দক্ষিণবাংলার মানুষ শৈশব থেকেই যেমন বাঘ-কুমির, ডাকাত আর পোড়োর (সুন্দরবনের ভূত) গল্প শুনে বড়ো হয়, আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। বাংলা সাহিত্য পড়তে এসে মনে হলো— এই গল্পগুলোকে লিখিতরূপ দিলে তা দক্ষিণবাংলার লোকসাহিত্যকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে পারে। বিষয়টা তখন আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ইমরান কামালকেও জানাই কিন্তু এগুলোকে আশ্রয় করে যে একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব— এই চিন্তা মনেও আসেনি। পরে নানা ব্যস্ততায় বাঁদাবনের গল্পগুলোকে নিয়ে তৈরি করা পরিকল্পনাও হারিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু আমার সেই পরিকল্পনাকে একদিন হঠাৎ করে উস্কে দিল আমাদের অফিস স্টাফ জহিরুল।
২০১৯ সালে কলকাতার বাংলাদেশ বইমেলায় আমার প্রথম উপন্যাস ‘ময়নাঢিপির কথকতা’ প্রকাশ করে মূর্ধণ্য প্রকাশনী। আমার কর্মস্থল ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের বিদ্যোৎসাহী অধ্যক্ষ লে. কর্নেল জিএম সারওয়ার স্যার উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করলেন আড়ম্বরের সাথে। আমি তো লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। লুকোতে গিয়ে পড়লাম জহিরুলের সামনে। সে দক্ষিণের মানুষ। বলল, ‘সুন্দরবন নিয়ে কিছু লিখলেন না কেন? এবার কিন্তু লিখবেন।’ আমি বললাম লিখব। বৈষ্ণব পদাবলীর যুগ নিয়ে আর একটা উপন্যাসের খসড়া তৈরি করছিলাম তখন। সেটি কোনোরকমে শেষ করেই করোনার ছুটিতে শুরু করলাম ‘উপকূলমঙ্গল’। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। উপকূলমঙ্গলের শুরু এভাবেই।
আমাদের ঘরের কাছেই তৈরি হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ‘রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’। এটা চালু হলে যে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে এমন আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে অনেক করতাম এবং শুনতাম। দক্ষিণের মানুষকে শুধু নয়—পুরো দেশকে নানা দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। কিন্তু এই বন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং দেশে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়— এমন শঙ্কা মাথায় পাক খেত সবসময়।
আমাদের ঘরের কাছেই তৈরি হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ‘রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’। এটা চালু হলে যে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে এমন আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে অনেক করতাম এবং শুনতাম। দক্ষিণের মানুষকে শুধু নয়—পুরো দেশকে নানা দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। কিন্তু এই বন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং দেশে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়— এমন শঙ্কা মাথায় পাক খেত সবসময়। দক্ষিণবাংলার মানুষের সংগ্রামমুখর জীবন-যাপন, তাদের আশা-নিরাশা, বিচিত্র পেশাজীবির বৈচিত্র্যময় কার্যকলাপ, কালো কালো মুখের একেকটি সরল হাসি, অনুল্লেখ্য অতি সাধারণ জীবনস্রোতে তো আমি নিজেও ভেসেছি। বাঘ-কুমির, ঝড়-জল, দৈবের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো মাঝে মাঝে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যায় কিন্তু রাত পোহাবার সাথে সাথে আবারও তারা উঠে দাঁড়ায় জীবনের এক অমোঘ আহ্বানে। মাথায় লাল ফেটি বাঁধা ‘জগাই মাঝি’ নামক এক আশার ফেরিওয়ালা তাদের কানে শোনায় আশার বীজমন্ত্র। আবারও বাঁচতে চায় মৃতপ্রায় মানুষগুলো। তাদের এই বেঁচে থাকার পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। পরকালের স্বর্গসুখ তাদের কল্পনার বাইরে। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোই উপকূলের প্রাণ।
নারীসমাজের সদস্য হিসেবে নয়— নারীদের নিয়ে আমি সচেতনভাবে ভাবতে শুরু করি নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার সময়ে। সাহিত্যে হোক আর যেখানেই হোক না কেন সমাজকথিত পতিতাদের যে চিত্র আমরা দেখি তাদের আর একটু ভালোভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না কিংবা একটুখানি পবিত্রতার আবরণে তাদের মোড়ার সুযোগ আছে কি না বিষয়টি ভাবনায় আসে এবং এখানেই ঘটে তার প্রতিফলন। উপকূলমঙ্গলের পতিতাদের কাউকে অস্পৃশ্য মনে হয় না। এরা পুজো-অর্চ্চা করে, প্রেমে পড়ে, মরলে সৎকারের আশা করে এবং স্বপ্ন দেখে সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনদানের। বনজীবিদের মতো এরাও আশার ভেলায় একবার ডোবে, আবার ভাসে। ডুবলে নিরাশ হয় না। দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে থাকবার সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
উপকূলমঙ্গলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সুন্দরবন ও বনবিবির মহিমাসূচক কয়েকটি উপকাহিনি এবং হরিসাধন নামক এক বৃদ্ধ, যার কাজই হলো পুরাতনকে ধরে রাখা। কোহিনূর নামক এক ডাকাতসর্দার অনুপ্রাণিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী দ্বারা। নিষ্ঠুর ডাকাতের প্রথমে প্রেমিকা এবং তারপর জননীতে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি এখানে উঠে এসেছে।
উপকূলমঙ্গলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সুন্দরবন ও বনবিবির মহিমাসূচক কয়েকটি উপকাহিনি এবং হরিসাধন নামক এক বৃদ্ধ, যার কাজই হলো পুরাতনকে ধরে রাখা। কোহিনূর নামক এক ডাকাতসর্দার অনুপ্রাণিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী দ্বারা। নিষ্ঠুর ডাকাতের প্রথমে প্রেমিকা এবং তারপর জননীতে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি এখানে উঠে এসেছে। খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে সর্বহারাদের দাপট একসময় প্রচণ্ডরকম বেড়েছিল। সিরাজ শিকদার যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে জীবন দিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন জলের মধ্যে হঠাৎ করে ভেসে উঠে আবার ডুবে যায় এখানে।
নিম্নবর্গের মানুষের ঘরে ঘরে ঘটে চলা উৎসব-অনুষ্ঠান, অজাচার-ব্যভীচার, মিশনারিদের ধর্মপ্রচার, বনদস্যুদের দ্বারা সুন্দবনের কাঠচুরি, নাগরিকতার ছোঁয়া লাগায় মানুষের পেশা পরিবর্তনের প্রবণতা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং মুহূর্তের মধ্যে তা ভুলে অপরকে বুক দিয়ে আগলে রাখা, প্রেমের কারণে ঘরছাড়া, নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে শিশুকন্যাদের প্রথম মন্দস্পর্শের অভিজ্ঞতা, অপরিণামদর্শীতা, সর্বোপরি সর্বগ্রাসী কৈশোর-প্রেম— দক্ষিণবঙ্গবাসীর জীবনে এগুলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বাওয়ালি-মৌয়ালি, জেলে-মাঝি, মুচি, সুতোর-কামার, ধাই, ডাকাত এমনকি পতিতা— সকলে চেয়ে আছে বাঁদাবনের পানে। বনবিবির আশীর্বাদে যেমন তাদের জীবন মধুময় হয়ে ওঠে তেমনি বনদেবীর উগ্র নিশ্বাসে ধ্বংস হয় সর্বস্ব। বনদেবীর ওপর অত্যাচার করলে সেই পাপের ফল যে দেশবাসীকেই ভোগ করতে হবে— এই সত্যটা এখানে উঁকি দিয়েছে। নৈরাশ্যের ক্লান্তি নয়, নতুন আশার উদ্দীপনা বাঁচিয়ে রাখে উপকূলের মানুষকে এবং এই আশাই তাদের জীবনে বয়ে আনে মঙ্গলবারতা। বনদেবীর অভিশাপে ভেঙে পড়া জীবন আবার জোড়া লাগে বনদেবীরই আশীর্বাদে। ‘উপকূলমঙ্গল’ মূলত উপকূলের এইসব অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ জীবনেরই আলেখ্য।
জন্ম ১৯৯৩ সালের ১২ অক্টোবর বাগেরহাটের মোংলায়। পড়াশোনো করেছেন ভেকটমারী বেলাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সুন্দরবন ডিগ্রি মহিলা কলেজ এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলার প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ। প্রকাশিত গ্রন্থ; প্রবন্ধ: ‘বৈষ্ণব পদাবলী: নারীবাদী বীক্ষণ’, ‘বাউলপদাবলীতে চৈতন্যপ্রভাব’, উপন্যাস: ‘ময়নাঢিপির কথকতা’।