ঋত্বিক কুমার ঘটকের চলচ্চিত্রের একটি সৌন্দর্য এই যে, দৃশ্যমান কাহিনির বিভিন্ন প্রতীকের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে তাঁর নিজস্ব দর্শন ও চিন্তা-সম্বলিত দ্বিতীয় আরেকটি কাহিনি। যেখানে বেদনাবিধুর ইতিহাসের ছায়া যেমন থাকে, তেমনি থাকে মিথলজির বিভিন্ন চরিত্রের ছায়া। তাই তাঁর সিনেমায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতীক বোধগম্য না হলে এই সৌন্দর্যসুধা পান করা অসম্ভব হয়ে যায়। একইসাথে তাঁর ভাবনাগুলোও অধরাই থেকে যায়। তাঁর চলচ্চিত্রে একটি কাহিনি তো অবশ্যই দেখা যাবে, যেখানে উচ্চকিত মেলোড্রামা, সমাপতনের আকস্মিকতা, সংগীত ইত্যাদি অনেক উপাদান থাকবে; যা দেখে আমরা কখনো আনন্দিত হবো, কখনোবা বেদনায় ম্লান হবো, এ জন্য আলাদা করে কোনো চিন্তা করতে হয় না; কিন্তু এই কাহিনির অন্তরালে বিভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারে, বিশেষ বিশেষ শটের বিন্যাস ও সংঘর্ষে, সংগীতের ব্যবহারে ও বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন বার্তা; যা বোঝার জন্য মস্তিষ্কের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তাই ঋত্বিকের সিনেমার কোনো সহজ একরৈখিক ব্যাখ্যা হয় না। শেকড় ছেঁড়ার বেদনায় কাতর ঋত্বিক শেকড়ের কথা, জীবন-দর্শনের কথাই বলতে চান বারবার। চলচ্চিত্রকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার না করে কঠোর বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলতে চান। তাই ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্র-দর্শন নিয়ে একেবারেই আলাদা।
ঋত্বিক কুমার ঘটক তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অযান্ত্রিক’ চলচ্চিত্রটিকে ‘উদ্ভট কাব্যে’র সাথে তুলনা করে বলেছিলেন—
‘গুরুগম্ভীর ভঙ্গি করে এ ধরনের জিনিসের স্বাদ পাওয়া যায় না। হতে হবে শিশু, হতে হবে আদিবাসী ওঁরাও, হতে হবে বিমল। আমার ছবিতেও এই তিনটি স্তরই আছে। গোটা ছবিটাই হচ্ছে কিংবদন্তী।’
ঋত্বিক কেন এই কথা বলেন?
সুবোধ ঘোষের গল্পকে সম্প্রসারিত করে ঋত্বিক জীবনের চরম সত্যকেই ধরতে চেয়েছেন এবং তার মাধ্যম হিসেবে মনোবিদের বিভিন্ন দর্শন এবং মৌল প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন, যা নিয়ে রয়েছে তাঁর নিজস্ব ভাবনাও। ‘অযান্ত্রিকে’ উল্লিখিত ওঁরাও, শিশু, বিমল— এই তিনের মধ্যে প্রধান মিলটি হচ্ছে জড় বস্তুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা । ‘অযান্ত্রিকে’র মাধ্যমে এই জড়বস্তুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরেই ঋত্বিক মানব সভ্যতার চরম সত্যকেই উন্মোচন করতে চান, মৌল প্রতীককে ব্যাখ্যা করতে চান। পুরনো গাড়ি জগদ্দলের প্রতি যেমন বিমলের গভীর ভালোবাসার প্রকাশ রয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে অকেজো জগদ্দলের উপর প্রচণ্ড অভিমানে ক্ষিপ্ত হবারও প্রকাশ রয়েছে। কোনো জড়বস্তুতে আঘাত পেলে কোনো অভিমানী শিশু যেমন ওই জড়বস্তুর উপর রাগ করে তার উপর পাল্টা আক্রমণ করতে চায়, ঠিক তেমনি অনেক চেষ্টার পরও অকেজো হয়ে যাওয়া গাড়িটির উপর রাগী, অভিমানী বিমলকেও সজোরে আঘাত করতে দেখা যায়। ঋত্বিক চলচ্চিত্রেই শুধু তাঁর মৌল প্রতীক ভাবনার ব্যবহারই করেননি, মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবনার সূত্র ধরে বিভিন্ন লেখায় তার সহজ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টাও করেছেন। প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে তাঁর এক লেখায় ঋত্বিক উল্লেখ করেন, ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষের যে স্মৃতির ভান্ডার, সেটা জমা হয়ে যায় মস্তিষ্কের সেই অংশে যাকে আমরা বলি যৌথ অবচেতন কালেকটিভ আনকনশাস। ..এই অবচেতনের সমস্ত জিনিসগুলো হচ্ছে লক্ষ-কোটি বছরের সৃষ্টির ভান্ডার মথিত করে নির্যাসটুকু থেকে যাওয়া। সেটা কোনো বিশেষ মুহূর্তে, কোনো বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে আসে, এবং হঠাৎ মিলিয়ে যায়— সাধারণ কার্যকরণ পরম্পরায় তার হিসাব করতে গেলে কিছুই মেলে না’
ঋত্বিকের এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কারণ তাঁর বিভিন্ন সিনেমায় এই ঝিলিকটুকুর আভাস পাওয়া যায়। তাই, তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতার জন্ম হয় জগদ্দাত্রী পুজার দিনে এবং মৃত্যু হয় পাহাড়ের কোলে, ঋত্বিক যাকে বলেন মহাকালের সাথে মিলন। ‘কোমলগান্ধারে’ অনসূয়ার মধ্যে শকুন্তলার ছায়া দেখা যায়, ‘সুবর্ণরেখা’য় বহুরূপী কালীর মধ্যে দেখা যায় সেই টেরিবল মাদারের প্রতিমূর্তি, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে অনন্তর মায়ের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় ‘ভগবতী’র প্রতিমা। ‘অযান্ত্রিকে’ এই শিশু, ওঁরাও এবং বিমল এরা এক সারল্যের সম্পর্কেও সম্পর্কযুক্ত বটে। সকল জটিলতার ঊর্ধ্বে এদের অবস্থান। তাই অযান্ত্রিকে নৃগোষ্ঠী ওঁরাওদের গান, নৃত্য ঘুরে ফিরে এসে জীবনের চক্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। লং শটে জগদ্দলকে পাহাড় বেয়ে ওঠার দৃশ্য উঠে আসে এক গভীর কাব্যময়তায়। বুলাকি পাগলার উপস্থিতিও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। নতুন গামলা পেয়ে পুরনো গামলাকে ভুলে যাওয়া তো সেই জীবনের চরম সত্যের প্রতিই ঈঙ্গিত প্রদান। সিনেমা শেষ হয় শিশুর হাতে জগদ্দলের ক্রেংকার ধ্বনিতে, যা দেখে বিমলের ঠোঁটের কোনে হাসির ঝিলিক দেখা যায়; যে হাসিতে লুকিয়ে থাকে জীবন ও সভ্যতার পরিবর্তনের সত্য।
‘অযান্ত্রিকের’ প্রধান চরিত্র বিমল মানুষ হয়েও যন্ত্রের সাথে তুল্য হচ্ছে, আবার বিমলের গাড়ি জগদ্দল যন্ত্র হয়েও অযান্ত্রিক। বিমল যখন জগদ্দলের ইঞ্জিনে পানি ঢালে তখন জগদ্দল মানুষের মতোই ঢক ঢক শব্দ করে পানি পান করে, জগদ্দলের উপর আরোহিণী নারী যখন বিমলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার কাঁধে হাত রাখে, তখন বিমলের সাথে জগদ্দলও যেন কেঁপে উঠে।
অযান্ত্রিকে ঋত্বিক দেশভাগের ফলে তার শেকড় ছিন্নের অন্তর্গত বেদনার কথা, বাস্তুহারাদের কথাও আমাদের জানিয়ে দেন। যেমনটি দেখা যায় তাঁর দেশভাগের ট্রিলজি ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’ ও ‘কোমলগান্ধার’-এ। তাই ‘অযান্ত্রিকে’ শিশু সুলতান যখন বিমলের দেশ কোথায় জানতে চায়, তখন বিমল এক বেদনাবিধুর বিমর্ষচিত্তে নীরব থাকে। ট্রেন আসার পরে লম্পট পুরুষের দ্বারা পরিত্যাক্ত নারীটির মুখে আলো-ছায়ার খেলা এক অনিশ্চিত জীবনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ওই নারী যখন ট্রেনে ওঠে, তখনো জানে না তার গন্তব্য কোথায়। অস্ফুট কন্ঠে বলা ওই নারীর কথা বুঝতে বিমলকে তাই চলন্ত ট্রেনের পেছনে উদগ্রীব হয়ে ছুটে যেতে দেখা যায়। সে নারীটির গন্তব্য জেনে, পরিচয় জেনে স্বস্তি পেতে চায়।
বিমলের সাথে তার গাড়ি জগদ্দলের সম্পর্ক কখনো প্রেমিকার মতো, কখনো সন্তানের মতো আবার কখনো মায়ের মতো। তাই কখনো স্নেহার্দ্র কন্ঠে বিমলকে বলতে শুনি, ‘ভারী তেষ্টা পেয়েছে, না রে জগদ্দল? তাই হাঁসফাঁস কচ্ছিস? দাঁড়া বাবা দাঁড়া।’ এর আগের শটেই দেখানো হয় একটি বাছুর তার মা গাভীর দুধ পান করছে। গাড়িকে যখন বিমল পরম যত্নে ধুয়ে মুছে দিচ্ছে তখন পিয়ারা সিং বলে, ‘গাড়িভি ঘরকা আওরাত হায় ক্যা?’ এবং জগদ্দলের পেট্রলের পোঁড়া গন্ধে বিমলেরও কেমন ‘মিঠে নেশা’ লাগে! সুলতানের প্রশ্নের উত্তরে বিমল জানায়, জগদ্দল বিমলের জীবনে আসে তার মায়ের মৃত্যুর পরের বছর। গল্পকার সুবোধ ঘোষের বর্ণনার মধ্যেও জগদ্দলের মাতৃরূপের এক পরিচয় পাওয়া যায়, যেখানে বিমল এক বৃষ্টিমুখর রাতে সতরঞ্জি আর চাদর দিয়ে গাড়িটার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ে গাড়ির ভেতরে। যেন মাতৃজটরে নিরাপদে শুয়ে থাকে অনাগত এক শিশু।
সুবোধ ঘোষের গল্পের প্রতি ঋত্বিক বিশ্বস্ত থেকেই তাঁর ‘অযান্ত্রিক’ চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু করেন এবং লম্পট পুরুষ কর্তৃক পরিত্যাক্ত নারী, ওঁরাও নৃত্য ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করে জীবনচক্রকেই মুল উপজীব্য করেন। তাই জগদ্দলের সমস্ত অংশ আলাদা করে দিয়ে যখন বিক্রির জন্য গ্যারেজ থেকে বের করা হয়, তখন মানব জীবনের অমোঘ সত্য সেই শেষ যাত্রার কথাই মনে পড়ে। সুবোধ ঘোষের গল্পে যেরকম বিমল ভাবে, গাড়ীর মতো সে-ও তো অকেজো হয়ে গেছে।
‘আমি শুধু রৈনু বাকি… পরিশ্রান্ত বিমল মনে মনে যেন বলে উঠল। কিন্তু আমারও তো হয়ে এসেছে। চুলে পাক ধরেছে, রগগুলো জোঁকের মতো গা ছেয়ে ফেলেছে সব। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই, যেদিন জগদ্দলের মতো এমনি করে হাঁপিয়ে আর খুঁড়িয়ে আমাকেও বাতিল হয়ে যেতে হবে।’
সুবোধ ঘোষ ও ঋত্বিকের ‘অযান্ত্রিক’ নিয়ে এই দার্শনিক ভাবনার সাথে সাথে আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বসে বাউল করিমও চিন্তা করছেন এক মানবগাড়িকে নিয়ে। তার এই মানবগাড়ির ভাবনা নিয়ে লেখা গান জীবনের নিয়মের দিকই নির্দেশ করে। যত্ন করে যে মহাজন দেহগাড়িতে পেট্রল অর্থাৎ জীবনীশক্তি দিয়েছিলেন সেই গাড়ি আজ ‘কন্ডেম’ হয়ে গেছে। ‘কন্ডেম’ হয়ে যাওয়া গাড়ি নিয়ে তাই বিমলের মতো আব্দুল করিমও ভাবেন—
‘ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে/ কন্ডিশন ভালো নয়রে/ কখন জানি ব্রেক ফেল করে/ ঘটায় কোন দুর্ঘটনা/ গাড়ি চলে না, চলে না/চলে না রে, গাড়ি চলে না/ আব্দুল করিম ভাবছে এবার/ কন্ডেম গাড়ি কি করবে আর/ সামনে বিষম অন্ধকার/ করতেছি তাই ভাবনা।’
‘অযান্ত্রিকে’ও আমরা দেখি বিমলের সব চেষ্টার পরে শুনতে হয়, ‘তোমার গাড়ি কন্ডেম হয়ে গেছে বিমল! এবার বিক্রি করে দাও।’ বিমলের একরোখা, কৃপণ ও বুনোরাগী স্বভাবের আবরণে ঢাকা পড়ে যায় তার ভেতরের কোমল মন, যা প্রকাশ পায় তার ভাঙাচুরা জগদ্দলের উপর অপার প্রেমে তো বটেই, অসহায় নারীর পাশে দাঁড়িয়ে, বিপদগ্রস্ত যাত্রীদের প্রতি তার সহানুভূতিতে তা আরও প্রকট হয়। তাই গড়পড়তা মানুষ থেকে বিমল আলাদা। বিমলের ভেতরেই এক কবির বাস, বাউলের বাস— যা যন্ত্রণায় দগ্ধ। বিমলের প্রতি ছোটো ছোটো ছেলেদের কাঁদা ছোড়ার দৃশ্য যন্ত্রণাদগ্ধ কবি কিংবা বাউল জীবনের প্রতীক হিসেবেই উঠে আসে। যে যন্ত্রণা ধারণ করে গেছেন ঋত্বিক নিজেও সারাটা জীবন ধরে। সাধারণ মানুষের কাছে বিমল গ্রহণযোগ্য না হলেও, নৃগোষ্ঠী ওরাওঁদের সাথে সে মিশে যায় অবলীলায়। এখানে বিমলকে ঋত্বিক হাজির করেন ‘ভাবুক চেতনার’ মানুষ হিসেবে যার বিপরীতে আরেক ড্রাইভার পিয়ারা সিং উপস্থিত হয় ‘কর্মযোগী চেতনার’ প্রতিনিধি হয়ে। এ সম্পর্কে জোসেফ ক্যাম্পবেল এর মিথলজির ব্যাখ্যার সূত্র ধরে ঋত্বিকের বক্তব্য আমরা পাঠ করতে পারি—
‘এই মিথলজি দেখায় যে, এই সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস দুই রকম মানবচেতনার সংঘর্ষের ইতিহাস। এক হচ্ছে কর্মযোগীদের চেতনা, আর এক ভাবুকদের চেতনা। এই ভাবুকই কবি, শিল্পী, shaman, medicine man, ঋষি, স্বপ্নদ্রষ্টা।’
বিমলের কাছে জগদ্দল যেখানে তার বন্ধু, সন্তান কিংবা মাতৃতুল্যা, সেখানে পিয়ারা সিং এর কাছে তা নিছক এক বুড়ি। তাই পিয়ারা সিং যখন জগদ্দলকে বুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে, এবার তোমার বুড়িকে পেনশন দাও, তখন বিমলের সটান উত্তর—
‘হু, তারপর তোমার মতো একটা চটকদার হাল মডেল বেশ্যে রাখি।’
বিমল তার কৃপণতার জন্য অনেক সময় না খেয়ে থাকলেও জগদ্দলের জন্য সে দু হাতে টাকা খরচ করে, যার জন্য পিয়ারা সিং সবসময়ই ফোড়ন কেটে যায়। বিমল ও পিয়ারা সিং চরিত্র দুটোর সম্পর্ক নিয়ে ঋত্বিকের বক্তব্য ছিল এরকম—
‘পিয়ারা সিং হচ্ছে tough minded as opposite to tender mindness of বিমল।’
ঋত্বিক কুমার ঘটকের চলচ্চিত্র তাই শুধু দেখার বিষয় না হয়ে তা রীতিমতো পাঠের বিষয়ও হয়ে যায়। আর ‘অযান্ত্রিকে’ জগদ্দল নামের বিমলের গাড়িটি যখন নিজেই একটি চরিত্র হয়ে যায়, তখন পাঠের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। জগদ্দলের পেট্রল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়া যেন তার কান্না, হঠাৎ ধোঁয়া বের হয়ে যাওয়া যেন চেপে রাখা অভিমান কিংবা রাগের বহিঃপ্রকাশ। বিমলের প্রতি অপরিচিতা ওই নারীর কোমল দৃষ্টি, তার কলকল হাসি দেখে জগদ্দল দ্রুতবেগে তার ধোঁয়া নির্গতের মাধ্যমে যেন ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তার হেড লাইট দুটো যেন ক্ষুব্দ দুটো চোখ, নিয়ন্ত্রণহীন জগদ্দল যেন ওই নারীর উপর দিয়েই চলে যেতে চায়, যা বিমলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওই অনামিকা, অপরিচিতা নারীর ঠিক সামনে এসে থেমে যায়। হাস্যরত নারীর রহস্যময় সৌন্দর্যের কাছে মৃত্যু যেন থমকে দাঁড়ায়।
সমাধিস্থলে ওঁরাও নারীটির বেদনাবিধুর সুর-সংগীতের শটের সাথে বিমলের জগদ্দলের গ্যারেজে প্রবেশের শটের সংঘর্ষ যেন বলতে চায় জগদ্দল এক ব্যাথিত দুঃখিনী নারীর মতোই আর্তচিৎকার করছে। তাই গ্যারেজে ঢুকে বিমল জগদ্দলকে ভরসা দেয়, ‘আমি আছি জগদ্দল, আমি আছি।’
অযান্ত্রিক তাই শুধু এক যন্ত্রের গল্প নয়, তা বিভিন্ন দর্শনের পাশাপাশি জীবনের কিছু পঙ্কিলতাকেও আমাদের সামনে নিয়ে আসে যা ওই অনামিকা—অপরিচিতা নারীর ঘটনাবলীতে উন্মোচিত হয়।
গ্রন্থ সহায়িকা:
চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু : ঋত্বিক কুমার ঘটক, প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
পেশায় ব্যাংকার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শাবিপ্রবির চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন চোখ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক ছোটোকাগজ ‘প্রক্ষেপণ’ সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায় নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ ও গল্প লিখছেন।