রক্ত। একটি মাত্র শব্দ। এর রূপ বা রং বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। মানব বা প্রাণিকুলের দেহে লাখ লাখ রক্তকণা কী গতি নিয়ে যে ছোটাছুটি করে তা ভাবলে মন কেবল আকুলিবিকুলি করে। সেই লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল মাত্র ১২০ দিন। তারপর আবার সে জন্মায় কোষে কোষে। শুরু করে চলাচল। লেখার তাড়না একজন লেখকের মাথায় কতক্ষণ থাকে? যেহেতু তিনি মানবপ্রাণি—তারও আছে ক্ষুধা, কাম, জীবনকে চালিয়ে নিতে হাঁটতে হয় জীবিকার গলি। তার চেতনার জীবতকাল কতটুকু? কেমন তার লিখবার ছটফটানি? যখন তিনি লিখতে বসেন, তখন কি তার ২০৬ হাড়ে ধরিয়ে দেয় চিন্তার কাঁপুনি? এই প্রশ্নগুলো আমি বহন করি। তারা আমার সঙ্গে চলাচল করে। আমাকে ভাবিয়ে তোলে, কাঁপিয়ে তোলে! কীভাবে একটা লেখা তরতর করে হাঁটতে থাকে। কথা বলে। ডানার বিস্তার ঘটিয়ে সেই চিন্তাগুলো লেখা হয়ে ওঠে। কোথায় সে কারখানা? যেখান থেকে শব্দের উৎপাদন হয়? ভাষার হাজার দুয়ার খুলে দিয়ে ঘাপটি মেরে কোথায় বসে থাকে সেই যন্ত্র! মানবকুলের সবচেয়ে বড়ো অঙ্গ ত্বকের ভেতর সে কি লুকিয়ে থাকে? বলতে পারি না। লুপ্ত কোনো বড়শিতে গেঁথে ঝুলে থাকাই তখন আমার নিয়তি। হয়তো মুক্তি আছে কিংবা নেই। অনন্ত এই লিখনপ্রক্রিয়া শেষ হবার নয়। কীভাবে লোহিত রক্তকণিকা বাঁচে-মরে, তা ভাবতে ভাবতেই সময় ফুরিয়ে আসে। একটা কাঙ্ক্ষার নদীর জন্য সাধনায় নত হয়ে থাকতেই ভালো লাগে তখন।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, ‘আপনার লেখার মুহূর্তটি কেমন?’ তাকে কী উত্তর দেওয়া যায়! ভাবনার বিষয়। লেখার মুহূর্ত—অন্যকোনো সময়ের কথা তিনি বলছেন না। বলছেন লেখার মুহূর্তের কথা। তাকে তখন আনত হয়ে আমাকে বলতে হয়—লিখতে বসবার আগে এই অত্যল্পকালে উপমেয় এক মুকুরের সামনে বসে কোনো সুন্দর মুহূর্ত ভেসে উঠলে তাকে দেখি।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, ‘আপনার লেখার মুহূর্তটি কেমন?’ তাকে কী উত্তর দেওয়া যায়! ভাবনার বিষয়। লেখার মুহূর্ত—অন্যকোনো সময়ের কথা তিনি বলছেন না। বলছেন লেখার মুহূর্তের কথা। তাকে তখন আনত হয়ে আমাকে বলতে হয়—লিখতে বসবার আগে এই অত্যল্পকালে উপমেয় এক মুকুরের সামনে বসে কোনো সুন্দর মুহূর্ত ভেসে উঠলে তাকে দেখি। খুব তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করি। নিজের দেহমন একীভূত করে কল্পনা করি সেই হারানো—ছিটকে যাওয়া মুহূর্তকে কোনো ঝাউগাছের মাথায় বসিয়ে দিতে। যেন একটু হাওয়াতেই সে নড়ে উঠতে পারে। আমার ভেতর ঝিরিঝিরি কথার বুদবুদ তুলতে পারে। নিজস্ব নির্জনতায় যেন কেউ আমার বিরুদ্ধে লেখার পরোয়ানা জারি করে। আমি লিখতে বসি। সুন্দর মুহূর্তের সেই দোলা আমার ভেতর কাজ করে। লেখা শেষ হলে দেখা যায় সেই উজালা রূপটি আর নেই। সুন্দর মুহূর্ত বেদনার বেহালা হয়ে গেছে। হয়তো যে মুহূর্তকে লেখায় ধরতে চেয়েছি, সে কোনো হাহাকারের মাঠে বসে হাসছে। তখন যন্ত্রণা হয়। ক্ষরণ হয়। হৃদয় ফেটে ফালা ফালা হয়। চোখ বন্ধ করে তাকে ডাকি। দুধভাত দেবার লোভ দেখাই। সে আসে না। সংহারের সমুদ্রে তাকে ভাসিয়ে দিই। নতুন কোনো উজ্জীবনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।
নিজস্ব নির্জনতা প্রত্যেক কবি-লেখকের থাকা প্রয়োজন। নইলে বাইরের উতরোল তার বহন করা চিন্তাবীজকে খেয়ে ফেলে। মিলিয়ে যায় কৃষ্ণগহ্বরের গোলকধাঁধায়। তখন আর অনুতাপের সীমা থাকে না। এই মুহূর্তে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষাচিত্রী এলস্পেথ ডেভির কথা মনে পড়ছে। তিনি এক লেখায় বলেছেন, ‘একজন লেখক হিসেবে অব্যাহতভাবে শুনে যেতে হয়—অন্তরের কান দিয়ে—সেইসব কথা যা তিনি লিখতে যাচ্ছেন—সে লেখা হ্রস্বই হোক কিংবা দীর্ঘ। লেখক কান পেতে শুনতে থাকেন ছন্দ। তিনি নৈঃশব্দ্য সম্বন্ধে সচেতন।’ ডেভি নির্জনমুহূর্তের ব্যাপারে লেখককে সচেতন থাকার তাগিদ দিয়েছেন। নইলে অন্তরের কান—যা লেখক লিখতে চান, তা শুনতে পায় না। দেখা ও শোনার জন্য লেখককে স্থির হতে হয়। তার পরিভ্রমণ, পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা তাকে দিয়ে সেই নির্জনমুহূর্তে লিখিয়ে নেয়। তন্ত্রের স্বরের মতো বেরিয়ে আসা তরতাজা লেখা পাঠককে সম্মোহন করে। নিবিড় মুগ্ধতায় পাঠকও তখন সেই নির্মলমুহূর্তে বিচরণ করেন। লেখক-পাঠক মিলেমিশে ফানা হয়ে যান। হালকা হাওয়ায় দূরের ঝাউগাছে তখন চিরসবুজ সরু পাতাগুলো দুলতে থাকে।
আমি প্রতিদিনই লেখার টেবিলে বসি। নতুন কিছু লিখবার জন্য অতি কোলাহল ছাপিয়ে নির্জনমুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা চালাই। উল্লম্ফন চিন্তারাশিকে একটা সরল পথে আনতেই অনেক সময় পেরিয়ে যায়। কোনোদিন এক অধ্যায় লেখা এগিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে পড়ে। তাকে নানান কৌশলে ফুসলিয়ে দাঁড় করাতেই আমার ঘাম ঝরে যায়। কোনো কোনো দিন শূন্য হাতেই গভীর রাতে বিছানায় দেহ এলিয়ে দিই। যেহেতু কবিতা ও কথাশিল্প দু’মাধ্যমেই আমাকে লিখতে হয় ফলে নিজেকে সবসময় নবায়ন করার ফুরসত রাখি।
আমার গল্পের চরিত্ররা, কবিতার অনুভূতিগুলো মাঝেমধ্যে মগজের মধ্যে চলাফেরা করে। তখন আমি ঝিম মেরে যাই, চুপ হয়ে যাই, নত হয়ে ওদের দেখতে থাকি। কোনো লেখার ক্ষেত্রে কখনও তাড়াহুড়ো করি না। যেহেতু সমস্ত কিছুই আমার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, স্মৃতি ও আশেপাশের প্রতিবেশ থেকে আসে ফলে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। যা আমি লিখতে চাই, সেই লেখার উৎসমুখ আমার ভেতর বুদবুদ তুললেই তা লিপিবব্ধ করি।
আমার গল্পের চরিত্ররা, কবিতার অনুভূতিগুলো মাঝেমধ্যে মগজের মধ্যে চলাফেরা করে। তখন আমি ঝিম মেরে যাই, চুপ হয়ে যাই, নত হয়ে ওদের দেখতে থাকি। কোনো লেখার ক্ষেত্রে কখনও তাড়াহুড়ো করি না। যেহেতু সমস্ত কিছুই আমার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, স্মৃতি ও আশেপাশের প্রতিবেশ থেকে আসে ফলে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। যা আমি লিখতে চাই, সেই লেখার উৎসমুখ আমার ভেতর বুদবুদ তুললেই তা লিপিবব্ধ করি। হয়তো কোনো কবিতার একটা মাত্র লাইন লেখার পর আর লিখতেই পারিনি কিংবা কোনো গল্পের এক অধ্যায় লিখেছি তারপর আর এগোয়নি। সেই লেখা বছর কেটে যাওয়ার পর শেষ করতে পেরেছি। সাধারণত আমি রাতে লিখতে পছন্দ করি। ভোরবেলাটাও আমার কাছে প্রিয়। নিত্যনতুন পঠন-পাঠন-ভ্রমণের নিরন্তর দরজা ডিঙিয়ে নিজের উজ্জীবন ঘটাই।
আমি কখনও লেখক হবার স্বপ্ন দেখিনি। আদতে আমার জীবন নিয়ে কোনো স্বপ্নই ছিল না। শুধু চেয়েছি মানুষ হতে, নিজের কাছে নিজেকে সৎভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কারণ, লেখক হবার মতো কোনো পরিবেশ আমার অনুকূলে ছিল না। টানাপড়েন, অভাব, অপমান ও সংগ্রামের চোরাগলি বেয়ে বেড়ে উঠেছে আমার শৈশব। পিতার আঙুলের ছোঁয়া আমার হাত স্পর্শ করেনি। বেড়েওঠার সময়ে একমাত্র মা-ই ছিল আমাদের তিন ভাইবোনের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। তাকে ঘিরেই ছিল আমাদের যাপন। অনেক বেদনা, অনেক না-পাওয়া কিংবা সংগ্রামের অকূল পাথারে নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবার সেই আমিকে খোঁজার নিমিত্তে হয়তো এই লিখনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রাকৃতিক যুক্ত হওয়া। তাই সামান্য শব্দলিপিকার হিসেবে আমি কোনো অহংকার করি না। অহম করার কোনো কারণও দেখি না। কারণ, একজন লেখক যা কিছুই লিখুক না কেন তার উপাদান এই প্রকৃতি ও মানুষের কাছ থেকেই আহরণ করেন। আর সেই আহরিত সম্পদকে তিনি লেখায় রূপান্তর ঘটান। ফলে সেটা গল্প, কবিতা বা উপন্যাস যা-ই হোক না তাতে প্রকৃতি ও মানুষের ঋণ লুক্কায়িত থাকে। বই কিংবা প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে মানুষ ও সমাজের কাছেই লেখাটি আবার পরিবেশিত হয়। ফলে আমার কাছে লেখক কেবল অনুঘটক মাত্র। বরং কোনো লেখকের লেখা যখন কারো চিন্তার বিস্ফার ঘটিয়ে নবপ্রণোদনার সঞ্চার করে তখন তার আনন্দ হতে পারে। আর এই আনন্দটুকুই তার। আত্মদহন লুকিয়ে মানুষের মনের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনে তাকে হাঁটতে হয়। হয়তো সেই আনন্দ-লহরি অহমকে দূরে সরিয়ে আমাকে লেখার টেবিলে ফিরতে বাধ্য করে।
জীবিকার মাড়াইকলে নিজেকে পিষ্ট করেও লেখার টেবিলে বসাটাকেই সাধনার অংশ করে নিয়েছি। সস্তাবাজারি ঝলমলানি, মিডিয়ার শেয়ালকৌশল, গোষ্ঠীবদ্ধ পিঠ চাপড়ানি, কূট-যোগাযোগের আনুকূল্য গায়ে না মেখে কেবল নিজের লেখার দিকে মনোযোগ দিয়েছি।
সম্মিলিত কোলাহল থেকে নিজেকে সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখি। সাহিত্যের রাজনীতি, সমবায় পদ্ধতি, চোরাপথ, ফাঁদ বরাবরই এড়িয়ে যাই। অনুগ্র থেকে নিজের লেখাকে এগিয়ে নিতেই ভালো লাগে। ফলে জীবিকার মাড়াইকলে নিজেকে পিষ্ট করেও লেখার টেবিলে বসাটাকেই সাধনার অংশ করে নিয়েছি। সস্তাবাজারি ঝলমলানি, মিডিয়ার শেয়ালকৌশল, গোষ্ঠীবদ্ধ পিঠ চাপড়ানি, কূট-যোগাযোগের আনুকূল্য গায়ে না মেখে কেবল নিজের লেখার দিকে মনোযোগ দিয়েছি। যখন গহীন কোনো গ্রামের পাঠক আমার লেখা পড়েছেন বলে জানান, সেটাকেই সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে মান্য করি। তখন ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলতে থাকা ঝাউগাছের পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি। আমি জানি, কোনো কিছু পাবার জন্য মরিয়া হওয়ার চাইতে নিবিড়ভাবে কাজ করে গেলে সবকিছুই আপনাআপনিই ধরা দেয়। কারণ, সমস্ত প্রকৃতিই তখন তার জন্য কাজ করতে থাকে।
ফ্রান্সের চিত্রশিল্পী গুস্তাভ করবেটের কয়েকটি লাইন আমাকে খুব নাড়া দেয়। অনেকদিন তার কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি এবং নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছি। করবেট বলেছেন, ‘যখন আমি মৃত্যুবরণ করব, তখন আমার সম্পর্কে আপনারা এটাই বলবেন যে, সে কোনো স্কুল থেকে আসেনি। কোনো চার্চ, প্রতিষ্ঠান ও একাডেমি থেকেও শিক্ষা নেয়নি। সে কোনো নির্দিষ্ট শাসক শ্রেণির বাধ্য নয়। সে একটি স্বাধীনতাবাদী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছে এবং কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি, একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া।’
আর সেই স্বাধীনতা তখনই মেলে যখন আমার মন লেখার জন্য প্রস্তুত হয়, একজন লেখক হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারি। জীবনের বিপুল সংকটকে একপাশে সরিয়ে যে মুর্হূতে লেখার টেবিলে বসি, বন্ধনের গেরোকে তুচ্ছ করে স্বাধীনসত্তার আবির্ভাব ঘটাই। ঝরাপাতার ধ্বনির মতো মনের ভেতর চিন্তার বুদবুদ খেলা করে। তখন অনুপলের দুয়ার ডিঙিয়ে শব্দ ও ভাষার দুলুনিতে ভরে উঠতে থাকে আমার লেখার ঝাউবাংলো। ফলে লেখাই আমার নিয়তি, এর বাইরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো পথ আমার সামনে খোলা নেই।
কবিতা ও গল্প লেখেন। লেখালেখির ঝাউবাংলোয় মগ্ন থাকাই তার আরাধ্য। জন্ম ও বেড়েওঠা পদ্মাপারের রাজশাহীতে। জীবন-নির্বাহের জন্য কাজ করেন গণমাধ্যমে। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৫ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে ‘ডুমুরের আয়ু’ গ্রন্থের জন্য বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রকাশিত গল্পের বই ‘সান্ধ্য মাংসের দোকান’।