ, মা, ভাই বোনসহ গুষ্টিসুদ্ধ লোক তার ঘাড়ের ওপর বইসা থাকে। তাই তার জন্য চাকরি পারমানেন্ট করা জরুরি। বাপের রিটায়ারমেন্টের পর থেকে ফ্যামিলি আমার ওপর অনেকটাই ডিপেন্ড করে।
খুব দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে বাইর হইলাম বাসা থেকে। মা বলছিলেন, নাস্তা করে যাইতে। করলাম না। সামসাদের খাবারে রুচি থাকে না। তারা সংগীত থেকে শরীরের পুষ্টি লাভ করে। আমি কানে হেডফোন লাগায়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার মুখে আমার কলেজ। কচুক্ষেত টু ক্যান্টনমেন্ট প্রতিদিন আমাকে হাঁটতে হয়। ইচ্ছে করে হাঁটি তা না। সকালবেলা রিকশা পাওয়া কঠিন। দুই একটা যা পাই, প্লেনের টিকিটের সমান ভাড়া চায়। কাঁধে দুই মণ ওজনের ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে পুরোটা পথ আমি হাঁটি। এই সময় হেডফোন কানে লাগায়ে গান শোনার চেষ্টা করি।
দেখলে মনে হবে আমি একটা শান্তশিষ্ট আলাভোলা মেয়ে। সতীনাথ ভাদুড়ী টাইপ গান পছন্দ করি। আসলে তা না, আমি ম্যাক্সিমাম টাইম চিল্লাপাল্লা মার্কা গান শুনি। এই যেমন, ইমাজিন ড্রাগনস, কিম আ জুং বা কোরিয়ান কোনো হেভি মেটাল। গান শোনার ব্যাপারে আমার একটা নিয়ম আছে। আমি যখন লো ফিল করি, তখন চিল্লাপাল্লা গান শুনি। এতে স্পিরিট হাই হয়। আর যখন মেজাজ ঠিকঠাক থাকে, তখন শুনি দুনিয়ার সব মেলোডি। ইনস্ট্রুমেনটের মধ্যে খুবই প্রিয় হইলো ফ্লুট আর ভায়োলিন।
যখন স্টুডেন্ট ছিলাম, একটা ছেলের সাথে মাখামাখি ছিল। নাম শান্ত। শান্ত খালি গলায় গান গাইত। সেই গান আমার খুব ভালো লাগত। এখন আর খালি গলায় গান শোনানোর কেউ নাই। থাকলেও শুনতাম কি না সন্দেহ আছে। এইসব ভালো লাগে না আমার আর। নষ্ট হয়ে গেছি। অধিকাংশ সময় মেজাজ খারাপ থাকে। আর তাই হেভি মেটাল টাইপের চিল্লাপাল্লা শুনি।
ভাবছিলাম, একটা সাইকেল কিনে নেব যাওয়া-আসার জন্য। কিন্তু কোনো ফ্যাকাল্টি মেম্বার সাইকেল চালায়ে ক্লাস নিতে আসলে কলেজ অ্যাডমিনের সবাই দল বেঁধে সুইসাইড করবে। শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো কাপড় পরে গেলেই একগাদা কথা শোনায়। ব্লাউজ পড়তে হয় হাই নেকের। আমার আবার ওই টাইপের ব্লাইজ ছিল না কোনো। এই বালের কলেজে চাকরি নেওয়ার পর ওই জিনিস বানাতে হইছে।
এইরকম নানান আজাইরা নিয়ম চালু আছে কলেজে। সেইখানে আমি যদি সাইকেল চালায়ে হাজির হই তো আমাদের ভোটকা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখ দুইটা কোটর থেকে খুলে ফ্লোরের মধ্যে পড়বে। তারপর পিংপিং বলের মতো লাফাবে। তাছাড়া শাড়ি পরে সাইকেল চালানো যাবে কি না সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে।
যখন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়তাম তখন সাইকেল চালাইছি। পার্টির কাজ করতাম তখন। তিন চার বছর হেব্বি পলিটিক্স করছি। শান্তর সাথে তখনই আলাপ। সেই সময় আমি সত্যি সত্যিই ‘আমি’ ছিলাম। তারপর পার্টির কাজ করতে গিয়েই নিজের রুচি, পছন্দ সব বাদ দিতে হইছে একসময়। অন্যদের নিয়ে ভাবতে বলা হইত তখন। এইটাকে অভ্যাস করতে হইছে বছরের পর বছর। একটু একটু করে সামসা হওয়ার দিকে আগাইছি।
আসলে আমি একটা সার্কেলের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছি। বের হওয়ার জন্য যে চেষ্টা করতেছি তা-ও না। এক এক সময় অবশ্য মনে হয়, এই সব ফালতু চাকরি ছাইড়া দিয়া নিজের ইচ্ছা মতো একটা কাজ করি।
দুইটা কারণে করা হয় না। নিজের ইচ্ছার কাজটা কী তা ঠিকঠাক ধরতে পারি নাই আজতক। টুকটাক লেখালেখি করতে পারি। পত্রিকায় গল্প, কবিতাও ছাপা হয়। কিন্তু সেইটা থেকে তো কোনো টাকাপয়সা আসে না। সামসাদের জীবনে টাকাপয়সা ম্যাটার করে।
দুইটা কারণে করা হয় না। নিজের ইচ্ছার কাজটা কী তা ঠিকঠাক ধরতে পারি নাই আজতক। টুকটাক লেখালেখি করতে পারি। পত্রিকায় গল্প, কবিতাও ছাপা হয়। কিন্তু সেইটা থেকে তো কোনো টাকাপয়সা আসে না। সামসাদের জীবনে টাকাপয়সা ম্যাটার করে। তাই আমার লেখালেখির দৌড় ডায়েরি লেখা পর্যন্তই থাইমা আছে।
আর একটা কারণ হইল, চাকরি ছাড়ার জন্য যে হিম্মত থাকতে হয় সেইটাও আসলে আমার নাই। ফাইনানসিয়াল বার্ডেনের হাত থেকে রিলিফটা যদি খালি পাইতাম! নির্ভার হইতে পারতাম। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। তাই গ্রেগর সামসা হইয়াই থাকতে হবে।
— ৩০ নভেম্বর, ২০১৯।
দুই
আজ ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি হোল্ডেন হয়ে গেছি। দারুণ ব্যাপার। ‘কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়’ টাইপের একটা ফিল দিয়া দিন শুরু হইল।
জীবনে অনেকবার হোল্ডেন হইতে চাইছি। পারি নাই। হোল্ডেন হওয়ার জন্য ডেসপ্যারেট হইতে হয়, চিন্তাভাবনায় অনেস্ট হইতে হয়। কোনোটাই ছিলাম না।
জে ডি স্যালিঞ্জার একটা মাল। এই লেখকের ক্যাচার ইন দ্য রাই আমার অনার্সের সিলেবাসে ছিল। ঢাবিতে ইংলিশে পড়তাম। ফোর্থ ইয়ারে নিলাম আমেরিকান লিটারেচার। সারাদিন এই একটা বই নিয়ে পইড়া থাকতাম। আমার রুমমেটরা অবাক হইত, হঠাৎ কইরা এরইরকম স্টুডিয়াস হইলাম ক্যামনে! সারাদিন পড়াশোনা করতে তারা আমারে কখনো দেখে নাই এর আগে।
আসলে কিন্তু পড়াশোনা বলতে যা বোঝায়, তা করি নাই। শুধু ক্যাচার ইন দ্য রাই পড়ছি। প্রায় ৩০ বার পড়ছি একবছরে। এখনো অনেক জায়গা মুখস্ত বলে দিতে পারব। স্কুলপালানো ১৬ বছরের টিনেজার হোল্ডেনের প্রেমে পড়ে গেছিলাম তখন। কী ডেঞ্জারাস একটা ক্যারেকটার!
এইরকম একটা ক্যারেকটার লিখতে পারলে সেই রাইটারের জীবনে আর কিছু না লিখলেও চলে। এইজন্যই মনে হয়, স্যালিঞ্জার জীবনে আর কোনো উপন্যাস লিখে নাই। গুড ডিসিশন। ক্যাচার ইন দ্য রাই আরেকটা পয়দা না করতে না পারলে না লেখাই ভালো। কোনো কোনো ভার্সিটিতে এইটারে ক্লাসিক হিসেবে ট্রিট করে—পাঠ্য বই। আবার কোনো কোনো বলদ মনে করে, এই বই পড়লে পোলাপান বখে যাবে। এইটারে তারা নিষিদ্ধ করছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, একই সাথে কন্ট্রাডিকটরি।
হোল্ডেনের একটা বৈশিষ্ট্য হইল, সে প্রচুর কন্ট্রাডিকটরি কথাবার্তা বলে। দুনিয়ার সবাইরে তার কাছে বলদ মনে হয়। কারো কিছু পছন্দ না হইলে বমি পায় তার। আমারও ইদানিং প্রচুর বমি হইতেছে। সবাইরে বলদ মনে হয় আর ধরে ধরে থাপড়াইতে ইচ্ছা করে। দুই একটা নমুনা দেই।
কোভিডের কারণে মার্চ মাস থেকে আমাদের কলেজ ছুটি। যাইতে হয় না ফিজিক্যালি। তবে অনলাইনে ক্লাস নিতে হয়। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হইছে কমুনিকেশনের জন্য। সেই গ্রুপে সব ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা জয়েন দিছি। ফেসবুকেও একটা গ্রুপ আছে। সেইখানে স্টুডেন্টসহ ফ্যাকাল্টির সবাই আছে।
আমাদের আগের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম রিটায়ার করছে। হোৎকা সেই মহিলার বদলে এখন আসছে এক আধবুড়া। পরিপাটি, হাসিখুশি লোক। কিন্তু মাথায় নাই এক ছটাক বুদ্ধি। আগেরটার চেয়েও এইটা বড় বলদ। গাছবলদ একটা। তো সে আমারে হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইল পিক চেঞ্জ করতে বলছে। কারণ সেইখানে আমার দুই বছর আগের একটা ছবি। সেই ছবিতে চুল বয়কাট করা। ওই ভোদাইটার মনে হইছে, কলেজের ম্যাডামের চুল বয়কাট থাকতে পারবে না। এতে করে কলেজের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এইটারে না থাপড়ায়ে ভাত খাইলে সেই ভাত হজম হওয়ার কথা না।
এর মধ্যে আবার আরেক কাহিনি হইছে। আমি ফেসবুক ব্যবহারই করতাম নিজের লেখা কবিতাগুলো পোস্ট করার জন্য। সেইটার ব্যাপারেও নিষেধ আসছে। কলেজের এক ইয়াং ম্যাডাম ফেসবুকে উড়ু উড়ু টাইপের কবিতা পোস্টায় এইটাতে অন্যদের পাছা জ্বলে। তারা বলছে, এইগুলান করা যাবে না। ছাগলের দল, আমার ফেসবুকে আমি কী দেব না দেব সেইটা আমার হিসাব। তোর কথা শুনে দেব? কানের তিন আঙুল নিচে থাপ্পড় বসানো দরকার একেকটারে।
ভাবছিলাম, কোভিডের কারণে হঠাৎ পাওয়া এই ছুটিটা কাজে লাগাব। কিছু অনুবাদের কাজ করব। দুই একটা প্রকাশনার সাথে পরিচয় আছে আমার। ক্যাচার ইন দ্য রাই-এর বাংলায় ভালো অনুবাদ নাই। একটা ফাটাফাটি অনুবাদ করার ইচ্ছা ছিল। বইঘর খুব আগ্রহ নিয়ে বইটা ছাপাতে চাইছে। টাকা পয়সাও দেবে। প্রথম পাঁচটা চ্যাপ্টার অনুবাদও করে ফেলছি। তো এখন মনে হইতেছে, বইটার মধ্যে যে হারে স্ল্যাং—এই বই পাবলিশ হইলে কলেজের চাকরি নট হয়ে যাবে। বইয়ের কাজ করতে হবে ছদ্মনামে।
প্রকাশকরে একদিন বললাম আমার সমস্যার কথা। সে বলল, ছদ্মনামে করার দরকার নাই। অন্য একটা কাজ করেন।
জিজ্ঞেস করলাম, কী কাজ?
আপনে এই ঝামেলার বইটা কয়েক বছর পরে করেন। কলেজের প্রিন্সিপাল চেঞ্জ হোক। আপনিও একটু সিনিয়র হন। তখন আর কিছু বলতে পারবে না। এখন অন্য কিছু করেন। একটা মোটিভেশনাল বই অনুবাদ করে দেন। দ্য সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেকটিভ পিওপল। চালু বই। টাকা পয়সা ভালো পাবেন।
আপনে এই ঝামেলার বইটা কয়েক বছর পরে করেন। কলেজের প্রিন্সিপাল চেঞ্জ হোক। আপনিও একটু সিনিয়র হন। তখন আর কিছু বলতে পারবে না। এখন অন্য কিছু করেন। একটা মোটিভেশনাল বই অনুবাদ করে দেন। দ্য সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেকটিভ পিওপল। চালু বই। টাকা পয়সা ভালো পাবেন।
ওনার অফিসেই বইটা ছিল। হাতে নিয়ে দুই পাতা পড়ার চেষ্টা করলাম। বমি আসায় তিন নম্বর পাতা পর্যন্ত যাওয়া হয় নাই। তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি খুব তাড়াতাড়ি হোল্ডেন হয়ে যাইতেছি।
— ২৬ মে, ২০২০।
তিন
আজ ঘুম থেকে উঠে একসাথে অনেককিছু হইলাম। মিতু, নীতু, জরি, তিতলি কিংবা কংকা—হুমায়ূন আহমেদের ক্যারেকটার সবগুলান। এই ক্যারেকটারগুলো যে রকম হুইমজিক্যাল, ভাবের ওপরে চলে, সকাল থেকেই সেইরকম লাগতেছে নিজের কাছে। গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধাইতে মন চাইতেছে।
ঘুম থেকে ওঠার পর আম্মারে হুদাই বললাম, তোমার গায়ে গন্ধ। গোসল করো না কয়দিন?
এইটা বলার কোনো দরকার ছিল না। ডিসেম্বরের শেষ এখন। শৈত্যপ্রবাহ চলতেছে। এই কনকনে ঠান্ডায় সবাই প্রতিদিন গোসল করে না। আমি নিজেও লাস্ট দুই দিন করি নাই। তারপরও আম্মারে রাগানোর জন্য কথাটা বলছি।
শান্তরে ফেসবুকে খুঁজে বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইছি একটা। পুরনো প্রেম ঝালাই করার জন্য পাঠাইছি তা না। হুইমজিক্যালি পাঠাইছি। হুমায়ূন আহমেদের ক্যারেকটার হইলে এই টাইপ কাজকর্ম করতে হয়। তারপর দুপুরের দিকে ফেসবুকে আমার যত কবি, লেখক আর নাট্যকার বন্ধু আছে সবগুলারে আনফ্রেন্ড করছি। গভীর রাতে ন্যাকা ন্যাকা মেসেজ পাঠায়—আবালের দল।
এক কবি গতকাল রাত দুইটায় মেসেজ দিছে, কেমন আছেন?
আমি সিন করে রিপ্লাই দেই নাই।
সকালে আবারও লিখছে, কেমন আছেন, বললেন না তো।
দুইবার জানতে চাইছে। এরপরও রিপ্লাই না দিলে খারাপ দেখায়। লিখলাম, ভালো। আপনি কেমন আছেন?
সে উত্তর দিছে, কুসুম কুসুম ভালো।
মনে হইতেছিল, পায়ের চপ্পল খুইলা শালার বিচির মধ্যে একটা মারি। ডিম দুইটা ফাইটা কুসুমে মাখামাখি হয়ে যাক। আমার সাথে ‘কুসুম কুসুম ভালো’ মারাচ্ছে। আবাল একটা।
কোভিডের কারণে প্রায় সাত আট মাস হয়ে গেছে বাসা থেকে বাইর হই না। মাথা গরম হয়ে থাকে সবসময়। আমার আসলে দূরে কোথাও যাওয়া দরকার। সাফোকেশন নিতে পারতেছি না আর। এইভাবে হয় না। দিন দিন খিটখিটে হয়ে যাইতেছি।
একজনের কুসুম কুসুম ভালো থাকার অপরাধে সবগুলান কবি সাহিত্যিকরে আনফ্রেন্ড করাটা একটু বাড়াবাড়িই হইছে। সবাই তো আর খারাপ না। সন্ধ্যার দিকে এইটা নিয়ে একটু একটু অনুশোচনা হইল। তারপর লিস্ট ধইরা একে একে সবাইরে আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইলাম। ডায়েরি লিখতে লিখতে এখন আমি ল্যাপটপের স্ক্রিনে উঁকি দিচ্ছি, তারা রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল কি না।
হুমায়ূন আহমেদ বাঁইচা থাকলে মিতু, নীতু, জরি, তিতলি, কংকারা এইরকমই করত। ১০০০ টাকা বাজি।
— ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০।
চার
আজ ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মুরাকামির ক্যারেকটার হয়ে গেছি। অথচ আমি এই লোকটারে হেইট করি। তার ক্যারেকটারগুলারে আরও বেশি। ওইরকম ডিপ্রেশনে ভুগতে চাই না কখনো। আমি আসলে রোদ্দুর হইতে চাই—অমলকান্তির মতো।
গত তিনমাস ধরে প্রায়ই রাত জাইগা থাকি। বলা যায় ভোর পর্যন্ত। চাইলেই ঘুমাইতে পারি। কিন্তু ঘুমাই না। জীবনে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতেছি। কী লাভ ঘুমায়ে? বিছানায় শুয়ে ড্যাবড্যাব চোখে ফ্যান ঘোরা দেখি। আম্মার ধারণা, আমি পাগল টাগল হয়ে যাইতেছি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে নিয়ে গেছিল আমারে। বুইড়া ডাক্তার একগাদা ঘুমের ওষুধ দিছে। কিন্তু ওইগুলা আমি খাই না। আজাইরা ঘুমাইতে ইচ্ছা করে না। সব ওষুধ ড্রয়ারে জমতেছে। আম্মারে বুঝতে দেই নাই, আমি ওষুধ খাই না।
আমার ঢাকা ছাইড়া ফরিদপুরে গিয়ে থাকতে ইচ্ছা করতেছে। কিন্তু জানি, সেইটা করা যাবে না। যে দিন গেছে, সেই দিন আর ফিরবে না। অতীত হইল ছায়ার মতো, ধরা যাবে না।
একটা দরজা দেখতে পাই চোখের সামনে। মাঝেমধ্যেই মনে হয় দরজাটা খুলি। ওই পাশে একবার উঁকি দেই। উঁকি দেওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আমার অন্য পাশে চইলা যাইতে ইচ্ছে করে। জানি, একবার গেলে ফিরে আসাটা কঠিন। ম্যাক্সিমাম লোক ফিরতে পারে না। পাগল টাগল হয়ে যায়।
গত জানুয়ারি থেকে পাগল হওয়ার পথে বেশ অনেকগুলো স্টেপ নিয়ে নিছি। কিছুতে মন বসাইতে পারতেছি না। কলেজে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিছিলাম। যদিও অনলাইনে ক্লাস নিই, তারপরও ভালো লাগতেছিল না কাজটা করতে। ছুটি চাইছিলাম। ভাবছিলাম, দেবে না। কিন্তু দিয়ে দিছে।
গত জানুয়ারি থেকে পাগল হওয়ার পথে বেশ অনেকগুলো স্টেপ নিয়ে নিছি। কিছুতে মন বসাইতে পারতেছি না। কলেজে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিছিলাম। যদিও অনলাইনে ক্লাস নিই, তারপরও ভালো লাগতেছিল না কাজটা করতে। ছুটি চাইছিলাম। ভাবছিলাম, দেবে না। কিন্তু দিয়ে দিছে।
ছুটি পাওয়ার পর পড়ছি মহা বিপদে। আমার হাতে এখন প্রচুর সময়। এই ফাঁকা সময়টা কী দিয়ে ভরাব খুঁজে পাইতেছি না। পুরাটাই ডিপ্রেসিং। বই পড়তে ভালো লাগে না, ছবি দেখতেও না। কী যেন একটা করতে ইচ্ছা করে—জানি না!। আপাদমস্তক লক্ষ্যহীন এক মানুষ হয়ে যাইতেছি। যাদের কোনো গোল নাই তাদের সুখী হওয়ার কথা। খাবে-দাবে, ঘুরবে ফিরবে—কোনো টেনশন নেবে না। আমার ক্ষেত্রে তা-ও হইতেছে না। মনের মধ্যে শান্তি পাইতেছি না কিছুতেই।
রাস্তার একটা বিড়াল ঢুকছিল ঘরে। তারে কিচেন থেকে এক টুকরা মাছ আইনা দিতেই পোষ মাইনা গেছে। এখন আর সে যায় না। খুবই খারাপ লক্ষণ। মুরাকামির ক্যারেকটাররা বিড়াল নিয়ে ঘোরাফেরা করে। তারপর একদিন সুইসাইড করে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি এখন। লকডাউন তুলে দিছে। ইচ্ছা করলে কোথাও থেকে বেড়ায়ে আসতে পারি। কিন্তু কার সাথে যাব? একা একা কোথাও যাইতে ইচ্ছা করে না। আমার ভার্সিটির বন্ধুবান্ধব সব এক দুই বাচ্চার মা। তাদের নিজেদের লাইফ আছে। তারা আমারে সময় ক্যান দিবে? আর আমিও বা হ্যাংলার মতো তাদের কাছে সময় চাইতে যাব ক্যান? কথা বলার মতো একটা মানুষও পাই না আজকাল।
বাপ-মা, ভাই-বোনের সাথে টাইম পাস করা যায়। তাদের নিয়েও ঘুরে আসা যায় কোনো জায়গা থেকে। কিন্তু ফ্যামিলি আড্ডাগুলো খুব বোরিং হয়। সেখানে সবাই ঘুরে ফিরে একই জোক করে। বারবার করে। ২০০৫-এ যে জোক করছে, ২০২১-এও সেই একই জোক। ভেরিয়েশন নাই কোনো। খালেক নামে এক কাকা ছিল আমাদের। সেই খালেক কাকার জিলাপি খাওয়া নিয়ে একটা জোক ৮৩ বার শুনছি মিনিমাম। ৮৪-তম বার যখন ওই জোক শুনতে হবে, তখন ভদ্রতা করেও আর হাসতে পারব না। এই ভয়ে ফ্যামিলি আড্ডা এড়ায়ে চলি।
গতকাল দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হইছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। আমি বালিশে হেলান দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনার চেষ্টা করছি কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে ভাত খাইছি। বিড়ালটার সাথে খেলছি। বিকালে আম্মা চাইল ভাজা মাখায়ে দিছিল সরিষার তেল আর মরিচ-পিঁয়াজ দিয়ে। আমি কুটুর মুটুর করে চাবাইছি। মুখস্ত একটা জীবন।
আজকে আবার বৃষ্টি পড়তেছে। আমি নাচলাম কিছুক্ষণ। সত্যি সত্যি না, মনে মনে। ডান্সিং ইন দ্য রেইন। নাচের প্রত্যেকটা স্টেপ আমার মুখস্ত। জানি কখন ডান পা ফেলতে হবে, কখন বাম পা। শালার নাচটাও মুখস্ত হয়ে গেছে!
আমি অসুখি না, আবার সুখিও না। ফিফটি ফিফটি অবস্থা। এই ফিফটি ফিফটি মানুষগুলো আসলে কিছুই করতে পারে না জীবনে। আমার বয়স ৩২। এই ৩২ বছরে কোনো অর্জন আমার নাই। পরের ৩২-এ কোনো অর্জন হবে সেই রকম সম্ভাবনাও দেখতেছি না। হুদাই পৃথিবীর বাতাস ভারি করতেছি। বাল একটা আমি।
অমলকান্তি রোদ্দুর হইতে চাইছিল। পারে নাই। আমি কিছুই হইতে চাই নাই। কারণ আমি জানতাম, কিছু হইতে পারব না।
মুরাকামির ক্যারেকটার হইতে পারব হয়তো। নাওকো কিংবা কিজুকি—যারা সুইসাইড করতে পারে… অথবা সেই নয় আঙুলের মেয়ে, যে হারায়ে যায়।
তবে সুইসাইড বোধহয় করা হবে না আমার। কয়েকবার ভাবছি এই ব্যাপারে। ব্যাপক সাহস লাগবে। চুড়ই পাখির কলিজা দিয়ে এইটা হবে না। তাছাড়া নিজেরে জাস্টিফাইও করতে পারব না। সুইসাইড করার কোনো বেসিক কারণ আমার নাই।
ধরা যাক, আমি একজন রাইটার। একটা উপন্যাস লিখতেছি। সেইখানে নিজেরে পোর্ট্রে করব। আমার ডায়েরি কেউ পড়লে মনে করবে, আমি হইলাম এমন এক মেয়ে যে কি না ফুল অব লাইফ। কারণ, সব কিছুতে রিয়াক্ট করতেছি। আর সেই রিয়াকশনগুলো খুবই সার্কাস্টিক।
নির্বিকার না আমি। নির্বিকার হইলে আমার হতাশা মাইনা নেওয়া যাইত। যতক্ষণ রিয়াক্ট করতেছি, ততক্ষণ আমি জীবন্ত। আর জীবন্ত জিনিসটার সাথে সুইসাইড ব্যাপারটা মিশ খায় না। মুরাকামির নাওকো আর কিজুকি নির্বিকার ছিল। চ্যাতভ্যাত নাই তাদের। তাই তারা মরতে পারছে। আমি পারব না মনে হয়। ঘুমের ওষুধ পইড়া থাকবে ড্রয়ারে। খাওয়া হবে না।
আমি বড়জোর হারায়ে যাইতে পারব—মুরাকামির নয় আঙুলের মেয়েটার মতো। কিন্তু কই হারাব আমি?
একটা সূর্যমুখী খেত খুঁজতেছি—সানফ্লাওয়ার ছবিতে যেরকম ছিল। ওই ছবিতে সোফিয়া লরেন তার হাজবেন্ডের স্মৃতি খুঁজতে হাঁটা শুরু করে সূর্যমুখী খেতের মধ্য দিয়ে। দিগন্তবিস্তৃত হলুদ এক খেত। মাঝখানে সে। কী মন ক্যামন করা সেই ছবি!
একটা সূর্যমুখী খেত খুঁজতেছি—সানফ্লাওয়ার ছবিতে যেরকম ছিল। ওই ছবিতে সোফিয়া লরেন তার হাজবেন্ডের স্মৃতি খুঁজতে হাঁটা শুরু করে সূর্যমুখী খেতের মধ্য দিয়ে। দিগন্তবিস্তৃত হলুদ এক খেত। মাঝখানে সে। কী মন ক্যামন করা সেই ছবি!
পৃথিবীর একেবারে আদি থেকেই ওই ছবিটা আছে। সে খুঁজতেছে, কিন্তু পাইতেছে না। এই ছবি অনন্তকালের—মহাকালের বুকে কেউ যেন বাঁধাই করে রাখছে ওই সূর্যমুখী খেতটারে।
ওই খেতের একটা সূর্যমুখী হইতে পারলে বেশ হইতো। রোদ মাখতাম গায়ে।
— ১৭ এপ্রিল, ২০২১
আলভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ কৌশলে স্নাতক। পেশাগত জীবনে যন্ত্রপাতির খটমট বিষয়ে না গিয়ে বেছে নিয়েছেন অডিও ভিজুয়াল ফিকশন নির্মাণ। টেলিভিশন মিডিয়ার জন্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন। সিনেমার বড় পর্দায়ও অভিষেক হয়েছে। লেখালেখি তার নেশা। নিজের নাটক, সিনেমার জন্য গল্প, চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে তার লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আলভী আহমেদ হারুকি মুরাকামির তিনটি উপন্যাস অনুবাদ করেছেন—’নরওয়েজিয়ান উড’, ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ এবং ‘পিনবল, ১৯৭৩’। বইগুলো বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে, মুরাকামির গল্প সংকলন, ‘কনফেশনস অব আ সিনেগাওয়া মাংকি’। প্যারালাল ইউনিভার্সের ওপর তার প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘জীবন অপেরা’ ২০২১-এ প্রকাশিত হয়েছে। ১১ জন নিঃসঙ্গ মানুষকে নিয়ে লেখা ‘ব্লাইন্ড স্পট’ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। ইংরেজিতে লেখা তার পেপারব্যাক গল্পগ্রন্থ ‘ঢাকা ড্রিমস’ অ্যামাজনে ফিকশন বেস্ট সেলার ক্যাটাগরিতে শীর্ষে ছিল তিন সপ্তাহ।