জগতের হাতে পায়ে ধরি। জগৎ রে আমাকে তুই ফিরিয়ে নে মায়ের গর্ভে। সমস্ত বর্ষার বাতাসে আমি একটা জবাগাছ হয়ে দুলতে চাই। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের ভেতরে আমি ঘুমাতে চাই অনন্তকাল। অনাদির জঙ্গম হতে আমাকে তুই মুক্তি দে রে জগৎ।
জগৎ আমার কথা শোনে না। বধিরের ইশারার মতো সে আমাকে নামিয়ে দেয় শুধু জীবনের পথে। আমি অল্পবয়সী একটা মন নিয়ে হাঁটি জীবনের পথে পথে। আমি গান গাই, ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!’
কেউ কিছু বলে না। পথের হৃদয়ের ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। পথেরও হৃদয় থাকতে পারে এই কথা ভেবে আমরা শূন্যে হাঁটার পরিকল্পনা করি। পরিকল্পনা আমাদের হাত ধরে আর বারবার শতবার করে হাত ছেড়ে দেয়। আমরা আচানক চমকে উঠি ঘুমের ভেতর। আচমকা এই বনের ভূমিতে আমরা কতদূর যাব? বহুদূর; যতদূর যায় আমি তো ততদূর কোনো গান দীর্ঘ করতে চাই না।
ও জীবন তুই আমাকে ফেলে আয় শৈশবের ঘুমের ভেতর। ও জগৎ তুই আমাকে রেখে আয় বারাণসীর ঘাটে। ও প্রাণের আকুতি তুই আমাকে ফিরিয়ে নে এই নাটকের খপ্পর থেকে।
জোর ও জবরদস্তির খেলা আমার ভালো লাগে না। এই স্বচ্ছল সফল, সাহসিকতা আমার ভালো লাগে না।
জগৎ কথা বলে না, প্রাণের আকুতিও শোনে না!
সরল হয়ে যাই। নিবিড় হয়ে যাই। এই কঠিন ও কঠোরের পৃথিবীতে কোমল ও করুণ হয়ে যাই। অফুরান ঈর্ষায় তবু ফুরিয়ে যাই নিজেরই দ্যোতনায়। আমি কার কাছে যাব? কার পায়ের নিচে দাঁড়িয়ে যাব? বলব, আমাকে পিষে ফেলো, তুমি সাহসী হও, তুমি জয়ী হও, তুমি সফলতার প্লটে আমাদের মতো অসহায়দের ধ্বংসাত্মক রাজা হয়ে যাও।
অসংখ্য ভ্রম নিয়ে থাকি। অসংখ্য ভস্মতা ঘিরে ধরে চারপাশ। যেন বৃত্তভর্তি আগুনের ভেতর আমি এক সার্কাসের ক্লাউন। দ্বগ্ধ অনুভূতির ভঙ্গি বারবার তালির শব্দে মিলিয়ে যায়। আমি আগুন বললেও লোকে হাসে, পানি বললেও হাসে।
আমার এই অনুভূতি তুমি ধ্বংস করে দাও হে প্রভু!
আমার এই অনুভূতি তুমি নষ্ট করে দাও হে প্রভু
যন্ত্রণার আলেখ্যে অনুভূতি লিখিত হচ্ছে জীবনের রাত্রিভর।
এমন উপসংহার কোথায় পাই বলো?
কার কাছে গিয়ে দেখাই এ শুদ্ধতার ব্যকরণ
সমস্ত ক্রিয়াপদ ছেড়ে যাচ্ছে নক্ষত্রের তন্দ্রা
কোন মন্দাকিনী বনে আমি খুঁজে পাবো দুর্দিনের নটরাজ?
কাচ ও কামিজের কথা মনে পড়ে। লাজ ও লাটিমের কথা মনে পড়ে। আর সমস্ত লজ্জাবতী বনের জীবন ঘেটে আমরা আবিষ্কার করি শুধু লজ্জা লজ্জা কাব্য। আমাদের আবরণ লুট হয়ে গেছে। আমাদের স্ববরণ স্বমেহনে কাল ও কালান্তের গহবরে পড়ে গেছে। আমি কি সেই অন্ধ দোকানদার? আমার অপেক্ষা কিসের? আমার আঁধার ও আধেয়র ভেতরে আর কোনো সহিংস ক্রেতা আসবে না জেনেও আমি কিসের অপেক্ষায় হয়রান? সমস্ত বৃষ্টির শব্দে সমস্ত বর্ষার মর্মর গানের ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে কামারশালার শব্দ। এত অস্ত্র কোন পাষাণের হাতে হাতে ছুরি হয়ে যায়? এত সময় কোন কালান্তরের রচনায় খুনি হয়ে যায়? বিষয় ও বিবিধ জিজ্ঞাসা তাড়া করে আমাকে। চারদিকে হয়রান বাতাশ অসংখ্য মূর্ছনা পারি দিয়ে আসে। তারা কই থেকে আসে? তারা কোন প্রতিবেশীর অতিথি হয়ে ভূতের গল্প করে ঘুমিয়ে যায়? বিভৎস কোন দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হয়? নিঃস্ব কোনো হাওয়াঘরের পাশে চুপি চুপি কান্না করে কে যেন হেসে ওঠে প্রতিরাতে। এমন ভূতগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে আমাদের এই অস্থির মন আরও অস্থির হয়ে ওঠে। সুস্থির সান্ত্বনার অবশিষ্ট নামতা খোয়া গেছে ব্লাকবোর্ডের ইরেজারে।
ও মন তুমি শান্ত হও, ও মন তুমি ক্লান্ত হও। তোমার পায়ে ধরি। তুমি জগতের সাথে নিষ্ঠার সাথে মিশে কখনো জগৎ-নিষ্ঠুর হতে পারো না।
তুমি ফুলের কাছে প্রতারক হয়ে প্রেমিক হতে পারো না। তোমার ‘অঘ্রাণের ভরা খেতে’র বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে কৈশোর। কাক ও কদমের বনে অনন্ত ঝুমঝুম বৃষ্টির ভেতর তোমার নির্বাণ পাড়ি দিচ্ছে যন্ত্র ও জঠরের সাঁকো।
দুপুরের স্তব্ধতার ভেতর পানাপুকুরের নিঃসঙ্গ মাছের মতো তুমিও জগতের ভেতর প্রকাশ্য এক দৃশ্য।
ত্রিকোণ মূর্ছনার কতো নদি পারিয়ে আসে আমাদের ঘুম৷ ঘুমের নদিতে জীবন নৌকা চালাচ্ছে। সমস্ত ভূখণ্ডের পারে আশ্চর্য সামানিকে ডুবে যাচ্ছে ঘুমের নৌকা। ঘুমের নদী নৌকা চালাচ্ছে, তরল প্রবঞ্চনার সাথে আতাত করে জীবন নদী হয়ে গেছে, নৌকা ঘুম চালাচ্ছে সামানিক মিউজিকের ভেতর। আর জগতের ভেতর আমাদের জীবন পড়ে গেছে অনন্তের ধোঁকাবাজিতে।
জগৎ একটা রেসের ময়দান। এই ময়দানে তুমি রেসের ঘোড়া। তুমি দৌড়াও পেছনে টগবগিয়ে আসছে তোমার পরাজয়। তুমি দৌড়াও পেছনে তোমার যন্ত্রণার ভেতর ভেঙে যাচ্ছে দূর্মর গ্লানি। সমস্ত মানুষের হাততালি–তোমার বেদনার শব্দ। রিনঝিন রিনঝিন সন্ধ্যায় ডুবে গেছে তোমার যাপনের সূর্য। তুমি বিভৎস নিঃসঙ্গ। তুমি জ্বলন্ত আগুনের ভাষা হয়ে মোমবাতির ধোঁয়ায় মিলে গেছো জগতের ময়দানে। তোমার ঘুমের পাশে জিকির করে যায় অন্ধ ফকির। তোমার সমস্ত আলোর ঘূর্ণিতে পালিয়ে যাচ্ছে পালকের পশম। তোমার সপ্তডানার ভারে অতি ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে আয়ুর ভ্রহ্মাণ্ড। তোমার ঘুমের পাশে সারারাত কান্না করে কোন আততায়ী? তোমার ঘুমের ভেতর কার হন্তারক হাতের রিনরিন শব্দ মিলিয়ে যায় মরণের হাসিতে?
ধরো, আর কোনো কান্না নেই পৃথিবীতে। ক্রন্দতরত পৃথিবীর সমস্ত মানুষ বৃক্ষ হয়ে গেছে আজ। আর পাহাড়ের কান্নার দুঃখে পাথরগুলোও হয়ে গেছে নির্বাক। জীবন তোমাকে নামিয়ে দিয়েছি ঝরনার স্রোতে। যাও তুমি অশ্রুসজল, যাও তুমি নিরলম্ব বিষ্ময়, বিম্বের বোবাভাষ্য আর লাস্যময়ী হাসি দিয়ে তোমাকে ডেকে নিচ্ছে তিরষ্কার। তোমার হৃদয় থেকে টেনে বের করা হবে যাবতীয় অপমান। অপসৃয়মান তোমার জীবন অপচয় হচ্ছে খুচরা নোটের তকদিরে।
বোধ ও ব্যাধির কথা মনে পড়ে। ক্রোধ ও শোধের কথা মনে পড়ে। প্রতিশোধের পথে ফিরে আসি নির্লিপ্ত খরিদদার হয়ে। বহু খরিদ দেনা হয়ে পড়ে আছে পাওনাদারের মুখে। কার তপ্ত ছায়া ফুটফুটে অন্ধকারে খইভাজা হয়ে ফুটছে বন্দুকের মতো? নির্বাণের পাখি দেখি উড়ে গেছে গুলি ফোটার শব্দের ভেতর। পাণ্ডুর রাত নামে। আমাকে ঘিরে ধরে জীবনানন্দের ভূত। ভূত আর আমি রাতভর গল্প করি, শুয়ে থাকি জ্যোৎস্নার ঘাসের বুকে। আমরা একে অপরের দিকে জীবনের যত মায়া নিয়ে, কায়া নিয়ে, নির্মম মমতা নিয়ে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকি। আমি গান গাই, ‘তুমি আমার কত চেনা, সে কি জানো না।’
জানে না, শুধু সে নয় এই ব্রক্ষ্মাণ্ডের কেউই জানে না।
জীবনের আনন্দ পড়ে গেছে ধোঁকাবাজির খপ্পরে। প্রিয় সুকুমার স্যার, আপনার কাছে কি এমন কোনো সূত্র লুকিয়ে আছে, এই ধোঁকাবাজির আয়ুস্কাল নির্ণয়ের?
এতটা নিরানন্দ নিয়ে মানুষের নাম কেন জীবনানান্দ হয়? সমস্ত আনন্দের ভেতর আবারও বেদনা ফুটে ওঠে? টগবগ টগবগ করে আয়ুর পাত্র থেকে গড়িয়ে পড়ে বেদনার রঙিন রস?
আর আমি অসংখ্য নির্বাণের দিকে ছুটে যাই। স্তব্ধ একটা বোধ জনকোলাহলের ভেতর মুহূর্মুহু ডেকে যায়। রাতভর বাঁশি বাজে বারাণসীর ঘাটে। অন্ধ কালো আলোয় কে যেন কার হাত ধরে ডুবে যায় জলের ভেতর…
জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনাপাড়ের গ্রাম রান্ধুনীবাড়ীতে। রসায়ন বিষয়ে স্নাতক শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত। সম্পাদনা করছেন লিটলম্যাগ ‘শব্দ মিছিল’। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘আঙুলের ডগায় শীত’ (২০২০), ‘দেহ পালিত সাপ’ (২০২১)।