রবিবার, নভেম্বর ২৪

স্তব্ধতার দিকে : মণিকা চক্রবর্তী

0

১.
হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে মৃতের মতো অচেতনতার মধ্যেই সে। সেলাইন চলছে শরীরে। এর মধ্যেই যেন শুনছিল ট্রেনের ভোঁ শব্দটা। যেন অনেক দূর থেকে, চারপাশের হাজার মানুষদের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে ট্রেনের ভোঁ আওয়াজটির স্বপ্ন সে দেখছিল। যেন অজানা সময় ধরে সে অপেক্ষা করছিল এই নির্দিষ্ট ট্রেনটির জন্যই। সে যেন করুণভাবে দৌড়াচ্ছিল ওই ট্রেনটিতে উঠে পড়ার জন্য। আর একবারের জন্য উঠে পরতে পারলেই আকিমন যেন পেয়ে যাবে কোনো নিরুপদ্রব পৃথিবীতে একটুখানি ঠাঁই।

এখানে এই বার্ন ইউনিটে কে তাকে এনে ভর্তি করিয়েছে, সে কিছুই জানে না। পাশের বেডের একজনের মুখে শুনেছে দুজন টোকাই মিলে নাকি তাকে কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে ঢাকা মেডিকেলে এনে রেখে গিয়েছিল। সে ছিল তখন সম্পূর্ণ অজ্ঞান অবস্থায়, তার কিছুই মনে পড়ে না। নার্স ও ডাক্তার এসে তাকে নানা প্রশ্ন করে। তার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার! সে কেবলই নিরুত্তর থাকে। এমনকি তার নামটিও সে বলতে চায় না। শুধু মাথাটুকু নাড়িয়ে হাঁ বা না এর সংকেত জানায়, তাও তীব্র কোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে। বার্ন ইউনিটের অনেকেই ধরে নিয়েছে সে বোবা। নার্স এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না, আসলেই সে শ্রবণ ও বাক্ প্রতিবন্ধী কি না! অথবা মানসিক বিস্মৃতির শিকার! যখনই যন্ত্রণার ঘোর থেকে বেরিয়ে সে নার্সের মুখের দিকে তাকায়, সেই মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে সে অপলক। যেন সে আয়নায় দেখছে নিজেকে। নার্সটি যেহেতু মহিলা, তার দিকে তাকিয়ে থেকে আকিমনের মনে পড়ে, সে নিজেও একটা মেয়ে। নানা বয়সী নার্সদের ফিটফাট চুল আঁচরানো মুখ আর সাদা পোশাক তাকে মনে করিয়ে দেয় দীর্ঘদিন সে গোসল করেনি। এই হাসপাতালটি কোথায়, কীভাবে সে এখানে এসে পৌঁছল, সবকিছুই তার গোলমেলে লাগে। নার্স তাকে প্রশ্ন করলে সে একটি জবাবও দেবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে। কারণ প্রশ্নের উত্তর ঠিক কোথা থেকে শুরু করলে তা ঠিকঠাক জবাব হবে, তা সে বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে পড়ে একটাই দৃশ্য। ট্রেনের কোনো একটি ষ্টেশনে তাকে রেললাইনের পাশে ফেলে রাখা হয়। তখন তার কোমর থেকে হাঁটু অব্দি পোড়া ঘায়ের মাংসে পচন ধরে থিকথিক করছিল। তার মনে পড়ে রাস্তার কুকুরেরা সেই পঁচা ঘায়ের গন্ধে তার শরীরের আশপাশে ঘিরে ধরেছিল। তাদের ঘেউ-ঘেউ শব্দে আর দাঁত বসিয়ে দেবার আতঙ্কে আকিমন বারবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। চারপাশের মানুষজনদের সে করুণভাবে ডেকেও ছিল একটু সাহায্যের জন্য। কিন্তু যতটুকু মনে পড়ে কারও অবসর হয়নি তার দিকে ফিরে তাকাবার। মানুষ কেবলই দৌড়াচ্ছিল সেই ভোঁ শব্দ করা ট্রেনের দিকে।

এই হাসপাতালটি কোথায়, কীভাবে সে এখানে এসে পৌঁছল, সবকিছুই তার গোলমেলে লাগে। নার্স তাকে প্রশ্ন করলে সে একটি জবাবও দেবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে। কারণ প্রশ্নের উত্তর ঠিক কোথা থেকে শুরু করলে তা ঠিকঠাক জবাব হবে, তা সে বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে পড়ে একটাই দৃশ্য। ট্রেনের কোনো একটি ষ্টেশনে তাকে রেললাইনের পাশে ফেলে রাখা হয়। তখন তার কোমর থেকে হাঁটু অব্দি পোড়া ঘায়ের মাংসে পচন ধরে থিকথিক করছিল।

যতটুকু মনে পড়ে, তার শরীর পুড়ে যাবার আট-দশদিন পর সে তার স্বামীর সাথেই এক রাতের ট্রেনে উঠে বসেছিল। পোড়া ঘা শুকাচ্ছিল না বলে, তার স্বামী তাকে বলেছিল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম নিয়ে তাকে চিকিৎসা করানো হবে। তখন সে শুধু কিছু ব্যাথার ওষুধ খেয়েছিল। ওষুধগুলি তার স্বামীই তাকে দিয়েছিল। অসুখ শেষে তাকে সমুদ্রে বেড়াতে নিয়ে যাবার কথাও বলেছিল। তাই দূর থেকে ট্রেনের ভোঁ শব্দটা শুনতে পেয়েই নেচে উঠেছিল আকিমনের বুকের ভিতরটা। ট্রেনের ভোঁ শব্দটা তাকে দূর সমুদ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। মাইলের পর মাইল দীর্ঘ সমুদ্র। নীল সমুদ্র। তার উপর উড়তে উড়তে ভেসে যাচ্ছে পাখির দল। বাস্তবে সমুদ্র সে দেখেনি। তবে টেলিভিশনে সমুদ্র দেখতে দেখতে তার ঘোর লেগে যেত। বিয়ের পর কয়েকবার সমুদ্র দেখার শখটি পুরণের কথা সে শাশুড়ি বেঁচে থাকতে একান্তে শাশুড়িকেই বলেছিল।

 

২.
ছেঁড়া কাপড়ের পুতুলগুলি বুকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সেই বারো বছর বয়সে শাশুড়িই তাকে বুকে করে নিয়ে গিয়েছিল। আকিমন বই পড়তে ভালোবাসতো। সেই শখটুকুও পূরণ করেছিল আকিমুনের শাশুড়ি আম্মা। শীতের দুপুরে আঙিনায় পড়ে থাকা রোদের ওমে বসে বসে আকিমন পড়েছিল বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’ গল্পটি। এই বাড়িতে এসে এই একটিমাত্র গল্পের বইয়ের এই গল্পটি কীভাবে যেন তার সবটুকু মনোযোগকে ক্রমশই সারাক্ষণ ঘিরে থাকত। গল্পের ক্ষেন্তি মেয়েটি যেন আকিমনই। ক্ষেন্তির বাপের মতোই তার বাপ বড়ো দরিদ্র। ক্ষেন্তির মতোই তার অল্প বয়সে হঠাৎ বাল্যবিবাহ ঘটে যাওয়া, লকলকে পুঁইমাচার স্মৃতি সবই যেন আকিমনের সাথে মিলে যায়। তাই এই গল্পের মধ্যে সে সময়ে অসময়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত।

এত বড়ো বাড়িতে শাশুড়ি আর বউ আকিমন ছাড়া বাকিরা সবাই কাজের লোক। বিয়ের রাতের ছয়মাস পর শাশুড়ির অসুখের খবর শুনে খাগড়াছড়ি চা বাগানের কাজ ফেলে ছুটে এসেছিল আকিমনের স্বামী লতিফ। সেই নিয়ে বিয়ের পর দুইবার স্বামীর দেখা পেল আকিমন। প্রথম দফায় স্বামী তাকে ছুঁয়েও দেখেনি। না কি ঘোমটা তুলে একবার ওর মুখটা দেখছিল– আকিমনের মনেও পড়ে না। বাসর ঘরে ঢোকার সময় ভয়ে কান্নাকাটি করতে থাকলে শাশুড়ি আম্মা তাকে নিজের ঘরেই ঘুমাতে দেয়। পরদিন সকালে চাকর-বাকরের মুখে সে শুনতে পায় ‘এই পুঁচকা মাইয়ারে সাদী করাইয়া কী লাভ হইল! চা বগানের মাগীগো লইয়া রাত কাডানের অভ্যাস মিঞাসাবের! এই স্বভাবখান কি হে ছাড়তে পারব!’ আর এক জন মুখ চাপা দিয়ে বলে উঠল, ‘কী কস না কস! টাকাওয়ালা মাইনসের কত রহমের শখ থাহে! কেউ শুইন্যা ফালাইলে দিবনি আমগো প্যাডে লাত্থি!’ আর একজন বলতে থাকে, ‘তয় খালাম্মাতো বউডারে দেইখ্যা শুইন্যা আনছে। শুনলাম ভালা বংশ।’ ‘আরে থো তোর বংশ! এই মিঞাসাবের জ্বালায় খালাম্মায় দশটা বছর ধইরা জ্বলতাছে। তোগো সক্কলের আগে আমি এ বাড়ির কামে আইছি। খালুসাবে মরার সময় মিঞাসাবে বিদ্যেশ আছিল। তহনও শান্তি দেয় নাই। খালু মরার পর সক্কল ব্যবসার মালিক হইল। টাকা পয়সা বেক খরছা কইরা ফালাইতাছে। মিঞাসাবের বন্ধু আসলামসাবে বেবাক কথা খুইল্যা কওনের পর খালাম্মা এই সাদী করাইল। এহন যদি বউয়ের ভাগ্যে কিছু বদলায়!’

বিয়ের পরের দিন সকালে রান্নাঘরের বারান্দা পার হয়ে বাথরুমে যাবার পথে আকিমন শুনে ফেলে এইসব কথোপকথন। কিন্তু তাতে সে একেবারেই বিচলিত হয়নি। কারণ বিয়ে বিষয়টি তখনও তার মনে তেমন কোন আশা বা আনন্দের উৎস হয়ে ওঠার বয়স তার হয়নি। বরং এই বাড়ির শান-শওকত, শাশুড়ির আদর– সব মিলিয়ে সে একটা নতুনত্বের মধ্যে ছিল। যদিও এই বাল্যবিবাহে তার মামাদের ঘোর আপত্তি ছিল। কবুল বলার সময় সে নিজেও বুঝতে পারেনি তার সত্যি সত্যিই বিয়ে হচ্ছে। তবু বাড়িতে অনেকদিন পর একটা আনন্দ উৎসবের কেন্দ্র বিন্দু হতে পেরে তার কাছে ব্যাপারটা একটা ধোঁয়া ধোঁয়া স্বপ্নের মতো লেগেছিল। বড়ো বোনের বাচ্চা হয় না বলে বোনটি প্রতিনিয়তই শশুরবাড়িতে মানসিক অশান্তির শিকার হতো। প্রায়ই বরপক্ষ তালাক দেবার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় আকিমনের সম্বন্ধ এলে আকিমনের বাপ আর দেরি করে না। ফরিদপুরের এক অজপাড়াগ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অল্পবেতনের চাকরি। ছেলে দুইটা এখনও ছোটো। বড়ো মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েও শান্তি নাই। তাই খুলনা শহরের এত বড়ো বাড়ি থেকে আকিমনের সম্বন্ধ এলে অন্য আত্মীয় স্বজনের অমতেই আকিমনের বাপ রাজি হয়। একবারও খোঁজ করে না, যে ছেলের কাছে মেয়ে দিচ্ছে সে কেমন! আকিমনের শাশুড়ির মিষ্টি ব্যবহারে আকিমনের মা নিশ্চিত হয়। ভাবে আকিমনের নারীজীবন স্বচ্ছন্দেই কাটবে। কিন্তু আকিমনের স্কুলে পড়ার খুব শখ। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে আকিমন সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে। অংক করে করে সাদা খাতা ভরিয়ে ফেলে। অনেক সময় হাতের কাছে কাগজ না পেলে কুড়িয়ে পাওয়া ঠোঙার গায়েও অংক কষে। বিয়ের বিষয়ে পাকা সিদ্ধান্তের সময় আকিমনের মা আকিমনের শাশুড়িকে আব্দার করে বলে মেয়েটারে যেন পড়ার সুযোগ করে দেয়। আকিমনের শাশুড়ি রাজি হয়। স্কুলে যাবে না, বাড়িতে একজন শিক্ষক এসে পড়াবে।

বড়ো মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েও শান্তি নাই। তাই খুলনা শহরের এত বড়ো বাড়ি থেকে আকিমনের সম্বন্ধ এলে অন্য আত্মীয় স্বজনের অমতেই আকিমনের বাপ রাজি হয়। একবারও খোঁজ করে না, যে ছেলের কাছে মেয়ে দিচ্ছে সে কেমন! আকিমনের শাশুড়ির মিষ্টি ব্যবহারে আকিমনের মা নিশ্চিত হয়। ভাবে আকিমনের নারীজীবন স্বচ্ছন্দেই কাটবে। কিন্তু আকিমনের স্কুলে পড়ার খুব শখ।

বিয়ের পরের জীবন আকিমনের ভালোই লাগে। বিয়ের ছয়মাসের মধ্যে স্বামী একবারও আসে নাই। শাশুড়ির সাথে সে ঘুমায়। একা ঘরে ভয় করে। শাশুড়ি তার চুল বেঁধে দেয় যত্ন করে, আকিমনের কিশোরী মুখের লাবণ্য দেখে শাশুড়ির পরান ভরে। আকিমনের জন্য ক্লাশ সেভেনের বইয়ের সেট কিনে দেয়। বাড়িতে একজন বয়স্ক শিক্ষক এসে অংক আর ইংরেজি পড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে দু-এক পদ রান্না আর নিজের ঘর গোছানো ছাড়া আকিমনের আর কোনো কাজ নেই। এই দোতলা বাড়ির সব কাজের জন্যই অনেক লোক আছে। আকিমনের স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসলাম মাঝে মধ্যে আসে আর শাশুড়ি মায়ের সাথে একান্তে কথা বলে। আকিমন টের পায় ওরা দুজনে কি সব কথা বলে তার স্বামীকে নিয়ে। তাছাড়া শাশুড়ি মা প্রায়ই পেপটিক আলসারের ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে, তখনও ডাক্তারের কাছে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করে আসলাম। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আকিমনের স্বামী হঠাৎ একদিন আসে। শাশুড়ি তাকে সেই রাতে সাজিয়ে গুছিয়ে ছেলের ঘরে পাঠায়। মাত্র দুই মাস আগে সে সাবালিকা হয়েছে। শাশুড়ি মা তাকে কিছুদিন ধরেই চুল বাঁধার ফাঁকে ফাঁকে বিবাহিত জীবনের নানা পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ধারণা ছিল আকিমন ছেলের মন জয় করে নেবে। কিন্তু প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা ছিল আকিমনের কাছে ভয়ংকর। যেন সে ছিল একটা হিংস্র জন্তুর সান্নিধ্যে। সারা শরীরের কামড়ের দাগগুলো প্রতি মুহূর্তেই তাকে বিষণ্ন করেছে সহবাসের পরবর্তী কয়েকটি দিন। সেই যে একদিনই হঠাৎ এসে পরদিনই আবার চলে গিয়েছিল আকিমনের স্বামী! অন্ধকারে তাকে না ভালোবেসে, তার শরীরকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দিয়ে, তাকে থেঁতলে, চেপ্টে, আকিমনের জরায়ুতে ফেলে গিয়েছিল মাতলামির বীজ। বীজ থেকে জন্ম নেয় শরীর। আকিমন এতই বয়সে ছোটো যে শরীরের তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বুঝতে পারে না। এরই মধ্যে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে আকিমনের শাশুড়ি। ছেলেকে ডেকে পাঠায়। ছেলে এসে পৌঁছানোর আগেই আকিমনের শাশুড়ির মৃত্যু নিশ্চিত করে কর্তব্যরত ডাক্তার।

শাশুড়ির মৃত্যুর পর আকিমনের সমস্ত শরীরের রস নিংড়ে নিয়ে বাড়তে থাকে ওর গর্ভের শিশু। বাড়ির পুরানো ঝি-আয়া সবাই খুব খুশি। কিন্তু আকিমনের স্বামী লতিফের মনে শান্তি নেই। তার সন্দেহ এই বাচ্চা তার নয়। কিছুতেই নয়। তার ধারণা এ বাচ্চা আসলামের। বিনা কারণে উন্মাদ আক্রোশে সে প্রায়ই ঝাঁপিয়ে পরে আকিমনের উপর। একদিন রাতে আকিমনের শরীরের উপর ক্রুদ্ধ কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার ছোট্ট নরম তলপেট পায়ে মাড়িয়ে দিলে সেই মুহূর্তেই লাল আর কালো রক্তে থকথকে হয়ে ওঠে বিছানা। লতিফ চার মাসের ভ্রুণটিকে নষ্ট করে দিয়ে নিশ্চিত হয় বহিরাগত অন্য অস্তিত্বকে দমনের বিষয়ে। আকিমন কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন তার স্বামী এমন হিংস্র কুকুরের মতো আচরণ করে। এ বাড়িতে এখন আর কেউ নেই, যার কাছে দুটো কথা বলা যায়। কাজের লোকেরা সবই টের পায়। কিন্তু কাজ হারাবার ভয়ে তারা কিছু বলে না। আকিমনের বাপের বাড়িতে যাবারও পথ বন্ধ। লতিফ মোটেই পছন্দ করে না ওখানে যাওয়া। শাশুড়ির মৃত্যুর পর আকিমনের পড়াশোনাও পুরোপুরি বন্ধ। তবু সে এক বই বারবার পড়ে। বারবার পড়ে বিভুতিভূষনের ‘পুইঁমাচা’। চারপাশের পৃথিবীর বিভৎসতার সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে সে থমকে থাকে ‘পুইঁমাচা’ গল্পের শরীরে। জীবনের সব ভাংচুর নিয়ে এমন একটি গল্পের মুখোমুখি সে বসে থাকে। তার জীবনের সাথে মিলে যায় এমন একটি গল্প তার হাতের মুঠোয় পাওয়াতে সে মনে মনে বিস্মিত হতে থাকে। কোনো এক অভাবনীয় বোধের ভিতরে যখন দুর্দান্ত বোঝাপড়া চলতে থাকে, সে তখন ঘণ ঘণ শ্বাস নিতে থাকে গল্পের শব্দগুলির ভিতরে। লতিফের হাতে তীব্র মার খেতে খেতে তার ভিতরের দম আর গতি পুইঁমাচা গল্পের শব্দগুলির পিছনে দৌড়াতে থাকে।

আর চুলার আগুনটা ধরাতেই বোতলটা বিস্ফোরিত হয়ে ঝলসে যায় আকিমন। কেন রাত বারোটায় হঠাৎ লতিফের চা খেতে মন চাইল! তবু এসব নিয়ে ভেবে ভেবে নিজের মধ্যে রক্তাক্ত হতে চায়নি আকিমন। একবার জিজ্ঞেসও করেনি চুলার কাছে এ্যারোসোলের বোতল রেখে দিয়েছিল কে? অসহায়ভাবে লতিফের দিকে তাকিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাবার স্বপ্ন দেখেছিল তবুও।

সেদিন রাতে রান্নাঘরের আগুনটাও যে লতিফই পরিকল্পনা করে লাগিয়েছে, এখন এ ব্যাপারে আকিমন নিশ্চিত। রাত বারোটার সময় তাকে চা বানিয়ে আনতে বলল লতিফ। কাজের লোকেরা তখন ঘুমাচ্ছে। চুলার পাশে অ্যারোসোলের বোতলটা মুখ খুলে রেখেছিল লতিফই। বোতলটাকে যথাসম্ভব ঝাঁকিয়ে রাখা হয়েছিল। আর চুলার আগুনটা ধরাতেই বোতলটা বিস্ফোরিত হয়ে ঝলসে যায় আকিমন। কেন রাত বারোটায় হঠাৎ লতিফের চা খেতে মন চাইল! তবু এসব নিয়ে ভেবে ভেবে নিজের মধ্যে রক্তাক্ত হতে চায়নি আকিমন। একবার জিজ্ঞেসও করেনি চুলার কাছে এ্যারোসোলের বোতল রেখে দিয়েছিল কে? অসহায়ভাবে লতিফের দিকে তাকিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাবার স্বপ্ন দেখেছিল তবুও। ছুরির ফলাগুলি পরিষ্কার দেখতে পেয়েও কী এক বিশ্বাসে, কী এক আহ্বানে সে ট্রেনে চড়ে বসেছিল খুব মরিয়া হয়ে। রাতের ট্রেনে। তার ভিতরে উপচে উঠেছিল তীব্র আপত্তি, ঘেন্না, সমস্ত না পাওয়া। তবু একটু ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণায় সে থামিয়ে দিয়েছিল নিজের ভিতরের টানাপোড়েন। একবারও ভাবেনি তাকে ট্রেনের কামরায় ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে লতিফ চলে যেতে পারে! কী করে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়! সে কী তখন তার হাতদুটো দিয়ে, ঘুমন্ত শরীরের স্পর্শ দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখেনি লতিফকে?

খড়কুটোর মতো ট্রেনের কামরায় ভাসতে ভাসতে, একদিন সে নিজেকে প্রায় চেতনাহীন অবস্থায় আবিষ্কার করল রেললাইনের পাশে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। একা। পেটে এত ক্ষুধা! এত যন্ত্রণা শরীরে! ওই জায়গায়টায় সে পড়েছিল কতদিন! কতঘন্টা! কান পেতে শুনতে পেত ট্রেনের শব্দ। আর সেই শব্দ শেষ হলে পরে সে টের পেত ক্ষিপ্ত কুকুরেরা একত্রিত হয়ে তার শরীরের পঁচা গন্ধের সামনে এসে একত্রে ঘেউ ঘেউ করছে।

 

৩.
হাসপাতালে এতদিনেও সে তার নাম বলেনি। এতদিনেও একটিও কথা বলেনি কারো সঙ্গেই। পোড়া ঘা শুকাতে গেলেও প্রবল যন্ত্রণা হয়। তীব্র যন্ত্রণা হয় ড্রেসিং করার সময়ে। আশেপাশের রোগীরা কেবলই চিৎকার করত। শুধু একটুও স্পষ্ট বা অস্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ না করে মুখটা উঁচু করে চোখ বন্ধ করে থাকত আকিমন। যেন সে মরে গেছে পুঁইমাচা গল্পের ক্ষেন্তির মতোই।

বিনা খরচেই এতদিন চিকিৎসা হয়েছে সরকারিভাবে। আশপাশের রোগীদের কথাবার্তা থেকে সে শুনতে পেয়েছে এসব তথ্যগুলো। দু-একদিনের মধ্যেই তাকেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। নার্স এসে তাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করবে তার নাম। কী সব ফরম পুরণ করবে!

সে কী তার নাম বলবে! সে কী মোকাবিলা করবে তার নিজস্ব স্বর দিয়ে? বলবে তার সাথে যা ঘটে গিয়েছিল! তারপর কী হবে! মামলা-মোকাদ্দমা, ধর-পাকড়! তার গরীব বাপের যা কিছু তার সবই যাবে! বাপ-মায় জানে বেটি বড়ো সুখে আছে। কী লাভ হবে তাদের জানিয়ে! আর লতিফ! কে পারবে ওকে শাস্তি দিতে! টাকা দিয়ে কিনে নেবে থানা-পুলিশ। নিশ্চিন্তে পালিয়ে যাবে বিদেশে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকিমন আধো ঘুমের ভেতরে এইসব ভাবে। গাঢ় কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে তার ভিতরের তীব্র জিঘাংসা অসহায়ভাবে যেন তাকেই মেরে ফেলতে চায়। হঠাৎ কিছু স্পষ্ট আর অস্পষ্ট শব্দের ভেতর, হাসপাতালের ডেটলের গন্ধের ভেতর, তীব্র গোঙানির ভেতর কে যেন ফিসফিসিয়ে তার কানের কাছে বলে গেল, ‘আমি ক্ষেন্তি। তুমিও আমার মতোই অনেক আগে মরে গেছ’। ওই দেখ পুইঁমাচায় লকলকে ডগা। কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ! এ জীবনে এর স্বাদ আর আমাদের পাওয়া হবে না।’

শেষপর্যন্ত আকিমনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয় শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী হিসেবে। সরকারি প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে সে আশ্রয় পায়। নিজের প্রকৃত নামটি নিজের স্বরে সে আর কখনোই বলে না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মণিকা চক্রবর্তীর জন্ম কুমিল্লায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। মূলত গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। প্রথম উপন্যাস ‘অতঃপর নিজের কাছে’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাস,‘দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে’,২০১১ সালে, প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নভেলা ‘মন্দ্রসপ্তক’, এবং পরবতীতে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘হাওয়ার সংকেত ও অন্যান্য’। ২০১৯ এ প্রকাশিত নভেলা ‘অ্যাম্ফিখিয়েটার’ এবং ২০২১ বইমেলায় প্রকাশিত দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ ‘অপার্থিব গান’।২০২২ বইমেলায় প্রকাশিত নভেলা ‘যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক’। তিনি সংগীতের অনুরাগী, বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।