যখন আপনার গল্পে নতুন কোনো চরিত্রের আবির্ভাব ঘটবে, তখন অবশ্যই তার চেহারা ও পোশাকের বিস্তারিত বর্ণনা দেবেন। আপনি যদি সেটা না করেন তাহলে পাঠক নিজের মতো করে চিন্তা করে নেবে, যেটা পরবর্তীতে আপনার বর্ণনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। —সত্যজিৎ রায়
২ মে ২০২১। চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিন ছিল। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করা এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে, এ দিনে নানান আয়োজন ছিল।
শিল্প-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন রায় পরিবার। ঠাকুর পরিবারের পর তাদের অবদান স্মরণীয় এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছেন এই পরিবারের সদস্য সন্দীপ রায়। সত্যজিতের দাদু ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। যাঁর সৃষ্টিকে নতুনভাবে পরিচয় করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর বাবা সুকুমার রায় এখনও পরিবারের বাচ্চাদের প্রিয় লেখক। যাঁর রচনাসমগ্র পড়ে বাচ্চারা তাঁদের সুন্দর-সাবলীল জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই পরিবারের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন সত্যজিৎ রায়।
শিল্পের কোনো শ্রেণিচরিত্র থাকতে নেই। শিল্পীর শ্রেণি তাঁর শিল্প। যে শিল্প গণমানুষের কথা বলে। প্রাণ-প্রকৃতির চিত্র ফুটিয়ে তুলেন। আর সে কাজটি যে বা যাঁরা সাবলীলভাবে সম্পাদন করতে পেরেছেন, তাঁরাই ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। সত্যজিৎ রায় হলেন তেমন ব্যক্তিত্ব।
এখনও দৃঢ়ভাবে, সাহসী চেতনা নিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা যায়, যে কয়েকজন বাঙালি ব্যক্তিত্ব বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন, বাংলার ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন; তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। পুরো পৃথিবীতে তাঁর নাম রয়েছে, একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে। যাঁর মননে, চিন্তায়-চেতনায়, বোধে এবং শিল্পের প্রতি চরম দায়বোধের প্রকাশ রয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রকৃত রেনেসাঁর সন্ধান তাঁর হাত ধরেই। কিন্তু এ কাজটি সহজলভ্য ছিল না। এজন্য লেগে থাকার যে দৃঢ় মানসিকতা সেটি তিনি দেখিয়েছেন। নিরলস শ্রম এবং অনবরত চর্চা করা ছাড়া কোনো শিল্প দাঁড়ায়।
কলকাতার বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়। তাঁকে চলচ্চিত্রপ্রেমী-শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যাদের প্রেমবোধ রয়েছে, তাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ নিয়ে সম্পাদক, চিত্রশিল্পী এবং কবি বিধান সাহা সম্পাদনা করেছেন ‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’।
প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায়
এ বইটিতে প্রবন্ধ রয়েছে সাতটি—সত্যজিৎ রায় ও ‘বনলতা সেন’-এর প্রচ্ছদ: বৃষ্টির আশ্চর্য ছায়া ॥ গৌতম মিত্র, ‘পথের পাঁচালী’র পশ্চাৎপট: এক সিসিফাস-কথা ॥ জফির সেতু, অপুত্রয়ী : মৃত্যুর মাঝে জীবনের পাঁচালি ॥ বিধান রিবেরু, সত্যজিতের মেঘদূতেরা ॥ মারুফ রসূল, রায়ভুবনে টিনটিন। হিল্লোল দত্ত, আমার সত্যজিৎ ॥ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য এবং ভাগশেষ আর বিপন্নতা সত্যজিৎ রায় ॥ সৈকত দে ।
তাঁকে জানতে হলে তাঁর সৃষ্টির ইতিহাস জানাটা জরুরি। সেজন্য পড়তে হবে। তাঁর রচিত চলচ্চিত্রগুলো দেখতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। একজন ব্যক্তির সৃষ্টি, জীবনচরিত নিয়ে যাঁরা লেখেন, তাঁদের লেখাই ওই ব্যক্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখে। যেটির সাক্ষ্য আমরা বরাবরই পাই। এ বইটিতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এখানে যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই তরুণ চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁদের ভাবনার জগত পরিষ্কার। তাঁদের মননে-চেতনায় সত্যজিৎকে ধারণ করার প্রকাশ ঘটেছে প্রবন্ধগুলোতে।
সৃষ্টির বহুমাত্রিকতার ছাপই, লেখনিতে পড়ে। তিনি শুরু করেছেন রোজি থমাসের উক্তি দিয়ে—পশ্চিমা বিশ্বে ভারতের আর্টফিল্ম তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক ও উৎসাহের সঙ্গে গৃহীত হয়েছে, ইউরোপীয় আর্টসিনেমার রীতিনীতির সঙ্গে মিল থাকাতেই এটা হয়েছে, পশ্চিমা দর্শকের চলচ্চৈত্রিক গঠন সম্পর্কিত যে বোঝাপড়া, সেখানে ভারতীয় আর্টফিল্ম কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি বা চ্যালেঞ্জ জানায়নি।
বিধান রিরেরু একজন চলচ্চিত্র সমালোচক। এ বইয়ে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ হলো ‘অপুত্রয়ী : মৃত্যুর মাঝে জীবনের পাঁচালি।’ এটি হলো তাত্ত্বিক প্রবন্ধ। যার ভেতরে তথ্য ও তত্ত্বের জোগান রয়েছে। যে কারণে এর রূপ দাঁড়িয়েছে বহুমাত্রিক। আর এটাই শিল্প-শিল্পীর বৈশিষ্ট্য। তাঁদের সৃষ্টির বহুমাত্রিকতার ছাপই, লেখনিতে পড়ে। তিনি শুরু করেছেন রোজি থমাসের উক্তি দিয়ে—পশ্চিমা বিশ্বে ভারতের আর্টফিল্ম তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক ও উৎসাহের সঙ্গে গৃহীত হয়েছে, ইউরোপীয় আর্টসিনেমার রীতিনীতির সঙ্গে মিল থাকাতেই এটা হয়েছে, পশ্চিমা দর্শকের চলচ্চৈত্রিক গঠন সম্পর্কিত যে বোঝাপড়া, সেখানে ভারতীয় আর্টফিল্ম কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি বা চ্যালেঞ্জ জানায়নি।’
আর্টফিল্ম যে উক্তিটি দিয়েছেন রোজি থমাস। লেখক বিধান রিবেরু আর্টফিল্মের মূল যাত্রাপথ নিয়ে এবং রবিন উড লিখিত আকরগ্রন্থ ‘অপু ট্রিলজি’র বইটির উপর ভিত্তি করে এ প্রবন্ধটি তৈরি করেছেন। যেটিতে রয়েছে নানান বাহাস।
যেখানে তিনি উডের বক্তব্য এবং রোজি থমাসের বক্তব্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাননি। থমাসের দৃষ্টিতে, সত্যজিতের করা ছবিগুলোর মতো ভারতীয় ‘আর্টফিল্ম পাশ্চাত্যে সাদরে গৃহীত কারণ ওসবের গঠন পশ্চিমা ‘আর্ট’ সিনেমার মতোই। কিন্তু উড বলছেন, সত্যজিৎ শিল্পের শিক্ষা প্রধানত গ্রহণ করেছেন পাশ্চাত্য চলচ্চিত্র থেকে…। এসব নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে যাদের ভেতরে, তাদের চিন্তাগুলোকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন বিধান রিবেরু। যে কারণেই প্রথমে বলে নিয়েছি, এটি একটি তথ্য এবং তত্ত্ব নিয়ে লেখা প্রবন্ধ।
‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্র মনে দাগ কাটেনি কিংবা কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি দেখেননি এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। প্রবন্ধটি থেকে তুলে ধরছি—“অপুর চিন্তা ও চেতনার প্রগতি চিহ্নিত করতে উড উল্লেখ করেন ‘পথের পাঁচালী’র শেষভাগের কথা। যখন অপু দেখে, দুর্গা সত্যিই প্রতিবেশীর মালা চুলি করেছিল, তখন সে মালাটি সবার অলক্ষে ছুড়ে ফেলে দেয় পুকুরে। দুর্গা তখন আর নেই, তাই বোনের দোষ ঢাকতে অপু মালাটি কাউকে না বলে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দেয় কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে।…” এ থেকে অপুর উপস্থিত বুদ্ধি, বাস্তবসম্মত জ্ঞান এবং সচেতনতার প্রমাণ মেলে।
এসব বিষয় উডের বই ‘অপু ট্রিলজি’তে উঠে এসেছে। যে বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছেন রিবেরু। এ প্রবন্ধটি পড়ার মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে যারা ‘অপু ট্রিলজি’ বইটি পড়েননি, তাদের অনেক কিছু জানা হবে।
প্রবন্ধ তো এ রকমই হওয়ার কথা, যেখানে প্রশংসা, পর্যবেক্ষণ, আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা এবং নিজস্ব মনোভাবের প্রকাশ থাকবে। তা না হলে লেখার ধার থাকে না। সে হিসেবে এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রবন্ধ।
এর পর হিল্লোল দত্তের ‘রায়ভুবনে টিনটিন’ প্রবন্ধ। যেটি আবার দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। পাঠকের এ দুই প্রবন্ধের মাঝে কিছুটা সময় ভেবে নিতে হবে। কেননা কিছুক্ষণ আগে তাত্ত্বিক মানসম্পন্ন প্রবন্ধ পড়ার পর, এ রকম গল্পের ঢঙে লেখাটি পড়তে গেলে তাল মেলানো কষ্টকর। এখানে পাঠকের কিছুটা ভেবে দেখার পরিস্থিতি তৈরি হলেও, সম্পাদকের সার্থকতা রয়েছে। কারণ একটি বই সম্পাদনা করা তখনই সার্থক হয়, যখন এর মধ্যে একজন ব্যক্তির আদিঅন্ত জানা যায় কিংবা তার নানাদিক সম্পর্কে তথ্যবহুল জ্ঞান অর্জন করা যায়।
প্রতিবারই সত্যজিৎ রায় বিদেশ থেকে ফেরার পথে কমিকসপ্রেমবোধ থেকে ফরাসি সংস্করণ টিনটিন নিয়ে আসতেন। প্রথমে তিনি গোগ্রাসে গিলতেন, এরপর সন্দীপকে দিতেন।
এর পর সন্দীপ নিজেও যদি কোনো বই কিনতেন, তা সবার আগে সত্যজিৎ পড়ে নিতেন। এ বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠতেন। তিনিই প্রথম টিনটিনকে বাঙালির পাঠকের সম্মুখে আনেন ১৯৭৩ সালে। যেটি দেখা যায় ফেলুদার উপন্যাস ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে।
প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে সন্দীপ রায়ের স্মৃতিচারণ দিয়ে। প্রতিবারই সত্যজিৎ রায় বিদেশ থেকে ফেরার পথে কমিকসপ্রেমবোধ থেকে ফরাসি সংস্করণ টিনটিন নিয়ে আসতেন। প্রথমে তিনি গোগ্রাসে গিলতেন, এরপর সন্দীপকে দিতেন।
এর পর সন্দীপ নিজেও যদি কোনো বই কিনতেন, তা সবার আগে সত্যজিৎ পড়ে নিতেন। এ বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠতেন। তিনিই প্রথম টিনটিনকে বাঙালির পাঠকের সম্মুখে আনেন ১৯৭৩ সালে। যেটি দেখা যায় ফেলুদার উপন্যাস ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে। শ্রীমান তোপসের মুখবন্ধ ছিল এমন—“আজ সিনেমায় যাবার কথা ছিল, কিন্তু ঠিক দুটো বাজতে দশ মিনিটে এমন তেড়ে বৃষ্টি নামল যে, সে আশা ত্যাগ করে একটা নতুন কেনা টিনটিনের বই নিয়ে বৈঠকখানায় তক্তাপোশে বসে বেশ মশগুল হয়ে পড়ছি। টুনটুনির বই না, টিনটিনের বই। ‘টিনটিন ইন টিবেট’। বেলজিয়াম থেকে ফরাসি ভাষায় বেরোয় এই আশ্চর্য কমিক বই। তারপর পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ হয়। এখানে আসে ইংরেজিটা…”।
‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ শুরু হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনা দিয়ে, যেটি থেকেই উপলব্ধি করা যায়, সত্যজিৎ রায় টিনটিন প্রেমে কতটা আকৃষ্ট ছিলেন। ঠিক একই কাহিনির শুরুর ছিল ‘টিনটিন ইন টিবেট’ বইয়ে। এই যে শিল্পের বহুমাত্রিকতা, এটাই শিল্পীর সার্থকতা।
‘আমার সত্যজিৎ’ নামে যে প্রবন্ধটি লিখলেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, সেটি হলো তাঁর দেখা শৈশবে সত্যজিতের প্রতি প্রেম। যেখানে তিনি পুরোই তার মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। কীভাবে তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন, তার স্মৃতিচারণ করেছেন। তা হলে বোঝা গেল প্রথমে যে প্রবন্ধটি বইতে যুক্ত হলো, তার পর সে রকমই আরও কয়েকটা প্রবন্ধ নেই। প্রতিটি প্রবন্ধের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। যেখান থেকে পাঠক শুধু ‘কবে সত্যজিৎ জন্মেছিলেন, তার কয়টা চলচ্চিত্র…’ এসব জানতে পারবেন না! এর বাইরেও তাঁর জীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা নানা ইতিহাস জানার সুযোগ রয়েছে বইটিতে।
পাঠক তো জানতে চায়, অজানাকে বুঝতে চায়। সে জানাবুঝাকে সহজলভ্য, পাঠোপযোগী করে কারো না কারো তুলতে হয়। যেটির দায়িত্ব নিয়েছেন সম্পাদক বিধান সাহা। একজন সম্পাদক তাঁর বইটিকে কতটা পাঠযোগ্য করে তুলবে, পাঠকের চিন্তায়-মননে জায়গা করে নিবে; সেটি তাঁর কর্মের উপর নির্ভর করে। যেটির আমাদের বর্তমান সাহিত্য জগতে সংকট।
এ ছাড়াও এ বইটিতে যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের প্রবন্ধ পাঠযোগ্য এবং তথ্যবহুল। যেগুলো পাঠ করলে একজন সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জানাবুঝার অভাব অনেকটাই দূর হবে।
সাক্ষাৎকার পর্ব
সাক্ষাৎকার হলো ‘কারাগার’। যে কারাগারের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিটি সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গের। যেখানে ফুটে উঠে ব্যক্তির দায়বদ্ধতা, সীমাবদ্ধতা এবং প্রাপ্তি। একজন ব্যক্তির জীবনচরিত-সৃষ্টি এবং সমগ্র জীবনকে উপলব্ধি করতে হলে, তাঁকে নিয়ে যে সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়, সেগুলো পড়া জরুরি। আবার একই সঙ্গে এটাও জরুরি এই কারাগারের সম্মুখীন করছেন কে বা কোন গোষ্ঠী।
‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’-এ সাক্ষাৎকার রয়েছে চারটি— ‘আমার গল্পটল্পতে মানুষের মন একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে’ ॥ শ্রুতিলিখন: শাফিনূর শাফিন, ‘আর্টফিল্ম কাকে বলে আমি নিজে ঠিক জানি না’ ॥ অনুলিখন : আলী রেজা পিয়াল, ‘আমি পেশাদার ও অপেশাদার অভিনেতাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না’ ॥ ভাষান্তর : কুলসুম হেনা, ‘আমার সিনেমাজ্ঞানও এই নিখুঁত সিনেমাগুলো দেখে গড়ে উঠেছে’ ॥ ভাষান্তর : তন্ময় হাসান।
প্রথম সাক্ষাৎকারটির নামকরণ করা হয়েছে— ‘আমার গল্পটল্পতে মানুষের মন একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে’। যে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন ড. অমিয় চক্রবর্তী ও সংকর্ষণ রায়। এ বইটিতে এর শ্রুতিলিখন করেছেন শাফিনূর শাফিন।
এ সাক্ষাৎকারটি মূলত সাহিত্যে বিজ্ঞান; বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য নিয়ে তৈরি। যেখানে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন, আর তিনি অবলীলায় এর উত্তর দিয়েছেন।
এ সাক্ষাৎকারটি মূলত সাহিত্যে বিজ্ঞান; বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য নিয়ে তৈরি। যেখানে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন, আর তিনি অবলীলায় এর উত্তর দিয়েছেন।
‘সত্য বিজ্ঞানসম্মত হবে?’ এর উত্তরে তিনি বলেন—‘দৈনন্দিন জীবনে যে অভিজ্ঞতা বা মানুষ চেনা জানা, এমনকি দেশবিদেশ সম্বন্ধেও যেসব কথা লেখা হয় বা শহর সম্বন্ধে বা আরেকটা দিক যে মানুষের… বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে যে লেখা, গ্রাম সম্বন্ধে লেখা—সবসময়ই একটা বিজ্ঞানের দিক, সে রকমভাবে দেখতে গেলে তো থেকে যাবেই। যেটা প্রথম কথা বললাম, মনস্তত্ত্বের দিকটা তো থাকবেই। সেটি তো একটা বড়ো ব্যাপার। সেখানে সে বিজ্ঞানটা নিয়ে পড়াশোনা করা না থাকলেও চলে। মানুষের অবজারভেশনের ওপরেই মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সত্যটাকে চিনে নেওয়া—এই ক্ষমতাটা তো সাহিত্যিকের থাকতেই হবে।’
এটাই তো মূল কথা। যে সাহিত্যিকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নেই, সত্যটাকে চিনে নেওয়ার মতো অবস্থান তৈরি করতে পারেন না, তাদের সাহিত্য তো ইতিহাসে স্থান দখল করতে পারেন না! কী সুন্দর-সহজভাবে সত্য উন্মোচিত করেছেন তিনি। অল্প কথায় মৌলিক বিষয় তুলে ধরা।
এ ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখযোগ্য তিনটি পাঠ-পর্যালোচনা রয়েছে, যা লিখেছেন মুহাম্মদ শাওয়াব— ‘যখন ছোট ছিলাম’, ‘একেই বলে শুটিং’ এবং ‘বিষয় চলচ্চিত্র’।
সাহিত্যে মূল্যায়ন
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র হলো—গোয়েন্দা ফেলুদা, বৈজ্ঞানিক প্রফেসর শঙ্কু ও তারিনীখুড়ো। তিনি এই তিনটি চরিত্র ছড়াও অনেক ছোটো উপন্যাস ও ছোটো গল্প রচনা করেছেন। তারঁ লেখার মূল লক্ষ্য ছিল কিশোর তরুণ পাঠক বর্গ, যদিও তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে প্রিয় লেখক ছিলেন।
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ লেখালেখি জগতেও কম অবদান রাখেননি। বই রয়েছে-৮এর অধিক। এর বাইরে কবিতা, ছোটোগল্প এবং অন্যান্য নানান বিষয়ে লেখা রয়েছে। যেগুলো সব মলাটবন্দি হয়েছে, এমনটা হলপ করে বলা যায় না।
তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প প্রকাশ হয় কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। তাঁর অধিকাংশ চিত্রনাট্যগুলো বন্ধু নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
১৯৯০-এর দশকের মঝামাঝি তাঁর অনেক চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা এবং ছোটো গল্পের সংকলন পাশ্চাত্যেও প্রকাশিত হয়। তাঁর অনেক গল্পই ইংরেজিতে অনূত ও প্রকাশিত হয়েছে।
কতটা শক্তিশালী চলচ্চিত্রকার, লেখক হলে জীবন অবসানের ৩০ বছর পর মানুষ তাঁকে স্মরণ করেন, চিন্তায় স্থান দেন। তাঁকে নানাভাবে অনুসরণ, অনুকরণ করার চেষ্টা করেন। এটাই তাঁর জীবনের একমাত্র পাওয়া। যতদিন মানবসভ্যতা টিকে থাকবে, ততদিন তাঁর অস্তিত্ব বিলীন করে এমন শক্তি কারো নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এঁরাই যুগের পর যুগ দাপট করে বেড়ায়।
এ ছাড়াও সত্যজিৎ রায়কে নিবেদিত পোস্টার রয়েছে। যারা এই অসামান্য কাজটি করেছেন—আনিসুজ্জামান সোহেল, আরাফাত করিম, কাব্য কারিম, কাজী যুবাইর মাহমুদ, তৌহিন হাসান, তৃত তথাগত, তামজীদ নওরীন পূর্ণি, দেওয়ান আতিকুর রহমান, ধ্রুব এষ, নিতীশ বিশ্বাস, বিধান সাহা, মিতা মেহেদী, রাজীব রাজু, রাজীব দত্ত, রিয়াদ মাহমুদ, শতাব্দী জাহিদ, সব্যসাচী হাজরা, সঞ্জয় বিশ্বাস এবং সজীব সেন
‘মহারাজা তোমারে সেলাম’
এ ছাড়াও সত্যজিৎ রায়কে নিবেদিত পোস্টার রয়েছে। যারা এই অসামান্য কাজটি করেছেন—আনিসুজ্জামান সোহেল, আরাফাত করিম, কাব্য কারিম, কাজী যুবাইর মাহমুদ, তৌহিন হাসান, তৃত তথাগত, তামজীদ নওরীন পূর্ণি, দেওয়ান আতিকুর রহমান, ধ্রুব এষ, নিতীশ বিশ্বাস, বিধান সাহা, মিতা মেহেদী, রাজীব রাজু, রাজীব দত্ত, রিয়াদ মাহমুদ, শতাব্দী জাহিদ, সব্যসাচী হাজরা, সঞ্জয় বিশ্বাস এবং সজীব সেন।
এ বইয়ের শেষটি মনোহর। যেখানে ১৯জন চিত্রশিল্পীর আঁকা পোস্টার রয়েছে। যে পোস্টারগুলোতে ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’ লেখাটি লেখা রয়েছে। একই লেখা একেক শিল্পী, একেকভাবে উপস্থাপন করেছে। শতবর্ষকে ঘিরে যে পোস্টার করা হয়েছিল, তারই সংযোজন ঘটেছে বইটিতে। যা বইটিকে আরও বেশি মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
সমাপন
‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’ পড়ে যা মনে হলো, এ রকম একটি সাহিত্য শুধু পাঠ করাই নয়, এটি জীবনের পরতে পরতে শিক্ষণীয় হিসেবে কাজ করে। যে কারণে যারা বই পড়েন কিংবা পাঠকগোষ্ঠী, তারা বুঝেন এরকম একটি সম্পাদনা বই কেন অবশ্যপাঠ্য। সম্পাদনা করে একটি বিষয়কে মলাটবন্দি করা এবং পাঠকের সামনে তুলে ধরা সত্যিই দুঃসাধ্য কাজ। যে কাজটির মূল্যায়ন আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নেই বললেই চলে।
‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’ বইটিতে একজন সত্যজিতের কর্ম-সৃষ্টি এবং তাঁর লেখার যে দৃঢ়শক্তি ছিল, তা সম্পর্কে জানা যাবে। এ ছাড়াও তাঁর জীবনের নানা প্রসঙ্গ এসেছে সাক্ষাৎকার পর্বটিতে। যেখানে শৈশবের স্মৃতিচারণ থেকে শুরু করে, তাঁর কর্মময় জীবন প্রাধান্য পেয়েছে।
বইটি সম্পর্কে লেখা যখন সমাপন টানতে যাচ্ছি, তখন একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়; বইটিকে আরও বেশি ঐতিহাসিক করে তোলার ক্ষেত্রে পরিশেষে একটি জীবনীমূলক টীকা তৈরি করা যেত।
বইটি সম্পর্কে লেখা যখন সমাপন টানতে যাচ্ছি, তখন একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়; বইটিকে আরও বেশি ঐতিহাসিক করে তোলার ক্ষেত্রে পরিশেষে একটি জীবনীমূলক টীকা তৈরি করা যেত। যাতে পাঠক তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন সম্পর্কে একটি ধারণা পেত এবং কয়েকজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ কিংবা ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রকার জীবিত রয়েছেন, যাঁদের কিছু মূল্যায়নধর্মীও কমেন্ট যুক্ত করা যেত। যেটি হলে এটির রূপ আরও পূর্ণাঙ্গ হত। সর্বোপরি চলচ্চিত্রপ্রেমী পাঠকমহল ছাড়াও সবশ্রেণির বইপড়ুয়াদের মধ্যে এর প্রসার ঘটুক।
শেষ টানছি—
‘মহারাজা! তোমারে সেলাম
সেলাম, সেলাম, সেলাম
মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম
মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম
মোরা সাদা সিধা মাটির মানুষ
দেশে দেশে যাই
মোরা সাদা সিধা মাটির মানুষ,
দেশে দেশে যাই
মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন
আর ভাষা জানা নাই
মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন
আর ভাষা জানা নাই
মহারাজা, রাজামশাই
তবে জানা আছে ভাষা অন্য
তোমাদের শুনাইয়ে ধন্য
এসেছি তাহারি জন্য, রাজা!
তবে জানা আছে ভাষা অন্য
তোমাদের শুনাইয়ে ধন্য
এসেছি তাহারি জন্য, রাজা!
মহারাজ!
মোরা সেই ভাষাতেই করি গান
মোরা সেই ভাষাতেই করি গান
রাজা শোন ভরে মন প্রাণ
রাজা শোন ভরে মন প্রাণ
এ যে সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা
তালেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা
তালেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে
এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে
উঁচা-নিচা ছোটো বড় সমান
রাজা উঁচা-নিচা ছোটো বড় সমান
মোরা এই ভাষাতেই করি গান
মোরা এই ভাষাতেই করি গান
করি গান
মহারাজা তোমারে সেলাম’।
তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এই লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনাশিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে যৌথ সম্পাদনায় তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।