পাথর
পাঁচ বছর বয়সে আমার কোনো জন্মদিন হয়নি; দশ বছরেও না। কিন্তু বারো বছরে হলো। আব্বা ঘোড়া ছুটিয়ে ধানের ভুঁই থেকে সেদিন এসেই আমাকে ডাকল। বলল, এই যে তোর জন্মদিনের উপহার।
উপহারটা পকেটে নিয়ে আমি সারাদিন ঘুরলাম। ঘুরলাম নদী-ডাঙা-বাজার ও মানুষের মন। রাতে ফিরে আম্মাকে বললাম হারিকেন জ্বালিয়ে দিতে।
সবাই ঘুমালে লালচে আলোয় দেখলাম আব্বার দেওয়া উপহার। একটা চাপা পাথর। প্রায় গোল। নীল।
পাথর নিয়ে মানুষ কী করে আমি জানি না। কোনো উপায়ন্তর না দেখে পাথরটাকে ভাঙার চেষ্টা করলাম একদিন। হাতের কাছে যা পেলাম, তাই দিয়ে।
কিন্তু পাথর যে এত শক্ত কে জানত!
পাথরটা দোকানে চলল না, পানিতে ভাসল না; এবং আশ্চর্যজনকভাবে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে ফিরে এলো নিজের কাছেই।
সাত দিন মাটিতে পুঁতে দেখলাম কিছুই উদ্গারিত হলো না।
বাজে ও বেকার একটা জিনিস, এই পাথর।
বুঝলাম আব্বা খুব ফাঁকিবাজি করেছে। এমন একটা জিনিস দিয়েছে যা দিয়ে আসলে কিছুই করা যায় না। এমনকি, পোড়ে না আগুনেও।
ভাই-বোনদের আব্বা একটা নদী, দুইটা আকাশ আর তিনটা পাহাড় লিখে দিল। আমি বললাম, আমাকে কিছু দেবেন না?
আব্বা বলল, দিয়েছি তো।
আব্বা মরে গেলে অভিমান হলো খুব। একটা পাথর দিয়ে এমনকি এক থাল ভাতও তো খাওয়া যায় না!
২.
ভাতের কষ্ট আমার দূর হয় না।
কিন্তু বুঝতে পারি তারচেয়েও কত রকমের কষ্ট যে আমাদের আছে!
পাওয়ার কষ্ট, না পাওয়ার কষ্ট!
ভালোবাসা আর ঘৃণার কষ্ট!
এবং
মানুষের ক্রমাগত একলা হয়ে যাওয়ার এ গল্পে সবচেয়ে বেশিটা হলো বলতে না পারার কষ্ট।
একেকটা অভিব্যক্তি লাশের মতন জমাট হতে শুরু করে। এখানে ওখানে জমতে থাকে সর্বখানে। গিলে খাওয়া একেকটা তীব্র মৃত্যু জীবনের সাথে হয়ে ওঠে পারমাণবিক। দিন যায়, আসে… রাত যায়, আসে… জীবনের লাশ হয়ে থাকে জীবন্ত যাপন।
আর একদিন, মানুষের গোপন অশ্রু নিঃশেষ হয়ে গেলে একটা নিরেট পাথর, ঝিনুকের মুক্তোর মতো জমে ওঠে; মানুষেরই বুকে, অধিক নীরবে।
পাথরের নাই এর বেশি কোনো বিজ্ঞান।
৩.
আমার কাছে এখন দুইটা পাথর আছে। নীল।
কোনো এক জন্মদিনে আমার সন্তানকে সেগুলো উপহার দিয়ে দেবো।
জানি না, সন্তান পাথরগুলো গ্রহণ করবে কি না।
তেলাপোকা
তেলাপোকা লাল বা সাদা, হতে পারে যে কোনো রঙের। চোখ থাকায় পারে তাকাতে, এমনকি রাখতে পারে চোখে চোখও। কষ্ট করে তাকে উড়তে হয়। এবং ওড়ার সময় তাকে মনে হয় সবচে বিপন্ন প্রাণি। কিন্তু তারা বিপন্ন না; বরং তারাই নাকি টিকে আছে আদিকাল থেকে। তাদের টিকে থাকা প্রবাদের মতো এই বাঙলায়।
২.
পাতার খুব খেয়াল রাখে রিয়াদ।
বিশেষত তেলাপোকা যদি উড়ে আসে এ জন্য রিয়াদ তটস্থ থাকে সব সময়। তার হাতে থাকে মশা মারা ইলেক্ট্রিক ব্যাট।
তেলাপোকা এবং ওই সংক্রান্ত ভীতি পাতার উভয়ই বেড়েছে আজকাল। ডাক্তার বলেছে অন্তঃসত্ত্বাকালীন এমন ঘটনা ঘটতে পারে। রিয়াদকে এসব বুঝতে হবে।
৩.
অফিস শেষে বন্ধুদের আড্ডাটা বাদ দিয়েছে রিয়াদ। বাসায় ফিরেই চলে যায় সিংকে। থালাবাসন ধুয়ে-মুছে করে ফেলে টিপটপ। পাতা বারবার বলে, এসব পারি তো, করো না…
রিয়াদ শোনে না।
ঘর মুছছে রিয়াদ একদিন পরপর। তেলাপোকা বেড়েছে ইদানিং। প্রতিদিন মুছতে পারলে ভালো হতো। রিয়াদের খুবই নজর সব দিকে।
সপ্তাহে একদিন কাপড় কাচা
এবং রাতের রান্না
তদুপরি গাছে পানি দেওয়া
আলমারি গুছিয়ে রাখা
সেদিন এমনকি চুলও আঁচড়ে দিলো রিয়াদ। পাতার দুপাশে বেনি। পাতার দুচোখে কান্না। হৃদয় ভিজে যায়। ফোনে বলে, মা, তুমি আরও দেরি করে আসো, অসুবিধা নাই কিছু!
৪.
বন্ধুরা যেদিন আসে সেদিনই যা উঠতে হয় পাতাকে।
চা ও চানাচুর…
এমনকি শেষ পর্যন্ত গরুর ভুনা…
ডাল ও ভাত…
পাতার তবু আরাম লাগে। বলে, আজ তো তবু করছি একটু। আপনাদের বন্ধু কিন্তু আমাকে কিচ্ছু করতে দেয় না। নিয়ম করে ঝাঁট দেয় ঘর, কাপড় কাচে, আলমারি গুছায়, ভাত তরকারি সব রান্না করে…আমার তো চুলে তেলও দিয়ে দেয়…
বন্ধুদের চা ছলকে যায়। হাসিমুখ গোমড়া। ওরই ভেতর কেউ ফ্যাক করে বলে বসে, ভাড়ুয়া…
৫.
রাতে ফড়ফড় ওড়ে তেলাপোকা।
রিয়াদ বারান্দায়। সিগারেট খায়। ঘরে কাশে পাতা। ডাক দেয়। রিয়াদ শোনে, কিন্তু যেন শুনতে পায় না। অনেকক্ষণ পর ঢোকে ঘরে।
একটা তেলাপোকা ঘুরতে থাকে দেয়াল থেকে দেয়ালে। পাতা সেদিকে তাকিয়ে থাকে ভীতির সাথে।
রিয়াদ বলে, আমি যে ঘরের কাজ করি, এইসব আমার ফ্রেন্ডদের বলবা না আর কোনোদিন!
পাতা রিয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রিয়াদ একটু থেমে বলে, শুধু ফ্রেন্ডদের না, কাউকেই বলবা না! দরকার কী এইসব বলার, তাই না? আমি তোমার জন্য কী করি কী ভাবি সেইটা শুধু তুমি জানলেই হলো, হলো না?
পাতা রিয়াদের দিকে তাকিয়েই থাকে। তেলাপোকা ফড়ফড় উড়তে থাকে দেয়ালে দেয়ালে। পাতা সেদিকে তাকায় না আর। পাতা তাকিয়ে থাকে রিয়াদেরই দিকে। রিয়াদের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত ফড়ফড় আসতে থাকে; আসতেই থাকে; আসতেই থাকে…
পাগলাগারদ
তিন পাগল একদিন ঢুকে গেল তাজমহলে।
মমতাজমহলের রূপ নিয়ে তাদের কোনো কৌতুহল ছিল না।
মোঘলদের স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে তাদের কোনো উৎসাহ ছিল না।
শাহজাহানের শিল্পনিষ্ঠুরতা নিয়েও তাদের ছিল না কোনো দার্শনিক ভঙ্গি।
তাদের যা ছিল তা হলো একান্ত বৃত্তিবাসনা।
তারা শীতল পাথরে মল এবং
নিবিঢ় স্থাপনায় মূত্র ত্যাগ করতে ভালোবাসল।
তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনের দিকেই খেয়াল রাখল এবং হাতে করে মল নিয়ে কেবলই ঘৃণা ছড়াতে শুরু করল।
এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে ভালোবাসার অপরূপ নিদর্শন হিসেবে কথিত এই ভবনে ঘৃণাই ছড়াল সবচে দ্রুত। ফলে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তাজমহল ভরে উঠল দেশী বিদেশী হাজার পাগলে।
ছয় মাসের মধ্যে তাজমহলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাগলাগারদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলো।
পত্রিকায় খবর হলো–পাগল যেখানে থাকে সেটাই পাগলাগারদ।
ঘর বানানো বিষয়ক প্রস্তাবনা
ঘর বানানোর জন্য প্রথমেই লাগবে একটুকরো জমি।
আপনাকে দেখে নিতে হবে যে জমিটা যেন বৃষ্টিতে ভেসে না যায় এবং ডুবে না যায় বন্যায়। ফলে জমি বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের সাথে আপনার লাগবে প্রাকৃতিক কিছু প্রবৃত্তি। জমিটি নির্বাচিত হলেই আপনি তখন চারটি দেয়ালের কথা ভাববেন; এবং অতি অবশ্যই চার দেয়াল আপনি জমিনের ওপর স্থাপন করবেন না। ঝড়ো বাতাস আর প্রকৃতির বিভিন্ন গজব থেকে রক্ষার স্বার্থেই আপনি চারটি দেয়ালকে আসলে প্রোথিত করবেন মাটির ভেতরে। ঠিক গাছ যেভাবে নিজেকে রাখে। তবে আপনি কোনো শেকড়, কখনোই, স্থাপন করতে পারবেন না।
চারটি দেয়াল হওয়ার পরেই কেবল আপনি ছাদের কথা ভাবতে পারেন। কেননা প্রকৃতি চারপাশ থেকে হানাদার হয়ে উঠতে পারে তা না; বরং উবুর হয়ে আক্রমণ চালাতে পারে আকাশ থেকেও; এবং জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হবেন না যে ওপরে আছে অন্তত সাতটি আসমান।
ফলে আপনাকে স্থাপন করতে হবে ছাদ। কংক্রিটের ছাদ এখন সবচেয়ে ভালো। আপনি পাথর বা ইট যে কোনো কিছুই বিকল্প হিসেবে নিতে পারেন। আপনাকে আটকাতে হবে সমূহ বিপদ; যেন মেঝেতে শুয়ে, ওপরের দিকে তাকিয়ে, আপনি নিশ্চিত হতে পারেন; বোধ করতে পারেন নিরাপদ।
তবে এসব সম্পন্ন করলেই আপনি একজন গৃহপতি হয়ে উঠবেন তা কিন্তু নয়। ঘরের অন্যতম শর্ত হচ্ছে জানালা। চার দেয়ালে আপনাকে অন্তত দুটো জানালা নির্মাণ করতে হবে। জানালাগুলো তৈরি হবে দেয়ালের ভেতর গর্ত খুঁড়ে। গোলাকার বা চৌকো। এগুলো আপনাকে ঘরের ভেতর প্রকৃতিকে আসতে সাহায্য করবে। আলো ও তাপ, ঝঞ্ঝা ও বাতাস, ধুলো ও বালি—জানালা দিয়েই আপনার গৃহে প্রবেশ করবে। এবং অবশ্যই, এ বিষয়ে আপনার লাগবে, প্রাকৃতিক কিছু প্রবৃত্তি।
তবে জানালা সম্পন্ন করলেই আপনার কাজ ফুরিয়ে যাচ্ছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। জানালায় অবশ্যই আপনাকে কপাট দিতে হবে। যেন আলো ও তাপ, ঝঞ্ঝা ও বাতাস, ধুলো ও বালি—জানালা দিয়ে আসতে না পারে। এবং আপনি যদি আরেকটু জ্ঞানী হন, আপনি অবশ্যই জানালায় স্থাপন করবেন পর্দা। তাতে প্রকৃতি বিষয়ক উদ্বেগে আপনি পাবেন বেশ খানিকটা উপশম।
অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঘর বানানোর সময় আপনাকে নিশ্চিতভাবেই একটা দরজা বানাতে হবে। শুধুমাত্র প্রবেশের জন্য না, যেন দরজাটা দিয়ে আপনি বেরিয়েও যেতে পারেন কোনো এক অরণ্যের দিকে।
ঘের
তেমন কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু ডাইনোসরটা বলে বসল… ওই তিনটা পাহাড় আমার!
খরগোশের একটু মন খারাপ হলো—আহারে! তিনটা না হোক, অন্তত একটা পাহাড়ও যদি তার থাকত!
এরপর ডাইনোসরটা প্রতিদিন সেই তিনটা পাহাড়ে ঘোরে। গাছ খায়, পিঠ চুলকায় লেজ দিয়ে, রোদের ওম নেই…
ওদিকে খরগোশ এ বন ও বন যায়। এ পাহাড় ও পাহাড় ঘোরে। একদিন ঝর্ণায় গোসল করে একদিন নদীতে…
এর মধ্যেই ডাইনোসরের খোঁজ নিতে খরগোশটা ঢুকে পড়ল ওই তিনটা পাহাড়ে। খুব চটলো ডাইনোসর—জানো না তুমি, এই তিনটা আমার পাহাড়? যাও এখান থেকে।
খরগোশ বেরিয়ে গেলে ডাইনোসর বেশ কসরত করে বেড়া দেয়া শুরু করল পাহাড় তিনটার সীমান্তে। কাজটা করতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগল তার। কিন্তু ষষ্ঠ দিন শেষে যখন সে চারিদিকে তাকাল, বুকটা ভরে এলো। আহা, তার পাহাড় তিনটায় এবার আর কেউ ঢুকতে পারবে না!
সপ্তম দিনটা ডাইনোসর কাটাল বিশ্রামে। তারপর আবার সে প্রতিদিন সেই তিনটা পাহাড়ে ঘোরে। গাছ খায়, পিঠ চুলকায় লেজ দিয়ে, রোদের ওম নেই…
ওদিকে খরগোশ এ বন ও বন যায়। এ পাহাড় ও পাহাড় ঘোরে। একদিন ঝরনায় গোসল করে একদিন নদীতে…
অনেক দূর থেকে দেখে মনে হলো খরগোশটার জন্য আছে সারা পৃথিবী; কিন্তু ডাইনোসরটা তিনটা পাহাড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত বেড়ায় আটকা পড়ে গেছে। কেউ তাকে উদ্ধার করছে না; এমনকি ডাইনোসরটা জানতেও পারছে না তার প্রয়োজন উদ্ধারের!
জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৮১। দশ বছরের লেখালেখির জীবনে লিখছেন মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
বর্তমানে কর্মরত একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা :আত্মহননের পূর্বপাঠ (২০১০)
রম্য সংকলন : যে কারণে আমি সাকিব আল হাসান হতে পারি নি (২০১৭)
গল্প সংকলন : য পলায়তি স জীবতি (২০২০), সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা (২০২১), কী একটা অবস্থা (২০২২)।