বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

পচন : হামিরউদ্দিন মিদ্যা

0

Eid Motifঅঘ্রাণ শেষ। দামোদরকে এখন নদী বলে চিনতে পারবে না। একটা মৃত সেচখালের মতো ছাতিফাটা বুক নিয়ে পড়ে আছে। পাম্পের সাহায্যে জল তুলে নেওয়ার পরে যে নরম পাঁক, কাদা, আর ঘোলা জলের গাবানি পড়ে থাকে তলে—ধরে নাও নদীটার এখন তেমনই অবস্থা। মাঝে মাঝে বিষফোড়ার মতো জেগে আছে বালির ঢিবি। অদূরের একটা চরে কিছু চাষি কুমড়ো লাগিয়েছে। খেত দেখভালের জন্য তৈরি বাঁশের মাচানবাড়িগুলিও চোখে পড়বে, যদি কুয়াশা কম থাকে।

জেলেপাড়ার মানুষদের মনে এখন উৎসব লেগেছে। কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বুড়ো-হাবড়া সবাই খালে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। কেউ ঘুনজাল নিয়ে, কেউ বা সামান্য অংশ বাধ দিয়ে আটকে, থালা-বাসন দিয়ে জলসেচ করছে। তুলে নিচ্ছে চুনোপুঁটি-সহ নদীর সতেজ কই, ল্যাঠা, ট্যাংরা।

জেলেপাড়ার মানুষদের মনে এখন উৎসব লেগেছে। কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বুড়ো-হাবড়া সবাই খালে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। কেউ ঘুনজাল নিয়ে, কেউ বা সামান্য অংশ বাধ দিয়ে আটকে, থালা-বাসন দিয়ে জলসেচ করছে। তুলে নিচ্ছে চুনোপুঁটি-সহ নদীর সতেজ কই, ল্যাঠা, ট্যাংরা। জোয়ান মরদরা ঘুরছে পোলো হাতে।

বশির পোলো আনেনি। নদীখাতের নিচু অংশটায় যেখানে এক কোমর জল জমেছে, সেই খালে ঘুরনি জাল দিয়ে খেয়া মারবে সে। খালের জলে লুকিয়ে থাকে পুরনো শোল, মাগুর, বোয়াল। সেই ধান্দাতেই কয়েকদিন ধরে তক্কে তক্কে ঘুরছে বশির। গতকাল জালে ফাঁসিয়েছিল একটা কেজি দেড়েক ওজনের শোলমাছ। আজও সেই টানেই জাল নিয়ে বেরিয়েছে।

‘আরে ও বশিরে-এ! ওদিক পানে যাস না। কী যেন মরেছে। পচা “বাস” পাসনি?’

সালেমের ডাকে পেছনে ঘুরল বশির। গন্ধটা তার নাকে এসেও লেগেছে। গতকাল খালে মাছ ধরতে গিয়েও নদীখাতের ওপাশে বেনাঝোপ থেকে গন্ধটা পেয়েছিল, বাতাস উল্টোদিকে বইছিল বলে, তেমন অসুবিধা হয়নি। আজ উত্তুরে বাতাসে গন্ধটা আরও তীব্রভাবে ভেসে আসছে। যে কোনো প্রাণি মরে পচলেই এমন বিটকেলে গন্ধ ছড়ায়।

বশির বলল, ‘কি মরেছে রে দোস্ত?’

‘কে জানে! কুত্তা, বিলুই, গরু, ছাগল হবে কিছু একটা। কত লোকে তো ঝোপেঝাড়ে ফেলে যায়। কিছুদিন গন্ধ উঠে, তারপর পচতে পচতে বাতাসে মিলিয়ে যায়।’

পাশ থেকে বুড়ো লালচাঁদ মুখ তুলে বলল, ‘বাতাস কি আর শুদ্ধ আছে রে বাপ! নদীর পানির পচন, মাটির পচন। আগে গরু চরাতে এসে পিয়াস লাগলে, দামুদরে মুখ ডুবিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়েছি। এখন পানির রং দেখেছিস? হাত-পা ধুলেও গা কুটকুট করে। পচা গন্ধ তো সবসময় মিশেই আছে বাতাসে। পালাবি কুথায়!’

খালে জল থাকতে যাও-বা পাওয়া যায় কিছুদিন, এখন কামাই করা মানেই, একটা দিন পুরো লস। আজ অবশ্য একটা মোকা আছে বশিরের। গন্ধের জন্যে খালটায় কেউ নামেনি। সে যদি নাকে গামছা জড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারে, তাহলে দিনটাই অন্যরকম হয়ে যেতে পারে।

কাদা থেকে উঠে বশির তার ছোটো ডিঙি নৌকাটা খুলল। মাছমারা যখন তার পেশা, ওসব গন্ধটন্ধ ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো পেট চলবে না। নদীতে তো এখন এমনিতেই আগের মতো মাছ নেই। খালে জল থাকতে যাও-বা পাওয়া যায় কিছুদিন, এখন কামাই করা মানেই, একটা দিন পুরো লস। আজ অবশ্য একটা মোকা আছে বশিরের। গন্ধের জন্যে খালটায় কেউ নামেনি। সে যদি নাকে গামছা জড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারে, তাহলে দিনটাই অন্যরকম হয়ে যেতে পারে।

বিকট গন্ধকে উপেক্ষা করেই বশির খেয়া দিতে লাগল। লগিটা পাটাতনের খোলে পুরে দিয়েছে। মাথার দিকটা আকাশমুখো। একটা গাঙচিল অনেকক্ষণ ধরেই বশিরের মাথার ওপর চক্কর কাটছে।

‘শালার গন্ধের লেগে থাকন যায় না রে!’ মুখে গামছা জড়িয়ে গন্ধটাকে পাত্তা দিতে না চাইলেও, গন্ধটা কিন্তু পিছু ছাড়ে না বশিরের। বরঞ্চ গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে নাকের ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়ে ভেতরের নাড়িভুঁড়িগুলোকে পাকিয়ে তোলে। এই মাঝ নদীতে মরেছে কী? এই প্রশ্নটাই তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গরু-ছাগল মরলেও জল-কাদা ডিঙিয়ে এতদূরে কেউ ফেলতে আসবে বলে মনে হয় না। আর এখন নদীতে স্রোতও নেই, যে ভেসে আসবে। সেই শরতেই নদীর জল নেমে গেছে। থাক গে, তার এত ভেবে লাভ কী! অনেক মানুষই তো মাছ ধরছে। কেউ তো এত মাথা ঘামায়নি। গন্ধ উঠছে? তো ওদিকে যেও না, ব্যাস। কিন্তু বশির এত কাছাকাছি এসেও কি একবার উঁকি মেরে দেখবে না?

খালের পশ্চিম ঘেঁষে বিঘা দেড়েক জায়গা নিয়ে থালার মতো জেগে উঠেছে একটা বালির চর। কাশ, বেনা, সর, প্রভৃতি আলাপালা গাছে ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা। গন্ধটা আসছে ওখান থেকেই। ডিঙিটা চরের ধারে লাগিয়ে, লুঙিটা সেঁটে দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে পেছনে গুঁজে নিল বশির। গায়ে একখানা বগলকাটা গেঞ্জি। দুই হাত দিয়ে বেনাগাছ সরিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল সে। গন্ধটা এখন এতই তীব্র, যে গামছাতেও মানছে না। একটা জায়গা থেকে মাছি ওড়ার ভন ভন আওয়াজ কানে আসছে। সেই শব্দকে অনুসরণ করেই বশির এগিয়ে গেল। গিয়েই থমকে দাঁড়াল বশির। এ কী! একটা লাশ! রজিনার বয়সী একটা মেয়ে আলুথালু চুল ছড়িয়ে বালির ওপর পড়ে আছে। শরীরে এক টুকরো পোশাকও নেই। পচন ধরে গেছে লাশটায়। বশির বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক ছুটে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ডিঙি নৌকাটার কাছে চলে এলো। পাটাতনে উঠে জলের দিকে ঝুঁকে পড়ল সে। পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়িগুলোও পাক দিয়ে উঠছে। যেন মুখ ঠেলে সব বেরিয়ে আসবে।

ওদিকে তখন মাছধরার আনন্দে মানুষ মশগুল। বমি করার শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল কয়েকজন। বশির কোনোমতে সোজা হয়ে উঠে, লগি ঠেলে তীরের বেগে পাড়ের দিকে এগতে থাকে।

সালেম বলল, ‘এই মাত্র গেল, বশির ওরকম করে চলে আসছে কেন বলত? সাপে কাটল নাকিন!’
‘হতি পারে। ওখানে তো সাপের কুনু অভাব নাই।’

‘চল, চল, গিয়ে দেখি।’ বলেই মাছধরা বাদ দিয়ে কয়েকজন নদীখাতের দিকে এগিয়ে গেল। বশির তখনও হাঁফাচ্ছে। কথা আটকে যাচ্ছে মুখে।

‘ও বশিরে! কী হইছে রে! ‘

বশির হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘লাশ! লাশ! ‘

‘লাশ! কার লাশ? কোথায় লাশ? ‘

চরের দিকে আঙুল বাড়াল বশির। বলল, ‘ঝোপের ভেতরে একটা জোয়ান মেয়ে পড়ে আছে।’

মেয়ে মানুষ! সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ পড়ে গেল। খালে আধ-হাঁটু কাদা-জলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো নড়েচড়ে উঠল। কেউ কেউ মাছ ধরা বাদ দিয়ে, যা পেয়েছে তা নিয়েই সুর সুর করে বাড়ির পথ ধরল। খবরটা শুধু নদীর খালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না, খাল ছাড়িয়ে পাড়ের মানুষজনের কানেও পোঁছে গেল।

 

০২.
শেয়াল নয়, কুকুর নয়, বেড়াল নয়—একটা রক্তমাংসের মানুষের লাশ সবার অজান্তে বেনাঝোপে পড়ে পড়ে পচছে, কথাটা ভেবেই শিউরে উঠছে সবাই। বশির না দেখলে, হয়তো জানতেই পারত না কেউ। নাকে চাপা দিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যেত জায়গাটা। কিন্তু এখন যেহেতু জানা গেছে গন্ধের আসল রহস্য, সেক্ষেত্রে মানুষ হয়ে একটা মানুষের লাশ ওই ভাবে পচতে দিতে বিবেকে বাঁধল কারও কারও।

একটা রক্তমাংসের মানুষের লাশ সবার অজান্তে বেনাঝোপে পড়ে পড়ে পচছে, কথাটা ভেবেই শিউরে উঠছে সবাই। বশির না দেখলে, হয়তো জানতেই পারত না কেউ। নাকে চাপা দিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যেত জায়গাটা।

ধনঞ্জয় বলল, ‘পুলিশে খবর দে রে কেউ।’

ধনঞ্জয়ের পকেটেও ফোন আছে। কিন্তু সে নিজে ফোন করতে চায় না। কী দরকার! পরে তাকে নিয়েই যদি সাক্ষীসাবুদের জন্য টানাটানি করে!

যারা এতক্ষণ হাতে ফোন ধরে ছিল, পুলিশকে ফোন করার কথা শুনে অনেকেই পকেটে পুরে নিল। ভাবখানা এমন, যেন ফোন আনেনি কেউ।

ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন বয়স্ক মানুষও ছিল। ধনঞ্জয়ের যুক্তির ওপর পাল্টা যুক্তি খাঁড়া করে একজন বলল, ‘থানা পুলিশে জড়ানোটা কি ঠিক হবে ধনা? দেখ, চরটা নদীর মাঝে। আমাদের গ্রামের মধ্যে তো লাশটা পাওয়া যায়নি। এত হ্যাপা আমরা কেন পোহাতে যাব?’

বুড়োকে সমর্থন করল আরও কয়েকজন, ‘তুমি ঠিক কথায় বলেছ খুড়ো। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। ওসব ঝামেলায় না গিয়ে অন্য কথা ভাবতে হবে। দরকার হলে গ্রাম থেকেই কয়েকজন গিয়ে মরাটার সৎকার করে দিয়ে আসুক। তাহলেই সব জ্বালা চুকে যাবে।’

চ্যাংড়া ছেলে-ছোকরাদের মধ্যে একজন বলল, ‘কোন গ্রামের মেয়ে, কার মেয়ে সেসব আমরা কেউ জানি না। আমাদের সৎকার করাটা কি ঠিক হবে? পরে জানাজানি হলে কত বড়ো কেস হবে জানো? টেনে ছাড়ানোয় তখন মুশকিল হয়ে পড়বে। তার থেকে পুলিশে খবর দিলে ঠিক খুঁজে বের করবে লাশের পরিচয়। যতই হোক মুখে আগুনটুকু অন্তত পরিবারের হাত থেকে পাবে।’

বশির, লালচাঁদ, ওসমান এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্রামের মানুষদের আলোচনা শুনছিল। লালচাঁদ বলল, ‘লাশটা তো মুসলমানেরও হতি পারে!’

লালচাঁদের একটা কথাতেই সব আলোচনা থেমে গেল।

কয়েকজন বলল, ‘আমাদের একবার লাশটার কাছে যাওয়া দরকার। চল চল গিয়ে দেখে আসি।’

অধিকাংশ মানুষই প্রস্তাবে সাড়া দিল না। জল-কাদার সঙ্গে যাদের বারোমাসের সম্পর্ক, শেষমেশ জেলেপাড়ারই কয়েকজন প্রথমে এগিয়ে গেল। দেখাদেখি পিছু ধরল আরও কয়েকজন। কাঁদার ওপর হেঁটে পার হয়ে নদীখাতের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সব।

কার্তিকের শুরুতেই যখন দামোদরে মরা টান ধরতে শুরু করে, তখন পনের অভাবে কন্যাদান করতে না পারা বাপের মতো নৌকাগুলোকে বুকে নিয়ে নদীটা হু হু করে কাঁদে। তুমি শুনবে, লি লি করে বাতাস বইছে। কিন্তু কোনো জেলেকে জিজ্ঞেস করো, তারা বলবে, ও হল গিয়ে বাপু দামুদরের কাঁদন। জলের অভাবে লদীটা, কাঁদছে গো!

বশিরের ডিঙি নৌকায় কয়েকজন উঠে পড়ল। তিলকচাঁদের নৌকাটা বালির ওপর বসে গিয়েছিল। কয়েকজন ঠেলে তুলল সেটা।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে লাশটাকে দেখল। মাথায় কোনো সিঁদুর নেই, হাতে নেই শাখা-পলা। ষোলো-সতের বছরের একটি যুবতি মেয়ে। বশিরেরও ওই বয়সী একটি মেয়ে আছে। রজিনার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল তার। লাশটার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না বশির।

চরে নেমে বশিরকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সবাই। দূর থেকে দাঁড়িয়ে লাশটাকে দেখল। মাথায় কোনো সিঁদুর নেই, হাতে নেই শাখা-পলা। ষোলো-সতের বছরের একটি যুবতি মেয়ে। বশিরেরও ওই বয়সী একটি মেয়ে আছে। রজিনার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল তার। লাশটার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না বশির। দৌড়ে কাছে চলে গেল। তারপর কাঁধের গামছাটা খুলে মেয়েটার শরীরে ঢাকা দিয়ে দিল। ততক্ষণে লাশটা দেখে অনেকেই সরে পড়েছে। নৌকাতেও উঠে বসে পড়েছে কয়েকজন। বশিরকে ডাকল, ‘টপটপ চলে আয় বাপ। আর দেখার কিছু নাই।’

‘আহা গো! কাদের বাড়ির মেয়ে গো! কোন বাপ-মায়ের বুক খালি হল গো!’ তিলকচাঁদ জিভ চুকচুক করে উঠল।

করম আলী বলল, ‘এই মেয়ে বাপু আমাদের এলাকার নয়। চুলগুলো দেখলে? কেমন শহুরে মেয়েদের মতো ইস্টাইল করে কাট দিয়েছিল। দুগ্গাপুরের দিকে হবে কোনো জায়গার। স্নান করতে নেমে বোধহয় তলিয়ে গেছে। পরে ভেসে ভেসে এসে চরে আটকে গেছে।’

‘বাঁদরের মতো কথা বলিস না তো করম, ‘—ধনঞ্জয় ধমকে থামিয়ে দিল করম আলীকে। বলল, ‘দেখলি না সারা গায়ে নখের কাটাছেঁড়া দাগ। শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খেয়েছে মেয়েটাকে। নদীতে কি জল বইছে, যে লাস ভেসে আসবে! ‘

‘তাহলে বলতি চাইছ রেপ কেস!’ আঁতকে উঠল সবাই। যারা নৌকায় উঠেনি এতক্ষণ, তারাও এবার চেপে পড়ল।

‘চল বাপু পালিয়ে চল এখান থেকে। কোথা থেকে কী হয়ে যায়। কার মনে কী ছিল! শেষে দেখা গেল, আমাদের মধ্যেই কেউ জড়িয়ে পড়লাম শুধুশুধু।’

 

০৩.
ধনঞ্জয় লোকাল থানায় ফোন করে খবরটা জানিয়েছিল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছল।

লাশের কাছে লোকজন না থাকলেও, এতক্ষণ নদীর পাড়ে কিছু কৌতুহলী মানুষজনের ভিড় ছিল। লাশটাকে নিয়ে নানাজনে নানারকম আলোচনা করছিল। হতে পারে মেয়েটা কোনো খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়েছিল, শেষমেশ এই পরিণতি। হতে পারে মেয়েটা টিউশন পড়ে কোনো নির্জন রাস্তা দিয়ে একা বাড়ি ফিরছিল, চারপাশে অন্ধকার নেমে আসতেই সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। তারপর টেনেহিঁচড়ে নদীর পাড়ে তুলে এনে, অনেকদিনের লালসা মিটিয়ে, কোনো প্রমাণ না রাখার জন্য খুন করে ফেলে গেছে ওই নির্জন জনমানবহীন জায়গায়। এমন ঘটনা তো রোজ কোথাও না কোথাও ঘটছেই।

গ্রামের কিছু বউ-ঝিও কান পেতে পুরুষদের আলোচনা শুনছিল। পুলিশ আসতেই সব আলোচনা থেমে ভিড়টা ম্যাজিকের মতো পাতলা হয়ে গেল। কেউ কেউ একবারেই না গিয়ে, অনেক দূর থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখছিল। কোনো বাপ ডেকে নিল তার নিজের ছেলেকে, খোকা, বাড়ি আয়।

বড়োবাবু বললেন, ‘লাশটা কোনখানে?’

কয়েকজন আঙুল বাড়িয়ে চরটা দেখাল পুলিশদের।

‘ও, স্ট্রেঞ্জ! ওখানে যাওয়াটাই তো মুশকিল! নৌকা যাবে না?’

বশির, তিলকচাঁদ ওরা জানাল, ‘না স্যার। কাদায় বসে যাবে নৌকা। কাদাটা হেঁটেই পেরোতে হবে।’

মেজবাবু বললেন, ‘আপনি এখানেই দাঁড়ান স্যার। আমরা লাশটা আনার ব্যবস্থা করছি।’

বড়োবাবু ধমকে উঠলেন, ‘তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে ভৌমিক! লাশটা হুট করে নিয়ে চলে এলেই হলো?’ বড়োবাবুর হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল, এমন ভাব করে হঠাৎ থেমে গেলেন। তারপর গ্রামের মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ওই চরটা ঠিক আমাদের এলাকার মধ্যে পড়ছে তো?’

নদীটা দুটো জেলাকে ভাগ করে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। কোথাও বর্ধমানের ভেতর দিয়ে পুরোটা, কোথাও বা বাঁকুড়ার মধ্যে দিয়ে। কয়েক জায়গায় নদীর মাঝ বরাবর দুই জেলার সীমানা পড়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নদী পেরিয়েও ওপারে থেকে গেছে বাঁকুড়ার কয়েকটা গ্রাম। তাদের থানা, প্রঞ্চায়েত, পোস্ট অফিস সব এধারে।

নদীটা দুটো জেলাকে ভাগ করে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। কোথাও বর্ধমানের ভেতর দিয়ে পুরোটা, কোথাও বা বাঁকুড়ার মধ্যে দিয়ে। কয়েক জায়গায় নদীর মাঝ বরাবর দুই জেলার সীমানা পড়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নদী পেরিয়েও ওপারে থেকে গেছে বাঁকুড়ার কয়েকটা গ্রাম। তাদের থানা, প্রঞ্চায়েত, পোস্ট অফিস সব এধারে। নতুন চরটা খাতাকলমে ঠিক কোন জেলার মধ্যে পড়ছে, সেটা সাধারণ মানুষের অজানা। সবাই চুপচাপ বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুড়ো ধরনী রায় বলল, ‘তা তো জানি না বাবু। যে যা পেরেছে দখল করেছে। কোনো মাপজোকও কখনো হতে দেখিনি। ওই যে একটা চর দেখছেন, কুমড়ো লাগিয়েছে। ওটা আমাদের এধারের চাষির।’

‘ওই চরটা তো নদীর মাঝবরাবর। বর্ধমানেরও তো হতে পারে।’

বড়োবাবুকে চিন্তিত দেখাল। বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে স্পটে চলুন তো একবার। লাশটা দেখে আসি।’

বশির, তিলকচাঁদ, ধনঞ্জয় ওরা সবার সামনে হাঁটছিল। পুলিশরা জুতো, বুট পাড়ে খুলে রেখে, প্যান্ট গুটিয়ে ওদের পিছু পিছু। পুলিশরা কাদায় নেমে পড়তেই, বহুদূরে অপেক্ষারত মানুষের দলটা সুযোগ বুঝে আড়াল আবডাল থেকে বেরিয়ে এসে নদীর পাড়ে ভিড় জমাল।

চরে নেমে বসির এগিয়ে গেল লাশটা দেখাতে। রুল দিয়ে দু-পাশের বেনাঝোপ সরাতে সরাতে বড়োবাবু এগিয়ে গেলেন লাশের কাছে। পিছু পিছু আরও কয়েকজন জুনিয়র পুলিশ অফিসার।

চারপাশ ঘুরে ফিরে পর্যবেক্ষণ করলেন বড়োবাবু। একজন অফিসার মোবাইলে ছবি তুলে নিলেন লাশটির।

‘এই গামছাটা কে ঢাকা দিয়েছে?’ বড়োবাবু পাবলিকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।

বশির ভয়ে মিন মিন করে বলল, ‘আমি ঢাকা দিয়েছি স্যার। মেয়েটা উদোম গায়ে পড়েছিল। সবাই দেখতে আসছিল লাশটা। তাই ভাবলাম…’

‘রাস্কেল! তোমাকে কে দায়িত্ব দিয়েছে গামছা ঢাকা দেওয়ার?’ বড়োবাবুর চোখেমুখে বিরক্তি ঝরে পড়ল।

বশির থতমত খেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা খুঁজে পেল না।

 

০৪.
দুপুর বারোটা। সূর্য মাথার ওপর উঠে একজন কৌতূহলী দর্শকের মতোই লাশটাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। বড়োবাবু এখনও কোনো ডিসিশন নিতে পারেননি। ওপারের থানায় ফোন করে খবরটা দিতেই পুলিশ এসে হাজির হয়েছে। এখন চলছে দুই থানার পুলিশদের মধ্যে শলাপরামর্শ।

ওপারের বড়োবাবুও সব ঘুরেফিরে দেখলেন। দেখে জানালেন, ‘এলাকাটা ঠিক আমাদের থানার আন্ডারে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। আপনারাই কিছু একটা ব্যবস্থা নিন। লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠান। পরে যদি আমরাও কোনো খোঁজখবর পাই, তখন জানাব আপনাদের।’

এপারের পুলিশরা একটু সরে এলেন একপাশে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেতে লাগলেন। মেজবাবু গলা নামিয়ে বড়োবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘স্যার, দেখলেন কেমন ঘোড়েল লোক। আমাদের ঘাড়ে পুরো চাপিয়ে দিতে চাইছে বোঝাটা। মেনে নেবেন না স্যার। এলাকাটা যে ওদের থানার আন্ডারে নয়, তার প্রমাণ কী?

এপারের পুলিশরা একটু সরে এলেন একপাশে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেতে লাগলেন। মেজবাবু গলা নামিয়ে বড়োবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘স্যার, দেখলেন কেমন ঘোড়েল লোক। আমাদের ঘাড়ে পুরো চাপিয়ে দিতে চাইছে বোঝাটা। মেনে নেবেন না স্যার। এলাকাটা যে ওদের থানার আন্ডারে নয়, তার প্রমাণ কী? কিছু একটা ব্যবস্থা করুন স্যার।’

আরও একজন পুলিশ সহমত পোষণ করে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘লাশটা আমরা তুলে নিলেই যত চাপ আমাদের স্যার। লাশের পরিচয় তো এখনও পাওয়া যায়নি। হতে পারে মেয়েটা ওপারের। কিংবা পরে যদি জানা যায় বিরোধী পার্টির, তাহলে বুঝতেই তো পারছেন স্যার কী কী ঘটতে চলেছে।’

বড়োবাবু কিছুক্ষণ পায়চারি করতে লাগলেন। ফোনেও যেন কার সঙ্গে কথা বলে নিলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন ওপারের বড়োবাবুর কাছে, বললেন, ‘দেখুন, আমরাও এখনও লাশে হাত দিতে পারছি না। আগে ঠিক হোক, এই স্পটটা কোন থানার আন্ডারে পড়ছে, তারপর লাশ তোলা হবে।’

নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন ওপারের পুলিশরা চরের দিকে হেঁটে আসছিল, তখনই কিছু মানুষ কৌতূহলী হয়ে পিছু নিয়েছিল। এখন বেশ কিছু লোক জমে গেছে।

জনতার মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করে উঠে, ‘স্পট ঠিক হতে হতে তো লাশটা পচে যাবে স্যার। ততক্ষণ এখানেই পড়ে থাকবে?’

খ্যাঁক করে উঠলেন একজন কন্সটেবল, ‘আমাদের কাজে কেউ বাধা দিতে আসবেন না, আইন মোতাবেক চলতে দিন আমাদের। ভিড় না করে, বাড়ি যান তো সব নিজের নিজের।’

বশির এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এপারের পুলিশদের কাছেই। এইসব আলোচনা তার মোটেই ভালো লাগছিল না। সুর সুর করে সরে পড়ল একপাশে। মেয়েটা আসলে কে? কোথায় তার বাড়ি? কী তার পরিচয়? কীভাবেই বা মরল? উত্তর না জানা বেশকিছু প্রশ্ন বশিরের মনের ভেতর আলোড়ন তুলতে থাকে। না জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই তার।

নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ল বশিরের। রজিনা ঠিকঠাক পথেঘাটে চলে তো? সে-ও তো স্কুল-টিউশন করে রোজ বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়। যদি এই মেয়েটির মতোই কোনোদিন….আর ভাবতে পারল না বশির। চোখগুলো তার ছলছল করে উঠল। লাশটার দিকে আড়চোখে তাকাল একবার, মনে হলো লাশের জায়গায় ঠিক যেন তার মেয়ে রজিনা শুয়ে আছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত কোনো থানার পুলিশই লাশটা তুলতে পারেননি। মিডিয়ার লোকজন হাজির হয়েছে। এবার হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। সারাদিন ধরে নদীর চরে কত মানুষ এলো! কত মানুষ গেল! সবাই উঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে লাশটাকে। কেউ কেউ ফোনে ছবি তুলছে। লাশটা পচতে পচতে গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। তবে গন্ধটাকে আর কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। গরু-ছাগল মরলে যেমন কিছুদিন নাক চাপা দিয়ে মানুষ চলে, তারপর অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক সেরকম লাশের পচা গন্ধটাও ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে মানুষের।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ 'আজরাইলের ডাক'। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান'। ২০২১ সালে 'আজরাইলের ডাক' গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন 'দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান'। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।